হিন্দু পুরাণ
হিন্দু পুরাণ হল হিন্দুধর্ম সংক্রান্ত অজস্র ঐতিহ্যবাহী কথামালার একটি বৃহৎ রূপ, যা প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্য (যেমন রামায়ণ ও মহাভারতের ন্যায়,প্রবিত্র গ্ৰন্ত অষ্টাদশ পুরাণ ও বেদ), প্রাচীন তামিল সাহিত্য (যেমন সংগম সাহিত্য ও পেরীয় পেরুনম্), ভাগবত পুরাণের (যাকে পঞ্চম বেদ আখ্যায় ভূষিত করা হয়) ন্যায় অন্যান্য হিন্দু রচনা এবং দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক সাহিত্যে লিপিবদ্ধ ও সংরক্ষিত রয়েছে। এছাড়াও এই হিন্দু পুরাণ ভারত ও নেপালের সংস্কৃতির অন্যতম অঙ্গ। সুসংবদ্ধ এই কাহিনিগুলি এক সুবিশাল ঐতিহ্যের বাহক ও রক্ষক, যা বিভিন্ন কালে, বিভিন্ন উপায়ে, বিভিন্ন মানুষ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দ্বারা বিভিন্ন অঞ্চলে বিকাশপ্রাপ্ত হয়। এটি যে কেবল হিন্দু সাহিত্য ও ঘটনাবলির দ্বারা প্রভাবিত তা নয়, বরং এই কাহিনিগুলি বিশদ ব্যাখ্যার মাধ্যমে সমাজ-সংসারের নানা চিত্রকে প্রতীকী মাধ্যমে গভীর ও সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছে।[1]
হিন্দুধর্ম |
---|
ধারাবাহিকের অংশ |
![]() |
বিদ্যালয়
|
শাস্ত্র
|
উপাসনা
|
গুরু, সন্ত, দার্শনিক
|
অন্যান্য বিষয়
|
|
উৎস
বেদ
ধ্রুপদী হিন্দুধর্ম থেকে উদ্ভূত পৌরাণিক কাহিনির মূল হল ভারতের প্রাচীন বৈদিক সভ্যতা ও তার সময়কাল। বেদ, বিশেষত ঋগ্বেদের অজস্র স্তোত্রে পরোক্ষ ভাবে নানা বিচিত্র কাহিনির উল্লিখিত হয়েছে (দেখুন ঋগ্বৈদিক দেবদেবী, ঋগ্বৈদিক নদনদী)।
বৈদিক চরিত্র, দর্শন এবং কাহিনিগুলি যে পৌরাণিক কথামালার সৃষ্টি করেছে, তা হিন্দু রীতিনীতি ও বিশ্বাসের সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। বেদ চারটি – ঋগ্বেদ, সামবেদ, যজুর্বেদ ও অথর্ববেদ।
ইতিহাস ও পুরাণ

পরবর্তী বৈদিক যুগে সভ্যতার নানা উপাদানই সংস্কৃত মহাকাব্যগুলিতে সংরক্ষিত করা হয়েছে। স্বাভাবিক কথামালাগুলির পাশাপাশি একাধিক খণ্ডে বিভক্ত মহাকাব্যগুলিও ভারতীয় সমাজ, সভ্যতা, দর্শন, সংস্কৃতি, জীবনযাত্রা ইত্যাদি সম্বন্ধীয় নানা তথ্যের ধারক হয়ে রয়েছে। রামায়ণ ও মহাভারত – এই দুটি হিন্দু মহাকাব্যই যথাক্রমে ভগবান্ বিষ্ণুর দুই অবতার – রাম ও কৃষ্ণের কাহিনি পরিবেশন করে। এই দুটি গ্রন্থই ‘ইতিহাস’ নামে পরিচিত। রামায়ণ ও মহাভারত উভয়কেই ধর্মের পথপ্রদর্শক এবং দর্শনতত্ত্ব ও নীতিকথার আধার হিসেবে গণ্য করা হয়। এই গ্রন্থ দুটি একাধিক অধ্যায়ে (কাণ্ড ও পর্ব) বিভক্ত এবং এতে অসংখ্য নীতিমূলক সংক্ষিপ্ত কাহিনি সংকলিত হয়েছে, যেখানে চরিত্রগুলি কাহিনির অন্তে হিন্দু নীতি ও