পাল সাম্রাজ্য

পাল সাম্রাজ্য ছিল ভারতীয় উপমহাদেশের পরবর্তী ধ্রুপদি যুগের একটি সাম্রাজ্য। এই সাম্রাজ্যের উৎসস্থল ছিল বাংলা অঞ্চল। পাল সাম্রাজ্যের নামকরণ করা হয় এই সাম্রাজ্যের শাসক রাজবংশের নামানুসারে। পাল সম্রাটদের নামের শেষে ‘পাল’ অনুসর্গটি যুক্ত ছিল। প্রাচীন প্রাকৃত ভাষায় এই শব্দটির অর্থ ছিল ‘রক্ষাকর্তা’। পাল সম্রাটেরা বৌদ্ধধর্মের মহাযানতান্ত্রিক সম্প্রদায়ের অনুগামী ছিলেন। ৭৫০ খ্রিষ্টাব্দে গৌড়ের সম্রাট পদে গোপালের নির্বাচনের সঙ্গে সঙ্গে এই সাম্রাজ্যের পত্তন ঘটে।[3] অধুনা বাংলা ও বিহার ভূখণ্ড ছিল পাল সাম্রাজ্যের প্রধান কেন্দ্র। এই সাম্রাজ্যের প্রধান শহরগুলি ছিল পাটলীপুত্র, বিক্রমপুর, রামাবতী (বরেন্দ্র), মুঙ্গের, তাম্রলিপ্তজগদ্দল

পাল সাম্রাজ্য

৮ম শতাব্দী–১২শ শতাব্দী
পালের অবস্থান
৮০০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ এশিয়ায় পাল সাম্রাজ্যের অবস্থান
রাজধানী
ভাষাসমূহ সংস্কৃত, প্রোটো-বাংলা
ধর্ম বৌদ্ধধর্ম, শৈব হিন্দুধর্ম
সরকার রাজতন্ত্র
সম্রাট
 -  ৮ম শতাব্দী গোপাল
 - ১২শ শতাব্দী মদনপাল
ঐতিহাসিক যুগ ধ্রুপদি ভারত
 - সংস্থাপিত ৮ম শতাব্দী
 - ভাঙ্গিয়া দেত্তয়া হয়েছে ১২শ শতাব্দী
বর্তমানে অংশ  বাংলাদেশ
 ভারত
   নেপাল
 পাকিস্তান

পাল সম্রাটরা ছিলেন প্রাজ্ঞ কূটনীতিবিদ ও যুদ্ধজয়ী। তাদের সেনাবাহিনীর বৈশিষ্ট্য ছিল একটি বৃহৎ যুদ্ধহস্তী বাহিনী। তাদের নৌবাহিনী বঙ্গোপসাগরে বাণিজ্যিক ও প্রতিরক্ষামূলক ভূমিকা পালন করত। পাল সম্রাটরা ছিলেন ধ্রুপদি ভারতীয় দর্শন, সাহিত্য, চিত্রকলাভাস্কর্যশিল্পের বিশিষ্ট পৃষ্ঠপোষক। তারা একাধিক বৃহদায়তন মন্দির ও মঠ নির্মাণ করিয়েছিলেন। এগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল সোমপুর মহাবিহার। তারা নালন্দাবিক্রমশিলা মহাবিহারের পৃষ্ঠপোষকতাও করতেন। তাদের রাজত্বকালেই প্রোটো-বাংলা ভাষার বিকাশ ঘটে। শ্রীবিজয় সাম্রাজ্য, তিব্বতি সাম্রাজ্য ও আরব আব্বাসীয় খিলাফতের সঙ্গে পাল সাম্রাজ্যের সুসম্পর্ক বজায় ছিল। বাংলা ও মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যে বাণিজ্য বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে পাল যুগেই বাংলায় প্রথম ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। পাল প্রত্নস্থলগুলিতে আব্বাসিদ মুদ্রা পাওয়া গিয়েছে। তাছাড়া আরব ইতিহাসবিদদের রচিত নথিপথেও পাল সাম্রাজ্যের সঙ্গে তাদের দেশের বাণিজ্যিক ও বৌদ্ধিক যোগাযোগের উল্লেখ পাওয়া যায়। বাগদাদের বাইতুল হিকমাহ এই যুগেই ভারতীয় সভ্যতার গাণিতিক ও জ্যোতির্বিজ্ঞান-সংক্রান্ত কীর্তিগুলির সঙ্গে পরিচিত হয়েছিল।[4]

খ্রিস্টীয় ৯ম শতাব্দীর প্রথম ভাগে পাল সাম্রাজ্য সর্বাধিক সমৃদ্ধি লাভ করেছিল। এই সময় পাল সাম্রাজ্যই ছিল ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তরাঞ্চলের প্রধান রাজনৈতিক শক্তি। সেই যুগে এই সাম্রাজ্য অধুনা পূর্ব-পাকিস্তান, উত্তর ও উত্তরপূর্ব ভারত, নেপালবাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভূখণ্ডে প্রসারিত হয়।[3][5] পাল সাম্রাজ্য সর্বাধিক সমৃদ্ধি ঘটেছিল সম্রাট ধর্মপালদেবপালের রাজত্বকালে। তিব্বতে অতীশের মাধ্যমে পাল সাম্রাজ্য প্রভূত সাংস্কৃতিক প্রভাব বিস্তার করেছিল। পাল সাম্রাজ্যের সাংস্কৃতিক প্রভাব পড়েছিল দক্ষিণপূর্ব এশিয়াতেও। উত্তর ভারতে পাল শাসন ছিল ক্ষণস্থায়ী। কারণ কনৌজের আধিপত্য অর্জনের জন্য গুর্জর-প্রতিহাররাষ্ট্রকূটদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে পাল সম্রাটরা পরাজিত হন। কিছুকালের জন্য পাল সাম্রাজ্যের পতন ঘটেছিল। তারপর সম্রাট প্রথম মহীপাল বাংলা ও বিহার অঞ্চলে দক্ষিণ ভারতীয় চোল অনুপ্রবেশ প্রতিহত করেন। সম্রাট রামপাল ছিলেন সর্বশেষ শক্তিশালী পাল সম্রাট। তিনি কামরূপকলিঙ্গে আধিপত্য বিস্তার করেছিলেন। খ্রিস্টীয় ১১শ শতাব্দীতে পাল সাম্রাজ্যের নানা অঞ্চলে বিদ্রোহ মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। এর ফলে সাম্রাজ্যের শক্তি অনেকটাই হ্রাস প্রাপ্ত হয়।

খ্রিস্টীয় ১২শ শতাব্দীতে হিন্দু সেন রাজবংশের পুনরুত্থানের ফলে পাল সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। সেই সঙ্গে ভারতীয় উপমহাদেশের সর্বশেষ প্রধান বৌদ্ধ সাম্রাজ্যের অবসান ঘটে। বাংলার ইতিহাসে পাল যুগকে অন্যতম সুবর্ণযুগ মনে করা হয়।[6][7] বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে কয়েক শতাব্দীব্যাপী গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে পাল সম্রাটরা বাংলায় স্থিতাবস্থা ও সমৃদ্ধি আনয়ন করেছিলেন। পূর্বতন বঙ্গীয় সভ্যতাকে তারা উন্নত করে তোলেন। সেই সঙ্গে শিল্পকলা ও স্থাপত্যের ক্ষেত্রে অসামান্য কীর্তি রেখে যান। তারা বাংলা ভাষার ভিত্তি রচনা করেছিলেন। বাংলার প্রথম সাহিত্যকীর্তি চর্যাপদ পাল যুগেই রচিত হয়েছিল। আজও তিব্বতি বৌদ্ধধর্মে পাল উত্তরাধিকার প্রতিফলিত হয়।

