নেপালের ইতিহাস

বিস্তীর্ণ ভারতীয় উপমহাদেশ ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের ইতিহাস তথা দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ার ইতিহাসের সাথে জড়িয়ে আছে নেপালের ইতিহাস।

এটি একটি বহু জাতির, বহুসংস্কৃতির, বহু ধর্মের এবং বহুভাষার দেশ।নেপালের আসল কথ্য ভাষা নেপালী হলেও আরও বেশ কয়েকটি জাতিগত ভাষা রয়েছে।

বিংশ শতাব্দীতে এবং একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে নেপাল গনতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করেছিল। ১৯৯০ সাল থেকে শুরু করে ২০০৮ সাল পর্যন্ত দেশটি একটি গৃহদ্বন্দ্বে ভুগছিল।এরপর ২০০৬ সালে একটি শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং ওই একই বছরে নির্বাচন

অনুষ্ঠিত হয়। সাংবিধানিক নির্বাচনের জন্য নেপালের সংসদ ২০০৬ সালের জুন মাসে রাজতন্ত্রের অবসানের পক্ষে ভোট দেয়। নেপাল একটি ফেডারেল বা যুক্তরাষ্ট্রীয় প্রজাতন্ত্র হয়ে ওঠে এবং ২০০ বছরের পুরনো শাহ রাজবংশের পতন ঘটিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে নেপাল হয়ে ওঠে, 'যুক্তরাষ্ট্রীয় গণপ্রজাতান্ত্রিক নেপাল'।

স্থান পরিচিতি

টিসটুঙ্গে পাওয়া লিছ্ছবি যুগের শিলালিপিতে, স্থানীয় জনগণকে 'নেপালস' বলে সম্বোধন করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রাচীন যুগের নেপালের কিছু বা সমস্ত অধিবাসীরা সম্ভবত 'নেপালস' নামে পরিচিত ছিল।  যার অর্থ হল "নেপাল" শব্দটি জায়গা এবং ওখানকার অধিবাসীদের  উভয়কেই বোঝাতে  ব্যবহৃত  হয়েছিল। এইসব "নেপালস" দের  আজকের দিনের নিউয়ার প্রজন্মের পূর্বপুরুষ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। "নেপাল' এবং "নিউয়ার" শব্দদুটি  একই শব্দের বিভিন্ন রূপ। মধ্যযুগীয় গ্রন্থে পাওয়া অন্যান্য ভাগ গুলি হল "নেপার" এবং "নিউয়াল"।

নেপালে শব্দের উৎপত্তি কোথা থেকে এই ব্যাপারে অন্যান্য অনেক তত্ত্ব রয়েছে:

নেপ হল সেইসব মানুষেরা যারা গরু চরাত (গোপাল) এবং যারা আজকের দিনের ভারতের গঙ্গা সমভূমি থেকে নেপাল উপত্যকায় এসেছিলে  নেপ আর গোপাল এই দুটো শব্দের সমন্বয়ে তৈরি হয়েছে নেপাল!

সংস্কৃত শব্দ "নেপালয়া" মানে হল "পর্বতের পাদদেশে" বা "পাদদেশে বাসস্থান"। নেপাল শব্দটি এখান থেকেও আসতে পারে।

তিব্বতি শব্দ "নিয়ামপল" মানে হল "পবিত্র ভূমি"। নেপাল শব্দটি এখান থেকেও আসতে পারে।

উত্তর নেপালের কিছু অধিবাসীরা তিব্বত থেকে এসেছিল, যেখানে তারা ভেড়াপালন করত এবং তার থেকে উল তৈরি করত। তিব্বতি ভাষায়, "নে" শব্দের অর্থ হল "উল" এবং "পাল" শব্দের অর্থ হল "ঘর"। এইভাবে, নেপাল শব্দের অর্থ হল "উলের ঘর"।

আরও একটি জনপ্রিয় মতবাদ হল লেপচা লোকেরা "নে" (পবিত্র) এবং "পাল" (গুহা) শব্দদুটি ব্যবহার করত এবং তাই নেপাল শব্দের অর্থ "পবিত্র গুহা"।

বৌদ্ধ কিংবদন্তির মতে, দেবতা "মানজুসরি" নাগাদহ (একটি পৌরাণিক হ্রদ যা কাঠমান্ডু উপত্যকার ভরাট বলে মনে করা হয়) থেকে জল সরিয়ে দেয়। এরফলে উপত্যকাটি বাসযোগ্য হয়ে ওঠে এবং "ভূমিগুপ্ত" নামের এক গোপালক "নে" নামক এক ঋষি থেকে উপদেশ নিয়ে উপত্যকা শাসন করতে লাগলেন। "পালা" মানে হল "রক্ষাকর্তা" বা " যে যত্ন নিচ্ছে এমন"। তাই নেপালী পণ্ডিত ঋষিকেশ শাহের মতে, ওই ঋষি যেহেতু ওই স্থানটির যত্ন নিত তাই ওই দুই শব্দ থেকে নেপালের নাম এসেছে।

পূর্বইতিহাস

ড্যাং জেলার শিবালিক পাহাড়ে প্যালিওলিথিক, মেসোলিথিক এবং নিওলিথিকের যুগের প্রাগৈতিহাসিক স্থানগুলি আবিষ্কার করা হয়েছে। নেপাল ও তার আশেপাশের এলাকাগুলির প্রাচীনতম অধিবাসীরা সিন্ধু উপত্যকা থেকে এসেছিলেন। দ্রাবিড় জনগণের ইতিহাস ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রোঞ্জ যুগ (প্রায় ৩৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) শুরু হওয়ার থেকেও পুরনো। এটা এমনকি সীমান্ত থেকে তিব্বতি-বর্মা এবং ইন্দো-আর্যদের মতো অন্যান্য জাতিগত গোষ্ঠীগুলির আগমনেরও আগের। থেরাস, মিশ্র দ্রাবিড় এবং অস্ট্রো-এশিয়াটিক বৈশিষ্ট্যগুলির লোকেরা আসলে নেপালের কেন্দ্রীয় তরাই অঞ্চলের বনে বসবাসকারী অধিবাসী। কিরাত লোকেরা প্রায় ২০০০ বছর আগে তিব্বত থেকে এসেছিল এবং উত্তর নেপালে এসে বসবাস শুরু করেছিল। ইন্দো-আর্য বংশের অন্যান্য জাতিগত গোষ্ঠীর লোকেরা পরবর্তীকালে উত্তর ভারতের গাঙ্গেয় সমভূমি থেকে নেপালের দক্ষিণ অংশে গিয়ে বসবাস শুরু করে।

কিংবদন্তী এবং প্রাচীন কাল

নেপালের প্রাথমিক ইতিহাস সম্পর্কে খুব কমই জানা যায়। কিংবদন্তি এবং নথিবদ্ধ তথ্যসমূহ দিয়ে খ্রিস্টপূর্ব ৩০ শতক পর্যন্ত জানতে পারা যায় :

এছাড়াও, বাল্মীকি আশ্রমের মত ঐতিহাসিক স্থানগুলির উপস্থিতি প্রমাণ করে যে, সেই সময় নেপালের কিছু অংশে সনাতন (প্রাচীন) হিন্দু সংস্কৃতির অস্তিত্ব ছিল।