আচরণবিধির সঠিক শিক্ষালাভ করে। এগুলির মধ্যে সর্বাধিক প্রসিদ্ধ হল মহাভারতের ভগবদ্গীতা, যেখানে শ্রীকৃষ্ণ তাঁর সখা মহারথি অর্জুনকে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের ঠিক প্রাক্কালে ধর্মাচরণ ও জীবনকর্তব্যের বিশদ ব্যাখ্যা প্রদান করেন। এই গ্রন্থটি হিন্দু দর্শনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে ও হিন্দুধর্মের প্রধান উপদেশমূলক গ্রন্থ হিসেবে খ্যাত হয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, মহাভারত হল পৃথিবীর সর্ববৃহৎ কাব্যগ্রন্থ, এতে প্রায় এক লক্ষ শ্লোক রয়েছে।
মহাকাব্যগুলির প্রতিটিই ভিন্ন যুগে বা সময়কালে বর্ণিত। মহর্ষি বাল্মীকি রচিত রামায়ণ, যা রামের (ভগবান বিষ্ণুর সপ্তম অবতার) জীবন ও সময়কাল বর্ণনা করে, তা ত্রেতা যুগে সংঘটিত হয়। মহাভারত বর্ণনা করে পাণ্ডব ও কৃষ্ণের (বিষ্ণুর অষ্টম অবতার) সময়কাল, এটি ঘটিত হয় দ্বাপর যুগে। সর্বসাকুল্যে যুগ রয়েছে ৪টি। সত্য বা কৃত যুগ, ত্রেতা যুগ, দ্বাপর যুগ এবং কলি যুগ। অবতার-এর ধারণাটি পৌরাণিক যুগে উঠে এসেছিল, যা মহাকাব্যদ্বয়ের সাথে সরাসরি সম্বন্ধযুক্ত, তবুও অবতার প্রাক্-পৌরাণিক যুগের বলে বর্ণিত হয়েছে।
পুরাণের কাহিনিগুলি অনেক প্রাচীন এবং মূলত মহাকাব্যগুলিতে অনুপস্থিত (অথবা কদাচিৎ উপস্থিত)। এতে রয়েছে ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টির কাহিনি, বিভিন্ন দেবদেবীর জীবন ও কীর্তিকলাপ, নায়ক-নায়িকা এবং পৌরাণিক জীবের (অসুর, দানব, দৈত্য, যক্ষ, রাক্ষস, গন্ধর্ব, অপ্সরা, কিন্নর, কিংপুরুষ ইত্যাদি) কাহিনি। প্রাচীন রাজা, ভগবানের অবতার, পবিত্র তীর্থ ও নদীসমূহের সাথে সম্পর্কিত নানা ঐতিহ্যও এতে রয়েছে। ভাগবত পুরাণ হল সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় পুরাণ, ভগবান বিষ্ণু ও তাঁর মর্ত্যে অবতার গ্রহণের গল্প রয়েছে এই পুরাণে।
সৃষ্টিতত্ত্ব
সৃষ্টি
হিন্দু পুরাণে একাধিক উপায়ে সৃষ্টিকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। ঋগ্বেদের অন্যতম প্রাচীন সৃষ্টিতত্ত্ব অনুযায়ী (১০.১২১) সৃষ্টির প্রকাশ হয়েছিল হিরণ্যগর্ভ নামক এক মহাজাগতিক অণ্ড তথা ডিম থেকে। পুরুষসূক্তের (১০.৯০) মতে, দেবতাদের দ্বারা পরাজিত পুরুষ নামক এক অলৌকিক মানবের ছিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ থেকে নানা বস্তুর সৃষ্টি। পুরাণ অনুসারে, বরাহরূপী বিষ্ণু কল্পের জল থেকে পৃথিবী বা ভূমিকে উদ্ধার করেছিলেন।
