রাষ্ট্রকূট রাজবংশ

রাষ্ট্রকূট রাজবংশ হল খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ থেকে দশম শতাব্দীতে ভারতে রাজত্বকারী একটি রাজবংশ। রাষ্ট্রকূটদের সবচেয়ে পুরনো যে লেখটি এখনও পর্যন্ত পাওয়া গিয়েছে, সেটি হল সপ্তম শতাব্দীর। এই তাম্রলিপি থেকে জানা যায়, আধুনিক মধ্যপ্রদেশ রাজ্যের মালওয়া অঞ্চলের মানপুর তাঁরা শাসন করতেন। অন্যান্য কয়েকটি লেখ থেকে সমসাময়িক আরও কয়েকটি রাষ্ট্রকূট শাসকগোষ্ঠীর উল্লেখ পাওয়া যায়। এঁরা হলেন অচলপুর (অধুনা মহারাষ্ট্র রাজ্যের এলিচপুর) ও কনৌজের রাজা। রাষ্ট্রকূটদের উৎপত্তি, আদি নিবাস ও ভাষা নিয়ে একাধিক বিতর্কিত মত প্রচলিত আছে।

মান্যখেতের রাষ্ট্রকূট
ರಾಷ್ಟ್ರಕೂಟ
সাম্রাজ্য

৭৫৩–৯৮২
মান্যখেতের রাষ্ট্রকূটের অবস্থান
  রাষ্ট্রকূট সাম্রাজ্যের বিস্তার, ৮৮-৯১৫ খ্রিস্টাব্দ
রাজধানী মান্যখেত
ভাষাসমূহ কন্নড়
সংস্কৃত
ধর্ম হিন্দু
জৈন
বৌদ্ধ
সরকার রাজবংশ
মহারাজা
 -  ৭৩৫–৭৫৬ দন্তিদূর্গ
 - ৯৭৩–৯৮২ চতুর্থ ইন্দ্র
ইতিহাস
 - প্রাচীনতম রাষ্ট্রকূট নিদর্শন ৭৫৩
 - সংস্থাপিত ৭৫৩
 - ভাঙ্গিয়া দেত্তয়া হয়েছে ৯৮২
নবম শতাব্দীর ধ্রুপদি কন্নড় গ্রন্থ কবিরাজমার্গ-এর একটি পংক্তি।
রাষ্ট্রকূট সম্রাটগণ (৭৫৩-৯৮২)
দন্তিদূর্গ (৭৩৫ - ৭৫৬)
প্রথম কৃষ্ণ (৭৫৬ - ৭৭৪)
দ্বিতীয় গোবিন্দ (৭৭৪ - ৭৮০)
ধ্রুব ধারাবর্ষ (৭৮০ - ৭৯৩)
তৃতীয় গোবিন্দ (৭৯৩ - ৮১৪)
প্রথম অমোঘবর্ষ (৮১৪ - ৮৭৮)
দ্বিতীয় কৃষ্ণ (৮৭৮ - ৯১৪)
তৃতীয় ইন্দ্র (৯১৪ -৯২৯)
দ্বিতীয় অমোঘবর্ষ (৯২৯ - ৯৩০)
চতুর্থ গোবিন্দ (৯৩০ – ৯৩৬)
তৃতীয় অমোঘবর্ষ (৯৩৬ – ৯৩৯)
তৃতীয় কৃষ্ণ (৯৩৯ – ৯৬৭)
কোট্টিগ অমোঘবর্ষ (৯৬৭ – ৯৭২)
দ্বিতীয় কর্ক (৯৭২ – ৯৭৩)
চতুর্থ ইন্দ্র (৯৭৩ – ৯৮২)
দ্বিতীয় তৈলপ
(পশ্চিম চালুক্য)
(৯৭৩-৯৯৭)

এলিচপুরের শাসকরা ছিলেন বাদামি চালুক্যদের সামন্ত। দন্তিদূর্গের রাজত্বকালে চালুক্যরাজ দ্বিতীয় কীর্তিবর্মণকে পরাজিত করে অধুনা কর্ণাটক রাজ্যের গুলবার্গ অঞ্চলকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে রাষ্ট্রকূট সাম্রাজ্য। ৭৫৩ খ্রিস্টাব্দে দক্ষিণ ভারতে রাষ্ট্রকূটরা প্রধান শক্তিতে পরিণত হয়। সেই সময় থেকেই এঁদের মান্যখেতের রাষ্ট্রকূট বলা হত। এই সময়ই পূর্ব ভারতে বিহার-পশ্চিমবঙ্গের পাল রাজবংশ এবং উত্তর-পশ্চিম ভারতে মালওয়ার প্রতিহার রাজবংশ প্রভাব বিস্তার করেছিল। আরবি গ্রন্থ সিলসিলাতুত্তাভারিখ-এর (৮৫১) মতে, রাষ্ট্রকূট সাম্রাজ্য ছিল বিশ্বের প্রধান চারটি সাম্রাজ্যের একটি।[1]

অষ্টম থেকে দশম শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে গাঙ্গেয় উপত্যকায় কনৌজের দখল নিয়ে উক্ত তিনটি প্রধান সাম্রাজ্যের সংঘাতবাধে। মান্যখেতের রাষ্ট্রকূটদের সাম্রাজ্য উত্তরে গঙ্গা-যমুনা দোয়াব অঞ্চল থেকে দক্ষিণে কুমারিকা অন্তরীপ পর্যন্ত প্রসারিত হয়েছিল। রাজনৈতিক ক্ষমতার বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রকূট সাম্রাজ্যে স্থাপত্য ও সাহিত্যেরও বিশেষ উন্নতি ঘটেছিল। প্রথম দিকের রাষ্ট্রকূট রাজারা ছিলেন হিন্দু। পরবর্তীকালে তাঁরা জৈনধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হন।

রাষ্ট্রকূট শাসনকালে জৈন গণিতবিদ ও পণ্ডিতেরা কন্নড় ও সংস্কৃত ভাষায় বহু উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। এই সাম্রাজ্যের সর্বশ্রেষ্ঠ রাজা প্রথম অমোঘবর্ষ কবিরাজমার্গ নামে একটি বিখ্যাত কন্নড় গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। দ্রাবিড় স্থাপত্য রাষ্ট্রকূট রাজত্বে বিশেষ উন্নতি লাভ করেছিল। এই স্থাপত্যের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য নিদর্শন হল ইলোরা গুহার কৈলাসনাথ মন্দির (অধুনা মহারাষ্ট্র রাজ্যে), কাশীবিশ্বনাথ মন্দির ও জৈন নারায়ণ মন্দির (অধুনা কর্ণাটক রাজ্যে)। এই সবকটিই এখন ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান

ইতিহাস

ভাস্কর্যে শিব, ইলোরা গুহা।
ইলোরার তিনতলা একশিলা স্থাপত্যবিশিষ্ট জৈন গুহা।
মান্যখেতে রাষ্ট্রকূট সাম্রাজ্যের মূল এলাকা

ভারতের ইতিহাসে রাষ্ট্রকূট রাজবংশের উৎপত্তি একটি বিতর্কিত বিষয়। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে সম্রাট অশোকের রাজত্বকালে রাষ্ট্রকূটদের আদিপুরুষদের অস্তিত্বের সন্ধান পাওয়া যায়।[2] খ্রিস্টীয় সপ্তম থেকে দশম শতাব্দীর মধ্যে উত্তর, মধ্য ও দক্ষিণ ভারতে রাষ্ট্রকূটদের বিভিন্ন গোষ্ঠী ছোটো ছোটো রাজ্য শাসন করত। এই রাষ্ট্রকূট গোষ্ঠীগুলি সঙ্গে সবচেয়ে বিখ্যাত রাজবংশ মান্যখেতের (অধুনা কর্ণাটক রাজ্যের গুলবার্গ জেলার মালখেদ অঞ্চল) রাষ্ট্রকূটদের সম্পর্ক নিয়েও বিতর্ক আছে।[3][4][5]

রাষ্ট্রকূট ইতিহাসের প্রধান উপাদান হল মধ্যযুগীয় শিলালিপু, প্রাচীন পালি সাহিত্য,[6] সমসাময়িক সংস্কৃত ও কন্নড় সাহিত্য এবং আরব পর্যটকদের ভ্রমণবৃত্তান্ত।[7] শিলালিপি, রাজকীয় প্রতীক, "রাষ্ট্রিক" প্রভৃতি নাম, "রাট্টা", "রাষ্ট্রকূট", "লাট্টালুরা পুরাবরাধীশ্বর" প্রভৃতি উপাধি, রাজকুমার ও রাজকুমারীদের নাম, ধ্বংসাবশেষ ও মুদ্রা থেকে পাওয়া সূত্র ধরে এই রাজবংশের উৎস, আদি নিবাস ও রাজত্ব এলাকা সম্পর্কে নানা তত্ত্বের অবতারণা করা হয়েছে।[5][8] প্রাচীন রাষ্ট্রকূটরা কোন জাতি বা ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্গত তা নিয়ে গবেষকদের মধ্যে মতান্তর আছে। সম্ভবত তারা উত্তর-পশ্চিম ভারতীয় কোনো জাতিগোষ্ঠী[9] বা কন্নড়[10][11] বা রেড্ডি[12] বা মারাঠি[13][14] বা পাঞ্জাব অঞ্চলের[15] কোনো গোষ্ঠী ছিল।

তবে গবেষকরা এই বিষয়ে একমত যে, খ্রিস্টীয় অষ্টম থেকে দশম শতাব্দীর মধ্যে রাষ্ট্রকূটরা কন্নড় ভাষাকে সংস্কৃতের সমতুল্য মর্যাদা দিয়েছিলেন। রাষ্ট্রকূট শিলালিপিগুলি অধিকাংশই সংস্কৃত ও কন্নড় ভাষায় (ঐতিহাসিক শেলডন পোলক ও জ্যঁ হবের মতে অধিকাংশই কণ্ণড়ে) লিখিত।[16][17][18][19][20] শাসকেরা উভয় ভাষার সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। কণ্ণড় সাহিত্যের প্রচীনতম কীর্তিগুলি শাসক ও সভাকবিদের রচনা।[21][22][23][24] রাষ্ট্রকূটরা কন্নড় হলেও,[5][25][26][27][28] তাঁদের মাতৃভাষা ছিল একটি উত্তর দক্ষিণী ভাষা।[29]

রাষ্ট্রকূট সাম্রাজ্যের কেন্দ্র ছিল প্রায় সমগ্র কর্ণাটক, মহারাষ্ট্র এবং অন্ধ্রপ্রদেশের কিছু অংশ। অন্ধ্রের ঐ অঞ্চলে রাষ্ট্রকূটদের ২০০ বছরের শাসন ছিল। সামানগড় তাম্রলিপি (৭৫৩) থেকে জানা যায়, বেরারের (অধুনা মহারাষ্ট্রের এলিচপুর) অচলপুরের সামন্ত রাজা দন্তিদূর্গ ৭৫৩ খ্রিস্টাব্দে বাদামির চালুক্য রাজা দ্বিতীয় কীর্তিবর্মণকে পরাজিত করে চালুক্য সাম্রাজ্যের উত্তরাঞ্চল জয় করে নেন।[30][31][32] পরে তিনি তাঁর শ্বশুর পল্লব রাজা নন্দীবর্মণকে চালুক্যদের হাত থেকে কাঞ্চী উদ্ধার করতে সাহায্য করেন। তিনি মালওয়ার গুর্জরদের পরাস্ত করেন এবং কলিঙ্গ, কোশলশ্রীশৈলম জয় করেন।[33][34]