ইতিহাসের কিছু কিংবদন্তীদের মতে, গোপালবংশী / গোপাল বংশ বা "গোপালক পরিবার" প্রায় ৪৯১ বছর ধরে নেপালের অধিবাসীদের শাসন করেছিল। এটা মনে করা হয় যে এরপর মহাপল্লভ বংশ বা "মহিষপালক সাম্রাজ্য" নেপাল শাসন করেছিল এবং যে সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ভুল সিং নামে এক রাজপুত।

কিরাত রাজবংশ

কিরাতরা লিছছবি রাজবংশের আগে এবং মহীসপাল বা আভির রাজবংশের পরে নেপাল শাসন করেছিল বলে বিভিন্ন পাণ্ডুলিপিতে পাওয়া যায়। সুন কোসি এবং তমা কোসি নেপালকে তাদের দেশীয় ভূমি হিসাবে উল্লেখ করে, এছারাও কিরাত রাজাদের তালিকা গোপাল বংশতালিকায় পাওয়া যায়। আভির রাজবংশের শেষ রাজা ভুবনসিংহকে যুদ্ধে  পরাজিত করে, কিরাত রাজা ইয়ালুং বা ইয়ালামবার উপত্যকায় নিজের দখল কায়েম করেন। হিন্দু পৌরাণিকে এই ঘটনাটি দ্বাপরযুগের শেষ পর্যায়ে বা কলিযুগের প্রাথমিক পর্যায়ে বা খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে ঘটেছিল বলে মনে করা হয়। আমরা গোপাল বংশতালিকা, ভাষার ভিত্তিতে পাওয়া বংশতালিকা এবং বিভিন্ন  

লেখকদের মতানুসারে যথাক্রমে ৩২, ২৮ এবং ২৯ জন  কিরাত রাজাদের বর্ণনা পাওয়া যায়। পূর্ব ও পশ্চিমের অন্যান্য জায়গায় উল্লেখিত তথ্যের  মাধ্যমে জানা যায় যে ২০০০ থেকে ২৫০০ বছর আগে কিরান্তি জনগণ তাদের বর্তমান আবাসস্থলে এসেছে এবং তাদের ক্ষমতা মহান ছিল। তাদের কর্তৃত্ব ব্যাপক ছিল যে একসময় সেটা সম্ভবত গাঙ্গেয় বদ্বীপ অঞ্চলেও পৌঁছেছিল।

লিছছবি রাজবংশ

কিরাত রাজবংশের পরে লিছছবি রাজবংশের ( যা আধুনিক ভারতের  বিহারের বৈশালী থেকে উদ্ভূত) রাজারা নেপালকে শাসন করেছিল বলে জানা যায়। 'সূর্যবংশীয় ক্ষত্রিয়রা কিরাতকে পরাজিত করে নতুন শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন' বলে বিভিন্ন বংশবৃতান্তে ও পুরাণে পাওয়া যায়। এটি গোপাল বংশবৃতান্তে লিখিত আছে যে, " সূর্যবংশীয়দের প্রভাব নিয়ে কিরাত রাজাকে পরাজিত করে, নেপালে লিছছবি রাজবংশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।"  অনুরূপভাবে, পশুপতী পুরাণে লেখা আছে যে, বৈশালীর রাজারা মিষ্টি কোথায় ভুলিয়ে কিরাতদের যুদ্ধে পরাজিত করে তাদের নিজদের শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। প্রায় একই কথা "হিমবাতখন্ড"তেও পাওয়া যায়। সেই পুরাণটি উল্লেখ করে যে "বৈশালীর রাজারা কিরাতকে পরাজিত করে নেপালে শাসন শুরু করেছিলেন।" এভাবে, কিরাত রাজবংশের শাসনের পরেই লিছছবি শাসন শুরু হয় বলে মনে করা হয়। যাইহোক, বিভিন্ন বংশবৃতান্তে শেষ কিরাত রাজার একাধিক নাম পাওয়া যায়। লেখকদের বংশানুক্রমিক অনুসারে "গস্তি", ভাষা বংশানুক্রমিক অনুসারে "গালিজ" এবং গোপাল বংশানুক্রমিক অনুসারে "খিগু" কিরাত রাজাকে পরাজিত করে নেপালের লিছছবি রাজবংশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

সিমরুন রাজবংশ

সিমরুন, কারনাত বা দেব রাজবংশটি ১০৯৭ খ্রিষ্টাব্দে বর্তমানে বারা জেলার সিমরুনগড়ে সদরঘাট প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে স্থাপিত হয়েছিল। এই রাজবংশটি বর্তমান নেপাল ও ভারতের বিহারের তিরহুট বা মিথিলার মতো এলাকাগুলিতে রাজত্ব করত। সিমরুনগড়ের শাসকদের নাম নিম্নরূপ:

নানিয়া দেব - ১০৯৭ - ১১৪৭ খ্রিষ্টাব্দ

গঙ্গা দেব - ১১৪৭ - ১১৮৭ খ্রিষ্টাব্দ

নরসিংহ দেব - ১১৮৭ - ১২২৭ খ্রিষ্টাব্দ

রামসিংহ দেব - ১২২৭-১২৮৫ খ্রিষ্টাব্দ

শক্তিসিংহ দেব - ১২৮৫ -১২৯৫ খ্রিষ্টাব্দ

হরিসিংহ দেব - ১২৯৫ - ১৩২৪ খ্রিষ্টাব্দ

13২4 খ্রিষ্টাব্দে গিয়াসুদ্দীন তুঘলক সিমরুনগড় আক্রমণ করেন এবং দুর্গ ধ্বংস করেন। অবশিষ্টাংশ এখনও পুরো সিমরুনগড় অঞ্চলে ছড়িয়ে রয়েছে। রাজা তখন উত্তরদিকে এবং তারপর নেপালে পালিয়ে গেলেন। হরিসিংহ দেবের পুত্র, জগৎসিংহ দেব ভক্তপুরের বিধবা রাজকুমারী নায়ক দেবীকে বিয়ে করেছিলেন।

ঠাকুরি রাজবংশ

ঠাকুরি রাজাদের শাসন

ঠাকুরি রাজবংশ হল রাজপুত বংশীয়। আরামুদির পরে, ঠাকুরি রাজারা দ্বাদশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন অংশে শাসন করেছিলেন বলে কাশ্মিরের ইতিহাস নিয়ে লেখা "কলহন" এর "রাজতরঙ্গিনী"তে (১১৫০ খ্রিস্টাব্দ) উল্লেখ আছে। মনে করা হয় যে, রাঘব দেব ৮৭৯ খ্রিস্টাব্দে লিছছবি শাসনের অবসান ঘটিয়ে ঠাকুরি রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার স্মরণে রঘু দেব ২০ শে অক্টোবর, ৮৭৯ খ্রিস্টাব্দে "নেপাল যুগ" এর শুরু করেন। ৬০৫ খ্রিষ্টাব্দ থেকে শাসনকারী অমশূবর্মার পর ঠাকুরিরা ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিল এবং তারা ৮৬৯ খ্রিষ্টাব্দে পুনরুদ্ধার করতে পেরেছিল।