শতপথ ব্রাহ্মণে লেখা আছে, সৃষ্টিকর্তা তথা পরমপিতা প্রজাপতি সৃষ্টির আদিতে সম্পূর্ণ একলা ছিলেন। তাই তিনি নিজেকে পুরুষ ও স্ত্রী-রূপী দুটি খণ্ডে বিভক্ত করেন। স্ত্রী ও পুরুষ ক্রমে ক্রমে প্রত্যেকটি প্রাণীর দুই ভিন্ন প্রজাতি তৈরী করলেন। পরে এই প্রজাপতিকেই পুরাণে ব্রহ্মা হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।
পুরাণে বলা আছে, সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা, পালনকর্তা বিষ্ণু ও সংহারকর্তা মহেশ্বরের (শিব) সাথে যুক্ত হয়ে এক ত্রিমূর্তি গঠন করেন। বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করেন ব্রহ্মা, তা পালন করেন বিষ্ণু এবং পরবর্তী সৃষ্টির জন্য বর্তমান সৃষ্টিকে ধ্বংস করেন শিব। আবার কিছু গল্পে দেখা যায়, ব্রহ্মাও বিষ্ণু থেকে উৎপন্ন হয়েছেন। কল্পের সাগরে শেষনাগের অনন্তশয্যায় শায়িত বিষ্ণুর নাভি থেকে জাত পদ্মের ওপরে ব্রহ্মাকে বসে থাকতে দেখা যায়। সৃষ্টির আদিতে বিষ্ণুই একা ছিলেন, সৃষ্টির কথা স্মরণ হতেই তাঁর নাভিজাত পদ্মে ব্রহ্মার উৎপত্তি হয়।
লোক বা জগৎ
%2C_folio_3_from_the_Shiva_Purana%2C_c._1828.jpg)
হিন্দুধর্মে চোদ্দটি লোক বা জগতের কথা বলা হয়েছে – ৭টি ঊর্ধ্বলোক এবং ৭টি নিম্নলোক (পৃথিবী রয়েছে ঊর্ধ্বলোকগুলির সবচেয়ে নীচে)। ঊর্ধ্বলোকগুলি হল – ভূ (ভূমি), ভূবঃ (বায়ু), স্ব (স্বর্গ), মহঃ, জন, তপ ও সত্য। সত্যলোকে ব্রহ্মার বাস, মহঃ লোকে ঋষিগণের বাস এবং স্বর্গে বাস দেবতাদের। নিম্নলোকগুলি হল – অতল, বিতল, সুতল, রসাতল, তলাতল, মহাতল ও পাতাল[2]।
প্রতিটি লোকই হল (পৃথিবী বাদে) মৃত্যুর পর আত্মার অস্থায়ী বাসস্থান। পৃথিবীতে জীবের মৃত্যুর পর ধর্মরাজ যম জীবের সমস্ত পাপ-পুণ্যের বিচার করে তাকে ঊর্ধ্ব কিংবা নিম্নলোকে পাঠান। ধর্মের কিছু শাখায় বলা আছে, পাপ ও পুণ্য পরস্পরকে প্রশমিত করতে পারে, তাই পরবর্তী জন্ম স্বর্গ বা পাতালে হতেই পারে। আবার কোথাও বলা হয়েছে, পাপ ও পুণ্য একে অপরকে প্রভাবিত করতে পারে না। এই ক্ষেত্রে আত্মা উপযুক্ত লোকটিতে জন্ম নেয়। তারপর ওই লোকে আত্মার জীবনকাল শেষ হলে তা পুনরায় পৃথিবীতে ফিরে আসে (পৃথিবীর কোনো এক জীব রূপে জন্ম নেয়)। বলা হয়, একমাত্র পৃথিবীতে মানুষ হিসেবে জন্মগ্রহণ করলেই আত্মার মোক্ষলাভ বা পরমধামে যাত্রা হতে পারে, যে স্থান জন্ম-মৃত্যুর চক্র থেকে মুক্ত, যেখানে রয়েছে স্বর্গীয় পরমানন্দ।[3][4]
সময়ের প্রকৃতি
হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী, মহাজগৎ অনন্তকাল ধরে সময়চক্রে গতিশীল। এই চক্রের প্রারম্ভিক বিভাগটি হল কল্প, বা ‘ ব্রহ্মার একটি দিন’, যা ৪৩ লক্ষ ২০ হাজার কোটি বছরের সমান। ব্রহ্মার এক রাতের পরিসরও একই। একইরকম ৩৬০টি ব্রাহ্ম দিন-রাত মিলে তৈরী হয় একটি ব্রাহ্ম বৎসর, যেখানে ব্রহ্মার জীবনকাল ১০০ ব্রাহ্ম-বৎসর। অর্থাৎ সর্ববৃহৎ সময়চক্রটি ৩,১১০,৪০০ লক্ষ কোটি বছরের সমান। এই সময়কাল অতিবাহিত হলে গোটা ব্রহ্মাণ্ড পরমাত্মা বা পরংব্রহ্মে বিলীন হয়, যতক্ষণ না নতুন সৃষ্টিকর্তার উদ্ভব ঘটে।
