দশমহাবিদ্যা

মহাবিদ্যা বা দশমহাবিদ্যা হিন্দুধর্মে দেবী অর্থাৎ দিব্য জননীর দশটি বিশেষ রূপের সমষ্টিগত নাম। দেবীত্বের এই ক্রমবির একদিকে যেমন রয়েছেন ভয়ংকর দেবীমূর্তি, তেমনই অন্য প্রান্তে রয়েছেন এক অপরূপ সুন্দরী দেবীপ্রতিমা।[1]

দশমহাবিদ্যা - (উপরে বামদিক থেকে) কালী, তারা, ষোড়শী, ভুবনেশ্বরী, ভৈরবী, (নিচে বামদিক থেকে) ছিন্নমস্তা, ধূমাবতী, বগলা, মাতঙ্গী, কমলা
কালী
ললিতা-ত্রিপুরসুন্দরী
ছিন্নমস্তা
বগলামুখী

মুণ্ডমালা তন্ত্র অনুসারে দশমহাবিদ্যা হলেন কালী, তারা, ষোড়শী, ভৈরবী, ভুবনেশ্বরী, ছিন্নমস্তা, ধূমাবতী, বগলা, মাতঙ্গীকমলাকামিনী। তবে মহাবিদ্যার সংখ্যা নিয়ে মতান্তর রয়েছে। এমনকি একটি মতে মহাবিদ্যার সংখ্যা ২৭ বলা হয়েছে। দুর্গা, কামাখ্যাঅন্নপূর্ণাও মহাবিদ্যা। মালিনী বিজয় গ্রন্থের মতে, মহাবিদ্যা হলেন কালী, নীলা, মহাদুর্গা, ত্বরিতা, ছিন্নমস্তিকা, বাগ্বাদিনী, অন্নপূর্ণা, প্রত্যঙ্গিরা, কামাখ্যাবাসিনী, বালা, মাতঙ্গীশৈলবাসিনী[2]

শাক্তধর্মের ইতিহাসে মহাবিদ্যা ধারণার বিকাশ একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়। এই ধারণা শাক্তধর্মে ভক্তিবাদের সূচনা ঘটায়; অষ্টাদশ শতাব্দীতে যা লাভ করে চূড়ান্ত সমৃদ্ধি। উত্তর-পৌরাণিক যুগে, খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দী নাগাদ হিন্দু দেবমণ্ডলীতে পুরুষদেবতার প্রাধান্যের প্রতিক্রিয়ারূপে এক নতুন ধর্মান্দোলনের সূচনা ঘটেছিল। এই নতুন ধর্মমতে পরম সত্ত্বাকে নারীরূপে কল্পনা করা হয়। এই মতকে ভিত্তি করে একাধিক ধর্মগ্রন্থ রচিত হয়। এই গ্রন্থগুলির মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ছিল দেবীভাগবত পুরাণদেবীভাগবত-এর সপ্তম স্কন্দের শেষ নয়টি অধ্যায় দেবী গীতা নামে পরিচিত। এটি শাক্তধর্মের প্রধান ধর্মগ্রন্থ।[3]

ব্যুৎপত্তি

মহাবিদ্যা কথাটি মূলত সংস্কৃত শব্দ। সংস্কৃত মহা (অর্থাৎ মহৎ) ও বিদ্যা (অর্থাৎ প্রকাশ, রূপ, জ্ঞান বা বুদ্ধি) শব্দদুটি থেকে মহাবিদ্যা কথাটির উৎপত্তি।[3] এর সঙ্গে কখনও কখনও সংখ্যাবাচক দশ কথাটি যুক্ত হয়ে থাকে।

নাম

শাক্তরা বিশ্বাস করেন, "একই সত্য দশটি ভিন্ন রূপে প্রকাশিত ; দিব্য জননী দশটি বিশ্বরূপে দৃষ্ট ও পূজিত হয়ে থাকেন ।” এই দশটি রূপই হল দশমহাবিদ্যা[4] মহাবিদ্যাগণ প্রকৃতিগতভাবে তান্ত্রিক। তাদের সাধারণ নামগুলি হল:[5]