গুণকাম দেব

রাজা রাঘব দেবের মৃত্যুর পর, দ্বাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত অনেক ঠাকুরি রাজা দক্ষিণ নেপালকে শাসন করেন। সেই সময়ের মধ্যে, গুণকাম দেব বিখ্যাত রাজাগুলির মধ্যে একজন ছিলেন। তিনি 949 থেকে 994 খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত শাসন করেন। তার শাসনকালে, একটিমাত্র গাছ থেকে একটি বড় কাঠের বাড়ি তৈরি করা হয়েছিল, যাকে "কাষ্ঠমণ্ডপ" বলে ডাকা হয়, তার এইরকম নাম থেকেই নেপালের রাজধানী "কাঠমান্ডু" নামটি এসেছে।  গুণকাম দেব, কান্তিপুর নামে একটি শহর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যা আজকের দিনে "কাঠমান্ডু" নামে পরিচিত। গুণকাম দেবই প্রথম "ইন্দ্র যাত্রা" উৎসব শুরু করেছিলেন। তিনি পশুপতিনাথ মন্দিরের উত্তর অংশে অবস্থিত মন্দির মেরামত করেছিলেন। তিনি কৃষ্ণ যাত্রা এবং লক্ষী যাত্রাও চালু করেছিলেন। তিনি "কটিহমা" শুরু করেছিলেন।

গুণকাম দেবের উত্তরসূরী  

গুণকাম দেবের পরেই এসেছিলেন ভোলা দেব। পরবর্তী শাসক লক্ষ্মীকাম দেব ১০২৪ থেকে ১০৪০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত শাসন করেছিলেন। তিনি "লক্ষ্মী বিহার" নির্মাণ করেছিলেন এবং কুমারী মেয়েকে পূজা করার প্রথার সূচনা করেছিলেন। তারপর,লক্ষ্মীকামের পুত্র বিজয়কাম দেব নেপালীদের রাজা হন। বিজয়কাম দেব এই রাজবংশের শেষ শাসক ছিলেন। তিনি "নাগ" এবং "বাসুকি" কে পূজা করা শুরু করেন। তার মৃত্যুর পর, নুওয়াকোট এর ঠাকুরি উপজাতি নেপালের সিংহাসন দখল করে।  

নুওয়াকোট এর ঠাকুরি রাজারা  

নুওয়াকোট এর ঠাকুরি ভাস্কর দেব, বিজয়কাম দেব এর পরবর্তী শাসক এবং তিনি নুওয়াকোট-ঠাকুরি শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি "নববহল" ও "হেমবর্ণ বিহার" নির্মাণ করেছিলেন। ভাস্কর দেবের পরে পরে এই বংশের চারজন রাজা পুরো দেশ শাসন করেছিল। তারা হলেন বাল দেব, পদ্ম দেব, নাগারজুন দেব ও শঙ্কর দেব।

শঙ্কর দেব (১০৬৭-১০৮০ খ্রিষ্টাব্দ) এই রাজবংশের সবচেয়ে বিখ্যাত শাসক ছিলেন। তিনিই "শান্তেশ্বর মহদেব" এবং "মনোহর ভগবতী" নামে ছবি দুটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। নাগপঞ্চমীর দিনে ঘরের দরজাগুলিতে নাগ ও বাসুকির ছবি আঁকার প্রথা তার আমলেই শুরু হয়েছিল। তার সময়কালেই, বৌদ্ধরা হিন্দু ব্রাহ্মণদের (বিশেষ করে যারা শৈব ছিলেন) শঙ্করচার্য থেকে প্রাপ্ত অত্যাচারের প্রতিশোধ নিয়েছিল। শঙ্কর দেব বৌদ্ধদের দ্বারা নির্যাতিত ব্রাহ্মণদের রক্ষা করার চেষ্টা করেছিলেন।

সূর্যবংশী (সৌর রাজবংশ)

অমশুবর্মের বংশধর বামা দেব, ১০৮০ খ্রিষ্টাব্দে শঙ্কর দেবকে পরাজিত করেন। তিনি নুওয়াকোট-ঠাকুরিদের দমন করেন এবং নেপালে দ্বিতীয়বারের মত পুরনো সূর্য রাজবংশের শাসন পুনরুদ্ধার করেছিলেন। বামা দেবের উত্তরাধিকারী হর্ষ দেব একজন দুর্বল শাসক ছিলেন। সমাজে গন্যমান্যদের মধ্যে কোন ঐক্য ছিল না এবং তারা নিজেরা একে অপরের উপর প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে জোর দিয়েছিল। সেই সুযোগটি গ্রহণ করে, কর্ণাট রাজবংশের রাজা নান্না দেব, সিমরুনগড় থেকে নেপাল আক্রমণ করেন।এর প্রত্যুত্তরে নেপালের সেনাবাহিনী বীরের মত যুদ্ধ করে জয়লাভ করে এবং সফলভাবে নেপালকে বিদেশি আক্রমণ থেকে রক্ষা করেছিল।

তৃতীয় শিবদেব

হার্শা দেবের পর, রাজা তৃতীয় শিবদেব ১০৯৯ থেকে ১১২৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত  শাসন করেন। তিনি একজন সাহসী এবং শক্তিশালী রাজা ছিলেন। তিনি কিরতিপুর শহরটি প্রতিষ্ঠা করেন এবং পশুপতিনাথ মন্দিরের  ছাদ সোনা দিয়ে বাধান। তিনি পঁচিশ পয়সার মুদ্রা চালু করেছিলেন। তিনি বিভিন্ন জায়গায় কুয়ো, খাল ও জলাধার নির্মাণ করেন।

তৃতীয় শিবদেবের পরে ক্রমান্বয়ে মহেন্দ্র দেব, মান দেব, দ্বিতীয় নরেন্দ্র দেব, আনন্দ দেব, রুদ্র দেব, অমৃত দেব, দ্বিতীয় রত্ন দেব, সোমেশ্বর দেব, দ্বিতীয় গুণকাম দেব, তৃতীয় লক্ষ্মীকাম দেব এবং দ্বিতীয় বিজয়কাম দেব নেপালকে শাসন করেন। বিভিন্ন রাজাদের শাসন এবং তাদের নিজ নিজ সময়কাল সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের আলাদা আলাদা মতামত রয়েছে। ঠাকুরি রাজবংশের পতনের পর, অরি দেব বা অরি মল্ল একটি নতুন রাজবংশ প্রতিষ্ঠিত করেন, যা "মল্ল রাজবংশ" নামে পরিচিত।

মল্ল রাজবংশ

দ্বাদশ শতাব্দীতে অরি মল্লার সঙ্গে মল্ল শাসন শুরু হয়েছিল। পরবর্তী দুই শতাব্দী জুড়ে তার রাজত্ব ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করে, প্রধানত ভারতীয় উপমহাদেশ এবং ছোট ছোট রাজ্যে বিভক্ত (পরে, যা পরে বাইশ রাজ্য নামে পরিচিত হয়) হয়ে যাওয়ার আগে পশ্চিম তিব্বতের বেশিরভাগ অঞ্চলে।