প্রতি ব্রাহ্ম দিনে ব্রহ্মা মহাজগৎ সৃষ্টি করেন এবং তাকে আত্মসাৎ করেন। প্রতি ব্রাহ্ম রাতে নিদ্রিত ব্রহ্মার শরীরে সমাহিত হয় ব্রহ্মাণ্ড। প্রতিটি কল্প ১৪টি উপকল্প বা মন্বন্তর-এ বিভক্ত, যার এক-একটির পরিসর ৩০৬,৭২০,০০০ বছর। দুটি মন্বন্তরের মাঝে এক বিরাট শূন্যস্থান থাকে। এই সময় বিশ্বে পুনর্জন্ম হয় এবং এক নতুন মনুর উদ্ভব হয়, যিনি মনুষ্যজাতির জনক ও রক্ষক। বর্তমানে আমরা এই কল্পের সপ্তম মন্বন্তরে রয়েছি, বর্তমান মনুর নাম মনু বৈবস্বত।
প্রত্যেকটি মন্বন্তর আবার ৭১টি মহাযুগ সমন্বিত (১০০০টি মহাযুগে এক কল্প)। আবার প্রতিটি মহাযুগে ৪টি যুগ নিয়ে গঠিত – সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর ও কলি। এদের সময়কাল যথাক্রমে ৪৮০০, ৩৬০০, ২৪০০ ও ১২০০ ‘দৈব বৎসর’। উল্লেখ্য, চারটি যুগে ক্রমাগত ধর্ম, নীতি, আদর্শ, মর্যাদা, সুখ ইত্যাদির ক্রম-অবনমন ও পতন ঘটে। আমরা বর্তমানে কলিযুগে বাস করছি – গণনা অনুযায়ী যা শুরু হয়েছে ৩১০২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে, সেই বছরটিতে, যে বছর কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
কলিযুগের সমাপ্তির লক্ষণগুলি হল বর্ণাশ্রম প্রথার ধ্বংস, সুযোগ্য ব্যক্তিদের পতন, ধর্মের মর্যাদা নাশ এবং স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের শাসন। এরপর বিশ্ব ধ্বংস হবে বিধ্বংসী আগুন ও বন্যার দ্বারা। মধ্যযুগীয় নানা পুঁথিতে বলা আছে, কল্পান্তে মহাপ্রলয় সবকিছুর বিনাশ করবে। কিন্তু যুগান্তরের প্রলয় সেই তুলনায় নগণ্য।
প্রলয়
প্রতিটি কল্পের শেষে ব্রহ্মাণ্ডের ধ্বংসকে প্রলয় বলা হয়। কল্পান্তের প্রলয়কে নৈমিত্তিক বলে। প্রলয় জীবজগতের ধ্বংসসাধন হয়, কিন্তু ব্রহ্মাণ্ড গঠনকারী পদার্থের নাশ হয় না। অন্য প্রকার প্রলয় ঘটে ব্রহ্মার জীবনান্তে, যা প্রাকৃতিক নামে পরিচিত। তৃতীয়টি অত্যন্তিক, যা চরম নাশ এবং ভবিষ্যৎ থেকে মোক্ষ দেয়।
হিন্দু দেবতা
বিষ্ণু
ঋগ্বেদের সূর্যদেবতাই পরবর্তীকালে বিষ্ণুতে পরিণত হন, ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর ত্রয়ীতে পালনকর্তা হিসেবে স্থান পান। ধর্মকে রক্ষা এবং অধর্মের নাশ করার জন্য বারংবার অবতার গ্রহণের ধারণাটিই বিষ্ণুকে ‘সচ্চিদানন্দঘন’ করে তুলেছে। পুরাণে বলা হয়েছে, তিনি অপার কারণ-সমুদ্রে সহস্রফণা-বিশিষ্ট শেষনাগের অনন্তশয্যায় শায়িত থাকেন। তাঁর