লংগদু উপজেলা

লংগদু বাংলাদেশের রাঙ্গামাটি জেলার অন্তর্গত একটি উপজেলা

লংগদু
উপজেলা
লংগদু
বাংলাদেশে লংগদু উপজেলার অবস্থান
স্থানাঙ্ক: ২২°৫৭′ উত্তর ৯২°৯′ পূর্ব
দেশ বাংলাদেশ
বিভাগচট্টগ্রাম বিভাগ
জেলারাঙ্গামাটি জেলা
প্রতিষ্ঠাকাল১৮৬১
সংসদীয় আসন২৯৯ পার্বত্য রাঙ্গামাটি
সরকার
  সংসদ সদস্যঊষাতন তালুকদার (স্বতন্ত্র)
আয়তন
  মোট৩৮৮.৪৯ কিমি (১৫০.০০ বর্গমাইল)
জনসংখ্যা (২০১১)
  মোট৮৪,৬৭৭
  জনঘনত্ব২২০/কিমি (৫৬০/বর্গমাইল)
সাক্ষরতার হার
  মোট৪২.২০%
সময় অঞ্চলবিএসটি (ইউটিসি+৬)
পোস্ট কোড৪৫৮০
প্রশাসনিক
বিভাগের কোড
২০ ৮৪ ৫৮
ওয়েবসাইটপ্রাতিষ্ঠানিক ওয়েবসাইট

আয়তন

লংগদু উপজেলার মোট আয়তন ৩৮৮.৪৯ বর্গ কিলোমিটার।[1]

অবস্থান ও সীমানা

রাঙ্গামাটি জেলার উত্তরাংশে ২২°৪৮' হতে ২৩°০৬' উত্তর অক্ষাংশ এবং ৯২°০৫' হতে ৯২°১৯' পূর্ব দ্রাঘিমাংশ জুড়ে লংগদু উপজেলার অবস্থান।[2] রাঙ্গামাটি জেলা সদর থেকে এ উপজেলার দূরত্ব প্রায় ৭৬ কিলোমিটার।[3] এ উপজেলার উত্তর-পূর্বে বাঘাইছড়ি উপজেলা; পূর্বে ও দক্ষিণে বরকল উপজেলা, পশ্চিমে রাঙ্গামাটি সদর উপজেলা, নানিয়ারচর উপজেলা, খাগড়াছড়ি জেলার মহালছড়ি উপজেলাখাগড়াছড়ি সদর উপজেলা এবং উত্তরে খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালা উপজেলা অবস্থিত।

নামকরণ

লংগদু নামের উৎপত্তি সম্পর্কে কোন সুনিশ্চিত ধারণা পাওয়া যায় না, তবে কয়েকটি ব্যাখ্যা প্রচলিত আছে। লংগদু শব্দটির কোন আভিধানিক অর্থ নেই। ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ শাসনামলে পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা প্রতিষ্ঠার পর ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য একটি থানা গঠন করে। পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার সদর দপ্তর তখন চন্দ্রঘোনায় স্থাপন করা হয়। জেলা সদর থেকে নবগঠিত থানাটির দীর্ঘ দূরত্বের জন্য এটিকে ইংরেজী শব্দ লং (অর্থাৎ দীর্ঘ) দূর সংক্ষেপে লংদূর বা লংদু ডাকা হত। লংদু পরবর্তীতে লোকমুখে পরিবর্তিত হয়ে লংগদু নামে অভিহিত হয় বলে অনেকেই ধারণা করেন। লংগদু থানা গঠন পরবর্তী সময়ে সমগ্র থানায় লংগদু নামে একটিই ইউনিয়ন ছিল, যা পরবর্তীতে ৭টি ইউনিয়নে বিভক্ত হয়েছে।