জয়স্থিতি মল্লর সঙ্গে সঙ্গে কাঠমুন্ডু উপত্যকায় পরবর্তী মল্ল রাজবংশ ১৮ শতকের শেষদিকে রাজত্ব করতে শুরু করে। রাজা পৃথ্বী নারায়ণ শাহ ইন্দ্র যাত্রা উৎসবের দিনে কাঠমান্ডু দখল করেন। ১২ শতক থেকে শুরু করে ১৮ শতক পর্যন্ত (শাসনকালের প্রায় 600 বছর) শাসন করা মল্ল রাজবংশ হল দীর্ঘতম শাসক রাজবংশ। উপত্যকায় এই যুগ বিভিন্ন সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংস্কার যেমন উপত্যকায় জনগণের সংস্কৃতকরণ, ভূমি পরিমাপ ও বরাদ্দকরণের নতুন পদ্ধতি ইত্যাদির জন্য বিখ্যাত। এই যুগে নতুন শিল্প ও স্থাপত্য চালু হয়েছিল। কাঠমান্ডু উপত্যকায় থাকা স্মৃতিস্তম্ভগুলি যা

বর্তমানে ইউনেস্কোর তালিকাভুক্ত, তা মল্ল শাসনকালেই নির্মিত হয়েছিল। চতুর্দশ শতাব্দীতে, কাঠমান্ডু প্রধান তিনটি রাজ্যে বিভক্ত হয়ে যাওয়ার আগে, আরানিকো শিল্প ও স্থাপত্যের দক্ষতার প্রতিনিধিত্ব করার জন্য অভয় মল্লর অনুরোধে চীনে যান এবং তিনি স্থাপত্যের প্যাগোডা স্টাইলটি চীন এবং পরবর্তীকালে পুরো এশিয়াতে উপস্থাপিত করেন। জয়স্থিতি মল্লর নাতি যক্ষ মল্ল পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত কাঠমান্ডু উপত্যকা শাসন করেছিলেন। তার মৃত্যুর পর, উপত্যকাটি প্রায় ১৪৮৪ খ্রিষ্টাব্দে কাঠমুন্ডু, ভক্তপুর ও পাটান- এই তিনটি স্বাধীন রাজ্যে বিভক্ত হয়ে যায়। এর ফলে মল্ল শাসকদের নিজেদের মধ্যে আঞ্চলিক ও বাণিজ্যিক লাভ কায়েম করার জন্য অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষ ও যুদ্ধ শুরু হয়। পারস্পরিক যুদ্ধগুলি ধীরে ধীরে তাদের দুর্বল করে দেয়, যার ফলে গোর্খার রাজা পৃথ্বী নারায়ণ শাহ কাঠমান্ডু উপত্যকায় যুদ্ধে সহজে জয় লাভ করেন। শেষ মল্ল শাসকগণ ছিলেন জয় প্রকাশ মল্ল, তেজ নরসিংহ মল্ল এবং রঞ্জিত মল্ল যথাক্রমে কাঠমান্ডু, পাটান এবং ভক্তপুর রাজত্বের।  

শাহ রাজবংশ এবং নেপালের একীকরণ

পৃথ্বী নারায়ণ শাহ (১৭৭৯-১৮৭৫ খ্রিষ্টাব্দ), যার সঙ্গে আমরা নেপাল ইতিহাসের আধুনিক যুগে প্রবেশ করি তিনি গোর্খা শাসকগোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা দ্রাব্য শাহের (১৫৫২-১৫৭০ খ্রিষ্টাব্দ) নবম প্রজন্মের বংশধর ছিলেন। 1743 খ্রিষ্টাব্দে পৃথ্বী নারায়ণ শাহ তার পিতার নারা ভূপাল শাহকে গোর্খার সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করেছিলেন। রাজা পৃথ্বী নারায়ণ শাহ উপত্যকা রাজ্যের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং এর পাশাপাশি "বাইশে" এবং "চাউবিশি" রাজ্যের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কেও সচেতন ছিলেন। তিনি ভবিষ্যতে টিকে থাকার জন্য জরুরি অবস্থা হিসাবে ক্ষুদ্র রাজত্বগুলিকে অধিগ্রহণ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন এবং তারপর তিনি নিজেকে সেই কাজেই লিপ্ত করেছিলেন।

পাহাড় রাজ্যেগুলির মধ্যে পরিস্থিতি সম্পর্কে তার মূল্যায়ন সঠিক ছিল, এবং তিনি বেশ সহজভাবেই তা করায়ত্ত করেছিলেন। রাজা পৃথ্বী নারায়ণ শাহের বিজয় অভিযান ১৭৪৪ খ্রিষ্টাব্দে কাঠমান্ডু ও গোর্খার মধ্যে অবস্থিত  নুওয়াকোট বিজয় লাভের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিল। নুওয়াকোটের পর তিনি কাঠমান্ডু উপত্যকায় আশেপাশের পাহাড়গুলিতে কৌশলগত ভাবে উল্লেখযোগ্য জায়গাগুলি দখল করেছিলেন। বাইরের জগতের সাথে উপত্যকার যোগাযোগ এভাবে বন্ধ হয়ে গেল। ১৭৫৬ খ্রিষ্টাব্দে কুটি পাস দখলের মধ্য দিয়ে তিব্বতের সাথে উপত্যকায় বাণিজ্য যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। অবশেষে, পৃথ্বী নারায়ণ শাহ উপত্যকায় প্রবেশ করেন। কীর্তিপুরের বিজয়ের পর কাঠমান্ডুর রাজা জয় প্রকাশ মল্ল ব্রিটিশদের কাছ থেকে সাহায্য প্রার্থনা করেন এবং এর ফলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭৬৭ সালে ক্যাপ্টেন কিনলকের অধীনে একটি সেনাদল পাঠায়। রাজা পৃথ্বী নারায়ণ শাহের সেনাবাহিনীর দ্বারা সিন্ধুলিতে ব্রিটিশ বাহিনী পরাজিত হয়েছিল। ব্রিটিশদের এই পরাজয় সম্পূর্ণরূপে রাজা জয় প্রকাশ মল্লের আশা ভেঙ্গে দেয়। কাঠমান্ডুর অধিগ্রহণ (২৫ সেপ্টেম্বর, ১৭৬৮) খুব নাটকীয় ছিল। কাঠমান্ডুর মানুষ যখন ইন্দ্রযাত্রা উৎসব উদযাপন করছিল তখন পৃথ্বী নারায়ণ শাহ ও তার লোকেরা শহরে ঢুকেছিল। কাঠমান্ডুর রাজার প্রাসাদের আঙ্গিনায় একটি সিংহাসন বসানো হয়েছিল। পৃথ্বী নারায়ণ শাহ এরপর সিংহাসনে বসেছিলেন। জয়া প্রকাশ মল্লা কোনভাবে নিজের জীবন বাঁচান এবং পালিয়ে গিয়ে পাটানে আশ্রয় নেন। কয়েক সপ্তাহ পর যখন পাটানকেও দখল করা হয়, তখন জয় প্রকাশ মল্ল এবং পাটানের রাজা  তেজ নরসিংহ মল্ল ভক্তপুরে আশ্রয় নিয়েছিলেন। কিছুদিন পর ভক্তপুরকেও দখল করা হয়। এইভাবে, কাঠমান্ডু উপত্যকায় রাজা পৃথ্বী নারায়ণ শাহ রাজত্ব শুরু করেন এবং ১৭৬৯ সালে আধুনিক নেপালের রাজধানী হয়ে ওঠে কাঠমান্ডু।

1794 খ্রিষ্টাব্দে পৃথীবী নারায়ণ শাহের সৈন্যরা নুওয়াকোট সম্পূর্ণরূপে জয়লাভ করে যা বীরাজ থাপা কর্তৃক পরিচালিত হয়েছিল, কিন্তু তারা নিম্নলিখিত কারণে খুব খারাপভাবে পরাজিত হয়েছিল:

তুলসী নদী

অস্ত্র ও গোলাবারুদ অভাব

প্রশিক্ষিত সৈন্যদের অভাব

গভীর ভাবনাচিন্তা এবং পরিকল্পনার অভাব

রাজা পৃথ্বী শাহ ১৭৪০ খ্রিষ্টাব্দে রাপতি অঞ্চলে বাইসে-রাজ্যের বিভিন্ন অংশগুলি একত্রিত করতে শুরু করেছিলেন। ১৭৬৩ খ্রিষ্টাব্দে, তুলসিপুর-ড্যাং রাজ্যের পতন ঘটে এবং ১৭৭৫ খ্রিষ্টাব্দে, তুলসিপুরের চৌহান রাজা নল সিং সম্পূর্ণরূপে পরাজিত হন। রাজা পৃথ্বী্র কাছে তার উত্তরের পাহাড়ি অঞ্চল হারানোর পর, চৌহান রাজা নল সিং দক্ষিণের অঞ্চলে (যা বর্তমানে ভারতের ভারতে তুলসিপুর / বলরামপুর) যেতে বাধ্য  হয়েছিলেন  এবং আউধের বৃহত্তম তালুকদারের মধ্যে একজন হিসাবে শাসন শুরু করেছিলেন।  

রাজা পৃথ্বী নারায়ণ শাহ বিভিন্ন ধর্মীয়-জাতিগত গোষ্ঠীকে এক জাতির অধীনে একত্রিত করতে সফল হন। তিনি একজন সত্যিকারের জাতীয়তাবাদী ছিলেন এবং ব্রিটিশদের ব্যাপারে আপোষহীন নীতি গ্রহণের পক্ষে ছিলেন। নেপালের ভূতাত্ত্বিক প্রেক্ষাপটে তার নেওয়া সামাজিক ও অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তগুলি দীর্ঘদিন ধরে দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নতিতে সহায়তা করে তাই নয়, এইরকম ভুরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য দেশের বৈদেশিক নীতির মূল নির্দেশিকাও গঠন করেন। কিন্তু বর্তমান যুগে পাশাপাশি থাকা দুটি বৃহৎ দেশের মধ্যে সংযোগ হিসাবে নেপালকে করা হয় যাতে নেপাল উভয় দেশ থেকে সুবিধা পেতে সক্ষম হয়।

নেপালের রাজত্ব

গোর্খা শাসন

বিভিন্ন রাজ্যের রাজাদের নিজেদের মধ্যে কয়েক দশক ধরে প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলার পর, আধুনিক নেপাল আঠারো শতকের শেষভাগে এসে একীভূত হয়েছিল, যখন গোর্খার এক ছোট রাজ্যের শাসক পৃথ্বী নারায়ণ শাহ বেশ কয়েকটি স্বাধীন পাহাড়ি রাজ্যেগুলিকে নিয়ে একটি ঐক্যবদ্ধ দেশ গঠন করেছিলেন। পৃথ্বী নারায়ণ শাহ অল্প বয়সে কাঠমান্ডু উপত্যকায় একটি একক রাষ্ট্র গঠনের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন এবং ১৭৬৮ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে অস্থায়ী জোট গঠন করেন যাতে কোম্পানি গোর্খা রাজ্যে গোলাবারুদ সরবরাহ করে।

দেশটি গোর্খা সাম্রাজ্য নামে পরিচিত ছিল। এই প্রসঙ্গে একটি ভুল ধারণা আছে যে গোর্খালিরা নেপালের গোর্খা অঞ্চল থেকে নিজেদের নাম গোর্খা গ্রহণ করেছিল। প্রকৃতপক্ষে, গোর্খালিরা এই অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার পরে অঞ্চলটি গোর্খা সাম্রাজ্য নামে পরিচিতি পায়।

শাহের মৃত্যুর পর শাহ রাজবংশ তাদের রাজ্যকে ভারতীয় উপমহাদেশে বিস্তৃত করতে শুরু করে। ১৭৮৮ থেকে ১৭৯১ সালের মধ্যে, চীন-নেপাল যুদ্ধের সময়, নেপাল তিব্বত আক্রমণ করে এবং শিগাটসে তে থাকা তাসিহুন্পো মঠ লুট করে। এরফলে চীনের কিং রাজবংশের সম্রাট কিংয়ান লং তিব্বত অভিযানের জন্য ফুকুআংগান কে কমান্ডার-ইন-চীফ নিযুক্ত হন। ফুকুআংগান তার সৈন্যদেরকে রক্ষা করার জন্য একটি তাই চুক্তি স্বাক্ষর করেন। পরে নেপালি বাহিনী বিজয়ী হয় প্রধানমন্ত্রী জং বাহাদুর রানার নির্দেশে।

১৮০০ সালের পর পৃথ্বী নারায়ণ শাহের উত্তরাধিকারীরা নেপালে দৃঢ় রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে অক্ষম হন। এইসময় এক অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা দেখা দেয়। নেপাল এবং ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মধ্যে যে বৈরিতা চলছিল তার ফলে নেপাল ও ব্রিটিশ-ভারত সীমান্তবর্তী রাজ্যে অবশেষে অ্যাংলো-নেপালি যুদ্ধ (১৮১৪-১৬) সংঘটিত হয়েছিল, যে যুদ্ধে নেপাল পরাজিত হয়। ১৮১৬ খ্রিষ্টাব্দে সুগৌলি চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয় যার ফলস্বরুপ নেপাল দ্বারা নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলগুলির বৃহৎ অংশ ব্রিটিশদের অধীনে চলে যায়।  

রানা রাজত্ব

এই রাজবংশের প্রথম শাসক ছিলেন জং বাহাদুর রানা। রানা শাসকদের শিরোনাম ছিল "শ্রী তীণ" এবং "মহারাজা", অপরপক্ষে শাহ রাজাদের শিরোনাম ছিল "শ্রী পঞ্চ" এবং "মহারাজাধীরাজ"। রানা রাজবংশ এবং শাহ রাজবংশ উভয়েই ছিল হিন্দু রাজপুত। জং বাহাদুর আইন সংশোধন করেছিলেন এবং রাষ্ট্রীয় আমলাতন্ত্রকে আধুনিকীকরণ করেছিলেন। 1885 সালের অভ্যুত্থানে, জং বাহাদুর ও রণদীপ সিংয়ের ভাগ্নে, রণদীপ সিংকে এবং জং বাহাদুরের পুত্রকে খুন করেন। এরপর তিনি জং বাহাদুরের নাম নিয়ে নেপালের ক্ষমতা দখল করেন। নয়জন রানা শাসক প্রধানমন্ত্রীর উত্তরাধিকারী অফিস গ্রহণ করেন। এরা সবাই লামজুং এবং কাস্কির স্বঘোষিত মহারাজা ছিলেন।  

রানা শাসন ছিল একটি কেন্দ্রীয় স্বৈরাচার শাসন  এবং তেনারা বাইরের প্রভাব থেকে নেপালকে আলাদা করার নীতি অনুসরণ করে। এই নীতি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক যুগে নেপালকে তার জাতীয় স্বাধীনতা বজায় রাখতে সাহায্য করেছিল। কিন্তু এটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং আধুনিকীকরণকে বাধা দেয়। রানারা ১৮৭৬ সালের ভারতীয় বিদ্রোহের সময় ও পরে দুটো বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশদের সমর্থক ছিল এবং ব্রিটিশদের সহায়তা করেছিল। চীনাদের দাবি অনুসারে, বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে ব্রিটিশরা নেপালিদের স্বাধীনতাকে সমর্থন করেছিল।