নাভিপদ্ম থেকে ব্রহ্মার জন্ম হয়, যিনি পরে জগৎ সৃষ্টি করেন। সৃষ্টিকার্য সমাপ্ত হলে বিষ্ণু ‘বৈকুণ্ঠ’ পরমধামে গমন করেন। পালনকর্তা বিষ্ণু অবতার ধারণের মাধ্যমে জগৎকে রক্ষা করেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিষ্ণুর ১০টি অবতার বর্ণনা করা হয় – মৎস্য, কূর্ম, বরাহ, নৃসিংহ, বামন, পরশুরাম, রাম, কৃষ্ণ, বুদ্ধ ও কল্কি।
শিব
শিব হলেন হিন্দু দের প্রধান দেবতা যিনি পরমাত্মা রূপেও প্রকাশক। পশুপাত, শৈব সিদ্ধান্ত এবং অন্যান্য গ্রন্থানুযায়ী, শিব ব্রহ্মের সমান। শিব নির্গুণ এবং ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের মূলধারার বাইরের উপাসকদের আরাধ্য। শিব তন্ত্র সাধনা সৃষ্টি করেন
ধ্রুপদী হিন্দু ধর্মে, শিব বিনাশের দেবতা, হিমালয়ের দুর্গম কৈলাস পর্বতে বসবাসকারী এক যোগিপুরুষ। তাঁর সারা গা ভস্ম-মাখা, তাঁর কেশ জটায় পরিণত। তার পরনে বাঘছাল ও হাতে ত্রিশূল। কণ্ঠে সর্প ও মাথায় অর্ধচন্দ্র। তাঁর কপালের মাঝখানে রয়েছে তৃতীয় নেত্র। তাঁর অর্ধাঙ্গিনী স্ত্রী পার্বতী, পুত্র স্কন্দ বা কার্তিকেয় এবং গণেশ।
শিবের প্রাচীন নাম রুদ্র, তিনি ছিলেন পশুদের দেবতা। ঋগ্বেদে (১০.৬১ ও ১.৭১) বলা হয়েছে, সৃষ্টির প্রাক্কালে তিনি এক বন্য শিকারি রূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন, তাঁর হাতের বাণ সৃষ্টিকর্তা প্রজাপতির গায়ে বিদ্ধ হয় এবং প্রজাপতি তাঁর কন্যা ঊষার প্রেমে পড়ে যান। ভীত প্রজাপতি রুদ্রকে পশুপতি হিসেবে ভূষিত করেন।
মূলত রুদ্র থেকে শিব হয়ে ওঠার এই রূপান্তর পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে স্পষ্ট। কারণ, সে সময় ভক্তের কাছ থেকে ঈশ্বরের অঞ্জলি গ্রহণের দ্বি-অর্থক ধারণা তৈরী হয়। আসলে গোঁড়া বৈদিক যাগযজ্ঞ ও তার আহুতি থেকে রুদ্রকে বাদ দেওয়া হয়, তাই ভগবানের এই রূপটির প্রয়োজন হয় ভক্তদের নিবেদন আদায় করার, তাই শিবকে ‘উচ্ছিষ্ট’ (যাকে কেউ গ্রহণ করেনি) নিবেদন নিতে দেখা যায়। হিন্দু পুরাণে এই প্রসঙ্গটির পরোক্ষ বা রূপকীয় উপস্থাপনা দেখা যায়, শিব ও তার শ্বশুর দক্ষের সংঘর্ষের মাধ্যমে। ব্রহ্মার মানসপুত্র দক্ষ তার আয়োজন করা মহাযজ্ঞে শিবকে আমন্ত্রণ করে না, তাই ক্রুদ্ধ সতী (দক্ষের কন্যা ও শিবের পত্নী) অভিযোগ জানাতে দক্ষের কাছে হাজির হন। তবুও দক্ষ শিবের নিন্দা করেন, এবং সতী ভয়ানক অপমানিত হয়ে নীচ দক্ষের কন্যা হয়ে থাকার চেয়ে মৃত্যুই শ্রেয় মনে করেন ও তৎক্ষণাৎ প্রাণত্যাগ করেন। শিব পত্নীবিয়োগের যন্ত্রণায় ও ক্ষোভে রুদ্রমূর্তি ধারণ করেন এবং দক্ষের মাথা কেটে সেখানে ছাগলের মাথা জুড়ে দেন, উল্লেখ্য, ছাগল বলিতে ব্যবহৃত হয়।
