খিলজি রাজবংশ

খিলজি রাজবংশ (ফার্সি: سلسله خلجی; Hindi: सलतनत ख़िलजी) ছিল তুর্কি বংশোদ্ভুত মুসলিম রাজবংশ। [2] ১২৯০ থেকে ১৩২০ সাল পর্যন্ত সময়ের মধ্যে এই রাজবংশ দক্ষিণ এশিয়ার বিরাট অংশ শাসন করে।[3] জালালউদ্দিন ফিরোজ খিলজি এই রাজবংশের পত্তন করেন। এটি দিল্লি সালতানাত শাসনকারী দ্বিতীয় রাজবংশ। আলাউদ্দিন খিলজির সময় খিলজিরা সফলভাবে মোঙ্গল আক্রমণ ঠেকাতে সক্ষম হয়।[4][5]

খিলজি সালতানাত
سلسله خلجی

১২৯০–১৩২০
খিলজি সালতানাতের অবস্থান
খিলজি রাজবংশ
রাজধানী দিল্লি
ভাষাসমূহ ফারসি (সরকারি)[1]
ধর্ম সুন্নি ইসলাম
সরকার সালতানাত
সুলতান
 -  ১২৯০–১২৯৬ জালালউদ্দিন ফিরোজ খিলজি
 - ১২৯৬–১৩১৬ আলাউদ্দিন খিলজি
 - ১৩১৬ শিহাবউদ্দিন উমর খিলজি
 - ১৩১৬–১৩২০ কুতুবউদ্দিন মোবারক শাহ
ইতিহাস
 - সংস্থাপিত ১২৯০
 - ভাঙ্গিয়া দেত্তয়া হয়েছে ১৩২০
আয়তন  বর্গ কি.মি. ( বর্গ মাইল)
বর্তমানে অংশ  ভারত
 পাকিস্তান
 বাংলাদেশ
   নেপাল
 আফগানিস্তান
 তাজিকিস্তান
 চীন
সতর্কীকরণ: "মহাদেশের" জন্য উল্লিখিত মান সম্মত নয়

খলজি বা খিলজী রাজবংশ হল মধ্য যুগের মুসলিম রাজবংশ যারা ১২৯০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৩২০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ভারতের বিশাল অংশ শাসন করত। জালাল উদ্দিন ফিরোজ খিলজী এর প্রতিষ্ঠাতা । খিলজী শাসনামল অবিশ্বাস ,হিংস্রতা এবং দক্ষিণ ভারতে তাদের শক্ত অভিযানের জন্য খ্যাত হলেও ,খিলজী শাসনামল মূলত ভারতে হওয়া বারবার বর্বর মোঙ্গল অভিযান রুখে দেওয়ার জন্য সুপরিচিত।

বংশসুত্র

খিলজীরা মূলত তুরক আফগান জাতি গোষ্ঠীর যারা মূলত তুর্কি এবং যারা দিল্লিতে আসার আগে আফগানিস্তান বসবাস করত। জালালুদ্দিন খিলজীর পূর্বসূরীরা হেলমান্দ এবং লামঘান এ ২০০ বছরের ও অধিক সময় ধরে বসবাস করত।

তবে খিলজীদের তুর্কি জাতিগোষ্ঠীর থেকে আলাদা ভাবা হত।বরং তারা স্থানীয় আফগানদের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে তাদের সাথেই মিশে গিয়েছিল এবং তাদের সংস্কৃতিকে নিজের করে নিয়েছিল।দিল্লি দরবারে তারা আফগান হিসেবেই পরিচিত ছিল

ইতিহাস

খিলজীরা ছিল দিল্লির মামলুক রাজবংশের সামন্ত এবং দিল্লির সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবন এর অধীন । বলবনের উত্তরাধিকারীদের ১২৮৯-১২৯০ সালে হত্যা করা হয় এবং এর পরপরই মামলুকদের মধ্যে ক্ষমতা নিয়ে কোন্দল শুরু হয়ে যায়। এই কোন্দলের মধ্যে জালালউদ্দিন ফিরোজ খিলজীর নেতৃত্বে বিদ্রোহ সংগঠিত হয় এবং মামলুকদের বংশের শেষ উত্তরাধিকারী ১৭ বছর বয়সী মুইজ উদ দিন কাইকোবাদ কে হত্যা করেন।