দন্তিদুর্গের উত্তরসূরি প্রথম কৃষ্ণ আধুনিক কর্ণাটক ও কোঙ্কণ অঞ্চলের বৃহত্তর অংশ নিজের শাসনাধীনে আনেন।[35][36] ৭৮০ খ্রিস্টাব্দে ধ্রুব ধারাবর্ষ সিংহাসনে বসেন। তিনি কাবেরী নদী উপত্যকা ও মধ্য ভারতে রাষ্ট্রকূট সাম্রাজ্য বিস্তার করেন।[35][37][38][39] তিনি তদনীন্তন উত্তর ভারতের ক্ষমতাকেন্দ্র কনৌজে কয়েকটি সফল সামরিক অভিযান চালান। সেখানে গুর্জর প্রতিহার ও বঙ্গের পাল রাজাদের পরাজিত করে প্রচুর খ্যাতি ও লুণ্ঠন সামগ্রীর অধিকারী হন। তবে সাম্রাজ্যের আয়তন বিস্তারে তিনি সক্ষম হননি। তিনি পূর্ব চালুক্য ও তালাকাডের গঙ্গ রাজবংশকে নিজের অধীনে আনেন।[35][40] আলতেকর ও সেনের মতে, তাঁর রাজত্বকালেই রাষ্ট্রকূটরা সর্বভারতীয় শক্তিতে পরিণত হয়।[39][41]

ধ্রুব ধারাবর্ষের তৃতীয় পুত্র তৃতীয় গোবিন্দের রাজত্বকালে সাম্রাজ্যের আয়তন সর্বাধিক বৃদ্ধি পায়।[42] রাষ্ট্রকূটদের আদি রাজধানীর অবস্থান সঠিকভাবে জানা যায় না।[43][44][45] তৃতীয় গোবিন্দের রাজত্বকালে রাষ্ট্রকূটরা গাঙ্গেয় অববাহিকার দখলকে কেন্দ্র করে পাল ও প্রতিহারদের সঙ্গে ত্রিমুখী সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। প্রতিহার সম্রাট দ্বিতীয় নাগভট্ট ও পাল সম্রাট ধর্মপালের বিরুদ্ধে বিজয়ের কথা উল্লেখ করে[35] সঞ্জন লিপিতে বলা হয়েছে, তৃতীয় গোবিন্দের যুদ্ধাশ্ব হিমালয়ের নদীগুলির হিমশীতল জল পান করেছিল এবং যুদ্ধহস্তীরা পান করেছিল গঙ্গার পবিত্র জল।[46][47] তাঁর সামরিক বাহিনীকে মহামতি আলেকজান্ডার ও মহাভারতের অর্জুনের সেনাবাহিনীর সঙ্গে তুলনা করা হত।[48] কনৌজ জয়ের পর তিনি দক্ষিণে যান এবং গুর্জর, কোশল ও মহীশূর অঞ্চলের রাশ নিজের হাত নেন। তিনি কাঞ্চীর পল্লবদের বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য করেন, বেঙ্গিতে নিজের আজ্ঞাবহ রাজাকে সিংহাসনে বসান এবং সিংহলের রাজাকে নিজের বশে আনেন। চোল, পাণ্ড্য ও চের রাজারা তাঁকে কর দিতেন।[49][50][51] দক্ষিণে কুমারিকা অন্তরীপ থেকে উত্তরে কনৌজ, পূর্বে বারাণসী থেকে পশ্চিমে ভারুচ পর্যন্ত রাষ্ট্রকূটদের সাম্রাজ্য বিস্তৃত ছিল।[52][53]

তৃতীয় গোবিন্দের পুত্র প্রথম অমোঘবর্ষ মান্যখেতে সাম্রাজ্যের রাজধানী স্থানান্তরিত করেন। সাম্রাজ্যের পতন পর্যন্ত মান্যখেতই ছিল রাষ্ট্রকূটদের রাজধানী।[54][55][56] ৮১৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি সিংহাসনে বসেন। ৮২১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তাঁকে সামন্ত ও মন্ত্রীদের বিদ্রোহ দমনে ব্যস্ত থাকতে হয়। প্রথম অমোঘবর্ষ তাঁর দুই কন্যার সঙ্গে পশ্চিম গঙ্গ রাজবংশের বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করেন। বিঙ্গাবল্লীর যুদ্ধে আক্রমণকারী পূর্ব চালুক্য বাহিনীকে পরাজিত করে "বীরনারায়ণ" উপাধি গ্রহণ করেন।[57][58] তিনি তৃতীয় গোবিন্দের মতো যুদ্ধবিগ্রহে বেশি সময় দেননি। বরং প্রতিবেশী রাজ্যগুলির সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রেখে চলতেন। গঙ্গ, পূর্ব চালুক্য ও পল্লবদের সঙ্গে তিনি বৈবাহিক সূত্রে মিত্রতা করেছিলেন। তাঁর রাজত্বকালে শিল্প, সাহিত্য ও ধর্মের সমৃদ্ধি ঘটে। কন্নড় ও সংস্কৃত ভাষায় সুপণ্ডিত দ্বিতীয় অমোঘবর্ষকে শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রকূট সম্রাট মনে করা হয়।[59][60] তাঁর কবিরাজমার্গ কন্নড় ভাষায় একটি গুরুত্বপূর্ণ কাব্যগ্রন্থ এবং তাঁর প্রশ্নোত্তর রত্নমালিকা গ্রন্থটি একটি উল্লেখযোগ্য সংস্কৃত গ্রন্থ। শেষোক্ত গ্রন্থটি তিব্বতি ভাষায় অনূদিত হয়।[61] ধর্মের প্রতি তাঁর বিশেষ আগ্রহ, শিল্প ও সাহিত্যের প্রতি তাঁর বিশেষ অনুরাগ ও তাঁর শান্তিপ্রিয় মানসিকতার জন্য তাঁকে "দাক্ষিণাত্যের অশোক" বলা হয়ে থাকে।[62]

দ্বিতীয় কৃষ্ণের রাজত্বকালে, রাষ্ট্রকূট সাম্রাজ্য পূর্ব চালুক্যদের বিদ্রোহের মুখে পড়ে। পশ্চিম দাক্ষিণাত্য ও গুজরাট এই সময় রাষ্ট্রকূটদের হাতছাড়া হয়।[63] দ্বিতীয় কৃষ্ণ গুজরাট শাখার স্বাধীনতা বাতিল করে তাদের মান্যখেতের প্রত্যক্ষ শাসনে আনেন। তৃতীয় ইন্দ্র পরামারকে পরাজিত করে মধ্য ভারতে সাম্রাজ্যে হারানো অংশ পুনরুদ্ধার করেন। তারপর তিনি গঙ্গা-যমুনা দোয়াব অঞ্চল আক্রমণ করেন। এছাড়া তিনি রাষ্ট্রকূটদের চিরশত্রু প্রতিহার ও পাল রাজাদেরও পরাজিত করেন এবং বেঙ্গিতে রাষ্ট্রকূট আধিপত্য বজায় রাখতে সাহায্য করেন।[63][64][65] চতুর্থ গোবিন্দের ৯৩০খ্রিস্টাব্দের তাম্রলিপি থেকে জানা যায় যে, দ্বিতীয় কৃষ্ণের কনৌজ বিজয়ের ফল বহু বছর রাষ্ট্রকূটরা ভোগ করেছে।[66][67] এরপর কয়েকজন দুর্বল রাজার শাসনে রাষ্ট্রকূটরা উত্তর ও পূর্ব ভারতের কিছু অঞ্চলের দখল হারান। তৃতীয় কৃষ্ণ নর্মদা নদী থেকে কাবেরী নদী পর্যন্ত সাম্রাজ্যকে বিস্তৃত করেন। উত্তর তামিল রাজ্য তোন্ডাইমণ্ডলমও তাঁর অধীনে আসে। শ্রীলঙ্কার রাজারা তাঁকে কর দিতেন।[68][69][70][71][72]

খোট্টিগ অমোঘবর্ষের রাজত্বকালে পারমার রাজা সিকায় হর্ষ রাষ্ট্রকূট সাম্রাজ্য আক্রমণ করে মান্যখেত লুণ্ঠন করেন। এর ফলে রাষ্ট্রকূটদের শক্তি হ্রাস পায়। এরপরই রাষ্ট্রকূট সাম্রাজ্যের পতন ঘটে।[73] এই পরাজয়ের সুযোগ নিয়ে তারদাবাদি প্রদেশের (আধুনিক বিজাপুর জেলা, কর্ণাটক) শাসক তৃতীয় তৈলপ নিজেকে স্বাধীন রাজা ঘোষণা করলে রাষ্ট্রকূট সাম্রাজ্যের পতন সম্পূর্ণ হয়।[74][75] সর্বশেষ রাষ্ট্রকূট সম্রাট চতুর্থ ইন্দ্র জৈন সন্ন্যাসীদের প্রথা অনুসারে শ্রবণবেলগোলায় অনশনে মৃত্যুবরণ করেন। রাষ্ট্রকূটদের পতনের সঙ্গে সঙ্গে দাক্ষিণাত্য ও উত্তর ভারতে তাদের সামন্ত শাসকেরা স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। পশ্চিম চালুক্য সাম্রাজ্য ১০১৫ খ্রিস্টাব্দে মান্যখেত দখল করে সেখানেই তাদের রাজধানী স্থাপন করে। এরপর একাদশ শতাব্দীতে মান্যখেত পশ্চিম চালুক্যদের সাম্রাজ্যের কেন্দ্রে পরিণত হয়। শাসনকেন্দ্র কৃষ্ণা নদীগোদাবরী নদীর দোয়াব বেঙ্গিতে স্থানান্তরিত হয়। পশ্চিম দাক্ষিণাত্যে রাষ্ট্রকূটদের পূর্বতন সামন্ত শাসকদের চালুক্যরা নিজেদের অধীনে নিয়ে আসে। এরপর তাঁরা দাক্ষিণাত্যে তাঁদের প্রধান শত্রু তাঞ্জোরের চোল রাজাদের পরাস্ত করে।[76]