১৮১৬ সালে সাক্ষরিত সুগোলি চুক্তি উঠিয়ে দিয়ে ১৯২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে ব্রিটেন ও নেপাল আনুষ্ঠানিকভাবে "চিরস্থায়ী শান্তি ও বন্ধুত্বের চুক্তি" স্বাক্ষর করে এবং কাঠমান্ডুর ব্রিটিশ অধিবাসীদের জন্য একজন দূতকে  নিয়োগ করে।

১৯২৪ সালে চন্দ্র শামশের জং বাহাদুর রানার অধীনে নেপালে দাসত্ব প্রথার বিলোপ ঘটে।

পোল্যান্ডের জার্মান আক্রমণের পর, নেপাল ৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দে জার্মানির সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করে। জাপান এই সংঘর্ষে প্রবেশ করলে, নেপালি সেনাদের ১৬ টি ব্যাটালিয়ন বর্মা ফ্রন্টে যুদ্ধ করে। সামরিক সহায়তার পাশাপাশি নেপাম বন্দুক, সরঞ্জাম, হাজার হাজার পাউন্ড চা, চিনি ও কাঁচামাল ইত্যাদি সরবরাহ করে।

১৯৫১ এর বিপ্লব

প্রধান নিবন্ধ: নেপালে গণতন্ত্র আন্দোলন

১৯৫১ সালের বিপ্লব শুরু হয়েছিল যখন রানা পরিবারের পারিবারিক শাসনের বিরুদ্ধে কিছু শিক্ষিত লোকের মধ্যে অসন্তুষ্টি দেখা দিয়েছিল। যারা বিভিন্ন দক্ষিণ এশীয় স্কুল ও কলেজে পড়াশুনা করেছিল। এমনকি, রানাদের নিজেদের মধ্যে থেকেও, অনেকে ক্ষমতাসীন রানাদের প্রতি অসন্তুষ্ট হয়েছিল। নির্বাসিত নেপালিদের অনেকেই ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিল এবং তারা নেপালকে স্বৈরাচারী রানাশাসন থেকে মুক্ত করতে চেয়েছিল। ইতিমধ্যে বি পি কৈরালা, গণেশ মান সিং, সুবর্ণ সামশের রানা, কৃষ্ণ প্রসাদ ভট্টরাই, গিরিজা প্রসাদ কৈরালা, এবং অন্যান্য দেশপ্রেমী নির্বাসিত নেপালি নেতাদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল প্রজাপরিষদ ও নেপালি কংগ্রেসের মতো রাজনৈতিক দলগুলি, যারা স্বৈরাচারী রানা শাসনকে উৎখাত করতে সামরিক অভ্যুত্থান ও রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন। এভাবে নেপালী কংগ্রেস তার নিজের সামরিক বাহিনী গঠন করেছিলেন "নেপালি কংগ্রেস লিবারেশন আর্মি" নামে। রানাদের হাতে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার জন্য প্রধান শহীদদের মধ্যে ধর্ম ভক্ত মাথমা, শুক্ররাজ শাস্ত্রী, গঙ্গালাল শ্রেষ্ঠতা, এবং দশরাথ চাঁদ ছিলেন প্রজা পরিষদের সদস্য। । এই অশান্তি চরম পরিনতি পায় যখন রাজা ত্রিভুবন, যিনি পৃথ্বী নারায়ণ শাহের প্রত্যক্ষ বংশধর, ১৯৫০ সালে "রাজ কারাগার" থেকে পালিয়ে ভারতে পালিয়ে যান। এই ঘটনার ফলে শাহ পরিবারের নেপালে ক্ষমতায় আসার স্বপ্ন চিরতরে শেষ হয়ে যায়। একই সঙ্গে "দিল্লি সমঝোতা" নামে স্বাক্ষরিত এক ত্রিপক্ষীয় চুক্তি অনুসারে অ-রানা প্রধানমন্ত্রী  নিয়োগের স্বপ্নও শেষ হয়ে যায়।এই সময় হল আধো-সাংবিধানিক শাসনের একটি সময়, যে সময়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলির নেতাদের সহায়তায় শাসন চলছিল। ১৯৫০ এর দশকে, নেপালের সংবিধান প্রণয়নের জন্য প্রচেষ্টা করা হয়েছিল যা মূলত ব্রিটিশ মডেলের উপর ভিত্তি করে তৈরি হবে।  প্রধানমন্ত্রী মোহন শামসের এর নেতৃত্বে 10 সদস্যের ক্যাবিনেট গঠন করা হয় যার মধ্যে ৫ জন রানা ও বাকী ৫ জন নেপালি কংগ্রেসের সদস্য ছিলেন।  এই সরকার "অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আইন" নামে একটি সংবিধান প্রণয়ন করেছিল যা ছিল নেপালের প্রথম সংবিধান। কিন্তু এই সরকারও  রানাদের  মতো ভেঙ্গে পড়ে এবং কংগ্রেসম্যানরা কখনো ভাল অবস্থায় ছিলেন না। তাই, ১ মংসির ২০০৮ বিএস (নেপালি ক্যালেন্ডার) এতে, রাজা ১৪ মন্ত্রীর নতুন সরকার গঠন করেন যেটা পরে আবার ভেঙ্গে যায়। পরে শরওয়ান ২০০৯ বিএস এতে রাজা ৫ সদস্যের কাউন্সিলর সরকার গঠন করে যা আবার ব্যর্থ হয়েছিল।

রাজা মহেন্দ্রের রাজকীয় অভ্যুত্থান

সংসদীয় গণতন্ত্রের ব্যর্থতা ঘোষণার পর ১৮ মাস পরে ১৯৬০ সালে রাজা মহেন্দ্র একটি রাজকীয় অভ্যুত্থান পরিচালনা করেন। তিনি নির্বাচিত কৈরালা সরকারকে বরখাস্ত করেন, ঘোষণা করেন যে "পার্টিহীন" ব্যবস্থা নেপালে শাসন করবে এবং ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৬০ সালে একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন করবে।

এরপরে, নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী, সংসদ সদস্য এবং শত শত গণতান্ত্রিক কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়। (প্রকৃতপক্ষে, রাজনৈতিক কর্মী ও গণতান্ত্রিক সমর্থকদের গ্রেফতারের এই কর্মকাণ্ড এবং এরকম পার্টিহীন পঞ্চায়েত সিস্টেম রাজা মহেন্দ্রের ও তার পুত্র বীরেন্দ্রর  অধীনে ৩০ বছর ধরে অব্যাহত ছিল)।