ইতিহাস

উৎস

খালিমপুর তাম্রলিপি অনুসারে, প্রথম পাল রাজা গোপাল ছিলেন বাপ্যত নামে এক যোদ্ধার পুত্র। রামচরিতম্‌ গ্রন্থে বলা হয়েছে যে, পাল রাজাদের পিতৃভূমি (‘জনকভূ’) ছিল বরেন্দ্র (উত্তরবঙ্গ)। এই রাজবংশের জাতিগত উৎস অজ্ঞাত। পরবর্তীকালের নথিপথ দাবি করে যে, গোপাল ছিলেন কিংবদন্তি সূর্যবংশের এক ক্ষত্রিয়বল্লালচরিত গ্রন্থেও বলা হয়েছে যে, পাল সম্রাটেরা ছিলেন ক্ষত্রিয়। তারানাথের ভারতে বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস ও ঘনারাম চক্রবর্তীর ধর্মমঙ্গল কাব্যেও (উভয় গ্রন্থই খ্রিষ্টীয় ১৬শ শতাব্দীতে রচিত) একই দাবি করা হয়েছে। রামচরিতম্‌ গ্রন্থে পঞ্চদশ পাল সম্রাট রামপালকে ক্ষত্রিয় বলা হয়েছে। পাল রাজবংশকে পৌরাণিক সূর্যবংশের উত্তরসূরি বলে যে দাবি করা হয়, তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। সম্ভবত এই রাজবংশের উৎসটি খুবই সাধারণ এবং তাকে আবৃত করার জন্যই এমন দাবি করা হয়েছিল।[7] মঞ্জুশ্রীমূলকল্প প্রভৃতি গ্রন্থে পাল রাজবংশকে শূদ্র বলা হয়েছে। সম্ভবত বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী হওয়ার জন্য এই দাবি করা হয়।[8][9][10][11][12][13][14] আবুল-ফজল ইবন মুবারকের আইন-ই-আকবরি গ্রন্থে পালদের কায়স্থ বলা হয়েছে। কোনও কোনও উপাখ্যানে এমন দাবিও করা হয়েছে যে, গোপাল সম্ভবত ব্রাহ্মণ বংশের সন্তান ছিলেন।[15][16]

প্রতিষ্ঠা

শশাঙ্কের রাজ্যের পতনের পর বাংলা অঞ্চলে নৈরাজ্য দেখা দেয়। এই সময় এই অঞ্চলে কোনও কেন্দ্রীয় শাসক ছিলেন না। ক্ষুদ্র গোষ্ঠীপতিরা নিরন্তর নিজেদের মধ্যে যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন। সমসাময়িক গ্রন্থে এই অবস্থাটিকে ‘মাৎস্যন্যায়’ (অর্থাৎ বড়ো মাছ যেমন ছোটো মাছকে খেয়ে ফেলে, সেই রকম অবস্থা) বলে বর্ণনা করা হয়েছে। এই সময়েই গোপাল প্রথম পাল রাজা হিসেবে সিংহাসনে আরোহণ করেন। খালিমপুর তাম্রলিপি থেকে অনুমিত হয়, বাংলা অঞ্চলের ‘প্রকৃতি’ (জনসাধারণ) তাকে রাজা নির্বাচিত করেছিল।[7] প্রায় ৮০০ বছর পরে তারানাথও লিখেছেন যে, বাংলার জনসাধারণ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে তাকে নির্বাচিত করেছিল। যদিও এই ঘটনাটি কিংবদন্তির আকারে প্রচলিত এবং ঐতিহাসিকভাবে নির্ভরযোগ্য তথ্য নয়। এই কিংবদন্তি অনুসারে, নৈরাজ্যের এক যুগের পর জনসাধারণ পরপর একাধিক রাজাকে নির্বাচিত করেছিলেন। কিন্তু তাদের সকলকেই নির্বাচনের পরের রাতেই এক নাগ রানি ভক্ষণ করেন। গোপাল সেই নাগ রানিকে হত্যা করতে সমর্থ হন এবং সিংহাসনে আসীন থাকতে সমর্থ হন।[17] ঐতিহাসিক প্রমাণ নির্দেশ করে যে, গোপাল প্রত্যক্ষভাবে জনসাধারণ কর্তৃক নির্বাচিত হননি। একদল সামন্ত গোষ্ঠীপতি তাকে নির্বাচিত করেন। এই ধরনের নির্বাচন বাংলা অঞ্চলের সমসাময়িক সমাজে খুবই সাধারণ ঘটনা ছিল।[7][17]

গোপালের সিংহাসনারোহণ একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ঘটনা ছিল। কারণ একাধিক স্বাধীন গোষ্ঠীপতি কোনও প্রকার বিরোধ ছাড়াই তার রাজনৈতিক কর্তৃত্বকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন।[6]


খালিমপুর তাম্রপত্র

খালিমপুর তাম্রলেখ, ১-৩৩ পংক্তি

খালিমপুর তাম্রলেখ, ৩৪-৬২ পংক্তি

ধর্মপাল ও দেবপালের রাজ্যবিস্তার

কনৌজ ত্রিভূজের একটি মানচিত্র

গোপালের সাম্রাজ্যের ব্যাপক প্রসার ঘটান তার পুত্র ধর্মপাল ও পৌত্র দেবপাল। প্রথম দিকে প্রতিহার শাসক বৎসরাজার হাতে ধর্মপাল পরাজিত হয়েছিলেন। পরে রাষ্ট্রকূট রাজা ধ্রুব ধর্মপাল ও বৎসরাজা দুজনকেই পরাজিত করেন। ধ্রুব দাক্ষিণাত্য অঞ্চলে ফিরে গেলে ধর্মপাল উত্তর ভারতে একটি শক্তিশালী সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন। তিনি কনৌজের ইন্দ্রায়ুধকে পরাজিত করেন এবং কনৌজের সিংহাসনকে নিজের নির্বাচিত চক্রায়ুধকে স্থাপন করেন। উত্তর ভারতের আরও কয়েকটি ছোটো রাজ্য ধর্মপালের আধিপত্য স্বীকার করে নেয়। কিছুকাল পরেই বৎসরাজার পুত্র দ্বিতীয় নাগভট ধর্মপালের রাজ্যবিস্তার পর্যবেক্ষণ করতে আসেন। তিনি কনৌজ জয় করেন এবং চক্রায়ুধকে বিতাড়িত করেন। এরপর দ্বিতীয় নাগভট মুঙ্গের পর্যন্ত অগ্রসর হন এবং একটি আকস্মিক যুদ্ধে ধর্মপালকে পরাজিত করেন। ধর্মপাল আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হন এবং রাষ্ট্রকূট সম্রাট তৃতীয় গোবিন্দের সঙ্গে মিত্রতা স্থাপন করেন। তৃতীয় গোবিন্দ উত্তর ভারত আক্রমণ করে দ্বিতীয় নাগভটকে পরাজিত করেন।[18][19] রাষ্ট্রকূট নথিপত্র থেকে জানা যায় যে, চক্রায়ুধ ও ধর্মপাল দুজনেই রাষ্ট্রকূট আধিপত্য স্বীকার করেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে তৃতীয় গোবিন্দ দাক্ষিণাত্যে ফিরে গেলে ধর্মপাল উত্তর ভারত নিজের নিয়ন্ত্রণে আনেন। তিনি ‘পরমেশ্বর পরমভট্টারক মহারাজাধিরাজ’ উপাধি গ্রহণ করেছিলেন।[6]

ধর্মপালের পর তার পুত্র দেবপাল সিংহাসনে আরোহণ করেছিলেন। তাকে সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী পাল শাসক মনে করা হয়।[6] তিনি প্রাগজ্যোতিষ (অধুনা অসম) ও উৎকল (অধুনা ওড়িশা) আক্রমণ করেছিলেন। প্রাগজ্যোতিষের রাজা বিনাযুদ্ধেই তার কাছে আত্মসমর্পণ করেন এবং উৎকলের রাজ্য রাজ্য ছেড়ে পালিয়ে যান।[20] তার উত্তরসূরিদের দ্বারা উৎকীর্ণ লিপিগুলিতে দাবি করা হয়েছে যে, তিনি আরও কিছু অঞ্চল জয় করেছিলেন। তবে এগুলি অতিমাত্রায় অতিরঞ্জিত তথ্য (নিচে ভূগোল অংশটি দেখুন)।[7][21]

পতনের প্রথম পর্যায়

দেবপালের মৃত্যুর পর পাল সাম্রাজ্য ধীরে ধীরে ভেঙে পড়তে শুরু করে। দেবপালের ভ্রাতুষ্পুত্র বিগ্রহপাল অল্প কিছুকাল রাজত্ব করার পর সিংহাসন ত্যাগ করেন এবং সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। বিগ্রহপালের পুত্র তথা উত্তরসূরি নারায়ণপাল ছিলেন একজন দুর্বল শাসক। তার রাজত্বকালে রাষ্ট্রকূট রাজা অমোঘবর্ষ পালদের পরাজিত করেন। পালেদের পতনের সুযোগ নিয়ে অসমের রাজা হরজর সম্রাট উপাধি গ্রহণ করেন এবং শৈলোদ্ভব রাজবংশ ওড়িশা অঞ্চলে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করে।[6]