মান্যখেতের রাষ্ট্রকূটরা উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের রাজনীতিতে গভীর প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সুলেমান (৮৫১), আল মাসুদি (৯৪৪) ও ইবন খুরদাধবা (৯১২) তাঁদের রচনায় রাষ্ট্রকূট সাম্রাজ্যকে সমসাময়িক ভারতের বৃহত্তম সাম্রাজ্য বলে উল্লেখ করেছেন। সুলেমান বলেছেন, এই সাম্রাজ্য সমসাময়িক বিশ্বের চারটি প্রধান সাম্রাজ্যের একটি।[77][78][79] দশম শতাব্দীর আরব পর্যটক আল মাসুদি ও ইবন খরদিদবিহের মতে, "হিন্দুস্তানের অধিকাংশ রাজা প্রার্থনা করার সময় রাষ্ট্রকূট রাজাদের মুখাপেক্ষী হয়। তাঁরা রাষ্ট্রকূটদের দূতেদের কাছেও প্রণতি জানায়। রাষ্ট্রকূট রাজারা রাজাধিরাজ। তাদের সেনাবাহিনী সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী। তাঁরা কোঙ্কণ থেকে সিন্ধু পর্যন্ত অঞ্চল নিজেদের অধিকারে রাখেন।"[80] কোনো কোনো ঐতিহাসিক এই যুগটিকে "সাম্রাজ্যবাদী কনৌজের যুগ" বলেন। রাষ্ট্রকূটরা যেহেতু কনৌজ সফলভাবে অধিকার করতে সক্ষম হয়েছিলেন, তাঁরা উত্তর ভারতীয় রাজাদের থেকে কর নিতেন। তাই এই অঞ্চলকে "সাম্রাজ্যবাদী কর্ণাটকের যুগ"ও বলা হয়।[79] অষ্টম থেকে দশম শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে মধ্য ও উত্তর ভারত দখলের সময়, রাষ্ট্রকূট ও তাঁদের আত্মীয়রা ওই অঞ্চলে অনেক রাজ্য স্থাপন করেছিলেন। এগুলির কতকগুলি মূল সাম্রাজ্যের সঙ্গে সঙ্গে শাসনকার্য চালিয়েছে অথবা মূল সাম্রাজ্যের পতনের অনেক পরে গুরুত্ব অর্জন করেছে। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য গুজরাটের রাষ্ট্রকূট (৭৫৭-৮৮৮),[81] কর্ণাটকের সৌনদাত্তির রাট্টা (৮৭৫-১২৩০),[82] কনৌজের গহদবল (১০৬৮-১২২৩),[83] রাজস্থানের রাষ্ট্রকূট ও হস্তিকুন্ডি বা হাথকুন্ডির রাষ্ট্রকূট (৮৯৩-৯৯৬),[84] দহলের (জব্বলপুরের কাছে) রাষ্ট্রকূট,[85] মান্দোরের (যোধপুরের কাছে) রাষ্ট্রকূট, ধানোপের রাঠোর,[86] আধুনিক মহারাষ্ট্রের ময়ূরগিরির রাষ্ট্রকূট,[87] ও কনৌজের রাষ্ট্রকূট।[88] খ্রিস্টীয় একাদশ শতাব্দীতে রাজাধিরাজ চোল সিঙ্ঘল আক্রমণ করে সেখানকার ৪ জন রাজাকে পরাস্ত করেন। ঐতিহাসিক কে. পিল্লাইয়ের মতে, এঁদের একজন জাফনা রাজ্যের রাজা মহাবরজাহ ছিলেন পূর্বতন রাষ্ট্রকূট অধীনস্থ সামন্ত।[89]

প্রশাসন

শিলালিপি ও অন্যান্য সাহিত্যিক সূত্র থেকে জানা যায়, রাষ্ট্রকূটরা বংশানুক্রমে একজন যুবরাজকে অভিষিক্ত করতেন। সবসময় যে জ্যেষ্ঠ পুত্রই যুবরাজ হতেন, তা নয়। বয়স বা জন্মতারিখের বদলে যোগ্যতাকে যৌবরাজ্যের মাপকাঠি হিসেবে ধরা হত। যেমন তৃতীয় গোবিন্দ ছিলেন ধ্রুব ধারাবর্ষের তৃতীয় পুত্র। রাজার পরেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদটি ছিল "মহাসন্ধিবিগ্রহী" বা মুখ্যমন্ত্রীর। পতাকা, শঙ্খ, পাখা, শ্বেতছত্র, ঢাক ও পাঁচটি বাদ্যযন্ত্রযুক্ত তাঁর প্রতীকটিকে বলা হত "পঞ্চমহাশব্দ"। তাঁর নিচে ছিলেন "দণ্ডনায়ক" বা সেনাধ্যক্ষ, "মহাক্ষপতলাধিকৃত" বা বিদেশমন্ত্রী ও একজন "মহামাত্য" বা "পূর্ণামাত্য" বা প্রধানমন্ত্রী। এঁদের প্রত্যেকের সঙ্গে একজন করে সামন্ত রাজার যোগ থাকত এবং এঁরা সরকারপ্রধানের মর্যাদা পেতেন।[90] "মহাসামন্ত" ছিলেন একজন সামন্ত রাজা বা উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী। সকল মন্ত্রীই রাজনীতি বিষয়ে বিশেষ অভিজ্ঞ ও সামরিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হতেন। মহিলারাও বিশেষ স্থান অর্জন করতে পারতেন। দ্বিতীয় অমোঘবর্ষের কন্যা রেবাকানিমাদ্দি এডাতোর বিষয়ের শাসক ছিলেন।

সাম্রাজ্য বিভক্ত ছিল কতগুলি "মণ্ডল" বা "রাষ্ট্রে" (প্রদেশ)। রাষ্ট্রের প্রধানকে বলা হত "রাষ্ট্রপতি"। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সম্রাট নিজে ছিলেন রাষ্ট্রপতি। প্রথম অমোঘবর্ষ ষোলোটি রাষ্ট্রের প্রধান ছিলেন। রাষ্ট্রের অধীনে "বিষয়" বা জেলা গঠিত হত। জেলাশাসককে বলা হত "বিষয়পতি"। বিশ্বস্ত মন্ত্রীরা মাঝে মাঝে একাধিক রাষ্ট্র শাসন করতেন। দ্বিতীয় অমোঘবর্ষের সেনাধ্যক্ষ বানকেশ ছিলেন বানাভাসি-১২০০০, বেলভোলা-৩০০, পুলিগেরে-৩০০, কুন্ডুরু-৫০০ ও কুন্ডার্গ-৭০-এর শাসক (প্রত্যেক বিষয়ের সঙ্গে জড়িত সংখ্যাগুলি উক্ত বিষয়ের অধীনস্থ গ্রামের সংখ্যা)। বিষয়গুলি "নাড়ু"তে বিভক্ত হত। এগুলির শাসক ছিলেন "নাড়ুগৌড়া" বা "নাড়ুগাভুন্ডা"। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এই পদে দুই জন আধিকারিককে নিয়োগ করা হত। একজন বংশানুক্রমে শাসন করতেন, অপরজনকে সম্রাট নিয়োগ করতেন। সর্বনিম্ন বিভাগ ছিল "গ্রাম"। গ্রামের প্রধানকে বলা হত "গ্রামপতি" বা "প্রভু গাভুন্ডা"।[91]

রাষ্ট্রকূট সেনাবাহিনীতে পদাতিক, অশ্বারোহী, ও হস্তি বিভাগ ছিল। মান্যকুটে "স্তিরভূট কটক" নামে একটি বাহিনী সর্বদা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত রাখা হত। সামন্ত শাসকেরাও, যাঁরা যুদ্ধের সময় সাম্রাজ্যকে সামরিক সাহায্য দিতেন, তাঁরা বড় সেনাবাহিনী রাখতেন। সকল প্রধান ও আধিকারিকেরা প্রয়োজনের সেনাধ্যক্ষের কাজ করতেন।[92]

রাষ্ট্রকূটেরা "সুবর্ণ", "দ্রাম্মা" (রুপো ও সোনার মুদ্রা), কালাঞ্জু, "গদ্যনক", "কাসু", "মনজাতি" ও "আক্কাম" নামে মুদ্রা চালু করেছিল। এগুলি "অক্কশেল" টাঁকশালে তৈরি হত।[93]

অর্থনীতি

কাশীবিশ্বনাথ মন্দির, পাট্টাডাকাল, কর্ণাটক

প্রাকৃতিক সম্পদ, কৃষিজ পণ্য, শিল্প কর ও অন্য রাজ্য জয়ের সময় লুণ্ঠিত সম্পদ ও করদ রাজ্যগুলি থেকে আদায় করা কর ছিল রাষ্ট্রকূট অর্থনীতির প্রধান উৎস। দক্ষিণ গুজরাত, খান্দেশ ও বেরার অঞ্চলের প্রধান কৃষিজ পণ্য ছিল তুলো। মীননগর, গুজরাত, উজ্জয়িনী, পৈঠান ও তাগারা ছিল বস্ত্রশিল্পের প্রধান কেন্দ্র। পৈঠান ও ওয়ারাঙ্গলে মসলিন বস্ত্র উৎপাদিত হত। ভারোচ থেকে সুতো ও বস্ত্র রফতানি করা হত। বুরহানপুর ও বেরারে সাদা সুতির কাপড় উৎপাদিত হত। এগুলি রফতানি করা হত পারস্য, তুরস্ক, পোল্যান্ড, আরব ও মিশরে[94] সামন্ত সিলহারদের অধীনস্থ কোঙ্কণ অঞ্চলে প্রচুর পান, নারকেল ও ধান উৎপাদিত হত। সামন্ত গঙ্গদের অধীনস্থ মহীশূরের বনাঞ্চলে চন্দন ও অন্যান্য কাঠ উৎপাদিত হত। ঠাণে ও সাইমুরের বন্দর থেকে ধূপ ও সুগন্ধী দ্রব্য রফতানি করা হত।[95]

দাক্ষিণাত্যের জমি গাঙ্গেয় উপত্যকার মতো উর্বর ও কৃষিসমৃদ্ধ না হলেও এখানে প্রচুর খনিজ পাওয়া যায়। গুডাপ্পা, বেলারি, চন্দ, বুলধান, নরসিংহপুর, আহমদনগর, বীজাপুর ও ধরওয়ারের তাম্রখনি ছিল রাষ্ট্রকূট অর্থনীতির নুতম প্রধান উৎস।[96] গুডাপ্পা, বেলারি, কুরনুলগোলকুন্ডা থেকে হিরে উত্তোলন করা হত। রাজধানী মান্যখেত ও দেবগিরি ছিল হিরে ব্যবসার প্রধান কেন্দ্র। গুজরাত ও উত্তর মহারাষ্ট্রের কোনো কোনো অঞ্চলে চর্মশিল্প বিকাশলাভ করেছিল। মহীশূর অঞ্চলে হাতি পালন করা হত। এই অঞ্চল গজদন্তশিল্পের জন্য প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল।[97]

সমকালীন ভারতে আরব সাগরে বাণিজ্য মূলত রাষ্ট্রকূটেরাই নিয়ন্ত্রণ করত।[95] সাম্রাজ্যের গুজরাত শাখা ভারোচের বন্দর থেকে প্রচুর আয় করত। এই বন্দর সমকালীন বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বন্দর ছিল।[98] সাম্রাজ্যের প্রধান রফতানি দ্রব্য ছিল সুতো, সুতির কাপড়, মসলিন, পশুচর্ম, মাদুর, নীল, ধূপ, সুগন্ধী, পান, নারকেল, চন্দন, কাঠ, তিলের তেল ও গজদন্ত। মুক্তো, সোনা, আরবের খেজুর, ক্রীতদাস, ইতালীয় সুরা, টিন, সিসে, টোপাজ, স্টোর‍্যাক্স, মিষ্টি ক্লোভার, ফ্লিন্ট কাচ, অ্যান্টিমনি, সোনা ও রুপোর মুদ্রা, রাজসভার বিনোদনের জন্য গায়ক বালক-বালিকা আমদানি করা হত। ঘোড়া কেনাবেচা ছিল গুরুত্বপূর্ণ লাভজনক ব্যবসা। আরব ও কিছু স্থানীয় ব্যবসায়ীর এই ব্যবসা একচেটিয়া ছিল।[99] রাষ্ট্রকূট সরকার বন্দরে নোঙর করা প্রতিটি বিদেশি বাণিজ্যতরীর জন্য এক স্বর্ণ "গদ্যনক" মুদ্রা ও স্থানীয় বাণিজ্যতরীর জন্য এক "কথর্ণ" রৌপ্যমুদ্রা কর বসিয়েছিল।[100]