  • কালী : সর্বসংহারকারিনী, জন্ম ও শক্তির দেবী। কালীকুল সম্প্রদায়ের সর্বোচ্চ দেবী।
  • তারা : পথপ্রদর্শক ও রক্ষাকারিনী (তারিনী) দেবী। বিশ্বের উৎস হিরণ্যগর্ভের শক্তি এবং মহাশূন্যের প্রতীক।
  • ত্রিপুরসুন্দরী বা ললিতা-ত্রিপুরসুন্দরী (ষোড়শী) : পূর্ণতা ও পূর্ণাঙ্গতার স্বরূপ। শ্রীকুল সম্প্রদায়ের সর্বোচ্চ দেবী। তান্ত্রিক পার্বতী নামে পরিচিতা।
  • ভুবনেশ্বরী : বিশ্বজননী। পার্থিব জগতের শক্তিসমূহের প্রতীক।
  • ভৈরবী : ভয়ংকরী দেবী। সেই কামনা ও প্রলোভনের স্বরূপ যা মৃত্যুর দিকে টেনে নিয়ে যায়।
  • ছিন্নমস্তা  : উলঙ্গিনী দেবীমূর্তি। তিনি স্বহস্তে নিজ মস্তক ছিন্ন করে নিজ রক্ত নিজেই পান করেন। চক্রপথে আত্মধ্বংস ও আত্মপুনরুজ্জীবনের মাধ্যমে সৃষ্ট জগতের অবিরাম বিদ্যমানতার শক্তির প্রতীক।
  • ধূমাবতী : বিধবা দেবীমূর্তি। অগ্নির দ্বারা জগৎ ধ্বংসের পর ভষ্মরাশির মধ্য থেকে যে ধূম নির্গত হয়, তার স্বরূপ। তিনি কখনও কখনও অলক্ষ্মী বা জ্যেষ্ঠাদেবী নামেও অভিহিতা হন।
  • বগলামুখী  : শত্রুনিষ্ক্রিয়কারিনী দেবী। ঈর্ষা, ঘৃণা ও নিষ্ঠুরতার মতো মানবচরিত্রের অন্ধকার দিক নিয়ন্ত্রণ করেন। তাকে সারস-মুণ্ড রূপেও কল্পনা করা হয়।
  • মাতঙ্গী  : কর্তৃত্ব শক্তির দেবী। জাতিহীন দেবী (কালীকুল সম্প্রদায়ে), ললিতার প্রধানমন্ত্রী (শ্রীকুল সম্প্রদায়ে); তান্ত্রিক সরস্বতী
  • কমলাকামিনী  : বরাভয় প্রদায়িনী শুদ্ধ চৈতন্যের দেবী। ভাগ্যদেবী লক্ষ্মীর অন্যরূপ। তান্ত্রিক লক্ষ্মী নামেও অভিহিতা।

মহাভাগবত পুরাণবৃহদ্ধর্ম পুরাণ–এ ত্রিপুরসুন্দরীকে দেবীরই অপর নাম ষোড়শী নামে অভিহিত করা হয়েছে।[1] গুহ্যাতিগুহ্য তন্ত্রে বলা হয়েছে মহাবিদ্যাগণই হলেন বিষ্ণু দশ অবতারের উৎস। দেবীর এই দশ রূপ, তা ভয়ংকরই হোক বা কোমল, বিশ্বজননী রূপে পূজিত হয়।

পৌরাণিক উপাখ্যান

বৃহদ্ধর্ম পুরাণ–এ বর্ণিত কাহিনি অনুসারে, শিব ও তার স্ত্রী তথা পার্বতীর পূর্বাবতার দাক্ষায়ণী সতীর মধ্যে একটি দাম্পত্য কলহ দশমহাবিদ্যার উৎস। সতীর পিতা দক্ষ শিব ও সতীর বিবাহে মত দেননি। তাই তিনি যখন যজ্ঞের আয়োজন করেন তখন নববিবাহিত শিব-সতীকে আমন্ত্রণ জানান না। সতী বিনা আমন্ত্রণেই পিতৃগৃহে যেতে চাইলে শিব বারণ করেন। ক্রুদ্ধ সতী স্বামীর অনুমতি আদায়ের জন্য তৃতীয় নয়ন থেকে আগুন বের করতে থাকেন এবং কালী বা শ্যামায় রূপান্তরিত হন। এই মূর্তি দেখে ভীত শিব পলায়ন করতে গেলে সতী দশ মহাবিদ্যার রূপ ধারণ করে শিবকে দশ দিক দিয়ে ঘিরে ফেলেন। এরপর শিব তাকে দক্ষযজ্ঞে উপস্থিত থাকার অনুমতি দান করেন।[3]

আরও দেখুন

পাদটীকা

  1. Mahavidyas Hindu goddesses: visions of the divine feminine in the Hindu religious tradition, by David R. Kinsley. University of California Press, 1988. আইএসবিএন ০-৫২০-০৬৩৩৯-২. Page 161-165.
  2. পৌরাণিকা: বিশ্বকোষ হিন্দুধর্ম, প্রথম খণ্ড, অমলকুমার মুখোপাধ্যায়, ফার্মা কেএলএম প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, ২০০১
  3. The Devī Gītā: the song of the Goddess, by Cheever Mackenzie Brown. SUNY Press, 1998. আইএসবিএন ০-৭৯১৪-৩৯৪০-২. Page 23
  4. Shankarnarayanan, S., The Ten Great Cosmic Powers: Dasa Mahavidyas. Samata Books (Chennai, 1972; 4th ed. 2002)., pp. 4, 5.
  5. Kinsley, David. Tantric Visions of the Divine Feminine: The Ten Mahavidyas. University of California Press (Berkeley, 1997).

আরও পড়ুন

  • Tantric visions of the Divine Feminine: The Ten Mahāvidyās, by David R. Kinsley. University of California Press, 1997. আইএসবিএন ০-৫২০-২০৪৯৯-৯. Excerpts

বহিঃসংযোগ

This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.