নারায়ণপালের পুত্র রাজ্যপাল অন্তত ১২ বছর রাজত্ব করেছিলেন। তিনি কয়েকটি জনসেবামূলক প্রতিষ্ঠান ও সুদৃশ্য মন্দির নির্মাণ করান। তার পুত্র দ্বিতীয় গোপাল কয়েক বছর রাজত্ব করার পরই বাংলার উপর থেকে আধিপত্য হারান এবং তারপর শুধুমাত্র বিহার অঞ্চল শাসন করেন। পরবর্তী রাজা দ্বিতীয় বিগ্রহপালকে চান্দেলকলচুরি আক্রমণ সহ্য করতে হয়। তার রাজত্বকালে পাল সাম্রাজ্য গৌড়, রাঢ়, অঙ্গ ও বঙ্গ প্রভৃতি ছোটো ছোটো রাজ্য বিভাজিত হয়ে যায়। হরিকেলের (পূর্ব ও দক্ষিণ বাংলা) কান্তিদেব ‘মহারাধিরাজ’ উপাধি গ্রহণ করেন এবং এবং একটি পৃথক রাজ্য স্থাপন করেন। পরবর্তীকালে চন্দ্র রাজবংশ এই রাজ্যটি শাসন করেছিল।[6] কম্বোজ পাল রাজবংশ গৌড় রাজ্যটি (পশ্চিম ও উত্তর বাংলা) শাসন করত। এই রাজবংশের শাসকেরা নামের শেষে ‘-পাল’ উপসর্গটি ব্যবহার করতেন (যেমন রাজ্যপাল, নারায়ণপালনয়পাল)। এই রাজবংশের উৎসটি অজ্ঞাত। তবে এই ব্যাপারে সর্বাধিক যুক্তিগ্রাহ্য মতটি হল, কোনও এক পাল আধিকারিক রাজধানী সহ পাল সাম্রাজ্যের একটি বৃহৎ অংশের ক্ষমতা হস্তগত করে এই রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।[6][7]

প্রথম মহীপালের রাজ্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা

প্রথম মহীপাল ৯৮৮ খ্রিষ্টাব্দে সিংহাসনে আরোহণ করেন। তার তিন বছরের মধ্যেই তিনি উত্তর ও পূর্ব বাংলা পুনরুদ্ধার করেছিলেন। এছাড়াও তিনি অধুনা বর্ধমান বিভাগের উত্তরাঞ্চলও পুনরুদ্ধার করেছিলেন। তার রাজত্বকালে ১০২১ থেকে ১০২৩ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে চোল সাম্রাজ্যের প্রথম রাজেন্দ্র চোল কয়েকবার বাংলা আক্রমণ করেছিলেন। তার উদ্দেশ্য ছিল গঙ্গার জল সংগ্রহ। রাজ্যবিস্তার করতে গিয়ে তিনি একাধিক শাসককে পদানত করতে সক্ষম হন এবং প্রভূত সম্পদ লুণ্ঠন করেন। বাংলার ধর্মপাল, রণসুর ও গোবিন্দচন্দ্রকে প্রথম রাজেন্দ্র চোল পরাজিত করেন। এঁরা সম্ভবত পাল রাজবংশের প্রথম মহীপালের অধীনস্থ সামন্ত শাসক ছিলেন।[22] প্রথম রাজেন্দ্র চোল প্রথম মহীপালকেও পরাজিত করেন এবং পাল রাজার থেকে “দুর্লভ শক্তির হস্তীবাহিনী, নারী ও সম্পত্তি” লাভ করেন।[23] প্রথম মহীপাল উত্তর ও দক্ষিণ বিহারেও আধিপত্য বিস্তার করেছিলেন। সম্ভবত গজনির মামুদের ভারত আক্রমণের ফলে উত্তর ভারতের রাজশক্তিগুলির দুর্বল হয়ে পড়া তাকে এই রাজ্যবিস্তারে সহায়তা করেছিল। তিনি সম্ভবত বারাণসী ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলিও জয় করেছিলেন। কারণ, তার ভ্রাতা স্থিরপাল ও বসন্তপাল বারাণসীতে একাধিক ধর্মীয় স্থাপনা নির্মাণ ও সংস্কারের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। পরবর্তীকালে কলচুরি রাজা গাঙ্গেয়দেব অঙ্গের শাসককে পরাজিত করে বারাণসী অধিকার করেন। অঙ্গের এই শাসক সম্ভবত ছিলেন প্রথম মহীপাল।[6]

পতনের দ্বিতীয় পর্যায়

প্রথম মহীপালের পুত্র নয়পাল এক দীর্ঘ যুদ্ধের পর কলচুরি রাজা কর্ণকে (গাঙ্গেয়দেবের পুত্র) পরাজিত করেন। পরবর্তীকালে তারা বৌদ্ধ পণ্ডিত অতীশের মধ্যস্থতায় একটি শান্তিচুক্তি সাক্ষর করেন। নয়পালের পুত্র তৃতীয় বিগ্রহপালের রাজত্বকালে কর্ণ পুনরায় বাংলা আক্রমণ করেন। কিন্তু সেবারও তিনি পরাজিত হন এবং সেবারও একটি শান্তিচুক্তির মাধ্যমে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। তৃতীয় বিগ্রহপাল কর্ণের কন্যা যৌবনশ্রীকে বিবাহ করেন। পরে চালুক্য রাজা ষষ্ঠ বিক্রমাদিত্যের হাতে তৃতীয় বিগ্রহপাল পরাজিত হন। ষষ্ঠ বিক্রমাদিত্যের বাংলা আক্রমণের সময় দক্ষিণ ভারত থেকে বাংলায় বহু সৈনিক এসে বসতি স্থাপন করেছিলেন। এটিই সেন রাজবংশের দাক্ষিণাত্য উৎসের ব্যাখ্যা।[24] ওড়িশার সোমবংশী রাজা মহাশিবগুপ্ত যযাতিও তৃতীয় বিগ্রহপালের রাজ্য আক্রমণ করেছিলেন। এরপরে একাধিক আক্রমণের ফলে পাল সাম্রাজ্যের শক্তি অনেকটাই হ্রাস পায়। তার রাজত্বকালেই বর্মণরা পূর্ব বাংলা অধিকার করেন।[6][7]

তৃতীয় বিগ্রহপালের পুত্র দ্বিতীয় মহীপাল অল্প কিছুকালের জন্য পালেদের সামরিক গৌরব ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন। সন্ধ্যাকর নন্দীর রামচরিতম্‌ গ্রন্থে তার রাজত্বকালের বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়। দ্বিতীয় মহীপাল তার ভ্রাতা রামপাল ও দ্বিতীয় সুরপালকে কারারুদ্ধ করেছিলেন। তিনি সন্দেহ করেছিলেন, তারা তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন। এর কিছুকাল পরেই তিনি কৈবর্ত (ধীবর) প্রজাসত্ত্বভোগী গোষ্ঠীপতিদের বিদ্রোহের সম্মুখীন হন। এই অভ্যুত্থান কৈবর্ত বিদ্রোহ নামে খ্যাত। দিব্য (বা দিব্বক) নামে এক গোষ্ঠীপতি তাকে হত্যা করেন এবং বরেন্দ্র অঞ্চল অধিকার করেন। এই অঞ্চল দিব্যকের উত্তরসূরি রুদক ও ভীমের নিয়ন্ত্রণে থাকে। দ্বিতীয় সুরপাল মগধে পালিয়ে যান এবং অল্প কিছুকাল রাজত্ব করার পর মারা যান। তারপর তার ভ্রাতা রামপাল সিংহাসনে বসে। তিনি দিব্যের পৌত্র ভীমের বিরুদ্ধে একটি প্রধান যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। তার মামা মথন (রাষ্ট্রকূট রাজবংশের) এবং দক্ষিণ বিহার ও দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলার একাধিক সামন্ত শাসক তাকে সাহায্য করেন। রামপাল শেষ পর্যন্ত ভীমকে পরাজিত করেন এবং তাকে ও তার পরিবারকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেন।[6][7]

রামপাল কর্তৃক রাজ্য পুনরুদ্ধার

বরেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ হস্তগত করার পর রামপাল পাল সাম্রাজ্যকে পুনরুদ্ধার করার চেষ্টা করেন। তবে তেমন সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হন না। তিনি নতুন রাজধানী রামাবতী থেকে রাজ্যশাসন করতেন। রামাবতীই পাল সাম্রাজ্যের পতন পর্যন্ত সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল। তিনি করভার হ্রাস করেছিলেন, কৃষিকার্যে উৎসাহ দান করতেন এবং একাধিক জনসেবামূলক প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। তিনি কামরূপ ও রাঢ় অঞ্চলে নিজের আধিপত্য বিস্তার করেন এবং পূর্ব বাংলার বর্মণ রাজাকে তার আধিপত্য স্বীকার করতে বাধ্য করেন। অধুনা ওড়িশা ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণ অর্জনের জন্য তিনি তিনি গঙ্গ রাজার সঙ্গে যুদ্ধ করেন। রামপালের মৃত্যুর পূর্বে গঙ্গরা উক্ত অঞ্চল অধিকার করতে সমর্থ হয়নি। পাল ও চোল সাম্রাজ্যের সাধারণ শত্রু গণ ও চালুক্যদের বিরুদ্ধে সমর্থন জোগাড় করার জন্য রামপাল চোল রাজা কুলোত্তুঙ্গর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতেন। তিনি সেনদের উপর নজর রেখেছিলেন। কিন্তু কর্ণাটকের নান্যুদেব নামক গোষ্ঠীপতির কাছে মিথিলা হারান। গহদবল শাসক গোবিন্দচন্দ্রের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করে তিনি পাল সাম্রাজ্যকে উক্ত শাসকের আগ্রাসী সমরনীতির হাত থেকে রক্ষা করেন।[6][7]