নতুন সংবিধানে একটি "পার্টিহীন"পঞ্চায়েত ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হয়, যেখানে রাজা মহেন্দ্রকে নেপাল সরকারের গণতান্ত্রিক রূপ বলে মনে করা হয়। একটি পিরামিড গঠন হিসাবে, এই  পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় রাজতন্ত্র সম্পূর্ণ ক্ষমতা পায় এবং এই সংবিধান মন্ত্রিসভা (মন্ত্রীদের কাউন্সিল) ও সংসদসহ সকল সরকারী প্রতিষ্ঠানের উপর একমাত্র কর্তৃত্বের সাথে রাজাকে রাষ্ট্রের প্রধান হিসাবে নিযুক্ত করে। বিভিন্ন জাতিগত ও আঞ্চলিক গোষ্ঠীকে একত্রিত করে রাষ্ট্রকে ঐক্যবদ্ধ করার লক্ষ্যে, "এক ভাষা এক জাতি" প্রধান জাতীয় নীতি হয়ে ওঠে। ১৯৬৭ সালে "গৌন ফারকা আভিয়ান" চালু হয় যা পঞ্চায়েত ব্যবস্থার প্রধান গ্রামীণ উন্নয়ন প্রোগ্রামগুলির মধ্যে একটি ছিল।

১৯৭২ সালে ২৭ বছর বয়সী রাজা বীরেন্দ্র রাজা মহেন্দ্র উত্তরাধিকারী হন। ১৯৭৯ সালে ছাত্র বিক্ষোভ ও শাসন বিরোধী কার্যকলাপের সময় রাজা বীরেন্দ্র নেপালের সরকারের প্রকৃতির ব্যাপারে (নতুন গণতান্ত্রিক সংস্কারের সাথে একই পঞ্চায়েত ব্যবস্থা না বহুদলীয় ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা) সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য জাতীয় গণভোটের আহবান জানান। গণভোট অনুষ্ঠিত হয় ১৯৮০ সালের মে মাসে, এবং পঞ্চায়েতের ব্যবস্থা খুব সীমিত ব্যবধানে বিজয় লাভ করে। রাজা প্রতিশ্রুতিমতো পঞ্চায়েতের সংস্কার করেন যার মধ্যে ছিল পঞ্চায়েত দ্বারা প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচন।

বহুদলীয় সংসদ

১৯৯০ সালে সংসদীয় গণতন্ত্র গ্রহণের পরে তাদের স্বার্থগুলি আরও ভালভাবে দেখা হবে বলে গ্রামীণ এলাকার জনগণের আশা ছিল। সমর্থন করে নেপাল কংগ্রেস "বামপন্থী দলগুলোর জোট" এর সমর্থন নিয়ে একটি জন আন্দোলন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, যা রাজতন্ত্রকে বাধ্য করেছিল সাংবিধানিক সংস্কার গ্রহণ এবং বহুদলীয় সংসদ প্রতিষ্ঠা করতে। 1991 সালের মে মাসে, নেপালে প্রায় ৫০ বছর পর তার প্রথম সংসদীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নেপাল কংগ্রেস ২০৫ টি আসনের মধ্যে ১১০ টি জিতে এবং ৩২ বছরে প্রথম নির্বাচিত সরকার গঠন করে।

বেসামরিক ধর্মঘট

১৯৯২ সালে নতুন কংগ্রেস সরকারের নীতির বাস্তবায়নের ফলে মূল্যবৃদ্ধি সহ অর্থনৈতিক সংকট এবং বিশৃঙ্খলার পরিস্থিতি দেখা দেয়। যার ফলে মৌলবাদী বামেরা তাদের রাজনৈতিক আন্দোলনকে অনেকটা এগিয়ে নিয়ে যায়। বিভিন্ন দলের সমন্বয়ে একটি "জয়েন্ট পিপলস আজিটেশান কমিটি"  গঠন করা হয় এবং ৬ এপ্রিল একটি সাধারণ ধর্মঘট আহ্বান করা হয়।

ধর্মঘটের আগে সন্ধ্যায় হিংসাত্মক ঘটনা ঘটতে শুরু করে। "জয়েন্ট পিপলস আজিটেশান কমিটি" রাজধানীতে ৩০ মিনিটের জন্য "লাইট আউট" করার আহ্বান জানায় এবং এরপর সক্রিয় কর্মীরা "লাইট আউট" প্রয়োগ করার মধ্য দিয়ে বীর হাসপাতালের বাইরে সহিংসতা শুরু করে। ৬ এপ্রিল ভোররাতে পুলচোক (পাটান) থানার বাইরে হরতাল কর্মী ও পুলিশের সংঘর্ষ হয় এবং এতে দুই বাম কর্মী মারা যায়।

পরে রাজধানী কাঠমান্ডুর তুণ্ডিখেলে নামক জায়গাতে সংঘর্ষ কমিটির একটি গণ সমাবেশে পুলিশ বাহিনী হামলা চালায়। ফলস্বরূপ, হাঙ্গামা বন্ধ হয়ে যায় এবং নেপালের টেলিযোগাযোগ ভবনে আগুন লেগে যায়। পুলিশ ভিড়ের মধ্যে আগুন লাগিয়ে দেয় এবং কয়েকজনকে হত্যা করে। নেপালের মানবাধিকার সংস্থার হিসাব অনুযায়ী কয়েকজন দর্শক সহ ১৪ জন ব্যক্তি পুলিশ ফায়ারিংয়ে নিহত হয়।

যখন প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ভূমি সংস্কারগুলি করতে সরকার ব্যর্থ হয়, তখন কিছু জেলায় জনগণ তাদের নিজস্ব ভূমি সংস্কার আইন প্রণয়নের জন্য এবং এবং সুদখোর জমিদারদের থেকে বাঁচার জন্য সংগঠিত হতে শুরু করে। যাইহোক, নেপাল সরকার "অপারেশন রোমিও" এবং "অপারেশন কিলো সেরা ২" দিয়ে এই আন্দোলনকে দমন করে, যার ফলে কয়েকজন সংগ্রামী নেতৃস্থানীয় কর্মীদের প্রান গিয়েছিল। ফলস্বরূপ, এই দমনের অনেক সাক্ষী পরে বিচ্ছিন্নতাবাদী হয়ে ওঠে।

নেপালী গৃহযুদ্ধ

মূল নিবন্ধ: নেপালী গৃহযুদ্ধ

১৯৯৭ সালের মার্চ মাসে, নেপালের কমিউনিস্ট পার্টি (মাওবাদী) "জনগণের যুদ্ধ" নামে মাওবাদী বিপ্লবী ধারার মধ্য দিয়ে , জনগণের নতুন গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের সাহায্যে সংসদীয় রাজতন্ত্রকে উৎখাত করার ডাক দিয়েছিল। যা নেপালকে গৃহযুদ্ধের দিকে পরিচালিত করেছিল। বাবুরাম ভট্টরাই এবং পুষ্প  কামাল দহলের নেতৃত্বে ("প্রচণ্ড" নামেও পরিচিত) রোলপা, রুকুম, জাজরকোট, গোর্খা, এবং সিন্ধুলি- নেপালের পাঁচটি জেলায় বিদ্রোহ শুরু হয়। নেপালের কমিউনিস্ট পার্টি (মাওবাদী) বিভিন্ন জেলা স্তরে একটি অস্থায়ী "জনগণের সরকার" প্রতিষ্ঠা করে।