শিল্পীরা গিল্ডের মাধ্যমে ব্যবসা চালাত। শিলালিপিগুলি থেকে বয়নশিল্পী, তেলি, ভাস্কর, ঝুড়ি ও মাদুরশিল্পী এবং ফলবিক্রেতাদের গিল্ডের কথা জানা যায়। সৌনদাত্তি শিলালিপি থেকে স্থানীয় গিল্ডের উদ্যোগে জেলার সকল অধিবাসীর সমাবেশের কথা জানা যায়।[101] কোনো কোনো গিল্ড অন্যান্য গিল্ডের তুলনায় অধিক ক্ষমতাশালী ছিল। এগুলির ক্ষমতার উৎস ছিল রাজকীয় সনদ। শিলালিপি থেকে জানা যায় বাণিজ্যপথে পণ্য সুরক্ষার জন্য এরা সামরিক বাহিনীও রাখত। গ্রামীণ কর্তৃপক্ষ ব্যাংক চালাত। এই ব্যাংক থেকে বণিক ও ব্যবসায়ীদের টাকা ধার দেওয়া হত।[102]

সরকারের আয়ের প্রধান উৎস ছিল পাঁচটি: নিয়মিত কর, সাময়িক কর, জরিমানা, আয়কর, অন্যান্য কর এবং সামন্তদের দেওয়া কর।[103] মাঝে মাঝে জরুরি কর আরোপ করা হত প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্থ সামন্ত রাজ্যকে সাহায্য করার জন্য। খাসজমি, পতিত জমি, মূল্যমান কাঠ পাওয়া যায় এমন বনাঞ্চল, খনি, নুন উৎপাদন ও খনি থেকে তোলা অন্যান্য সম্পদের উপর আয়কর আরোপ করা হত।[104] এছাড়া বিবাহ বা ছেলের বিবাহে রাজা বা রাজকীয় আধিকারিকদের উপহার দেওয়া বাধ্যতামূলক ছিল।[105]

প্রয়োজন ও অবস্থার ভিত্তিতে রাজা করের পরিমাণ নির্ধারণ করতেন।তিনি দেখতেন যাতে কৃষকদের উপর অতিরিক্ত করের চাপ না পড়ে।[106] ভূস্বামীরা নানা রকমের কর দিত। এর মধ্যে ছিল ভূমিকর, উৎপাদন কর, গাভুন্ডা বা গ্রামপ্রধানকে দেয় কর। উৎপাদন অনুযায়ী উৎপাদনের ৮ % থেকে ১৬ % কর দিতে হত। ৯৪১ খ্রিস্টাব্দের বনবাসী শিলালিপি থেকে জানা যায় পুরনো সেচখাল মজে যাওয়ায় ওই অঞ্চলে ভূমি কর বাড়ানো হয়েছিল।[107] যুদ্ধের সময় সামরিক খরচ মেটাতে ২০ % পর্যন্ত ভূমিকর বাড়ানো হত।[108] রাজ্যের অধিকাংশ অঞ্চলেই ভূমিকর পণ্য ও শ্রমের মাধ্যমে মেটানো হত। খুব কম ক্ষেত্রেই নগদ অর্থে এই কর দেওয়ার নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে।[109] করের কিছু অংশ (সাধারণত ১৫ %) গ্রামকে ফিরিয়ে দেওয়া হত রক্ষণাবেক্ষণের জন্য।[107]

মৃৎশিল্পী, পশুপালক, তন্তুবায়, গোয়ালা, দোকানদার, মালী ও মদ উৎপাদকদের উপর কর আরোপিত হত। মাছ, মাংস, মধু, ওষুধ, ফল প্রভৃতি দ্রব্য, জ্বালানির মতো প্রয়োজনীয় দ্রব্যের উপর সর্বাধিক ১৬ % কর আরোপিত হত।[100] নুন ও খনিজ দ্রব্যের উপর কর দেওয়া বাধ্যতামূলক ছিল। যদিও সাম্রাজ্য খনিগুলির মালিকানা দাবি করত না। ব্যক্তিগত উদ্যোগে খনিজ দ্রব্য উৎপাদিত হত। এর ফলে ব্যবসায় মন্দা দেখা দিত না।[110] কোনো সম্পত্তির মালিক মারা গেলে তাঁর কোনো উত্তরাধিকার না থাকলে সেই সম্পত্তি সাম্রাজ্য অধিগ্রহণ করে নিত।[111] ফেরি ও গৃহ কর ছিল অন্যান্য কর। শুধু ব্রাহ্মণ ও তাঁদের ধর্মীয় সংস্থাগুলিকে কম হারে কর দিতে হত।[112]

সংস্কৃতি

কৈলাসনাথ মন্দির

ধর্ম

রাষ্ট্রকূট রাজারা ধর্মীয় সহিষ্ণুতার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে সমসাময়িক যুগের জনপ্রিয় ধর্মবিশ্বাসগুলির পৃষ্ঠপোষকতা করতেন।[113] তাঁদের নিজেদের আচরিত ধর্মমত কোনটি ছিল, তা নিয়ে তাঁদের শিলালিপি, মুদ্রা ও সমসাময়িক সাহিত্যের ভিত্তিতে গবেষকরা বিভিন্ন মত দিয়েছেন। কেউ কেউ মনে করেন, রাষ্ট্রকূটরা জৈন মতাবলম্বী ছিলেন। কারণ, রাষ্ট্রকূট রাজসভার সংস্কৃত, কন্নড় ও অল্পসংখ্যক অপভ্রংশপ্রাকৃত সাহিত্যকার ছিলেন জৈন।[114] রাষ্ট্রকূট রাজারা অধুনা বাগলকোট জেলার লোকপুরার বিখ্যাত জৈন মন্দিরগুলি এবং তাঁদের সামন্ত পশ্চিম গঙ্গ রাজবংশ শ্রবণবেলগোলাকম্বদহল্লির জৈন স্থাপত্যগুলি নির্মাণ করিয়েছিলেন। গবেষকদের মতে, রাষ্ট্রকূট সাম্রাজ্যের মূল কেন্দ্র আধুনিক কর্ণাটকের প্রধান ধর্মবিশ্বাসই ছিল জৈনধর্ম। এই অঞ্চলের ৩০ শতাংশেরও বেশি মানুষ জৈন ধর্মাবলম্বী ছিলেন।[115] রাজা প্রথম অমোঘবর্ষ ছিলেন জৈন আচার্য জিনসেনের শিষ্য। তিনি তাঁর ধর্মবিষয়ক গ্রন্থ প্রশ্নোত্তর-রত্নমালিকা-য় লিখেছিলেন "বর্ধমানকে (মহাবীর) প্রণাম করে আমি প্রশ্নোত্তর-রত্নমালিকা রচনা করছি।" গণিতজ্ঞ মহাবীর তাঁর গণিত সারসংগ্রহ গ্রন্থে লেখেন, "অমোঘবর্ষের প্রজারা সুখে ছিলেন। রাজ্যে প্রচুর শস্য উৎপাদিত হত। জৈনধর্মের অনুগামী রাজা কৃপাতুঙ্গ অমোঘবর্ষের রাজ্য উত্তরোত্তর বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হোক।" সম্ভিবত বৃদ্ধ বয়সে অমোঘবর্ষ জৈনধর্ম গ্রহণ করেছিলেন।[116][117]

যদিও রাষ্ট্রকূট রাজারা হিন্দুধর্মের শৈব, বৈষ্ণব ও শাক্ত শাখারু পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। তাঁদের প্রায় সব কটি শিলালিপির সূচনাতেই হিন্দু দেবতা বিষ্ণু বা শিবের প্রশস্তি দেখা যায়। গুজরাতের সঞ্জন শিলালিপি থেকে জানা যায়, রাজা প্রথম অমোঘবর্ষ রাজ্যকে একটি বিপদের হাত থেকে রক্ষা করতে কোলহাপুরের মহালক্ষ্মী মন্দিরে নিজের বাঁ হাতের একটি আঙুল বলি দিয়েছিলেন। রাজা দন্তিদুর্গ "হিরণ্যগর্ভ" (অশ্বমেধ) যজ্ঞ করেছিলেন। চতুর্থ গোবিন্দের সঞ্জন ও খাম্বাত লিপি হেকে জানা যায়, ব্রাহ্মণেরা রাজসূয়, বাজপেয় ও অগ্নিষ্টোম যজ্ঞ অনুষ্ঠান করেছিলেন।[118] রাজা দন্তিদুর্গের প্রথম দিকের একটি তাম্রলিপিতে (৭৫৩) শিবের ছবি দেখা যায়। তাঁর উত্তরসূরি রাজা প্রথম কৃষ্ণের মুদ্রায় (৭৬৮) "পরম মহেশ্বর" (শিবের অপর নাম) কথাটি দেখা যায়। রাজাদের "বীরনারায়ণ" উপাধির মধ্যে বৈষ্ণব যোগসূত্র পাওয়া যায়। তাঁদের পতাকায় গঙ্গা ও যমুনা নদীর চিহ্ন দেখা যায়। সেটি সম্ভবত বাদামি চালুক্যদের অনুকরণে চালু হয়েছিল।[119] ইলোরার কৈলাসনাথ মন্দির ও অন্যান্য হিন্দু মন্দিরগুলি রাষ্ট্রকূট রাজাদের শাসনকালেই নির্মিত হয়েছিল। অর্থাৎ, এই যুগে হিন্দুধর্মও বেশ উন্নতিলাভ করেছিল।[118] রাষ্টকূটদের কুলদেবীর নাম ছিল "লাটানা" (অন্য নাম "রাষ্ট্রশ্যেনা", "মনসা", "বিন্ধ্যবাসিনী")। সেকালের জনপ্রিয় বিশ্বাস ছিল, তিনি বাজপাখির রূপ ধরে এসে রাজ্যকে রক্ষা করেন।[120] রাষ্ট্রকূট রাজারা বিভিন্ন ধর্মবিশ্বাসের উপযুক্ত মূর্তি ও অলংকরণসহ মন্দির নির্মাণ করতেন। সালোতগির মন্দিরটি শিব ও বিষ্ণুর অনুগামীদের জন্য নির্মিত হয়েছিল। কারগুদ্রির মন্দিরটি ছিল শিব, বিষ্ণু ও ভাস্কর (সূর্য) পূজার জন্য।[114]