সর্বশেষ পতন

রামপাল ছিলেন পাল রাজবংশের সর্বশেষ শক্তিশালী শাসক। তার মৃত্যুর পর তার পুত্র কুমারপালের রাজত্বকালে অসমে একটি বিদ্রোহ মাথাচাড়া দেয়। বৈদ্যদেব এই বিদ্রোহ দমন করেন। কিন্তু কুমারপালের মৃত্যুর পর বৈদ্যদেব কার্যত একটি পৃথক রাজ্য স্থাপন করেন।[6] রামচরিতম্‌ অনুসারে, কুমারপালের পুত্র তৃতীয় গোপালকে তার কাকা মদনপাল খুন করেন। মদনপালের শাসনকালে পূর্ব বাংলার বর্মণরা স্বাধীনতা ঘোষণা করে এবং ওড়িশায় পূর্ব গঙ্গদের সঙ্গে সংঘাত পুনরায় ঘনীভূত হয়। মন্দপাল গহদবলদের কাথ থেকে মুঙ্গের অধিকার করেছিলেন। কিন্তু বিজয়সেন তাকে পরাজিত করে দক্ষিণ ও পূর্ব বাংলা নিজের নিয়ন্ত্রণে আনেন। ১১৬২ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ গোবিন্দপাল নামে এক রাজা অধুনা গয়া জেলার ভূখণ্ডে রাজত্ব করতেন। কিন্তু পাল সম্রাটদের সনেগ তার কোনও সম্পর্ক ছিল বলে সুদৃঢ় প্রমাণ পাওয়া যায় না। পাল সাম্রাজ্যের পতনের পর সেন রাজবংশ বাংলা শাসন করতে শুরু করে।[7]

ভূগোল

পাল রাজবংশের সাম্রাজ্যসীমা তাদের সমগ্র রাজত্বকালে পরিবর্তনশীল ছিল। পালরা এক সময়ে উত্তর ভারতের একটি বৃহৎ অংশ জয় করলেও, গুর্জর-প্রতিহার, রাষ্ট্রকূট ও অন্যান্য কম শক্তিশালী রাজাদের সঙ্গে ক্রমাগত বিরোধিতার পরিপ্রেক্ষিতে তারা সেই সাম্রাজ্য ধরে রাখতে পারেননি। [25]

গোপালের প্রতিষ্ঠিত মূল রাজ্যটির সঠিক সীমারেখা কী ছিল, তার কোনও নথি পাওয়া যায় না। তবে সম্ভবত সমগ্র বাংলা অঞ্চল সেই রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল।[6] ধর্মপালের শাসনকালে পাল সাম্রাজ্যের ব্যাপক বিস্তার ঘটেছিল। বাংলা ছাড়াও তিনি অধুনা বিহার ভূখণ্ড প্রত্যক্ষভাবে শাসন করতেন। একটা সময় কনৌজ রাজ্য (অধুনা উত্তরপ্রদেশ) পালদের করদ রাজ্য ছিল এবং সেই রাজ্য শাসন করতেন চক্রায়ুধ।[6] কনৌজের সিংহাসনে নিজের নির্বাচিত রাজাকে স্থাপন করে ধর্মপাল একটি সাম্রাজ্য সভাও গঠন করেছিলেন। তার স্থাপিত খালিমপুর তাম্রলিপি থেকে জানা যায়, সেই সাম্রাজ্য সভায় ভোজ (সম্ভবত বিদর্ভ), মৎস্য (রাজস্থানের জয়পুর অঞ্চল), মদ্র (পূর্ব পাঞ্জাব), কুরু (দিল্লি অঞ্চল), যদু (সম্ভবত মথুরা, দ্বারকা বা পাঞ্জাবের সিংহপুর), যবন, অবন্তী, গান্ধার ও কিরার (কাংরা উপত্যকা) শাসকেরা উপস্থিত থাকতেন।[7][26] এই রাজন্যবর্গ কনৌজের সিংহাসনে চক্রায়ুধের নির্বাচন সমর্থন করেহিলেন এবং “সম্মানপ্রদর্শনপূর্বক তাঁদের কম্পিত শিরোভূষণ সহ অবনত হয়েছিলেন।”[27] এই ঘটনা থেকে অনুমিত হয় যে, সার্বভৌম সম্রাট হিসেবে ধর্মপালের কর্তৃত্ব অধিকাংশ শাসকই মেনে নিয়েছিলেন। তবে মৌর্য বা গুপ্ত সাম্রাজ্যের মতো এই ব্যবস্থা সুদৃঢ় ছিল না। অন্যান্য শাসকেরা ধর্মপালের সামরিক ও রাজনৈতিক আধিপত্য স্বীকার করেছিলেন। কিন্তু তারা নিজস্ব অঞ্চল শাসন করতেন।[7] উত্তর ভারতে তার আধিপত্যের পরিপ্রেক্ষিত্বে গুজরাতের কবি সোদ্ধল ধর্মপালকে ‘উত্তরাপথস্বামী’ (‘উত্তর ভারতের অধিপতি’) বলেছিলেন।[28]

উৎকীর্ণ লিপিগুলিতে দেবপালের সামরিক অভিযান সম্পর্কে অনেক অতিশয়োক্তি লক্ষিত হয়। দেবপালের উত্তরসূরি নারায়ণপাল কর্তৃক উৎকীর্ণ বাদল স্তম্ভলিপি অনুসারে, নিজের ব্রাহ্মণ মন্ত্রী দর্ভপাণির সুপরামর্শ ও নীতির বলে দেবপাল উত্তর ভারতের ‘চক্রবর্তী’ বা সার্বভৌম নরপতি হয়েছিলেন। তার রাজ্যের সীমানা ছিল বিন্ধ্য থেকে হিমালয় পর্বতমালা পর্যন্ত। এই লিলি অনুসারে, তার সাম্রাজ্য দুই মহাসমুদ্র (খুব সম্ভবত আরব সাগরবঙ্গোপসাগর) পর্যন্ত প্রসারিত হয়েছিল। এই লিপিতে এমনও দাবি করা হয়েছে যে, দেবপাল উৎকল (অধুনা ওড়িশা), হুন, কম্বোজ, দ্রাবিড়, কামরূপ (অধুনা অসম) ও গুর্জরদের পরাজিত করেছিলেন:[6]

  • দেবপালের গুর্জর প্রতিপক্ষ সম্ভবত ছিলেন মিহির ভোজ। পূর্ব ভারতে তার আগ্রাসন দেবপাল প্রতিহত করেছিলেন।
  • হুন রাজার পরিচয় অনিশ্চিত।
  • কম্বোজ রাজপুত্রের পরিচয়ও অনিশ্চিত। কম্বোজ নামক প্রাচীন দেশটি অধুনা আফগানিস্তান ভূখণ্ডে অবস্থিত ছিল। কিন্তু দেবপালের সাম্রাজ্য ততদূর পর্যন্ত প্রসারিত হয়েছিল বলে কোনও প্রমাণ পাওয়া যায় না। এই লিপিতে কম্বোজ বলতে উত্তর ভারতে আগত কম্বোজ উপজাতিও বোঝাতে পারে (কম্বোজ পাল রাজবংশ দেখুন)।
  • দ্রাবিড় রাজাকে সাধারণত রাষ্ট্রকূট রাজা অমোঘবর্ষ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। কোনও কোনও গবেষকের মতে, দ্রাবিড় রাজা হলেন পাণ্ড্য রাজা শ্রীমার শ্রীবল্লভ। কারণ ‘দ্রাবিড়’ শব্দটির মাধ্যমে কৃষ্ণা নদীর দক্ষিণাঞ্চল বোঝায়। এই তত্ত্ব অনুসারে, হয়ত চান্দেল রাজা বিজয় দেবপালকে দাক্ষিণাত্য অভিযানে সাহায্য করেছিলেন। তবে যদি দেবপাল দক্ষিণের কোনও অঞ্চল অধিকার করেও থাকেন, তবে তা ছিল সাময়িক।