জালাল উদ্দিন খিলজী

জালালউদ্দিন খিলজী যিনি সিংহাসন আরোহণের সময় ৭০ বছর বয়সি ছিলেন , একজন প্রজাদরদি এবং বিনয়ী সুলতান ছিলেন

তুর্কি অভিজাতদের বিরুদ্ধাচরণ সত্বেও তিনি ১২৯০ সালে দিল্লির মসনদে বসেন। জালাল উদ্দিনের এই আরোহণ সবাই মেনে নেই নি। বরং তার ৬ বছরের শাসনে বলবন এর ভাইপো মমলুকদের প্রতি অনুগত সামরিক অধিনায়কদের নিয়ে বিদ্রোহ করে ।জালাল উদ্দিন এই বিদ্রোহ দমান এবং অনেক অধিনায়ক দের মৃত্যুদণ্ড দেন। এরপর তিনি রান্থামবোর এর দিকে অভিযান করেন ,যদিওবা তিনি সফল হন নি। তবে তিনি তার ভাইপো জুনা খান কে সাথে নিয়ে মধ্য ভারতের সিন্ধ নদী তীরে মঙ্গোল বাহিনীকে সফল বাহিনী কে প্রতিহত করেন।

আলাউদ্দিন খিলজী

আলাউদ্দিন খিলজী ছিলেন জালাল উদ্দিন খিলজীর ভাইপো এবং জামাতা । যিনি হিন্দু রাজ্য মহারাষ্ট্রের রাজধানী দেবগীরি তে হামলা চালান এবং বিপুল পরিমাণ সম্পদ ভান্ডার লুট করেন। এরপর ১২৯৬ সালে তিনি দিল্লি আসেন এবং নিজ চাচা ও শ্বশুর জালাল উদ্দিন খিলজী কে হত্যা করেন এবং নিজে সুলতান হিসেবে দিল্লীর মসনদে বসেন।

আলাউদ্দিন খিলজী বিশ্বস্ত সেনানায়ক মালিক কাফুর এবং খসরু খান সাথে নিয়ে দিল্লি সালতানাতের সীমানা দক্ষিণ ভারতের দিকে প্রসার করেন। তার সেনা অধিনায়কেরা হিন্দু রাষ্ট্র গুলোতে অভিযান চালিয়ে যে যুদ্ধ লব্ধ সম্পত্তি পেত তার পাঁচ ভাগের এক ভাগ সুলতানের রাজকোষে পাঠিয়ে দিত যা খুম নামে পরিচিত ছিল। যা সুলতানের শক্তি বৃদ্ধিতে সাহায্য করেছিল।

আলাউদ্দিন খিলজী ২০ বছরের মত শাসন করেন।তিনি হিন্দু রাষ্ট্র সমূহ যেমন রান্থাম্বর (১৩০১) , চিত্তগ‌‌‍‌ড়(১৩০৩) ,মান্ডু (১৩০৫) এবং দেবগীরিতে অভিযান চালিয়ে দখল করেন। এছাড়াও তিনি দুবার ভারতের দিকে ধেয়ে আসা মঙ্গোল বাহিনীকে সফল ভাবে প্রতিহত করে।

আলাউদ্দিন খিলজীর শাসনামল কে ইতিহাসবিদরা হিংস্রতার শাসন হিসেবে দেখেন । আলাউদ্দিন খিলজী যাকেই নিজের ক্ষমতার জন্য বিপদজনক মনে করতেন তাকেই হত্যা করতেন। এমন কি ১২৯৯-১৩০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে নিজ পরিবারের কিছু সদস্যের ও তিনি হত্যা করেন এই ভেবে যে তারা বিদ্রোহ করবে এবং অনেককে হত্যা করা হতো প্রথমে চোখ উপড়ে ফেলে এরপর শিরচ্ছেদ করে।

১৩০৮ সালে আলাউদ্দিনের সেনানায়ক মালিক কাফুর ওয়ারাঙ্গল এ হামলা চালায় এবং দক্ষিণের হোয়সালা সাম্রাজ্য কে উপড়ে ফেলে তামিল নাডুর দিকে অভিযান চালান।এরপর সেখানে রাজকোষ অধিগ্রহণ করেন এবং লুট করা সম্পত্তি নিয়ে দিল্লিতে ফিরে আসেন এবং আলাউদ্দিন খিলজীর কাছে তা উপস্থাপন করেন যার মধ্যে বিশ্বখ্যাত এবং দুনিয়ার সবচেয়ে বড় হিরা কোহিনূর ও ছিল।