রাষ্ট্রকূট সাম্রাজ্যে বৌদ্ধধর্মের নিদর্শনও পাওয়া যায়। দম্বলবল্লিগাভির মতো জায়গায় বৌদ্ধধর্ম বেশ জনপ্রিয় ছিল। তবে পরবর্তীকালে বৌদ্ধধর্মের জনপ্রিয়তা কমে যায়।[121] খ্রিস্টীয় অষ্টম শতাব্দীতে আদি শঙ্কর দক্ষিণ ভারতে অদ্বৈত বেদান্ত প্রচার করলে বৌদ্ধধর্মের পতন সম্পূর্ণ হয়।[122] খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দী থেকেই দাক্ষিণাত্যের রাজ্য ও আরব অঞ্চলের মধ্যে বাণিজ্যের সূত্রে দক্ষিণ ভারত ইসলামের সংস্পর্শে আসে। খ্রিস্টীয় দশম শতাব্দীতে রাষ্ট্রকূট সাম্রাজ্যে জুমাম মসজিদ গড়ে উঠতে দেখা যায়।[123] এই সময় রাজ্যে মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মসজিদের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। এগুলি মূলত কয়ালপত্তনমনাগোরের মতো উপকূলীয় শহরে গড়ে উঠেছিল। মুসলমান আগন্তুকরা স্থানীয় মেয়েদের বিয়ে করত। তাদের সন্তানসন্ততিদের "মাপিল্লা" (বা "মোপলা") বলা হত। এরা ঘোড়া কেনাবেচা ও জাহাজ থেকে মাল খালাসের কাজ করত।[124]

সমাজব্যবস্থা

হিন্দু সমাজব্যবস্থার মূল চারটি বর্ণের বাইরেও প্রায় সাতটি বর্ণের উল্লেখ পাওয়া যায় রাষ্ট্রকূট রাজাবলিতে।[125] এক পর্যটকের বর্ণনায় ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্যশূদ্র ছাড়াও মোট ষোলোটি বর্ণের উল্লেখ পাওয়া যায়।[126] "জাকায়" ও "লাহুদ" বর্ণের মানুষেরা যথাক্রমে নৃত্য ও খেলাধূলায় বিশারদ হত।[127] নৌচালনা, শিকার, বয়ন, জুতাশিল্প, ঝুড়িশিল্প ও মাছ ধরার সঙ্গে যুক্ত মানুষেরা নির্দিষ্ট বর্ণের অন্তর্ভুক্ত ছিল। "অন্ত্যজ" শ্রেণির মানুষেরা ধনীদের কায়িক শ্রম দান করত। রাষ্ট্রকূট সমাজে ব্রাহ্মণদের স্থান ছিল খুবই উঁচুতে। ক্ষত্রিয়দের মধ্যে "সৎ-ক্ষত্রিয়"রা উচ্চ স্থানের অধিকারী ছিলেন।[128][129] জৈনরাও সমাজে উচ্চ মর্যাদা পেতেন।

ব্রাহ্মণদের পেশা ছিল শিক্ষাদান, বিচার, জ্যোতিষ, গণিত, কাব্য ও দর্শন চর্চা।[130] কোনো কোনো ব্রাহ্মণ বংশানুক্রমে প্রশাসনিক উচ্চ পদের অধিকারী হতেন।[131] এছাড়া ব্রাহ্মণরা অব্রাহ্মণদের পেশাতেও (যেমন, কৃষি, পান পাতার ব্যবসা ও সামরিক পদে চাকরি) নিযুক্ত ছিলেন।[132] মৃত্যুদণ্ড বহুল প্রচলিত হলেও, সত-ক্ষত্রিয় বা ব্রাহ্মণদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হত না। মধ্যযুগে ব্রাহ্মণকে হত্যা করা মৃত্যুদণ্ডযোগ্য অপরাধ হলেও এই অপরাধে এঁরা মৃত্যুদণ্ডের হাত থেকে নিষ্কৃতি পেতেন। বিকল্প শাস্তি হিসেবে ব্রাহ্মণের ডান হাত বা বাঁ পা কেটে নেওয়া হত।[133]

খ্রিস্টীয় নবম শতাব্দীতে ভারতে চার বর্ণেরই রাজা দেখা যেত।[134] ক্ষত্রিয়রা ব্রাহ্মণদের মতোই বেদ শিক্ষার অধিকার পেত। তবে বৈশ্য বা শূদ্ররা এই অধিকার পেত না। শিলালিপি থেকে জানা যায়, চার বর্ণের মানুষই ভূস্বামীত্ব পেত।[135] আন্তঃবর্ণ বিবাহ হত। তবে তা শুধু ক্ষত্রিয় নারীর সঙ্গে ব্রাহ্মণ পুরুষের।[136] অন্যান্য বর্ণের মধ্যে আন্তঃবর্ণ বিবাহ প্রায়ই দেখা যেত।[137] কোনো অনুষ্ঠানে একাধিক বর্ণের মানুষের উপস্থিতি কমই দেখা যেত। বিভিন্ন বর্ণের মানুষ একসঙ্গে বসে খেত না।[138]

সাধারণত পরিবারগুলি যৌথ পরিবার হত। তবে শিলালিপিগুলি থেকে জানা যায়, ভাইয়ে-ভাইয়ে এমনকি পিতা-পুত্রের মধ্যেই আইনসম্মত বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটত।[139] নারী ও কন্যারাও সম্পত্তি ও ভূমির অধিকার পেতেন। কারণ, শিলালিপি থেকে নারী কর্তৃক জমি বিক্রয়ের উল্লেখ পাওয়া যায়।[140] দুই পরিবারের মধ্যে দেখাশোনা করে বিয়ে দেওয়াই ছিল প্রথা। ব্রাহ্মণদের ক্ষেত্রে ছেলেদের বিয়ে হত ১৬ বছরের আগেই আর মেয়েদের ১২ বছরের আগে। তবে অন্যান্য বর্ণের ক্ষেত্রে এই বয়সের নিয়ম কঠোরভাবে মানা হত না।[141] সতীপ্রথা চালু ছিল। তবে শিলালিপিগুলি থেকে অনুমিত হয় যে, তা কেবল রাজপরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।[142] বিধবারা প্রায়শই মস্তক মুণ্ডন করত। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিধবারা চুল রাখতেন, তবে তার পরিচর্যা করতেন না।[143] বিধবাবিবাহ সমাজের উচ্চ স্তরে সুলভ ছিল না। তবে নিম্নবর্ণগুলির মধ্যে ছিল।[144]

সাধারণত পুরুষেরা দুটি সাধারণ কাপড় পড়ত। ঊর্ধ্বাঙ্গে ঢিলা পোষাক, নিম্নাঙ্গে ধুতি সদৃশ একটি পোষাক পরত। কেবল রাজারা পাগড়ি পরেন। সাধারণ্যে পাগড়ির চল অনেক পরে হয়েছিল।[145] নৃত্য ছিল বিনোদনের জনপ্রিয় মাধ্যম। শিলালিপি থেকে জানা যায়, রাজবাড়ির মেয়েদের বিনোদনের জন্য নর্তক-নর্তকী নিযুক্ত থাকত। মন্দিরে দেবদাসী প্রথা ছিল।[146] অন্যান্য বিনোদনের মধ্যে ছিল জন্তুজানোয়ারের লড়াই। আটাকুর শিলালিপিটি উৎসর্গিত হয়েছিল বুনো শুয়োর শিকারে গিয়ে নিহত একটি কুকুরের উদ্দেশ্যে। এই কুকুরটি ছিল পশ্চিম গঙ্গ রাজা দ্বিতীয় বুটুগার প্রিয়।[147] শিকার ছিল রাজাদের অন্যতম প্রধান বিনোদন। শিক্ষার বিষয় হিসেবে জ্যোতির্বিদ্যা ও জ্যোতিষ বিশেষ গুরুত্ব পেত।[147] মানুষ কুসংস্কারাচ্ছন্ন ছিল। ব্যাধিগ্রস্থ বৃদ্ধেরা তীর্থের পবিত্র নদীর জলে ডুবে বা পবিত্র আগুনে ঝাঁপ দিয়ে মৃত্যুবরণ করতেন।[148]

সাহিত্য

জৈন নারায়ণ মন্দির, পাট্টাডাকাল, কর্ণাটক

রাষ্ট্রকূট রাজত্বে কন্নড় সাহিত্যিক ভাষা হিসেবে বিশেষ গুরুত্ব পায়। এযুগে শিলালিপি ও সাহিত্যের মাধ্যমে এই ভাষার উল্লেখযোগ্য বিকাশ ও মর্যাদাপ্রাপ্তি ঘটে।[19][22][24] এই যুগটিকে ধ্রুপদি প্রাকৃত ও সংস্কৃত ভাষার অন্তিম কাল হিসেবেও চিহ্নিত করা হয়। রাজসভার কবি ও রাজারা কন্নড় ও সংস্কৃত ভাষায় গদ্য, পদ্য, হিন্দু মহাকাব্য ও জৈন তীর্থঙ্করদের জীবনী এবং অন্যান্য সাহিত্যগ্রন্থ রচনা করেন। অসগ প্রমুখ দ্বিভাষিক লেখক খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।[149] মহাবীর প্রমুখ গণিতজ্ঞ রাজা প্রথম অমোঘবর্ষের রাজসভায় বিশুদ্ধ গণিত নিয়ে গ্রন্থ রচনা করেছিলেন।[150][151]

রাজা প্রথম অমোঘবর্ষের কবিরাজমার্গ (৮৫০) কন্নড় ভাষায় রচিত প্রাচীনতম কাব্যতত্ত্ব-বিষয়ক গ্রন্থ।[60][61] যদিও এই গ্রন্থই প্রমাণ করে, কন্নড় ভাষায় কাব্যসাহিত্য পূর্ববর্তী কয়েকশো বছর ধরে চলে আসছিল।[152] কবিরাজমার্গ হল সেই সব কাব্যশৈলীর একটি সুসংহত রূপ যা কবিদের শিক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্যে রচিত হয়। এই বইতে কবি ও লেখক দুর্বিনীতের উল্লেখ পাওয়া যায়। তিনি সম্ভবত খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীতে পশ্চিম গঙ্গ রাজবংশের রাজা ছিলেন।[153][154][155]

জৈন লেখক আদিকবি পম্পাকে অন্যতম শ্রেষ্ঠ কন্নড় লেখক মনে করা হয়। তিনি চম্পু আকারে রচিত আদিপুরাণ (৯৪১) গ্রন্থের জন্য বিখ্যাত। এটি প্রথম জৈন তীর্থঙ্কর ঋষভের জীবনী। পম্পার অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ রচনা হল বিক্রমার্জুন বিজয় (৯৪১)। এটি হিন্দু মহাকাব্য মহাভারত অবলম্বনে অর্জুনকে নায়ক করে রচিত।[156] এটিকে পম্পাভারত-ও বলা হয়। এই গ্রন্থে লেখকের পৃষ্ঠপোষোক ভেমুলাওয়াড়ার চালুক্য রাজার (রাষ্ট্রকূট সামন্ত) প্রশংসা করে তাঁকে গুণে অর্জুনতুল্য বলে উল্লেখ করা হয়েছে। পরবর্তীকালের লেখকদের উপর পম্পার প্রভাব এতটাই গভীর ছিল যে বহু শতাব্দী ধরে পম্পার রচনার বহু ব্যাখ্যা রচিত হয়েছে।[157]