দেবপালের বিজয়াভিযান সম্পর্কে যে দাবি করা হয় তার মধ্যে অতিশয়োক্তি আছে। তবে তা সম্পূর্ণরূপে অস্বীকারও করা যায় না: দেবপাল যে উৎকল ও কামরূপ জয় করেছিলেন, তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। তাছাড়া রাষ্ট্রকূট ও গুর্জর-প্রতিহারদের প্রতিবেশী রাজ্যগুলি সেই সময় দুর্বল ছিল। তাও হয়ত তাকে সাম্রাজ্য বিস্তারে সাহায্য করেছিল।[21] মনে করা হয়, দেবপাল পাঞ্জাবে সিন্ধু নদ পর্যন্ত সামরিক অভিযান চালিয়েছিলেন।[6]

দেবপালের মৃত্যুর পর পাল সাম্রাজ্য দুর্বল হতে শুরু করে। তার উত্তরসূরি নারায়ণপাল অসম ও ওড়িশার নিয়ন্ত্রণ হারান। তিনি কিছু সময়ের জন্য মগধ ও উত্তর বাংলার নিয়ন্ত্রণও হারিয়েছিলেন। তৃতীয় গোপাল বাংলার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে শুধুমাত্র বিহারের একটি অংশ শাসন করতেন। দ্বিতীয় বিগ্রহপালের রাজত্বকালে পাল সাম্রাজ্য ছোটো ছোটো রাজ্যে ভেঙে পড়ে। মহীপাল বাংলা ও বিহারের অংশ পুনরুদ্ধার করেছিলেন। তার উত্তরসূরিরা আবার বাংলার আধিপত্য হারান। সর্বশেষ শক্তিশালী পাল সম্রাট রামপাল বাংলা, বিহার, অসম ও ওড়িশার কিছু অংশ নিজের নিয়ন্ত্রণে আনেন।[6] মদনপালের মৃত্যুর সময় পাল সাম্রাজ্যের সীমা ছিল মধ্য ও পূর্ব বিহার এবং উত্তর বাংলার মধ্যে সীমিত।[6]

প্রশাসন

পাল প্রশাসন ছিল রাজতান্ত্রিক। রাজাই ছিলেন সকল ক্ষমতার কেন্দ্র। পাল রাজারা ‘পরমেশ্বর’, ‘পরমভট্টারক’, ‘মহারাজাধিরাজ’ ইত্যাদি সম্রাটসুলভ উপাধি গ্রহণ করতেন। তারা প্রধানমন্ত্রীদের নিয়োগ করতেন। পাল সাম্রাজ্যে ‘গর্গের পরম্পরা’ ১০০ বছর প্রধানমন্ত্রিত্ব করেছেন:

  • গর্গ
  • দর্ভপাণি
  • সোমেশ্বর
  • কেদারমিশ্র
  • ভট্ট গৌরবমিশ্র

পাল সাম্রাজ্য পৃথক পৃথক ‘ভুক্তি’তে (প্রদেশ) বিভক্ত ছিল। ভুক্তিগুলি ‘বিষয়’ (বিভাগ) ও ‘মণ্ডলে’ (জেলা) বিভক্ত ছিল। ছোটো ছোটো প্রশাসনিক ক্ষেত্রগুলিকে ছিল ‘খণ্ডল’, ‘ভাগ’, ‘আবৃত্তি’, ‘চতুরক’ ও ‘পট্টক’। তৃণমূল স্তর থেকে সম্রাজ্য সভা পর্যন্ত প্রশাসনের পরিধি বিস্তৃত ছিল।[29]

পাল তাম্রলিপিতে নিম্নোক্ত প্রশাসনিক পদগুলির কথা উল্লিখিত হয়েছে:[30]

  • রাজা
  • রাজন্যক
  • রণক (সম্ভবত অধীনস্থ গোষ্ঠীপতি)
  • সামন্ত ও মহাসামন্ত (সামন্ত রাজা)
  • মহাসন্ধি-বিগ্রহিক (পররাষ্ট্র মন্ত্রী)
  • দূত (প্রধান রাষ্ট্রদূত)
  • রাজস্থানীয় (উপপ্রধান)
  • অগ্‌গরক্‌সা (প্রধান রক্ষী)
  • ষষ্ঠাধিকর্তৃ (কর সংগ্রাহক)
  • চৌরোদ্ধারণিক (আরক্ষা কর)
  • শৌলকক (বাণিজ্য কর)
  • দশপারাধিক (জরিমানা আদায়কারী)
  • তরিক (নদী পারাপারের উপর আরোপিত করের সংগ্রাহক)
  • মহাক্ষপতালিক (কোষাদ্ধক্ষ)
  • জ্যেষ্ঠকায়স্থ (নথি প্রবন্ধক)
  • ক্ষেত্রপ (ভূমি ব্যবহার বিভাগের প্রধান) ও প্রমাতৃ (ভূমি জরিপ বিভাগের প্রধান)
  • মহাদণ্ডনায়ক বা ধর্মাধিকার (প্রধান বিচারপতি)
  • মহাপ্রতিহার
  • দণ্ডিক
  • দণ্ডপাশিক
  • দণ্ডশক্তি (পুলিশ বাহিনী)
  • 'খোল (গোপন বাহিনী)
  • গবাধক্ষ (গো-খামারের প্রধান)
  • ছাগাধ্যক্ষ (ছাগ-খামারের প্রধান)
  • মেষাধ্যক্ষ (মেষ-খামারের প্রধান)
  • মহিষাধ্যক্ষ (মহিষ-খামারের প্রধান)
  • বোগপতি
  • বিষয়পতি
  • ষষ্ঠাধিকৃত
  • দৌঃশশধানিক
  • নকাধ্যক্ষ

সংস্কৃতি

ধর্ম

নালন্দাকে নথিভুক্ত ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়গুলির অন্যতম মনে করা হয়। পাল রাজত্বকালে এই মহাবিহারটি খ্যাতির মধ্যগগনে ছিল।
অতীশ ছিলেন একজন বৌদ্ধ শিক্ষক। তিনি তিব্বতি বৌদ্ধধর্মের সর্ম পরম্পরা প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করেছিলেন।

পাল সম্রাটরা ছিলেন মহাযান বৌদ্ধধর্মের পৃষ্ঠপোষক। গোপালের মৃত্যুর পর রচিত কয়েকটি নথিতে তাকে বৌদ্ধ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে তা সত্য কিনা জানা যায় না।[31] পরবর্তী পাল রাজারা নিশ্চিতভাবেই বৌদ্ধ ছিলেন। তারানাথ লিখেছেন যে, গোপাল গোঁড়া বৌদ্ধ ছিলেন এবং তিনি ওদন্তপুরীর বিখ্যাত মঠটি নির্মাণ করেন।[32] ধর্মপাল বৌদ্ধ দার্শনিক হরিভদ্রকে তার গুরুত্বে বরণ করেন। তিনি বিক্রমশিলা মঠ ও সোমপুর মহাবিহার প্রতিষ্ঠা করেন। তারানাথ আরও বলেছেন যে, তিনি ৫০টি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন এবং বৌদ্ধ লেখক হরিভদ্রের পৃষ্ঠপোষকতা করেন। দেবপাল সোমপুর মহাবিহারের সংস্কার করেন এবং তার আয়তন বৃদ্ধি করেন। এই মহাবিহার হিন্দু রামায়ণমহাভারত মহাকাব্যের দৃশ্যাবলি দ্বারাও সজ্জিত ছিল। প্রথম মহীপাল সারনাথ, নালন্দাবোধগয়ায় একাধিক মঠ ও মন্দির সংস্থার ও নির্মাণের নির্দেশ দিয়েছিলেন।[6] তাকে নিয়ে লেখা মহীপাল গীত নামে এক জাতীয় লোকসংগীত এখনও বাংলার গ্রামীণ অঞ্চলে জনপ্রিয়।

পাল সম্রাটরা বিক্রমশিলানালন্দার মতো বৌদ্ধ শিক্ষাকেন্দ্রের বিকাশে সাহায্য করেন। নালন্দাকে নথিবদ্ধ ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়গুলির অন্যতম মনে করা হয়। পাল সম্রাটদের পৃষ্ঠপোষকতায় এই মহাবিহারের সর্বাধিক সমৃদ্ধি ঘটেছিল। পাল যুগের বিশিষ্ট বৌদ্ধ পণ্ডিতরা ছিলেন অতীশ, সন্তরক্ষিত, সরহ, তিলোপা, বিমলমিত্র, দানশীল, দানশ্রী, জিনমিত্র, জ্ঞানশ্রীমিত্র, মঞ্জুঘোষ, মুক্তিমিত্র, পদ্মনাভ, সম্ভোগবজ্র, শান্তরক্ষিত, শীলভদ্র, সুগতশ্রী ও বিরচন।

