কালীঘাট মন্দির
কালীঘাট মন্দির কলকাতার একটি প্রসিদ্ধ কালীমন্দির এবং একান্ন শক্তিপীঠের অন্যতম হিন্দু তীর্থক্ষেত্র। এই তীর্থের পীঠদেবী দক্ষিণাকালী এবং ভৈরব বা পীঠরক্ষক দেবতা নকুলেশ্বর। পৌরাণিক কিংবদন্তি অনুসারে, সতীর দেহত্যাগের পর তাঁর ডান পায়ের চারটি (মতান্তরে একটি) আঙুল এই তীর্থে পতিত হয়েছিল।
কালীঘাট মন্দির | |
---|---|
![]() কালীঘাট মন্দির | |
ধর্ম | |
অন্তর্ভুক্তি | হিন্দুধর্ম |
অবস্থান | |
অবস্থান | কালীঘাট, কলকাতা |
স্থাপত্য | |
ধরন | মধ্যযুগীয় বাংলার মন্দির স্থাপত্য, আটচালা |

পৌরাণিক কিংবদন্তি
সতীপীঠ কালীঘাট
সত্যযুগে দক্ষ প্রজাপতি স্বগৃহে এক মহাযজ্ঞের আয়োজন করেছিলেন। সেই যজ্ঞে দেবতা, মুনি-ঋষি, যক্ষ, কিন্নর সকলকে নিমন্ত্রণ করলেও, দক্ষ আপন কন্যা সতী ও জামাতা শিবকে নিমন্ত্রণ জানাননি। সতী বিনা আমন্ত্রণে যজ্ঞস্থলে উপস্থিত হলে, তাঁর সম্মুখেই যক্ষ শিবের নিন্দা করেন। পতিনিন্দা সহ্য করতে না পেরে তৎক্ষণাৎ যজ্ঞকুণ্ডে আত্মবিসর্জন দেন সতী। তখন শিব ক্রুদ্ধ হয়ে সতীর শবদেহ স্কন্ধে নিয়ে বিশ্বধ্বংস করার উদ্দেশ্যে তাণ্ডবনৃত্য শুরু করেন। তাঁকে শান্ত করতে বিশ্বপালক বিষ্ণু আপন সুদর্শন চক্র দিয়ে সতীর দেহ খণ্ডবিখণ্ড করে দেন। সতীর খণ্ডবিখণ্ড দেহের টুকরোগুলি পৃথিবীর নানা স্থানে পতিত হয়েছিল। পৃথিবীতে পড়ামাত্রই এগুলি প্রস্তরখণ্ডে পরিণত হয়। পীঠমালা তন্ত্র অনুযায়ী, সতীর ডান পায়ের চারটি আঙুল পড়েছিল কালীঘাটে।[1]
ইতিহাস
কালীঘাট একটি বহু প্রাচীন কালীক্ষেত্র। কোনো কোনো গবেষক মনে করেন, "কালীক্ষেত্র" বা "কালীঘাট" কথাটি থেকে "কলকাতা" নামটির উদ্ভব।[2] জনশ্রুতি, ব্রহ্মানন্দ গিরি ও আত্মারাম ব্রহ্মচারী নামে দুই সন্ন্যাসী কষ্টিপাথরের একটি শিলাখণ্ডে দেবীর রূপদান করেন। ১৮০৯ সালে বড়িশার সাবর্ণ জমিদার শিবদাস চৌধুরী, তাঁর পুত্র রামলাল ও ভ্রাতুষ্পুত্র লক্ষ্মীকান্তের উদ্যোগে আদিগঙ্গার তীরে বর্তমান মন্দিরটি নির্মিত হয়েছে। পরবর্তীকালে মন্দিরের কিছু পোড়ামাটির কাজ নষ্ট হয়ে গেলে সন্তোষ রায়চৌধুরী সেগুলি সংস্কার করেন।[2] বর্তমান এই মন্দিরটি নব্বই ফুট উঁচু। এটি নির্মাণ করতে আট বছর সময় লেগেছিল এবং খরচ হয়েছিল ৩০,০০০ টাকা।