কন্নড় ভাষায় অপর এক বিখ্যাত জৈন লেখক হলেন শ্রীপোন্না। তাঁর পৃষ্ঠপোষক ছিলেন রাজা দ্বিতীয় কৃষ্ণ। শ্রীপোন্না তাঁর শান্তিপুরাণ গ্রন্থটির জন্য বিখ্যাত। এটি ষোড়শ তীর্থঙ্কর শান্তিনাথের জীবনী। সংস্কৃত ও কন্নড় দুই ভাষায় সমান দক্ষতার জন্য তিনি "উভয় কবিচক্রবর্তী" উপাধি পান। কন্নড় ভাষায় তাঁর অন্যান্য রচনাগুলি হল ভুবনিকা-রমাভ্যুদয়", "জিনক্ষরমলে" ও "গতপ্রত্যাগত"।[60][158] আদিকবি পম্পা ও শ্রীপোন্নাকে বলা হয় "কন্নড় সাহিত্যের রত্ন"।[156]

সংস্কৃত ভাষায় এযুগে অনেক গদ্যগ্রন্থও রচিত হয়।[22] মহাবীরের গণিত গ্রন্থ গণিতসারসংগ্রহ নয়টি অধ্যায়ে বিভক্ত। রাষ্ট্রকূট রাজা তৃতীয় কৃষ্ণের সামন্ত দ্বিতীয় অরিকেশরীর সভাসদ সোমদেবসূরি রচনা করেন "যশসতিলক চম্পূ, নীতিবাক্যামৃত ও অন্যান্য গ্রন্থ। চম্পূজাতীয় রচনার মূল উদ্দেশ্য ছিল জৈন নীতিগুলির প্রচার। এছাড়াও জৈন নৈতিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে অর্থশাস্ত্রও রচিত হয়।[159]

রাজা তৃতীয় ইন্দ্রের রাজসভার বিশিষ্ট পণ্ডিত ত্রিবিক্রম রচনা করেন নলচম্পূ (৯১৫)। এটি সংস্কৃত ভাষায় লেখা প্রথম দিকের চম্পূ। এছাড়া তিনি দময়ন্তী কথা, নলচম্পূ ও বেগুমরা লিপিও রচনা করেন। কথিত আছে, হিন্দু দেবী সরস্বতী রাজসভায় তাঁর অন্যান্য প্রতিদ্বন্দ্বীকে পরাজিত করে এই সকল গ্রন্থ রচনায় সাহায্য করেন।[159] জিনসেন ছিলেন ধর্মপ্রচারক ও প্রথম অমোঘবর্ষের গুরু। ধর্মতত্ত্ব বিষয়ে তাঁর গ্রন্থ ধবলজয়ধবল (ধর্মতাত্ত্বিক বীরসেনের সঙ্গে লিখিত)। এই গ্রন্থগুলি তাঁদের পৃষ্ঠপোষক রাজা অতিশয়ধবলের নামানুসারে রাখা। জিনসেনের অপর গ্রন্থ আদিপুরাণ (এটি সমাপ্ত করেন তাঁর শিষ্য গুণভদ্র), হরিবংশপার্শ্বভ্যুদয়[150]

স্থাপত্য

ইলোরা কৈলাসনাথ মন্দির, মহারাষ্ট্র
ইলোরা কৈলাসনাথ মন্দির, মহারাষ্ট্র

দাক্ষিণাত্যের স্থাপত্য ঐতিহ্যে রাষ্ট্রকূট রাজবংশের অবদান অপরিসীম। শিল্প ঐতিহাসিক অ্যাডাম হার্ডি রাষ্ট্রকূট স্থাপত্যকে তিন ভাগে ভাগ করেছেন: বাদামি ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের ইলোরা, আইহোল ও পাট্টাডাকাল এবং গুলবার্গের কাছে সিরভাল।[160] অধুনা মহারাষ্ট্রের ইলোরা ও এলিফ্যান্টার গুহামন্দিরগুলিতে জৈন সন্ন্যাসীরা বাস করতেন। ইলোরা প্রকৃতপক্ষে ৩৪টি বৌদ্ধ গুহামন্দিরের সমষ্টি। এগুলি সম্ভবত খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীর প্রথমার্ধ্বে নির্মাণ করা হয়েছিল। এগুলির মধ্যে পাণ্ড্য প্রভাব দেখা যায়। হিন্দু গুহামন্দিরগুলি অপেক্ষাকৃত পরবর্তীকালের নির্মাণ।[161]

রাষ্ট্রকূটরা বৌদ্ধ গুহাগুলির সংস্কার করে প্রস্তরখোদিত বেদিগুলি পুনরায় উৎসর্গ করেন। প্রথম অমোঘবর্ষ ছিলেন জৈনধর্মের পৃষ্ঠপোষক। তাঁর রাজত্বকালে ইলোরায় পাঁচটি জৈন গুহামন্দির নির্মিত হয়েছিল।[162] ইলোরায় রাষ্ট্রকূটদের সবচেয়ে বড়ো ও উল্লেখযোগ্য কীর্তিটি হল একশিলায় খোদিত কৈলাসনাথ মন্দির। এই মন্দিরটিই রাষ্ট্রকূট রাজাদের "বলহার" বা "বিশ্বের চার প্রধান সম্রাটের অন্যতম" সম্মানের পরিচায়ক।[78] এই মন্দিরের দেওয়ালে রাবণ, শিবপার্বতী সহ হিন্দু পুরাণের নানা চরিত্রের মূর্তি খোদিত। মন্দিরটির সিলিং চিত্রশোভিত।

সমগ্র দক্ষিণ ভারতে রাষ্ট্রকূট শাসন স্থাপিত হওয়ার পর রাজা প্রথম কৃষ্ণ কৈলাসনাথ মন্দির নির্মাণ করান। অ্যাডাম হার্ডির মতে, এই মন্দিরের স্থাপত্য "কর্ণাট দ্রাবিড়" গোত্রের। নাগর শৈলীর অনুরূপ কোনো শিখর বা চূড়া এই মন্দিরে দেখা যায় না। কর্ণাটকের পাট্টাডাকালে অবস্থিত বিরুপাক্ষ মন্দিরের গড়নের সঙ্গে এই মন্দিরের গড়নের মিল পাওয়া যায়।[163][164] শিল্প ঐতিহাসিক ভিনসেন্ট স্মিথের মতে, কৈলাসনাথ মন্দিরের সাফল্য একশিলায় খোদিত মন্দিরের স্থাপত্য নির্মাণের ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য স্থাপত্য এবং এই মন্দির বিশ্বের অন্যতম বিস্ময় হওয়ার দাবি রাখে।[165] শিল্প ঐতিহাসিক পার্সি ব্রাউনের মতে, শিল্পসৌকর্যের দিক থেকে কৈলাসনাথ মন্দির একটি অপ্রতিদ্বন্দ্বী প্রস্তর স্থাপত্য। এই মন্দির এমন একটি স্থাপত্য যা চিরকালই পর্যটকদের মুগ্ধ করেছে।[166]

এলিফ্যান্টার স্থাপত্য কোনো কোনো গবেষকের মতে, কালচুরি রাজাদের নির্মিত, আবার কোনো কোনো মতে রাষ্ট্রকূট রাজাদের নির্মিত।[167] এই গুহার নটরাজ, সদাশিব ইত্যাদি মূর্তি স্থাপত্যসৌন্দর্যে ইলোরা ভাস্কর্যগুলির থেকেও সুন্দর।[168] এলিফ্যান্টার অন্যান্য বিখ্যাত ভাস্কর্য হল অর্ধনারীশ্বর ও মহেশমূর্তি। মহেশমূর্তি হল ২৫ ফুট (৮ মি) একটি ত্রিমুখবিশিষ্ট শিবের মূর্তি। এটি ভারতের সূক্ষ্মতম ভাস্কর্যগুলির একটি। বলা হয়, ভাস্কর্যের জগতে কোনো দেবতার মূর্তিতে এত সূক্ষ্ম কাজ খুব কম দেখা যায়।[168] মহারাষ্ট্র অঞ্চলের অন্যান্য প্রস্তরখোদিত মন্দির হল ধুমার লেনা ও ইলোরা দশাবতার গুহামন্দির (বিষ্ণু ও শিবলীলা ভাস্কর্যগুলির জন্য বিখ্যাত) এবং মুম্বইয়ের কাছে যোগেশ্বরী মন্দির।

দ্রাবিড় শৈলীর স্থাপত্য, নবলিঙ্গ মন্দির, কুকনুর, কর্ণাটক।

কর্ণাটকে রাষ্ট্রকূটদের সবচেয়ে বিখ্যাত মন্দিরটি হল কাশীবিশ্বনাথ মন্দির ও পাট্টাডাকালের জৈন নারায়ণ মন্দির (একটি ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান)।[169][170] অন্যান্য বিখ্যাত মন্দির হল কোন্নুরের পরমেশ্বর মন্দির, সাবাদির ব্রহ্মাদেব মন্দির, আইহোলের সেত্তাব্বা, দ্বিতীয় কোন্তিগুড়ি, জদরগুড়ি ও অম্বিগেরাগুড়ি মন্দির, রোনের মল্লিকার্জুন মন্দির, হুলির অন্ধকেশ্বর মন্দির, সোগালের সোমেশ্বর মন্দির, লোকপুরার জৈনমন্দিরসমূহ, কুকনুরের নবলিঙ্গ মন্দির, সান্দুরের কুমারস্বামী মন্দির, গুলবর্গার শিরিভালের অসংখ্য মন্দির[171] এবং গাডেগের ত্রিকূটেশ্বর মন্দির, যেটি কল্যাণী চালুক্য রাজাদের আমলে পরিবর্ধিত হয়েছিল। পুরাতাত্ত্বিক গবেষণার ফলে জানা গিয়েছে, এই মন্দিরগুলির নকশা ছিল বহুকোণ-বিশিষ্ট। এই নকশাই মূলত বেলুরহালেবিড়ুতে হোয়সল রাজারা ব্যবহার করেছিলেন।[172] রাষ্ট্রকূটদের স্থাপত্যশৈলীকে অ্যাডাম হার্ডি "কন্নড় দ্রাবিড়" শৈলী নামে চিহ্নিত করেছেন। এই শৈলী প্রথাগত দ্রাবিড় শৈলীর অনুরূপ ছিল না।[173]

ভাষা

নবম শতাব্দীর "পুরনো কন্নড়" লেখ, নবলিঙ্গ মন্দির, কুকনুর, কর্ণাটক
নবম শতাব্দীর "পুরনো কন্নড়" লেখ, দুর্গাদেবী মন্দির, হাম্পি, কর্ণাটক

খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীতে উত্তর ভারতে গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের পর দাক্ষিণাত্যেও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দেখা যায়। এই পরিবর্তন শুধুমাত্র রাজনৈতিক পরিবর্তন ছিল না, ভাষা ও সাংস্কৃতিক জগতেও বিশেষ পরিবর্তন এসেছিল। উপদ্বীপীয় ভারতের (তামিলকামের বাইরে) রাজসভায় স্থানীয় কন্নড় ভাষার চর্চা বৃদ্ধি পায়। এর ফলে সংস্কৃত ও কন্নড় সংস্কৃতির মধ্যে আদানপ্রদানও বৃদ্ধি পায়। দ্বিভাষিক শিলালিপিগুলি থেকে অনুমান করা হয়, সংস্কৃতের পাশাপাশি কন্নড়ও প্রশাসনিক ভাষার মর্যাদা পেয়েছিল।[17][18] সরকারি অভিলেখাগারে জমির অনুদান সংক্রান্ত তথ্যগুলি কন্নড় ভাষায় রক্ষিত হত।[174] স্থানীয় ভাষায় "দেশী" সাহিত্য ও সংস্কৃতে "মার্গ" সাহিত্য রচিত হত। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ("ঘাতিকা") সংস্কৃত ভাষা ব্যবহৃত হত। কারণ, সংস্কৃত ছিল শিক্ষিত ব্রাহ্মণদের ভাষা। অন্যদিকে পূজার্চনার ক্ষেত্রে সাধারণের কথ্য কন্নড় ভাষা বেশি ব্যবহৃত হত। ধনী ও শিক্ষিত জৈনরা কন্নড় ভাষার পৃষ্ঠপোষকতা করত। যার ফলে পরবর্তী শতকগুলিতে কন্নড় ভক্তি আন্দোলনের ভাষায় পরিণত হয়।[175]

সমসাময়িক সাহিত্য ও শিলালিপিগুলি থেকে প্রমাণিত হয় যে, কন্নড় আধুনিক কর্ণাটক অঞ্চলেই শুধুমাত্র জনপ্রিয় ভাষায় ছিল না, বরং আধুনিক দক্ষিণ মহারাষ্ট্র ও উত্তর দাক্ষিণাত্যেও খ্রিস্টীয় অষ্টম শতাব্দীতে এই ভাষা বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল।[176] কবিরাজমার্গ গ্রন্থে বলা হয়েছে কাবেরী নদীগোদাবরী নদীর মধ্যবর্তী সমগ্র অঞ্চলটিই ছিল "কন্নড় দেশ"।[177][178][179] বেদ, ব্যাকরণ, জ্যোতিষ, সাহিত্য, মীমাংসা, ধর্মশাস্ত্র, পুরাণ ও ন্যায়ের মতো উচ্চশিক্ষার বিষয় সংস্কৃতে শিক্ষা দেওয়া হত। শিলালিপি থেকে জানা যায়, এই যুগে "কাব্য" বা ধ্রুপদি রচনাশৈলী বেশ জনপ্রিয় ছিল। শিলালিপির উচ্চ ও নিম্ন মান সম্পর্কে অভিলেখাগার-কর্মীদের জ্ঞান দেখে অনুমিত হয় যে, তাঁরা নিজেরা মধ্যমেধার কবি হলেও ধ্রুপদি সংস্কৃত সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করেছিলেন।[180] রাজা তৃতীয় কৃষ্ণের একটি কন্নড় শিলালিপি কাব্যিক কণাদ ছন্দে রচিত। এটি পাওয়া গিয়েছে অধুনা মধ্যপ্রদেশ রাজ্যের জব্বলপুরের কাছ থেকে।[16] কবিরাজমার্গ অনুসারে, সেকালে দাক্ষিণাত্যে কাব্যচর্চা জনপ্রিয় ছিল। ত্রিবিক্রমের নলচম্পূ সম্ভবত দাক্ষিণাত্যের চম্পূ-জাতীয় রচনার আদিতম নিদর্শন।[181]

পাদটীকা

  1. Reu (1933), p39
  2. Reu (1933), pp1–5
  3. Altekar (1934), pp1–32
  4. Reu (1933), pp6–9, pp47–53
  5. Kamath (2001), p72–74
  6. Reu (1933), p1
  7. Kamath (2001), p72
  8. Reu (1933), pp1–15
  9. J.F. Fleet in Reu (1933), p6
  10. A Kannada dynasty was created in Berar under the rule of Badami Chalukyas (Altekar 1934, p21– 26)
  11. Kamath 2001, p72–3
  12. A.C. Burnell in Pandit Reu (1933), p4
  13. C.V. Vaidya (1924), p171
  14. D.R.Bhandarkar in Reu, (1933), p1, p7
  15. Hultzsch and Reu in Reu (1933), p2, p4
  16. Kamath (2001), p73
  17. Pollock 2006, p332
  18. Houben(1996), p215
  19. Altekar (1934), p411–3
  20. Dalby (1998), p300
  21. Sen (1999), pp380- 381
  22. During the rule of the Rashtrakutas, literature in Kannada and Sanskrit flowered (Kamath 2001, pp 88–90)
  23. Even royalty of the empire took part in poetic and literary activities – Thapar (2003), p334
  24. Narasimhacharya (1988), pp17–18, p68
  25. Altekar (1934), pp21–24
  26. Possibly Dravidian Kannada origin (Karmarkar 1947 p26)
  27. Masica (1991), p45-46
  28. Rashtrakutas are described as Kannadigas from Lattaluru who encouraged the Kannada language (Chopra, Ravindran, Subrahmanian 2003, p87)
  29. Hoiberg and Ramchandani (২০০০)। [http://books.google.com/? id=ISFBJarYX7YC&pg=PA286&dq=Rashtrakuta Rashtrakuta Dynasty] |ইউআরএল= এর মান পরীক্ষা করুন (সাহায্য)। Students Brittanica। আইএসবিএন 978-0-85229-760-5। সংগ্রহের তারিখ ২০০৮-১০-১৩ line feed character in |লেখক= at position 12 (সাহায্য); line feed character in |ইউআরএল= at position 26 (সাহায্য)
  30. Reu (1933), p54
  31. From Rashtrakuta inscriptions call the Badami Chalukya army Karnatabala (power of Karnata) (Kamath 2001, p57,p65)
  32. Altekar in Kamath (2001), p72
  33. Sastri (1955), p141
  34. Thapar (2003), p333
  35. Sastri (1955), p143
  36. Sen (1999), p368
  37. Desai and Aiyar in Kamath (2001), p75
  38. Reu (1933), p62
  39. Sen (1999), p370
  40. The Rashtrakutas interfered effectively in the politics of Kannauj (Thapar 2003), p333
  41. From the Karda inscription, a digvijaya (Altekar in Kamath 2001, p75)
  42. The ablest of the Rashtrakuta kings (Altekar in Kamath 2001, p77)
  43. Modern Morkhandi (Mayurkhandi in Bidar district (Kamath 2001, p76)
  44. modern Morkhand in Maharashtra (Reu 1933, p65)
  45. Sooloobunjun near Ellora (Couseris in Altekar 1934, p48). Perhaps Elichpur remained the capital until Amoghavarsha I built Manyakheta. From the Wani-Dmdori, Radhanpur and Kadba plates, Morkhand in Maharashtra was only a military encampment, from the Dhulia and Pimpen plates it seems Nasik was only a seat of a viceroy, and the Paithan plates of Govinda III indicate that neither Latur nor Paithan was the early capital.(Altekar, 1934, pp47–48)
  46. Kamath 2001, MCC, p76
  47. From the Sanjan inscriptions, {{cite web|title=The Rashrakutas|url=http://www.kamat.com/kalranga/deccan/rashtrakutas/|author=Dr. Jyotsna Kamat|publisher=1996–2006 Kamat's Potpourri|work|accessdate=2006-12 -20}}
  48. Keay (2000), p199
  49. From the Nesari records (Kamath 2001, p76)
  50. Reu (1933), p65
  51. Sastri (1955), p144
  52. "The victorious march of his armies had literally embraced all the territory between the Himalayas and Cape Comorin" (Altekar in Kamath 2001, p77)
  53. Sen (1999), p371
  54. Which could put to shame even the capital of gods-From Karda plates (Altekar 1934, p47)
  55. A capital city built to excel that of Indra (Sastri, 1955, p4, p132, p146)
  56. Reu 1933, p71
  57. from the Cambay and Sangli records. The Bagumra record claims that Amoghavarsha saved the "Ratta" kingdom which was drowned in a "ocean of Chalukyas" (Kamath 2001, p78)
  58. Sastri (1955), p145
  59. Narasimhacharya (1988), p1
  60. Kamath (2001), p90
  61. Reu (1933), p38
  62. Panchamukhi in Kamath (2001), p80
  63. Sastri (1955), p161
  64. From the writings of Adikavi Pampa (Kamath 2001, p81)
  65. Sen (1999), pp373-374
  66. Kamath (2001), p82
  67. The Rashtrakutas of Manyakheta gained control over Kannauj for a brief period during the early 10th century (Thapar 2003, p333)
  68. From the Siddalingamadam record of 944 – Krishna III captured Kanchi and Tanjore as well and had full control over northern Tamil regions (Aiyer in Kamath 2001, pp82–83)
  69. From the Tirukkalukkunram inscription – Kanchi and Tanjore were annexed by Krishna III. From the Deoli inscription – Krishna III had feudatories from Himalayas to Ceylon. From the Laksmeshwar inscription – Krishna III was an incarnation of death for the Chola Dynasty (Reu 1933, p83)
  70. Conqueror of Kanchi, (Thapar 2003, p334)
  71. Conqueror of Kanchi and Tanjore (Sastri 1955, p162)
  72. Sen 1999), pp374-375
  73. "Amoghavarsha IV"। 2007 Encyclopædia Britannica। সংগ্রহের তারিখ ২০০৭-০৪-২৫ line feed character in |শিরোনাম= at position 13 (সাহায্য); line feed character in |প্রকাশক= at position 5 (সাহায্য)
  74. The province of Tardavadi in the very heart of the Rashtrakuta empire was given to Tailapa II as a fief (provincial grant) by Rashtrakuta Krishna III for services rendered in war (Sastri 1955, p162)
  75. Kamath (2001), p101
  76. Kamath (2001), pp100–103
  77. Reu (1933), p39–41
  78. Keay (2000), p200
  79. Kamath (2001), p94
  80. Burjor Avari (2007), India: The Ancient Past: A History of the Indian Sub-Continent from c. 7000 BC to AD 1200, pp.207-208, Routledge, New York, আইএসবিএন ০-৪১৫-৩৫৬১৫-৪ ISBN বৈধ নয়
  81. Reu (1933), p93
  82. Reu (1933), p100
  83. Reu (1933), p113
  84. Reu (1933), p110
  85. Jain (2001), pp67–75
  86. Reu (1933), p112
  87. De Bruyne (1968)
  88. Majumdar (1966), pp50–51
  89. Pillay, K. (১৯৬৩)। "South India and Ceylon"। University of Madrasওসিএলসি 250247191
  90. whose main responsibility was to draft and maintain inscriptions or Shasanas as would an archivist. (Altekar in Kamath (2001), p85
  91. Kamath (2001), p86
  92. From the notes of Al Masudi (Kamath 2001, p88)
  93. Kamath (2001), p88
  94. Altekar (1934), p356
  95. Altekar (1934), p354
  96. Altekar (1934), p355
  97. From notes of Periplus, Al Idrisi and Alberuni (Altekar 1934, p357)
  98. Altekar (1934), p358
  99. Altekar (1934), p358–359
  100. Altekar (1934), p230
  101. Altekar (1934), p368
  102. Altekar (1934), p370–371
  103. Altekar (1934), p223
  104. Altekar (1934), p213
  105. From the Davangere inscription of Santivarma of Banavasi-12000 province (Altekar 1934, p234
  106. From the writings of Chandesvara (Altekar 1934, p216)
  107. Altekar (1934), p222
  108. From the notes of Al Idrisi (Altekar (1934), p223
  109. From the Begumra plates of Krishna II (Altekar 1934, p227
  110. Altekar (1934), p242
  111. From the writings of Somadeva (Altekar 1934, p244)
  112. From the Hebbal inscriptions and Torkhede inscriptions of Govinda III (Altekar 1934, p232
  113. "Wide and sympathetic tolerance" in general characterised the Rashtrakuta rule (Altekar in Kamath 2001, p92)
  114. Kamath (2001), p92
  115. Altekar in Kamath (2001), p92
  116. Reu (1933), p36
  117. The Vaishnava Rashtrakutas patronised Jainism (Kamath 2001, p92)
  118. Kamath (2001), p91
  119. Reu (1933), p34
  120. Reu (1933, p34
  121. The Rise and Decline of Buddhism in India, K.L. Hazara, Munshiram Manoharlal, 1995, pp288–294
  122. A 16th-century Buddhist work by Lama Taranatha speaks disparagingly of Shankaracharya as close parallels in some beliefs of Shankaracharya with Buddhist philosophy was not viewed favourably by Buddhist writers (Thapar 2003, pp 349–350, 397)
  123. From the notes of 10th-century Arab writer Al-Ishtakhri (Sastri 1955, p396)
  124. From the notes of Masudi (916) (Sastri 1955, p396)
  125. From the notes of Magasthenesis and Strabo from Greece and Ibn Khurdadba and Al Idrisi from Arabia (Altekar 1934, p317)
  126. From the notes of Alberuni (Altekar 1934, p317)
  127. Altekar (1934), p318
  128. From the notes of Alberuni (Altekar 1934, p324)
  129. From the notes of Alberuni (Altekar 1934, pp330–331)
  130. From the notes of Alberuni, Altekar (1934) p325
  131. From the notes of Abuzaid (Altekar 1934, p325)
  132. From the notes of Alberuni (Altekar 1934, p326)
  133. Altekar (1934), p329
  134. From the notes of Yuan Chwang, Altekar (1934), p331
  135. From the notes of Alberuni (Altekar 1934, p332, p334)
  136. From the notes of Ibn Khurdadba (Altekar 1934, p337)
  137. From the notes of Alberuni (Altekar 1934, p337)
  138. From the notes of Al Masudi and Al Idrisi (Altekar 1934, p339)
  139. From the Tarkhede inscription of Govinda III, (Altekar 1934, p339)
  140. Altekar (1934), p341
  141. From the notes of Alberuni (Altekar 1934, p342)
  142. From the notes of Sulaiman and Alberuni (Altekar 1934, p343)
  143. Altekar (1934), p345
  144. From the notes of Ibn Khurdadba (Altekar 1934, p346)
  145. Altekar (1934), p349
  146. Altekar (1934), p350
  147. Altekar (1934), p351
  148. From the notes of Ibn Kurdadba (Altekar 1934, p353)
  149. Warder A.K. (1988), p. 248
  150. Kamath (2001), p89
  151. "Mathematical Achievements of Pre-modern Indian Mathematicians", Putta Swamy T.K., 2012, chapter=Mahavira, p.231, Elsevier Publications, London, আইএসবিএন ৯৭৮-০-১২-৩৯৭৯১৩-১
  152. The Bedande and Chattana type of composition (Narasimhacharya 1988, p12)
  153. It is said Kavirajamarga may have been co-authored by Amoghavarsha I and court poet Sri Vijaya (Sastri 1955, pp355–356)
  154. Other early writers mentioned in Kavirajamarga are Vimala, Udaya, Nagarjuna, Jayabhandu for Kannada prose and Kavisvara, Pandita, Chandra and Lokapala in Kannada poetry (Narasimhacharya 1988, p2)
  155. Warder A.K. (1988), p240
  156. Sastri (1955), p356
  157. L.S. Seshagiri Rao in Amaresh Datta (1988), p1180
  158. Narasimhacharya (1988, p18
  159. Sastri (1955), p314
  160. Hardy (1995), p111
  161. Rajan, K.V. Soundara (১৯৯৮)। Rock-cut Temple Styles`। Mumbai, India: Somaily Publications। পৃষ্ঠা 19, 115–116। আইএসবিএন 81-7039-218-7।
  162. Takeo Kamiya। "Architecture of the Indian Subcontinent"। Gerard da Cunha-Architecture Autonomous, India। সংগ্রহের তারিখ ২০০৭-০৪-১৮
  163. Takeo Kamiya। "Architecture of the Indian Subcontinent,20 September 1996"। Gerard da Cunha-Architecture Autonomous, Bardez, Goa, India। সংগ্রহের তারিখ ২০০৬-১১-১০
  164. Hardy (1995), p327
  165. Vincent Smith in Arthikaje, Mangalore। "Society, Religion and Economic condition in the period of Rashtrakutas"। 1998–2000 OurKarnataka.Com, Inc। ২০০৬-১১-০৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৬-১২-২০
  166. Percy Brown and James Fergusson in Arthikaje, Mangalore। "Society, Religion and Economic condition in the period of Rashtrakutas"। 1998–2000 OurKarnataka.Com, Inc। ২০০৬-১১-০৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৬-১২-২০
  167. Kamath (2001), p93
  168. Arthikaje in Arthikaje, Mangalore। "Society, Religion and Economic condition in the period of Rashtrakutas"। 1998–2000 OurKarnataka.Com, Inc। ২০০৬-১১-০৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৬-১২-২০
  169. Vijapur, Raju S.। "Reclaiming past glory"Deccan Herald। Spectrum। সংগ্রহের তারিখ ২০০৭-০২-২৭
  170. Hardy (1995),p.341
  171. Hardy (1995),p344-345
  172. Sundara and Rajashekar, Arthikaje, Mangalore। "Society, Religion and Economic condition in the period of Rashtrakutas"। 1998–2000 OurKarnataka.Com, Inc। ২০০৬-১১-০৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৬-১২-২০
  173. Hardy (1995),p5 (introduction)
  174. Thapar (2002), pp393–4
  175. Thapar (2002), p396
  176. Vaidya (1924), p170
  177. Sastri (1955), p355
  178. Rice, E.P. (1921), p12
  179. Rice, B.L. (1897), p497
  180. Altekar (1934), p404
  181. Altekar (1934), p408