গৌতম বুদ্ধের দেশের শাসক হিসেবে পাল সম্রাটরা বৌদ্ধ বিশ্বে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। যবদ্বীপের শৈলেন্দ্র রাজা বালপুত্রদেব দেবপালের কাছে এক দূত পাঠিয়ে নালন্দায় একটি মঠ নির্মাণের জন্য পাঁচটি গ্রাম অনুদান চান।[33] দেবপাল তার অনুরোধ রক্ষা করেছিলেন। তিনি নগরহরের (অধুনা জালালাবাদ) ব্রাহ্মণ বীরদেবকে নামন্দা মঠের প্রধান নিযুক্ত করেন। বৌদ্ধ কবি বজ্রদত্ত (লোকেশ্বরশতক গ্রন্থের রচয়িতা) তার সভাকবি ছিলেন।[6] পাল রাজত্বকালে বৌদ্ধ পণ্ডিতরা বাংলা থেকে অন্যান্য অঞ্চলে গিয়ে বৌদ্ধধর্ম প্রচার করেন। অতীশ তিব্বতসুমাত্রায় ধর্মপ্রচার করেন। তিনি ছিলেন ১১শ শতাব্দীতে মহাযান বৌদ্ধধর্ম প্রচারের অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব।

পাল সম্রাটরা শৈব সন্ন্যাসীদেরও (বিশেষত গোলাগি মঠের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন যাঁরা) সমর্থন করতেন।[34] নারায়ণপাল নিজে একটি শিবমন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি তার ব্রাহ্মণ মন্ত্রী কর্তৃক আয়োজিত যজ্ঞেও উপস্থিত ছিলেন।[35] বৌদ্ধ দেবদেবীদের পাশাপাশি পাল যুগে হিন্দু দেবতা বিষ্ণু, শিব ও সরস্বতীর মূর্তিও নির্মিত হয়েছিল।[36]

সাহিত্য

পাল সম্রাটরা সংস্কৃত পণ্ডিতদের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। তাদের কয়েকজন পাল আধিকারিকও ছিলেন। পাল শাসনকালেই ‘গৌড় রীতি’ নামক রচনাশৈলী বিকাশলাভ করে। অনেক বৌদ্ধ তান্ত্রিক গ্রন্থ পাল যুগে রচিত ও অনূদিত হয়। উপরে ধর্ম অংশে উল্লিখিত বৌদ্ধ পণ্ডিতেরা ছাড়াও পাল যুগের বিশিষ্ট কয়েকজন পণ্ডিত ছিলেন জীমূতবাহন, সন্ধ্যাকর নন্দী, মাধব-কর, সুরেশ্বর ও চক্রপাণি দত্ত।[6]

পালযুগে রচিত উল্লেখযোগ্য দর্শন গ্রন্থগুলি হল গৌড়পাদের আগম শাস্ত্র, শ্রীধর ভট্টের ন্যায় কুণ্ডলী ও ভট্ট ভবদেবের কর্মানুশীলন পদ্ধতি। চিকিৎসাবিদ্যা সংক্রান্ত গ্রন্থগুলির মধ্যে রয়েছে চক্রপাণি দত্তের চিকিৎসা সংগ্রহ, আয়ুর্বেদ দীপিকা, ভানুমতী, শব্দ চন্দ্রিকাদ্রব্য গুণসংগ্রহ, সুরেশ্বরের শব্দ-প্রদীপ, বৃক্ষায়ুর্বেদলোহপদ্ধতি, বঙ্গসেনের চিকিৎসা সারসংগ্রহ, গদাধর বৈদ্যের সুশ্রত, জীমূতবাহনের দায়ভাগ, ব্যবোহার মাত্রিকাকালবিবেক। সন্ধ্যাকর নন্দীর আধা-কথাসাহিত্যমূলক মহাকাব্য রামচরিতম্‌ (১২শ শতাব্দী) পাল ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্যসূত্র।

পাল যুগে রচিত চর্যাপদ নামক গানগুলিতে প্রোটো-বাংলা ভাষার একটি রূপ লক্ষিত হয়।[6]

শিল্প ও স্থাপত্য

পাল ভাস্কর্যশৈলীটি ভারতীয় শিল্পকলার একটি স্বতন্ত্র পর্যায়। এই ভাস্কর্যশৈলীটি বাংলার ভাস্করদের শৈল্পিক দক্ষতার একটি উল্লেখযোগ্য নিদর্শন।[37] এই ভাস্কর্যশৈলীটি গুপ্ত শিল্পকলার দ্বারা প্রভাবিত।[38]

পূর্বেই বলা হয়েছে যে, পাল সম্রাটরা বহু মঠ ও অন্যান্য ধর্মস্থান নির্মাণ করেছিলেন। অধুনা বাংলাদেশ রাষ্ট্রে অবস্থিত সোমপুর মহাবিহার এখন একটি ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান। ২১ একর (৮৫,০০০ বর্গমিটার) আয়তন-বিশিষ্ট চত্বরে অবস্থিত এই মহাবিহারে ১৭৭টি কক্ষ, বহু স্তুপ, মন্দির ও অন্যান্য ভবন রয়েছে। বিক্রমশিলা, ওদন্তপুরী ও জগদ্দল প্রভৃতি অন্যান্য বৃহদায়তন মহাবিহার পাল স্থাপত্যের উল্লেখযোগ্য নিদর্শন। এই সুবৃহৎ মহাবিহারগুলিকে তুর্কি আক্রমণকারী বখতিয়ার খিলজি দুর্গপ্রাসাদ মনে করে ধ্বংস করে দেন। পাল ও সেন রাজত্বকালে বিহার ও বাংলার শিল্পকলা নেপাল, ব্রহ্মদেশ, শ্রীলঙ্কা ও যবদ্বীপের শিল্পকলাকে প্রভাবিত করেছিল।[39]

পাল শাসকদের তালিকা

অধিকাংশ পাল উৎকীর্ণ লিপির প্রতিষ্ঠাকাল হিসেবে রাজবর্ষের উল্লেখ রয়েছে, কোনও সর্বজন-পরিচিত পঞ্জিকা যুগের উল্লেখ নেই। এই কারণে পাল রাজাদের রাজাবলির কালরেখা নির্ণয় করা কঠিন।[40] বিভিন্ন লিপি ও ঐতিহাসিক নথির ব্যাখ্যার ভিত্তিতে ইতিহাসবিদগণ নিম্নোক্ত পাল রাজাবলিটি নির্ণয় করেছেন:[41]

রমেশচন্দ্র মজুমদার (১৯৭১)[42] আব্দুল মোমিন চৌধুরী (১৯৬৭)[43] বিন্ধ্যেশ্বরীপ্রসাদ সিনহা (১৯৭৭)[44] দীনেশচন্দ্র সরকার (১৯৭৫-৭৬)[45] দিলীপকুমার গঙ্গোপাধ্যায় (১৯৯৪)[40]
প্রথম গোপাল ৭৫০–৭৭০ ৭৫৬–৭৮১ ৭৫৫–৭৮৩ ৭৫০–৭৭৫ ৭৫০-৭৭৪
ধর্মপাল ৭৭০–৮১০ ৭৮১–৮২১ ৭৮৩–৮২০ ৭৭৫–৮১২ ৭৭৪-৮০৬
দেবপাল ৮১০–আনুমানিক ৮৫০ ৮২১–৮৬১ ৮২০–৮৬০ ৮১২–৮৫০ ৮০৬-৮৪৫
মহেন্দ্রপাল অনুল্লিখিত (মহেন্দ্রপালের অস্তিত্ব পরবর্তীকালে আবিষ্কৃত একটি তাম্রলিপির মাধ্যমে প্রমাণিত হয়।) ৮৪৫-৮৬০
প্রথম শূরপাল ৮৫০–৮৫৩ ৮৬১–৮৬৬ ৮৬০–৮৬৫ ৮৫০–৮৫৮ ৮৬০-৮৭২
প্রথম বিগ্রহপাল ৮৫৮–৮৬০ ৮৭২-৮৭৩
নারায়ণপাল ৮৫৪–৯০৮ ৮৬৬–৯২০ ৮৬৫–৯২০ ৮৬০–৯১৭ ৮৭৩-৯২৭
রাজ্যপাল ৯০৮–৯৪০ ৯২০–৯৫২ ৯২০–৯৫২ ৯১৭–৯৫২ ৯২৭-৯৫৯
দ্বিতীয় গোপাল ৯৪০–৯৫৭ ৯৫২–৯৬৯ ৯৫২–৯৬৭ ৯৫২–৯৭২ ৯৫৯-৯৭৬
দ্বিতীয় বিগ্রহপাল ৯৬০–আনুমানিক ৯৮৬ ৯৬৯–৯৯৫ ৯৬৭–৯৮০ ৯৭২–৯৭৭ ৯৭৬-৯৭৭
প্রথম মহীপাল ৯৮৮–আনুমানিক ১০৩৬ ৯৯৫–১০৪৩ ৯৮০–১০৩৫ ৯৭৭–১০২৭ ৯৭৭–১০২৭
নয়পাল ১০৩৮–১০৫৩ ১০৪৩–১০৫৮ ১০৩৫–১০৫০ ১০২৭–১০৪৩ ১০২৭–১০৪৩
তৃতীয় বিগ্রহপাল ১০৫৪–১০৭২ ১০৫৮–১০৭৫ ১০৫০–১০৭৬ ১০৪৩–১০৭০ ১০৪৩–১০৭০
দ্বিতীয় মহীপাল ১০৭২–১০৭৫ ১০৭৫–১০৮০ ১০৭৬–১০৭৮/৯ ১০৭০-১০৭১ ১০৭০-১০৭১
দ্বিতীয় শূরপাল ১০৭৫–১০৭৭ ১০৮০–১০৮২ ১০৭১–১০৭২ ১০৭১–১০৭২
রামপাল ১০৭৭–১১৩০ ১০৮২–১১২৪ ১০৭৮/৯–১১৩২ ১০৭২–১১২৬ ১০৭২–১১২৬
কুমারপাল ১১৩০–১১৩৫ ১১২৪–১১২৮ ১১৩২–১১৩৬ ১১২৬–১১২৮ ১১২৬–১১২৮
তৃতীয় গোপাল ১১৪০–১১৪৪ ১১২৯–১১৪৩ ১১৩৬–১১৪৪ ১১২৮–১১৪৩ ১১২৮–১১৪৩
মদনপাল ১১৪৪–১১৬২ ১১৪৩–১১৬২ ১১৪৪–১১৬১/৬২ ১১৪৩–১১৬১ ১১৪৩–১১৬১
গোবিন্দপাল ১১৫৫–১১৫৯ অনুল্লিখিত ১১৬২-১১৭৬ বা ১১৫৮-১১৬২ ১১৬১–১১৬৫ ১১৬১–১১৬৫
পালপাল অনুল্লিখিত অনুল্লিখিত অনুল্লিখিত ১১৬৫–১১৯৯ ১১৬৫–১২০০

