রবীন্দ্র সরোবর, কলকাতা

রবীন্দ্র সরোবর (পূর্বনাম ঢাকুরিয়া লেক) দক্ষিণ কলকাতায় অবস্থিত একটি কৃত্রিম হ্রদ। লোকমুখে এটি "দক্ষিণ কলকাতার ফুসফুস" হিসেবে আখ্যায়িত। ঢাকুরিয়া লেক নামটি এই হ্রদসংলগ্ন অঞ্চলটিরও পরিচায়ক। এই হ্রদের উত্তরে সাউদার্ন অ্যাভিনিউ, পশ্চিমে রসা রোড, পূর্বে ঢাকুরিয়া এবং দক্ষিণে কলকাতা শহরতলি রেলওয়ের লাইন অবস্থিত।

রবীন্দ্র সরোবর, কলকাতায় বড় পানকৌড়ির কলোনি

ইতিহাস

১৯২০-এর দশকের প্রথম দিকে কলকাতা মহানগরীয় অঞ্চলের উন্নয়নের দায়িত্বে নিয়োজিত কলকাতা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট (কেআইটি) ১৯২ একর জলাজঙ্গলময় জমি অধিগ্রহণ করে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল এই অঞ্চলটি বসতিযোগ্য করে তোলা – রাস্তাঘাটের উন্নয়ন, আশপাশের জমিকে সমাতল করা এবং হ্রদ ও উদ্যান গড়ে তোলা। এ সময়ই একটি বৃহদাকার হ্রদ খনন করার কাজ শুরু হয়। এই হ্রদটিই পরিচিত হয় ঢাকুরিয়া লেক নামে। ১৯৫৮ সালের মে মাসে কেআইটি কর্তৃপক্ষ বিশিষ্ট বাঙালি সাহিত্যিক তথা নোবেল বিজয়ী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-এর নামে এই হ্রদটির নামকরণ করেন রবীন্দ্র সরোবর[1]। পরবর্তীকালে এই হ্রদটিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে শিশু উদ্যান, বাগান ও প্রেক্ষাগৃহের মতো কিছু বিনোদনকেন্দ্র। এখানেই কাজী নজরুল ইসলামের নামে নজরুল মঞ্চ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ২০০৩ সালে জাতীয় লেক সংরক্ষণ প্রকল্পে এই হ্রদটির নাম সংযুক্ত হয়[1]। বর্তমানে নগরোন্নয়ন দফতর প্রায় ১০কোটি টাকা খরচ করে নিরাপত্তা ও সৌন্দর্যায়নের ব্যবস্থা করছেন। রবীন্দ্রনাথের মূর্তি হ্রদ ও স্টেডিয়ামের মাঝে বসান হয়েছে[1]। বর্তমানে এই হ্রদসংলগ্ন অঞ্চলটি সমগ্র কলকাতা শহরের জনপ্রিয় বিনোদনকেন্দ্রগুলির অন্যতম। মূল হ্রদটির আয়তন ৭৩ একর [1]। বাকি অংশ গাছগাছালিতে ঢাকা। কিছু কিছু গাছ আবার শতাধিক বছরেরও পুরনো। ২০১২ সালে আংশিক বৃক্ষ গণনায় প্রায় ৫০টি ভিন্ন প্রজাতি এবং সংখ্যার তথ্য নেওয়া হয়[2]। শীতকালে এই হ্রদে অনেক পরিযায়ী পাখি আসে [3]। যদিও বর্তমানে দূষণের কারণে তাদের সংখ্যা অনেক কমে এসেছে। হ্রদে বিভিন্ন প্রজাতির মাছও রয়েছে। এখানে মাছ ধরা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।

রবীন্দ্র সরোবর হ্রদ।

সকালে বহু মানুষ এই হ্রদের ধারে মুক্তবায়ুতে প্রাতঃভ্রমণ করেন। সূর্যোদয়ের মুহুর্তে বহু মানুষ প্রার্থনা নিবেদন করতেও আসেন। দিনের বেলা বনভোজনরত পরিবার, পর্যটক, অল্পবয়সী প্রেমিক-প্রেমিকা এবং জগারদের আনাগোনায় এই হ্রদাঞ্চল মুখরিত থাকে। ২০১২ সালে হ্রদের ভিতর একটি পরিত্যক্ত ওয়াটার হাউস এলাকায় কলকাতা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট দ্বারা পরিচালিত প্রতিস্থাপিত শিল্পকর্মের জন্য গ্যালারী নির্মিত হয়। স্থানীয় লোকেরা এটিকে ঠাকুরদের গ্যালারী বলে থাকেন[4]। এখানে কলকাতার সাম্প্রতিক কালের বেশ কিছু পুরস্কার প্রাপ্ত দুর্গা মুর্তি রাখা আছে[5]