তথ্যসূত্র

বই

  • Altekar, Anant Sadashiv (১৯৩৪) [1934]। The Rashtrakutas And Their Times; being a political, administrative, religious, social, economic and literary history of the Deccan during C. 750 A.D. to C. 1000 A.D। Poona: Oriental Book Agency। ওসিএলসি 3793499
  • Chopra, P.N.; Ravindran, T.K.; Subrahmanian, N (২০০৩) [2003]। History of South India (Ancient, Medieval and Modern) Part 1। New Delhi: Chand Publications। আইএসবিএন 81-219-0153-7।
  • De Bruyne, J.L. (১৯৬৮) [1968]। Rudrakavis Great Poem of the Dynasty of Rastraudha। EJ Brill।
  • Dalby, Andrew (২০০৪) [1998]। Dictionary of Languages: The Definitive Reference to More Than 400 Languages। New York: Columbia University Press। আইএসবিএন 0-231-11569-5।
  • Hardy, Adam (১৯৯৫) [1995]। Indian Temple Architecture: Form and Transformation-The Karnata Dravida Tradition 7th to 13th Centuries। Abhinav Publications। আইএসবিএন 81-7017-312-4।
  • Houben, Jan E.M. (১৯৯৬) [1996]। Ideology and Status of Sanskrit: Contributions to the History of the Sanskrit language। Brill। আইএসবিএন 90-04-10613-8।
  • Jain, K.C. (২০০১) [2001]। Bharatiya Digambar Jain Abhilekh। Madhya Pradesh: Digambar Jain Sahitya Samrakshan Samiti।
  • Kamath, Suryanath U. (২০০১) [1980]। A concise history of Karnataka : from pre-historic times to the present। Bangalore: Jupiter books। এলসিসিএন 8095179 |lccn= এর মান পরীক্ষা করুন (সাহায্য)ওসিএলসি 7796041
  • Karmarkar, A.P. (১৯৪৭) [1947]। Cultural history of Karnataka : ancient and medieval। Dharwar: Karnataka Vidyavardhaka Sangha। ওসিএলসি 8221605
  • Keay, John (২০০০) [2000]। India: A History। New York: Grove Publications। আইএসবিএন 0-8021-3797-0।
  • Majumdar, R.C. (১৯৬৬) [1966]। The Struggle for Empire। Bharatiya Vidya Bhavan।
  • Masica, Colin P. (১৯৯১) [1991]। The Indo-Aryan Languages। Cambridge: Cambridge University Press। আইএসবিএন 0-521-29944-6।
  • Narasimhacharya, R (১৯৮৮) [1988]। History of Kannada Literature। New Delhi, Madras: Asian Educational Services। আইএসবিএন 81-206-0303-6।
  • Reu, Pandit Bisheshwar Nath (১৯৯৭) [1933]। History of the Rashtrakutas (Rathodas)। Jaipur: Publication Scheme। আইএসবিএন 81-86782-12-5।
  • Pollock, Sheldon (২০০৬) [2006]। The Language of the Gods in the World of Men: Sanskrit, Culture, and Power in Premodern India। Berkeley: University of California Press। আইএসবিএন 0-520-24500-8।
  • Rao, Seshagiri, L.S (১৯৮৮) [1988]। "Epic (Kannada)"। Amaresh Datta। Encyclopaedia of Indian literature – vol 2। Sahitya Akademi। আইএসবিএন 81-260-1194-7।
  • Rice, E.P. (১৯৮২) [1921]। Kannada Literature। New Delhi: Asian Educational Services। আইএসবিএন 81-206-0063-0।
  • Rice, B.L. (২০০১) [1897]। Mysore Gazatteer Compiled for Government-vol 1। New Delhi, Madras: Asian Educational Services। আইএসবিএন 81-206-0977-8।
  • Sastri, Nilakanta K.A. (২০০২) [1955]। A history of South India from prehistoric times to the fall of Vijayanagar। New Delhi: Indian Branch, Oxford University Press। আইএসবিএন 0-19-560686-8।
  • Sen, Sailendra Nath (১৯৯৯) [1999]। Ancient Indian History and Civilization। New Age Publishers। আইএসবিএন 81-224-1198-3।
  • Thapar, Romila (২০০৩) [2003]। Penguin History of Early India: From origins to AD 1300। New Delhi: Penguin। আইএসবিএন 0-14-302989-4।
  • Vaidya, C.V. (১৯৭৯) [1924]। History of Mediaeval Hindu India (Being a History of India from 600 to 1200 A.D.)। Poona: Oriental Book Supply Agency। ওসিএলসি 6814734
  • Warder, A.K. (১৯৮৮) [1988]। Indian Kavya Literature। Motilal Banarsidass। আইএসবিএন 81-208-0450-3।

ওয়েব

বহিঃসংযোগ

This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.