টীকা:[41]

  • প্রথম যুগের ইতিহাসবিদগণ মনে করতেন যে, প্রথম বিগ্রহপাল ও প্রথম শূরপাল একই ব্যক্তির দুই নাম। বর্তমানে জানা গিয়েছে যে, তাঁরা দুইজন জ্ঞাতিভ্রাতা ছিলেন। তাঁরা একই সময়ে (হয়ত ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলে) বা একজনের পর অপর জন শাসনকার্য চালান।
  • আব্দুল মোমিন চৌধুরী গোবিন্দপাল ও তাঁর উত্তরসূরি পালপালকে পাল সম্রাটবংশের সদস্য হিসেবে স্বীকার করেননি।
  • বিন্ধ্যেশ্বরীপ্রসাদ সিনহার মতে, গয়া উৎকীর্ণ লিপিটিকে “গোবিন্দপালের রাজত্বকালের ১৪শ বৎসর” বা “গোবিন্দপালের রাজত্বকালের ১৪ বছর পর” – এই দুই ভাবে পড়া যায়। তাই এক্ষেত্রে দুটি তারিখ প্রযোজ্য হওয়ার সম্ভাবনা আছে।


দক্ষিণ এশিয়া এবং ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস

প্রস্তর যুগ৭০,০০০–৩৩০০ BCE
মেহেরগড় সংস্কৃতি• ৭০০০–৩৩০০ BCE
সিন্ধু সভ্যতা৩৩০০–১৭০০ BCE
হরপ্পা সভ্যতা১৭০০–১৩০০ BCE
বৈদিক সভ্যতা১৫০০–৫০০ BCE
লৌহ যুগ১২০০–৩০০ BCE
মহাজনপদ• ৭০০–৩০০ BCE
মগধ সাম্রাজ্য• ৫৪৫ BCE - ৫৫০
মৌর্য সাম্রাজ্য• ৩২১–১৮৪ BCE
ভারতীয় উপমহাদেশের মধ্যাঞ্চলের রাজ্য সমূহ২৫০ BCE–১২৭৯ CE
চোল সাম্রাজ্য• ২৫০ BCE–১০৭০ CE
সাতবাহন সাম্রাজ্য• ২৩০BCE–২২০ CE
কুশান সাম্রাজ্য• ৬০–২৪০ CE
গুপ্ত সাম্রাজ্য• ২৮০–৫৫০ CE
পাল সাম্রাজ্য• ৭৫০–১১৭৪ CE
রাষ্ট্রকূট• ৭৫৩–৯৮২ CE
ইসলামিক সুলতানাত১২০৬–১৫৯৬
দিল্লীর সুলতানাত• ১২০৬–১৫২৬
দক্ষিণ ভারতের সুলতানাত• ১৪৯০–১৫৯৬
হৈসল সাম্রাজ্য১০৪০–১৩৪৬
কাকতীয় সাম্রাজ্য১০৮৩–১৩২৩
আহম রাজ্য১২২৮–১৮২৬
বিজয় নগর সাম্রাজ্য১৩৩৬–১৬৪৬
মুঘল সাম্রাজ্য১৫২৬–১৮৫৮
মারাঠা সাম্রাজ্য১৬৭৪–১৮১৮
শিখ সংঘরাষ্ট্র১৭১৬–১৭৯৯
শিখ সাম্রাজ্য১৮০১–১৮৪৯
ব্রিটিশ ভারত১৮৫৮–১৯৪৭
দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্রসমূহ১৯৪৭–বর্তমান
জাতীয় ইতিহাস
বাংলাদেশভুটানভারত
মালদ্বীপনেপালপাকিস্তানশ্রীলংকা
আঞ্চলিক ইতিহাস
আসামবেলুচিস্তানবঙ্গ
হিমাচল প্রদেশউড়িশ্যাপাকিস্তানের অঞ্চল সমূহ
পাঞ্জাবদক্ষিণ ভারততিব্বত
বিশেষায়িত ইতিহাস
টঙ্কনরাজবংশঅর্থনীতি
IndologyLanguageসাহিত্যMaritime
Militaryবিজ্ঞান ও প্রযুক্তিTimeline

সামরিক বাহিনী

পাল সাম্রাজ্যের সর্বোচ্চ সামরিক আধিকারিক ছিলেন ‘মহাসেনাপতি’। পাল সম্রাটেরা মালব, খাস, হুন, কুলিক, কর্ণাট, লতা, ওড্র ও মনহলি প্রভৃতি অঞ্চল থেকে ভাড়াটে সৈন্য আমদানি করতেন। সমসাময়িক রচনা থেকে জানা যায়, রাষ্ট্রকূটদের পদাতিক বাহিনী ছিল শ্রেষ্ঠ, গুর্জর-প্রতিহারদের অশ্বারোহী বাহিনী ছিল শ্রেষ্ঠ এবং পাল সাম্রাজ্যের হস্তীবাহিনী ছিল বৃহত্তম। আরব বণিক সুলেইমান বলেছেন যে, পাল সেনাবাহিনী বলহার (সম্ভবত রাষ্ট্রকূট) ও জুর্জের (সম্ভবত গুর্জর-প্রতিহার) রাজার সেনাবাহিনীর চেয়ে বড়ো ছিল। তিনি আরও বলেছেন যে, পাল সেনাবাহিনীতে ১০,০০০-১৫,০০০ লোককে জ্বালানি ভরা ও কাপড় কাচার কাজে নিয়োগ করা হত। তিনি আরও দাবি করেছেন যে, যুদ্ধের সময় পাল রাজা ৫০,০০০ যুদ্ধহস্তীর নেতৃত্ব দিতেন। সুলেইমানের বিবরণটি অতিরঞ্জিত বর্ণনার ভিত্তিতে রচিত হয়েছিল বলে মনে করা হয়। ইবন খালদুন উল্লেখ করেছেন হাতির সংখ্যা ছিল ৫,০০০।[46]

বাংলায় স্থানীয় ঘোড়ার ভাল প্রজাতি পাওয়া যায় না বলে, অশ্বারোহী বাহিনীর ঘোড়া পালেরা কম্বোজ প্রভৃতি বিদেশি রাষ্ট্র থেকে আমদানি করত।[47]

আরও দেখুন

  • ধ্রুপদি ভারত

উপাদান

পাল সাম্রাজ্য সম্পর্কে তথ্যের প্রধান সূত্রগুলি হল:[48]