শিব-সম্বন্ধীয় অধিকাংশ পৌরাণিক কাহিনিই সন্ন্যাসধর্ম ও সংসারধর্ম উভয়েরই অধিকারী শিবের ঐশ্বরিক সংজ্ঞার টানাপোড়েনের গল্প। শিব এমন এক দেবতা, যার মধ্যে ঋষিদের সংযম ও দেবতাদের পৌরুষ– দুই-ই আছে। প্রকৃতপক্ষে শিব এমন এক সূক্ষ্ম চেতনা যা অনুভূতি গ্রাহ্য। ভক্ত নিজগুণে তাকে নানারূপে দেখে এগুলি তার ই সংকলন মাত্র।
কঠিন তপস্যারত শিবের সংযম ভঙ্গ করতে প্রেমের দেবতা মদন (কামদেব) শিবের ওপর কামশর ছুঁড়তে উদ্যত হলে শিব তাঁর তৃতীয় নেত্রের মাধ্যমে কামকে ভস্ম করেন। কিন্তু, হিমালয়ের কন্যা পার্বতী তাঁর নিজ গুণ দ্বারা শিবের মন জয় করলে পার্বতীর অনুরোধে শিব মদনকে বিদেহী রূপে পুনর্জীবিত করেন।
ব্রহ্মার পঞ্চম মস্তক কেটে দেওয়ায় শিবের ওপর ব্রহ্মহত্যার মহাপাপ পড়ে এবং তাকে প্রায়শ্চিত্ত করতে হয় এবং ভিক্ষুক যাযাবর কাপালিকদের মতো মহাব্রত পালন করতে বাধ্য হতে হয়। শিবের এই মহাব্রত (ত্যাগিজীবন) পালন কাপালিকের তপস্যাধর্মের প্রমাণ, যারা তাদের তান্ত্রিক সংস্কার রক্ষার জন্য সচেষ্ট থাকেন। শিব ও পার্বতীর পুত্র স্কন্দের জন্মের কাহিনিটিও বেশ জটিল। একদিকে সে যেমন শিব-পার্বতীর পুত্র, তেমনি সে অগ্নি ও ৬ জন কৃত্তিকার-ও সন্তান, যার জন্ম হয় ভয়ানক তারকাসুরকে বোধ করতে।
তারকাসুরের তিন পুত্র পরে তিনটি দানব নগরী স্থাপন করে, যেগুলোকে শিব তাঁর পিনাকী ধনুকের একটিমাত্র বাণ দিয়ে একবারে ধ্বংস করেন। অন্ধক নামে এক পার্বতীর প্রতি লালায়িত হয় এবং শিব তাকে পরাস্ত করেন। শিবের অজান্তে পার্বতী যখন গণেশকে তৈরী করেন এবং গণেশ শিবকে চিনতে না পেরে তাঁকে পার্বতীর ঘরে ঢুকতে না দিলে শিব তার মস্তক ছেদ করেন। পরে সেই কাটা মাথায় দক্ষের মতোই হাতির মাথা জুড়ে দেওয়া হয়। এক যুদ্ধে গণেশ তাঁর একটি হস্তীদন্ত হারান। (অন্য একটি কাহিনিতে এও জানা যায়, গণেশ নিজেই তাঁর একটি হস্তীদন্ত ভেঙে বেদব্যাস প্রণীত মহাভারত লেখার কাজে ব্যবহার করেছিলেন।)
দেবী
দেবী হলেন দেবতারও আরাধ্য ঈশ্বরের রূপ যা স্ত্রীরুপে কল্পিত। নির্গুণ ব্রহ্মের চালিকা শক্তি ক দেবীরুপে ভাবা হয়। বস্তুত ব্রহ্ম ও শক্তি এক ও অভেদ।
‘আদ্যাশক্তি’ মহামায়া শিবের অর্ধ অংশ, তিনি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের জননীস্বরূপা এবিং প্রাণ, চেতনা, শক্তি ও মায়ার নিয়ন্তা। তাঁকে মাতৃ বা পত্নী রূপে বর্ণনা করলে, তাঁর সুন্দর, শান্ত, সৌম্য নারীমূর্তি কল্পনা করা হয়, যেমন – শিবের স্ত্রী পার্বতী, বিষ্ণুর স্ত্রী লক্ষ্মী এবং ব্রহ্মার স্ত্রী সরস্বতী। অন্যদিকে রয়েছে তাঁর ভয়ংকরী ‘যুদ্ধং দেহি’ রূপ – দুর্গা, যে রূপে তিনি মহিষরূপী মহিষাসুরকে দশ-অস্ত্রে দমন করেছেন। দেবীর সবচেয়ে ভয়ংকরী রূপ কালী বা চামুণ্ডা, যিনি রক্তবীজের সমস্ত রক্ত পান করে নেন। (রক্তবীজের শরীরের এক বিন্দু রক্ত মাটিতে পড়লেই তা থেকে অসুরের জন্ম হত।)