[2] মন্দির সংলগ্ন জমিটির মোট আয়তন ১ বিঘে ১১ কাঠা ৩ ছটাক; বঙ্গীয় আটচালা স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত মূল মন্দিরটির আয়তন অবশ্য মাত্র ৮ কাঠা।[2] মূল মন্দির সংলগ্ন অনেকগুলি ছোটো ছোটো মন্দিরে রাধাকৃষ্ণ, শিব প্রভৃতি দেবতা পূজিত হন।কালীঘাট মন্দিরের নিকটেই পীঠরক্ষক দেবতা নকুলেশ্বর শিবের মন্দির। ১৮৫৪ সালে তারা সিং নামে জনৈক পাঞ্জাবি ব্যবসায়ী বর্তমান নকুলেশ্বর মন্দিরটি নির্মাণ করিয়েছিলেন। শিবরাত্রি ও নীলষষ্ঠী উপলক্ষে এই মন্দিরে প্রচুর ভক্ত সমাগম হয়। কালীমন্দিরের পশ্চিম দিকে রয়েছে শ্যাম রায়ের মন্দির। ১৮৪৩ খ্রিস্টাব্দে বাওয়ালির জমিদার উদয়নারায়ণ মণ্ডল এই মন্দিরটি নির্মাণ করিয়েছিলেন। এখানে রামনবমী ও দোলযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। ১৮৬২ সালে শবদাহের জন্য মন্দিরের অদূরে নির্মিত হয় কেওড়াতলা মহাশ্মশান। বাংলার বহু বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়েছে এই শ্মশানে। এখানকার শ্মশানকালী পূজা বিখ্যাত।
মূর্তি
কালীঘাট কালীমন্দিরের কষ্টিপাথরের কালীমূর্তিটি অভিনব রীতিতে নির্মিত। মূর্তিটির জিভ, দাঁত ও মুকুট সোনার। হাত ও মুণ্ডমালাটিও সোনার। মন্দিরে মধ্যে একটি সিন্দুকে সতীর প্রস্তরীভূত অঙ্গটি রক্ষিত আছে; এটি কারোর সম্মুখে বের করা হয় না।
পূজা
প্রতি বছর পয়লা বৈশাখ, দুর্গাপূজা ও দীপান্বিতা কালীপূজার দিন মন্দিরে প্রচুর ভক্ত ও পু্ণ্যার্থীর সমাগম ঘটে।
- ১৮৮৭ সালের কালীঘাট মন্দির ও আদিগঙ্গা
- বেহালার একটি কালীপূজা মণ্ডপে কালীঘাটের কালীমূর্তির আদলে নির্মিত প্রতিমা
তথ্যসূত্র
- পীঠমালা তন্ত্রের শ্লোকটি হল:
-- কালীক্ষেত্র কালীঘাট, সুমন গুপ্ত, দীপ প্রকাশন, কলকাতা, ২০০৬, পৃ. ১৩বঙ্গানুবাদ: "কালীঘাট মহাশক্তিপীঠ। সকল পীঠস্থানের শ্রেষ্ঠ। কালীপীঠের দেবী মহাশক্তিস্বরূপিণী কালী। আর পীঠরক্ষক হলেন ভৈরব নকুলেশ্বর। এখানে পুজো দিলে ভক্তের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয়। কালীঘাটের দেবী কালিকা সর্বসিদ্ধিকারী।"যুগাদ্যায়ং মহাদেব দক্ষাঙ্গুষ্ঠং পদোমম
নকুলীশঃ কালীপীঠে দক্ষপদাঙ্গুলি সু চ মে
সর্বসিদ্ধিকারী দেবী কালিকা তত্র দেবতা।। - "কালীঘাটের কালীমন্দির", বাংলার ঐতিহ্য: কলকাতার অহংকার, পল্লব মিত্র, পারুল প্রকাশনী, কলকাতা, ২০১০, পৃ. ৬৯-৭০