লংগদু নামকরণের বিষয়ে কিছু ঐতিহাসিক ধারণা প্রচলিত আছে। বর্তমানে এ অঞ্চলে চাকমা নৃ-গোষ্ঠীর আধিক্য থাকলেও একসময়ে ত্রিপুরা এবং মারমা নৃ-গোষ্ঠীর বসবাস ছিল। লংগদু নামকরণের ক্ষেত্রে ত্রিপুরা এবং মারমা নৃ-গোষ্ঠীর সাথে সম্পৃক্ত দুইটি ব্যাখ্যা রয়েছে। পার্বত্য এলাকায় বসবাসকারী মারমাদের পূর্বপুরুষগণ মায়ানমারের রাখাইন প্রদেশের (সাবেক আরাকান) অধিবাসী ছিলেন। ১৭৮৪ সালে বর্মীরাজা বোদপায়া আরাকান জয় করেন। সৈন্যেরা আরাকান জয় করে আরাকানীদের উপর অত্যাচার শুরু করলে প্রাণ রক্ষার্থে তৎকালীন ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর অধিকৃত চট্টগ্রাম এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় আরাকানীরা উদ্বাস্তু হিসাবে আশ্রয় গ্রহণ করে। একদল আরাকানী মগ পরিবার জনৈক ম্রে-চাই এর নেতৃত্বে পালংখাইং নদী অববাহিকা এলাকা থেকে কর্ণফুলি নদীর উত্তরে বসতি গড়ে তোলে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ম্রে-চাই কে মং রাজা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। পরবর্তীতে বাংলাদেশের পার্বত্য এলাকায় বসবাসকারী আরাকানী মগগণ নিজেদের নামের সাথে মারমা পদবী গ্রহণ করেন। মারমা সম্প্রদায়ের কয়েকটি পরিবার মিলে গংসা বা দল গঠিত হয়। গং অর্থ সর্দার এবং সা অর্থ লোক বা সন্তান উভয়ই বুঝায়। গংসা অর্থে কোন দলপতির লোক বুঝানো হতো। মারমাদের অনেকগুলো গংসার মধ্যে লংকাডু-সা উল্লেখযোগ্য। লংকাডু নামে কোন দলপতি বা সর্দারের নামানুসারে লংকাডু-সা নামক গংসা বা দলের উৎপত্তি হয়েছিল মর্মে মনে করা হয়। ব্যক্তি লংকাডু বা লংকাডু-সা দলের নামানুসারে লংকাডু বা লংগাডু বা লংগদু নামের উৎপত্তি হয়েছে।

লংগদু নামকরণের বিষয়ে ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের সাথে সম্পর্কিত ব্যাখ্যাটি হল, মধ্যযুগে ত্রিপুরায় একটি শক্তিশালী রাজবংশ ছিল। পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিকার নিয়ে ত্রিপুরার রাজা, আরাকানের রাজা এবং বাংলার সুলতানের অনেক যুদ্ধ বিগ্রহ হয়েছিল। ত্রিপুরারাজ বিজয়মাণিক্য (১৫৩২-১৫৬৩ খ্রিষ্টাব্দ) চট্টগ্রাম জয় করে রামু পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছিলেন বলে জানা যায়। ষোড়শ শতাব্দীতে ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের লোকজন পার্বত্য ত্রিপুরা হতে আরাকান পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল। সে সময়ে ত্রিপুরা রাজ্যের সীমানা চট্টগ্রাম হতে বরাক নদী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। পঞ্চদশ শতাব্দীতে ত্রিপুরার রিয়াং সম্প্রদায়ের লোকজন পার্বত্য চট্টগ্রামের উত্তরাংশের মাইনী উপত্যকায় বসবাস শুরু করে। তারা মাইয়ুনী টাল্যাং থেকে এসেছিল বিধায় নদীর নাম মাইনী হয়েছে। ত্রিপুরা এবং রিয়াং ভাষায় মাই অর্থ ধান এবং ভাত দুটোই বুঝায়। মাইয়ুনী টাল্যাং শব্দের অর্থ ধান্য এলাকা বা পাহাড়। মাইনী নদী অববাহিকায় বসবাসকারী ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের দলপতির নাম ছিল লেংদু। সেই দলপতির নামে অত্র এলাকায় একটি খাল রয়েছে। খালটি লংগদুর পশ্চিমে বন্দুকভাঙ্গা পাহাড়শ্রেণী থেকে উৎপন্ন হয়ে পূর্বে কাচালং নদীতে এসে মিশেছে। ধারণা করা যায় যে, ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের দলপতির নামানুসারে পরবর্তীতে এলাকার নাম লেংদু বা লাংগাদু বা লংগদু হয়েছে।[4]