১ জুন, ২০০১ সালে রাজা বীরেন্দ্র ও রানী ঐশ্বর্য সহ রাজ পরিবারের পরিবারের ৯  সদস্যকে গুপ্তহত্যা করা হয়। শুধুমাত্র রাজকুমার দিপেন্দ্র বেঁচে থাকার কারণে, তিনি দেহে ক্ষতর কারনে মারা যাবার আগে সাময়িকভাবে আগে রাজা হয়েছিলেন। তার পর প্রিন্স জ্ঞানেন্দ্র (এইচএমজি রাজা বীরেন্দ্রের ভাই) ঐতিহ্য অনুসারে সিংহাসনে আরোহণ করেন। এদিকে, বিদ্রোহ আরও বেড়ে যায়, এবং অক্টোবর ২০০২ সালে রাজা সাময়িকভাবে সরকারের পতন ঘটিয়ে এটির সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেন। এক সপ্তাহ পরে তিনি আরেকটি সরকার গঠন করেন, কিন্তু দেশের অবস্থা তখনও খুব অস্থির ছিল।

অস্থায়ী সরকারের জন্য এবং ২০০৪ সালের আগস্ট মাসে কাঠমান্ডু উপত্যকায় অবরোধের ফলে রাজতন্ত্র সমর্থন হারাতে শুরু করে। ২০০৫  সালের ১ লা ফেব্রুয়ারি, রাজা জ্ঞানেন্দ্র সরকারকে বরখাস্ত করে এবং সম্পূর্ণ ক্ষমতা গ্রহণ করেন। এরপর বিপ্লব বাতিল করতে "জরুরি অবস্থা"র কথা ঘোষণা করেন। রাজনীতিবিদদের গৃহবন্দী করা হয়েছিল, ফোন ও ইন্টারনেট লাইন কেটে রাখা হয়েছিল। পাশাপাশি প্রেসের স্বাধীনতা কঠোরভাবে হ্রাস পেয়েছিল।

রাজার এই নতুন শাসন বিদ্রোহীদের দমন করার ক্ষেত্রে সামান্য সফলতা লাভ করে। ফেব্রুয়ারী ২০০৬ সালের পৌর নির্বাচনকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন "গণতন্ত্রের জন্য একটি পশ্চাদ্ধাবন পদক্ষেপ" হিসাবে বর্ণনা করে। এই নির্বাচনকে প্রধান দলগুলি করেছিল এবং কিছু প্রার্থীকে পদত্যাগ করার জন্য সেনা বাহিনী দিয়ে বাধ্য করা হয়েছিল। ২০০৬ সালের এপ্রিল মাসে কাঠমান্ডুতে ধর্মঘট ও রাস্তায় বিক্ষোভের কারণে রাজা সংসদের পুনর্বহাল করতে বাধ্য হন। একটি সাত দলীয় জোট সরকার গঠন করে এবং রাজার অধিকাংশ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। ১৫ জানুয়ারী ২০০৭ সাল পর্যন্ত, নেপাল একটি অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধানের অধীনে একটি ঐক্য পরিষদ দ্বারা পরিচালিত হয়। ২৪ ডিসেম্বর ২০০৭ সালে, সাবেক মাওবাদী দল ও ক্ষমতাসীন দল সহ সাতটি দল রাজতন্ত্র নির্মূল করার এবং নেপালকে ফেডারেল প্রজাতন্ত্র ঘোষণার পক্ষে রায় দেয়। ১০ এপ্রিল ২০০৪ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে "নেপাল প্রজাতন্ত্রের" মাধ্যমে সরকার গঠন করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে মাওবাদীরা সহজেই সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে।

ফেডারেল গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র

২৮ শে মে, ২০০৮ সালে, নবনির্বাচিত সংসদীয় পরিষদ ২৪০ বছরের রাজতন্ত্রের বিলুপ্ত ঘটিয়ে নেপালকে ফেডারেল ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক হিসেবে ঘোষণা করে। রাজতন্ত্রের এই বিলুপ্তি বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠদের ভোটের মাধ্যমে সংগঠিত হয়েছিল। সমাবেশে উপস্থিত .৫৬৪ জন সদস্যের মধ্যে ৫৬০ জন রাজতন্ত্রের অবলুপ্তির পক্ষে ভোট দেয়। শুধুমাত্র ৪ জন সদস্য এটির বিরুদ্ধে ভোট দেয়। ১১ ই জুন, ২০০৮ সালে প্রাক্তন রাজা জ্ঞানেন্দ্র প্রাসাদ ছেড়ে চলে যান। ২৩ শে জুলাই, ২০০৮ সালে নেপাল কংগ্রেসের রাম বরণ যাদব ফেডারেল ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিকের প্রথম রাষ্ট্রপতি হন। একইভাবে, সংসদীয় পরিষদ,  ইউনিফায়েড কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল (মাওবাদী) -এর পুষ্প কমল দহল ( প্রচণ্ড নামে যিনি পরিচিত) কে ১৫ই আগস্ট ২০০৮ সালে প্রথম রিপাবলিকান প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচন করে,নেপাল কংগ্রেস পার্টির শের বাহাদুর দেউবা কে হারিয়ে।

নির্দিষ্ট সময়সীমার আগে সংবিধান প্রণয়ন করতে ব্যর্থ হওয়ার , বর্তমান সংসদীয় পরিষদ ভেঙ্গে দেয়া হয় ২৮ মে ২০১২ সালে।এবং নেপাল সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি খিল রাজ রেগমি, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে একটি নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার (২০১৩-২০১৪) গঠন করেন। ২০১৩  সালের নভেম্বর মাসে সংসদীয় নির্বাচনে নেপাল কংগ্রেস বৃহত্তম অংশের ভোট পেলেও একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে ব্যর্থ হয়। নেপালের কমিউনিস্ট পার্টি (সংগঠিত মার্কসবাদী-লেনিনবাদী) (সিপিএন (ইউএমএল)) এবং নেপাল কংগ্রেস এক সমঝোতা সরকার গঠন করে এবং নেপালি কংগ্রেসের সুশীল কৈরালা সিপিএন (ইউএমএল) সমর্থন নিয়ে ফেব্রুয়ারি ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

২01২ সালের সংবিধানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ

২০ সেপ্টেম্বর ২০১৫ সালে নতুন সংবিধান কার্যকর হবার পর মাদেসী ও থারুর মতো সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠী সংবিধানের বিরুদ্ধে জোরালোভাবে প্রতিবাদ শুরু করে। তারা দাবী করে যে তাদের উদ্বেগগুলি এই সংবিধানে সমাধান করা হয়নি এবং নথিতে তাদের জাতিগোষ্ঠীগুলির জন্য মাত্র অল্প কয়েকটি সুরক্ষাবিল রয়েছে। খসড়া সংবিধানের জন্য শুরু হওয়া সংঘর্ষে কমপক্ষে ৫৬ জন বেসামরিক নাগরিক এবং ১১ জন পুলিশকর্মী নিহত হন। মাদেসি প্রতিবাদের প্রতিক্রিয়ায়, ভারত সীমান্ত এলাকায় নিরাপত্তাহীনতা ও সহিংসতার কথা উল্লেখ করে নেপালকে বিভিন্ন অত্যাবশ্যক সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। এরপর নেপাল অভিযোগ করে যে নেপালে পেট্রোলিয়াম ও ওষুধের সরবরাহ বন্ধ করে ভারত মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে। [27] তারপর নেপালের প্রধানমন্ত্রী, ওলি প্রকাশ্যে ভারতের এই ভূমিকাকে যুদ্ধের থেকেও বেশী অমানবিক বলে দাবি করে। ভারত অবশ্য এই দাবী অস্বীকার করে।


This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.