পাল বিবরণী
  • বিভিন্ন উৎকীর্ণ লিপি, মুদ্রা, ভাস্কর্য ও স্থাপত্য
  • রামচরিত, অভিনন্দ রচিত একটি সংস্কৃত গ্রন্থ (৯ম শতাব্দী)
  • রামচরিতম্‌, সন্ধ্যাকর নন্দী রচিত একটি সংস্কৃত মহাকাব্য (১২শ শতাব্দী)
  • সুভাষিত রত্নকোষ, বিদ্যাকর কর্তৃক সম্পাদিত একটি সংস্কৃত রচনা-সংকলন (পাল যুগের শেষভাগে রচিত)
অন্যান্য বিবরণ
  • সিলসিলতুত-তৌয়ারিখ আরব বণিক সুলেইমান কর্তৃক রচিত (৯৫১ খ্রিষ্টাব্দ)। সুলেইমান পাল রাজ্যকে ‘রুহ্‌মি’ বা ‘রাহ্‌মা’ বলে উল্লেখ করেছেন।
  • দ্‌পাল দুস খ্যি ‘খোর লো’ই চোস ব্‌স্‌কোর গ্যি ব্যুং খুংস ন্যের ম্‌খ্‌ (ভারতে বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস) তারানাথ কর্তৃক রচিত (১৬০৮)। এই গ্রন্থে পাল যুগ সম্পর্কে প্রচলিত কয়েকটি প্রথাগত কিংবদন্তি ও জনশ্রুতির উল্লেখ করা হয়েছে।
  • আইন-ই-আকবরি আবুল ফজল কর্তৃক রচিত (১৬শ শতাব্দী)

কথাসাহিত্যে পাল রাজবংশ

তথ্যসূত্র

  1. Michael C. Howard (২০১২)। Transnationalism in Ancient and Medieval Societies: The Role of Cross-Border Trade and Travel। McFarland। পৃষ্ঠা 72। আইএসবিএন 978-0-7864-9033-2।
  2. Huntington ও 1984 56
  3. R. C. Majumdar (১৯৭৭)। Ancient India। Motilal Banarsidass Publ.। পৃষ্ঠা 268–। আইএসবিএন 978-81-208-0436-4।
  4. Raj Kumar (২০০৩)। Essays on Ancient India। Discovery Publishing House। পৃষ্ঠা 199। আইএসবিএন 978-81-7141-682-0।
  5. Sailendra Nath Sen (১৯৯৯)। Ancient Indian History and Civilization। New Age International। পৃষ্ঠা 280–। আইএসবিএন 978-81-224-1198-0।
  6. Sailendra Nath Sen (১৯৯৯)। Ancient Indian History and Civilization। New Age International। পৃষ্ঠা 277–287। আইএসবিএন 978-81-224-1198-0।
  7. Sengupta 2011, পৃ. 39-49।
  8. Bagchi 1993, পৃ. 37।
  9. Vasily Vasilyev (ডিসেম্বর ১৮৭৫)। E. Lyall কর্তৃক অনূদিত। "Taranatea's Account of the Magadha Kings" (PDF)The Indian AntiquaryIV: 365–66।
  10. Ramaranjan Mukherji; Sachindra Kumar Maity (১৯৬৭)। Corpus of Bengal Inscriptions Bearing on History and Civilization of Bengal। Calcutta: Firma K.L. Mukhopadhyay। পৃষ্ঠা 11।
  11. J. C. Ghosh (১৯৩৯)। "Caste and Chronology of the Pala Kings of Bengal"। The Indian Historical QuarterlyIX (2): 487–90।
  12. The Caste of the Palas, The Indian Culture, Vol IV, 1939, pp 113–14, B Chatterji
  13. M. N. Srinivas (১৯৯৫)। Social Change in Modern India। Orient Blackswan। পৃষ্ঠা 9। আইএসবিএন 978-81-250-0422-6।
  14. Metcalf, Thomas R. (১৯৭১)। Modern India: An Interpretive Anthology। Macmillan। পৃষ্ঠা 115।
  15. André Wink (১৯৯০)। Al-Hind, the Making of the Indo-Islamic World। BRILL। পৃষ্ঠা 265। আইএসবিএন 90-04-09249-8।
  16. Ishwari Prasad (১৯৪০)। History of Mediaeval India। পৃষ্ঠা 20 fn।
  17. Biplab Dasgupta (২০০৫)। European Trade and Colonial Conquest। Anthem Press। পৃষ্ঠা 341–। আইএসবিএন 978-1-84331-029-7।
  18. John Andrew Allan; Sir T. Wolseley Haig (১৯৩৪)। The Cambridge Shorter History of India। Macmillan Company। পৃষ্ঠা 143।
  19. Bindeshwari Prasad Sinha (১৯৭৭)। Dynastic History of Magadha। Abhinav Publications। পৃষ্ঠা 179। আইএসবিএন 978-81-7017-059-4।
  20. Bhagalpur Charter of Narayanapala, year 17, verse 6, The Indian Antiquary, XV p 304.
  21. Bindeshwari Prasad Sinha (১৯৭৭)। Dynastic History of Magadha। Abhinav Publications। পৃষ্ঠা 185। আইএসবিএন 978-81-7017-059-4।
  22. Sengupta 2011, পৃ. 45।
  23. John Keay (২০০০)। India: A History। Grove Press। পৃষ্ঠা 220। আইএসবিএন 978-0-8021-3797-5।
  24. John Andrew Allan; Sir T. Wolseley Haig (১৯৩৪)। The Cambridge Shorter History of India। Macmillan Company। পৃষ্ঠা 10।
  25. Bagchi 1993, পৃ. 4।
  26. Bindeshwari Prasad Sinha (১৯৭৭)। Dynastic History of Magadha। Abhinav Publications। পৃষ্ঠা 177–। আইএসবিএন 978-81-7017-059-4।
  27. Paul 1939, পৃ. 38।
  28. Bagchi 1993, পৃ. 39–40।
  29. Paul 1939, পৃ. 122–124।
  30. Paul 1939, পৃ. 111–122।
  31. Huntington ও 1984 39
  32. Taranatha (১৮৬৯)। Târanâtha's Geschichte des Buddhismus in Indien [History of Buddhism in India] (জার্মান ভাষায়)। Anton Schiefner কর্তৃক অনূদিত। St. Petersburg: Imperial Academy of Sciences। পৃষ্ঠা 206। Zur Zeit des Königs Gopâla oder Devapâla wurde auch das Otautapuri-Vihâra errichtet.
  33. P. N. Chopra; B. N. Puri; M. N. Das; A. C. Pradhan, সম্পাদকগণ (২০০৩)। A Comprehensive History of Ancient India (3 Vol. Set)। Sterling। পৃষ্ঠা 200–202। আইএসবিএন 978-81-207-2503-4।
  34. Bagchi 1993, পৃ. 19।
  35. Bagchi 1993, পৃ. 100।
  36. Krishna Chaitanya (১৯৮৭)। Arts of India। Abhinav Publications। পৃষ্ঠা 38। আইএসবিএন 978-81-7017-209-3।
  37. Chowdhury, AM (২০১২)। "Pala Dynasty"Islam, Sirajul; Jamal, Ahmed A.। Banglapedia: National Encyclopedia of Bangladesh (Second সংস্করণ)। Asiatic Society of Bangladesh
  38. Rustam Jehangir Mehta (১৯৮১)। Masterpieces of Indian bronzes and metal sculpture। Taraporevala। পৃষ্ঠা 21।
  39. Stella Kramrisch (১৯৯৪)। Exploring India's Sacred Art Selected Writings of Stella Kramrisch। Motilal Banarsidass Publishe। পৃষ্ঠা 208। আইএসবিএন 978-81-208-1208-6।
  40. Dilip Kumar Ganguly (১৯৯৪)। Ancient India, History and Archaeology (ইংরেজি ভাষায়)। Abhinav। পৃষ্ঠা 33–41। আইএসবিএন 978-81-7017-304-5।
  41. Susan L. Huntington (১৯৮৪)। The "Påala-Sena" Schools of Sculpture (ইংরেজি ভাষায়)। Brill Archive। পৃষ্ঠা 32–39। আইএসবিএন 90-04-06856-2।
  42. R. C. Majumdar (১৯৭১)। History of Ancient Bengal [প্রাচীন বাংলার ইতিহাস] (ইংরেজি ভাষায়)। G. Bharadwaj। পৃষ্ঠা 161–162।
  43. Abdul Momin Chowdhury (১৯৬৭)। Dynastic history of Bengal, c. 750-1200 CE (ইংরেজি ভাষায়)। Asiatic Society of Pakistan। পৃষ্ঠা 272–273।
  44. Bindeshwari Prasad Sinha (১৯৭৭)। Dynastic History of Magadha, Cir. 450–1200 A.D. (ইংরেজি ভাষায়)। Abhinav Publications। পৃষ্ঠা 253–। আইএসবিএন 978-81-7017-059-4।
  45. Dineshchandra Sircar (১৯৭৫–৭৬)। "Indological Notes - R.C. Majumdar's Chronology of the Pala Kings"। Journal of Indian History (ইংরেজি ভাষায়)। IX: 209–10।
  46. Paul 1939, পৃ. 139–143।
  47. Paul 1939, পৃ. 143–144।
  48. Bagchi 1993, পৃ. 2-3।

গ্রন্থপঞ্জি

This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.