উল্লেখযোগ্য স্থান ও স্থাপনা

হ্রদের উত্তরাংশে রবীন্দ্র সরোবর স্টেডিয়াম নামে ২৬,০০০ আসনবিশিষ্ট একটি ফুটবল স্টেডিয়াম আছে। ১৯৫০-এর দশকে এই স্টেডিয়ামটি নির্মিত হয় এবং বর্তমানে এটি সম্পূর্ণ অডিও-ভিস্যুয়াল প্রশিক্ষণ সুবিধা সম্বলিত কলকাতার প্রথম স্টেডিয়াম। হ্রদাঞ্চলের উত্তরাংশে আরও রয়েছে নজরুল মঞ্চ নামে একটি বিশাল মুক্তমঞ্চ। হ্রদাঞ্চলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি পূর্ণাবয়ব ভাস্কর্যও রয়েছে। কলকাতার একমাত্র জাপানী বুদ্ধ মন্দিরটি রবীন্দ্র সরোবরের দক্ষিণাংশে অবস্থিত। ১৯৩৫ সালে আন্তর্জাতিক বৌদ্ধ সংগঠন নিপ্পনজান ম্যোয়োহোজি-এর প্রতিষ্ঠাতা নিচিদাৎসু ফুজি কর্তৃক এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠিত হয়। হ্রদের মধ্যভাগে অবস্থিত একটি দ্বীপে আছে একটি মসজিদ। এটি হ্রদ নির্মাণের আগে থেকেই সেখানে আছে। দ্বীপটি একটি কাঠের কেবল-স্টেইড ঝুলন্ত সেতু দ্বারা হ্রদের দক্ষিণভাগের সঙ্গে যুক্ত। এই সেতুটি ১৯২৬ সালে তৈরি হয়।

হ্রদের পশ্চিমভাগে কয়েকটি কামান রয়েছে। ১৯২০-এর দশকে খননকার্য চালানোর সময় এগুলি পাওয়া গিয়েছিল। মনে করা হয়, বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজদ্দৌলার কামান এগুলি। হ্রদাঞ্চলে একটি সাফারি উদ্যান ও শিশু উদ্যান রয়েছে, যার কেন্দ্রে রয়েছে একটি পদ্মপুকুর ও একটি সুইমিং পুল। ১৯৮৫ থেকে ১৯৮৯ সালের মধ্যে এখানে একটি টয়ট্রেনও চলত, যেটি শিশুদের মধ্যে খুব জনপ্রিয় ছিল। আজও হ্রদের ধারে তার ট্র্যাক দেখতে পাওয়া যায়। রবীন্দ্র সরোবর হ্রদাঞ্চলে বেশ কয়েকটি রোয়িং (নৌকাবাইচ) ও সুইমিং (সাঁতার) ক্লাব আছে। রোয়িং ক্লাবগুলি হ্রদের উত্তরভাগে এবং সুইমিং ক্লাবগুলি এর দক্ষিণভাগে অবস্থিত। ১৮৫৮ সালে ব্রিটিশরা কলকাতায় নৌকাবাইচকে জনপ্রিয় করার উদ্দেশ্যে ভারতের প্রাচীনতম ক্যালকাটা রোয়িং ক্লাব (সিআরসি) স্থাপন করে। রবীন্দ্র সরোবর হ্রদাঞ্চলের অন্যান্য রোয়িং ক্লাবের মধ্যে রয়েছে বেঙ্গল রোয়িং ক্লাব, লেক ক্লাবকলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় রোয়িং ক্লাব। ভারতের অন্যতম প্রসিদ্ধ ও প্রাচীনতম সুইমিং ক্লাব ইন্ডিয়ান লাইফ সেভিং সোসাইটি (পোষাকি নাম আন্ডারসন ক্লাব)-এর প্রধান কার্যালয় এই হ্রদাঞ্চলেই অবস্থিত।

অবনমন

দেশের সমস্ত কৃত্রিম হ্রদের মতো রবীন্দ্র সরোবরও পরিবেশ দূষণের শিকার। পর্যটক বৃদ্ধি ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে জনবসতির বিস্তারের ফলে বেড়েছে জল দূষণ। ভারত সরকারের পরিবেশ ও বন মন্ত্রক এই হ্রদকে জাতীয় হ্রদ পরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত করেছেন। স্থানীয় কর্তৃপক্ষ এখানে ব্যাপক হারে বৃক্ষরোপণ করে পরিবেশ দূষণ রোধের চেষ্টায় রত আছেন।

পরিবহন ব্যবস্থা

নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে রবীন্দ্র সরোবরের দূরত্ব ৩০ কিলোমিটার এবং হাওড়া স্টেশন থেকে এর দূরত্ব ১২ কিলোমিটার। এই অঞ্চলের নিকটবর্তী রেলস্টেশনের মধ্যে আছে রবীন্দ্র সরোবর মেট্রো স্টেশন এবং কলকাতা শহরতলি রেলওয়ে (বজবজ শাখা)-র টালিগঞ্জ ও লেক গার্ডেনস স্টেশন। দমদমের পর এটিই দ্বিতীয় অঞ্চল যেখানে এই দুই রেলব্যবস্থা পরস্পর মিলিত হয়েছে।

  1. "সাজছে রবীন্দ্র সরোবর-আনন্দবাজার পত্রিকা"আনন্দবাজার পত্রিকা। ২৩ অগস্ট, ২০১৪। সংগ্রহের তারিখ 12 January 2017 এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন: |তারিখ= (সাহায্য)
  2. Bag, Shamik (২১ জুন ২০১৪)। "Lakeside story"। সংগ্রহের তারিখ ১২ জানুয়ারি ২০১৭
  3. "Old charm returns as birds flock back to Sarovar - Times of India"The Times of India। ৯ নভেম্বর ২০১২। সংগ্রহের তারিখ ১২ জানুয়ারি ২০১৭
  4. "Goddesses by the lake"The Telegraph। ২২ নভেম্বর ২০১২। সংগ্রহের তারিখ ১২ জানুয়ারি ২০১৭
  5. "Durga museum offers re-viewing of idols - Times of India"The Times of India। নভে ৮, ২০১৪। সংগ্রহের তারিখ ১২ জানুয়ারি ২০১৭
This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.