প্রশাসনিক এলাকা

১৮৬০ সনে পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা ঘোষণার পর পার্বত্য এলাকায় আইন শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য যে কয়টি থানা প্রথম গঠিত হয় তার মধ্যে লংগদু অন্যতম। তবে লংগদু থানা প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৬১ সালে এবং ১৯৮৩ সালে প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের ফলে উপজেলায় রূপান্তরিত হয়।[4] এ উপজেলায় ৭টি ইউনিয়ন রয়েছে। সম্পূর্ণ উপজেলার প্রশাসনিক কার্যক্রম লংগদু থানার আওতাধীন।

ইউনিয়নসমূহ:

[5]

জনসংখ্যার উপাত্ত

২০১১ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী লংগদু উপজেলার জনসংখ্যা ৮৪,৬৭৭ জন। এর মধ্যে পুরুষ ৪৩,৮৪৬ জন এবং মহিলা ৪০,৮৩১ জন। মোট জনসংখ্যার ৭২.৪১% মুসলিম, ১.৫০% হিন্দু, ২৫.৮৭% বৌদ্ধ এবং ০.২২% খ্রিস্টান ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বী রয়েছে।[2] এ উপজেলায় প্রধানত বাঙালি ও চাকমা সম্প্রদায়ের লোকজন বসবাস করে। এছাড়া অল্পসংখ্যক ত্রিপুরা ও পাংখোয়া জাতিসত্বার লোকজন রয়েছে।[1]

শিক্ষা

লংগদু উপজেলার সাক্ষরতার হার ৪২.২০%। এ উপজেলায় ২টি কলেজ, ১টি আলিম মাদ্রাসা, ১০টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ২টি দাখিল মাদ্রাসা, ৬টি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ৬১টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ৪টি কিন্ডারগার্টেন ও ৫টি ইবতেদায়ী মাদ্রাসা রয়েছে।[1]

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান

যোগাযোগ ব্যবস্থা

রাঙ্গামাটি জেলা সদর থেকে লংগদু উপজেলায় যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম নৌপথ। লঞ্চ, ইঞ্জিন চালিত বোট প্রধান যোগাযোগ মাধ্যম। তবে খাগড়াছড়ি থেকে বাস বা সিএনজি চালিত অটোরিক্সা যোগে এ উপজেলায় যাওয়া যায়।

স্বাস্থ্য

লংগদু উপজেলায় ১টি সরকারি হাসপাতাল, ১টি বেসরকারি হাসপাতাল এবং ৭টি স্বাস্থ্য কেন্দ্র রয়েছে।[1]

অর্থনীতি

লংগদু উপজেলার কৃষি, মৎস্য সম্পদ, বনজ সম্পদ এর অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক। লংগদু উপজেলার কাট্টলী বিলে প্রচুর পরিমাণে মিঠাপানির মাছ পাওয়া যায়।

  • প্রধান রপ্তানি দ্রব্য: তরমুজ, কলা, কাঁঠাল, হলুদ, আদা, মাছ।

নদ-নদী

লংগদু উপজেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে মাইনী নদীকাচালং নদী। এছাড়া এ উপজেলার এক তৃতীয়াংশ জুড়ে রয়েছে কাপ্তাই হ্রদ[2][6]

হাট-বাজার

লংগদু উপজেলায় ১২টি হাট-বাজার রয়েছে।[1]