শেষ খিলজী সুলতান

১৩১৫ সালের ডিসেম্বরে আলাউদ্দিন খিলজীর মৃত্যু হয়।এরপরপরই সাম্রাজ্য জুড়ে বিশৃঙ্খলা ,একে অপরের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান ,গুপ্তহত্যা ছড়িয়ে পড়ে।এমনকি মালিক কাফুর নিজেকে সুলতান দাবি করে বসে। কিন্তু আমীরদের সম্মতি থাকায় তিনি মসনদ ধরে রাখতে পারেন নি এবং কয়েক মাসের মধ্যে তাকেও হত্যা করা হয়।

পরবর্তী তিন বছরে একের পর এক অভ্যুত্থান মধ্য দিয়ে তিন জন সুলতান দিল্লীর মসনদে বসেন।মালিক কাফুর এর মৃত্যুর পর আমিরগণ ৬ বছর বয়সী শিহাব উদ্দিন উমরকে মসনদে বসান কিন্তু অল্প দিনেই তার ভাই কুতুব উদ্দিন মোবারক শাহ তাকে হত্যা করে এবং নিজেকে সুলতান ঘোষণা করেন । আমির দের মন জয়ের জন্য বিভিন্নজন কে বিভিন্ন পদে অধিষ্ঠিত করেন। চার বছর শাসনের পর ১৩২০ সালে তিনি তার সেনানায়ক খসরু খান দ্বারা হত্যা হন।

এরপর সেনাপ্রধান গাজী মালিক বিশাল বাহিনী নিয়ে দিল্লি তে অভ্যুত্থান ঘটান ,এরপর খসরু খান কে হত্যা করেন এবং দিল্লীর মসনদ নিজ দখলে নেন। এরপর তিনি নিজের নাম বদলে গিয়াস উদ্দিন তুঘলক নাম ধারণ করেন এবং তুঘলক রাজবংশের গোড়াপত্তন করেন।

অর্থনৈতিক প্রণালী এবং প্রশাসন

আলাউদ্দিন খিলজী নিজের রাজকোষ কে শক্ত করার জন্য কর ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটান যাতে যুদ্ধ এবং বিশাল সেনাবাহিনীর খরচ মিটাতে পারেন। তিনি কৃষিজ করকে ২০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫০ শতাংশ তে নিয়ে যান এবং স্থানীয় প্রশাসনিক কর্মকর্তা যারা কর সংগ্রহ করে ভাতা পেত তা ও বন্ধ করে দেন ।

এছাড়া তিনি প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও আমীরদের নিজেদের পরিবারের মধ্যে বিবাহ বন্ধনের মাধ্যমে সম্পর্ক তৈরিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। তার রাজ্যে জ্ঞানী এবং কবিরা যে ভাতা পেত ,তিনি তা ও বন্ধ করে দেন।

আলাউদ্দিন খিলজী সালতানাতের অমুসলিমদের উপর কার ধরনের কর চাপিয়ে দেন,যেগুলা হল : জিজিয়া , খারাজ, কারি এবং চারি। কর দিতে সমস্যা করলে কর কর্মকর্তা রা মারধর করত , হোক সে মুসলিম বা অমুসলিম। এরপর তিনি দরবারের উমরা এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তা দের সকল ধরনের জমি বাজেয়াপ্ত করেন এবং রাজস্ব নিয়োগে মুসলিম জাগীরদার দের যে ভূমিকা ছিল তাও বাজেয়াপ্ত করেন।ফলে এমন অবস্থা সৃষ্টি হই যে,সবাই নিজের জীবিকা উপারজনের জন্য এত ব্যস্ত হয়ে পড়ে যে, সুলতানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের কথা কেউ চিন্তা ও করার সুযোগ পেত না।

আলাউদ্দিন খিলজী বাজারের বিভিন্ন শস্যের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন।এবং কারা কারা এর কেনা বেচা করতে পারবে তা ও নির্ধারণ করে দেই।

শাহনামা ই মান্ডী নামে বিশেষ বাজার গড়ে উঠে।বিশিষ্ট ব্যবসায়ী গণ এসব বাজারে একচেটিয়া ব্যবসা এর অধিকার পেতে যায়।এসব ব্যবসায়ী বাদে অন্য ব্যবসায়ীগণ এইসব শস্যের কেনা বেচা করতে পারত না। শহর জুড়ে এসব বাজারে আলাউদ্দিনের নিজস্ব গুপ্তচর ছড়িয়ে দেয়া হত।যদি কেউ নির্ধারিত দামের চেয়ে ভিন্ন দামে কেনা বেচা করত তবে তাকে শাস্তি দেয় হত। এমন কি অনেকের মাংস ও কেটে নেয়া হই।

শস্যের উপর অতিরিক্ত করে কারণে একসময় কৃষকেরা কৃষিকাজ তথা শস্য উৎপাদন ছেড়ে দেয়া শুরু করে।এতে এক সময় খাদ্যের স্বল্পতা দেখা যাওয়া শুরু করে। এরপর সালতানাত জুড়ে ভয়ংকর দুর্ভিক্ষ ছড়িয়ে পড়ে।

সংগ্রহ

'আলাউদ্দিন খিলজির সময়ের কপার কয়েন'

দিল্লির খিলজি শাসকদের তালিকা (১২৯০–১৩২০)

টেমপ্লেট:Refimprove-section

Titular Name Personal Name Reign
শায়েস্তা খান

(Jalal-ud-din)
جلال الدین

মালিক ফিরোজ
ملک فیروز خلجی
১২৯০–১২৯৬
আলাউদ্দিন[6]
علاءالدین
জুনা খান খিলজি
علی گرشاسپ خلجی
১২৯৬–১৩১৬
শিহাবউদ্দিন
شھاب الدین
উমর খান খিলজি
عمر خان خلجی
১৩১৬
'কুতুবউদ্দিন
قطب الدین
মোবারক খান খিলজি
مبارک خان خلجی
১৩১৬–১৩২০
খসরু খান ১৩২০ সালে খিলজি রাজবংশের সমাপ্তি ঘটান।


মালওয়ার খিলজি সুলতান (১৪৩৬–১৫৩১)

  • মাহমুদ খিলজি (১৪৩৬–১৪৬৯)
  • গিয়াসউদ্দিন খিলজি (১৪৬৯–১৫০০)

আরও দেখুন

তথ্যসূত্র

  1. "Arabic and Persian Epigraphical Studies - Archaeological Survey of India"। Asi.nic.in। ২০১১-০৯-২৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১০-১১-১৪
  2. "Khalji Dynasty"Encyclopædia Britannica। সংগ্রহের তারিখ ২০১০-০৮-২৩this dynasty, like the previous Slave dynasty, was of Turkic origin, though the Khiljī tribe had long been settled in what is now Afghanistan ... With the title of ʿAlāʾ al-Dīn Khaljī,He was the first Turkish Sultan of Delhi who separated religion from politics. He proclaimed- "KINGSHIP KNOWS NO KINSHIP." He was the first sultan to have permanent army-paid soldiers in cash,imported horses,detailed description of each soldier(CHEHRA) and each horse (DAGH) wqas kept. BOTH AMIR KHUSRAU and MIR HASAN DEHLVI enjoyed his patronage. Jūnā Khan reigned for 20 years.
  3. Dynastic Chart The Imperial Gazetteer of India, v. 2, p. 368.
  4. Mikaberidze, Alexander (২০১১)। Conflict and Conquest in the Islamic World: A Historical Encyclopedia: A Historical Encyclopedia। ABC-CLIO। পৃষ্ঠা 62। আইএসবিএন 1-5988-4337-0। সংগ্রহের তারিখ ২০১৩-০৬-১৩
  5. Barua, Pradeep (২০০৫)। The state at war in South Asia। U of Nebraska Press। পৃষ্ঠা 437। আইএসবিএন 0-8032-1344-1। সংগ্রহের তারিখ ২০১০-০৮-২৩

আরও পড়ুন

  • The Oxford History of India, Clarendon Press, 1958.

বহিঃসংযোগ

This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.