দর্শনীয় স্থান

  • কাপ্তাই হ্রদ
  • বনশ্রী রেস্ট হাউজ, মাইনীমুখ
  • মাইনীমুখ বাজার মসজিদ
  • তিনটিলা বন বিহার
  • ডুলুছড়ি জেতবন বিহার
  • বায়তুশ শরফ কমপ্লেক্স
  • কাট্টলী বিল
  • কাট্টলী বাজার
  • গরুসটাং পাহাড়
  • থলছাপ পাহাড়
  • কাকপাড়ীয়া প্রাকৃতিক বনভূমি
  • পাবলাখালী অভয়ারণ্য ও পাবলাখালী গেইম অভয়ারণ্য
  • যমচুগ বন বিহার
  • বনস্মৃতি রেস্ট হাউজ, পাবলাখালী

[2][7]

মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাবলী

১৯৭১ সালে পাকবাহিনী লংগদু উপজেলায় ব্যাপক গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট চালায়। বগাচতর ইউনিয়নের আমবাগান ও রাঙ্গীপাড়ায় পাকবাহিনীর সাথে মুক্তিবাহিনীর সম্মুখ লড়াই হয়। ৬ ডিসেম্বর লংগদু শত্রুমুক্ত হয়।[2]

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন
  • স্মৃতিস্তম্ভ: ১টি[2]

জনপ্রতিনিধি

সংসদীয় আসন
সংসদীয় আসন জাতীয় নির্বাচনী এলাকা[8] সংসদ সদস্য[9][10][11][12][13] রাজনৈতিক দল
২৯৯ পার্বত্য রাঙ্গামাটি রাঙ্গামাটি জেলা দীপংকর তালুকদার বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ
উপজেলা পরিষদ ও প্রশাসন
ক্রম নং পদবী নাম
০১ উপজেলা চেয়ারম্যান[14] মোহাম্মদ তোফাজ্জল হোসেন
০২ ভাইস চেয়ারম্যান[15] মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন
০৩ মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান[16] নুরজাহান বেগম
০৪ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা[17] প্রবীর কুমার রায়

আরও দেখুন

তথ্যসূত্র

  1. "এক নজরে লংগদু উপজেলা"langadu.rangamati.gov.bd
  2. "লংগদু উপজেলা - বাংলাপিডিয়া"bn.banglapedia.org
  3. "ভৌগলিক পরিচিতি - লংগদু উপজেলা-"langadu.rangamati.gov.bd
  4. "উপজেলা পরিচিতি - লংগদু উপজেলা-"langadu.rangamati.gov.bd
  5. "লংগদু উপজেলার ইউনিয়নসমূহ"langadu.rangamati.gov.bd
  6. "নদ নদী - লংগদু উপজেলা-"langadu.rangamati.gov.bd
  7. "দর্শনীয় স্থান - লংগদু উপজেলা-"langadu.rangamati.gov.bd
  8. "Election Commission Bangladesh - Home page"www.ecs.org.bd
  9. "বাংলাদেশ গেজেট, অতিরিক্ত, জানুয়ারি ১, ২০১৯" (PDF)ecs.gov.bdবাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন। ১ জানুয়ারি ২০১৯। ২ জানুয়ারি ২০১৯ তারিখে মূল (PDF) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২ জানুয়ারি ২০১৯
  10. "সংসদ নির্বাচন ২০১৮ ফলাফল"বিবিসি বাংলা। ২৭ ডিসেম্বর ২০১৮। সংগ্রহের তারিখ ৩১ ডিসেম্বর ২০১৮
  11. "একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফলাফল"প্রথম আলো। ৩১ ডিসেম্বর ২০১৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৩১ ডিসেম্বর ২০১৮
  12. "জয় পেলেন যারা"দৈনিক আমাদের সময়। সংগ্রহের তারিখ ৩১ ডিসেম্বর ২০১৮
  13. "আওয়ামী লীগের হ্যাটট্রিক জয়"সমকাল। সংগ্রহের তারিখ ৩১ ডিসেম্বর ২০১৮
  14. "উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান"langadu.rangamati.gov.bd
  15. "উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান"langadu.rangamati.gov.bd
  16. "মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান"langadu.rangamati.gov.bd
  17. "প্রোফাইল - লংগদু উপজেলা-"langadu.rangamati.gov.bd
  • চাকমা জাতির ইতিবৃত্ত, সুগত চাকমা।

বহিঃসংযোগ

This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.