অন্যান্য দেবদেবী
হিন্দু ধর্মে বিষ্ণু, শিব ও দুর্গা ছাড়াও অন্যান্য অনেক দেবতাও পূজিত হন। বলা হয়, হিন্দু ধর্মে তেত্রিশ রকমের দেবতা রয়েছেন। ব্রহ্মার গুরুত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় পরবর্তী বৈদিক যুগের আরণ্যক ও উপনিষদে। বেদে তিনিই ছিলেন প্রজাপতি, পরে তাকেই সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মায় রূপান্তরিত করা হয়। তাঁর সমস্ত সৃষ্টিই বারংবার পুনরাবৃত্ত হয় বলে বিশ্বাস। ব্রহ্মাণ্ডের চিরন্তন সত্তার মূল আধার হলেন বিষ্ণু, শিব অথবা শক্তি, কিন্তু ব্রহ্মা তার স্রষ্টা মাত্র (অথবা পুনঃস্রষ্টা)।
ঋগ্বেদের ৩৩ জন দেবতার নামোল্লেখ রয়েছে, যাঁদেরকে ‘ত্রিদশ’ (তেত্রিশ) বলা হয়। তাঁরা হলেন দ্বাদশ (১২) আদিত্য, অষ্ট (৮) বসু, একাদশ (১১) রুদ্র এবং অশ্বিনীদ্বয় (২)। দেবতাদের রাজা ‘ইন্দ্র’-কে শক্র বলা হয়, তিনি এই ৩৩ দেবতার সর্বপ্রথম জন। তাঁর পরেই রয়েছেন অগ্নি। এই দুই দেবভ্রাতার জোড়কে সাধারণত ইন্দ্র-অগ্নি, মিত্র-বরুণ ও সোম-রুদ্র বলা হয়।
নির্দিষ্ট দেবতারা কিছু বিশেষ চরিত্র ও চিহ্ন ধারণ করেন, যেমন – ইন্দ্র (দেবতাদের রাজা, যাঁর রাজধানী অমরাবতী, তাঁর হাতে থাকে বজ্র এবং তিনি বৃষ্টির দেবতা), বরুণ[5] (জলের দেবতা), যম (মৃত্যুর দেবতা), কুবের (ঐশ্বর্য, অলংকার ও সম্পদের দেবতা বা রক্ষক), অগ্নি (আগুনের দেবতা), সূর্য (সূর্যের দেবতা), বায়ু (বাতাসের দেবতা) এবং চন্দ্র বা সোম (চাঁদের দেবতা)। ইন্দ্র, যম, বরুণ ও কুবেরকে ‘দিক্পাল’ বা লোকপাল বলা হয়, এরা চতুর্দিকের অধিপতি। শিব ও পার্বতীর দুই পুত্র – গণেশ ও কার্তিক। কার্তিক যুদ্ধের দেবতা তথা দেব-সেনাপতি এবং গণেশ সিদ্ধির দেবতা, যিনি সকল বিঘ্ন-বাধা নষ্ট করেন। মদন হলেন প্রেমের দেবতা, এঁকে শিব ভস্ম করেন এবং পুনর্জন্ম দেন।
দেবীদের মধ্যে, বিষ্ণুর স্ত্রী লক্ষ্মী, সম্পদ ও সৌভাগ্যের দেবী। ব্রহ্মার স্ত্রী সরস্বতী হলেন বিদ্যা, কলা ও সংগীতের দেবী।
জীবজন্তু
এসব দেবদেবী ছাড়াও হিন্দু ধর্মে অসংখ্য অলৌকিক জীবজন্তুর কথা বলা হয়েছে, যারা পৃথিবীতেই বাস করে। ‘নাগ’-রা হল অর্ধেক মানুষ আর অর্ধেক সাপ, যারা প্রচুর ধনসম্পদের রক্ষক হিসেবে পাতালের ভোগবতী নগরে বাস করে। ‘যক্ষ’-রা হল এক ধরনের বামন আকৃতির জীব, যারা গ্রামের মানুষের পুজো পায় (কুবের একজন যক্ষ)। ‘গন্ধর্ব’ হল ইন্দ্রের সমস্ত সুদৃশ পুরুষ দাস এবং স্বর্গের গায়ক ও বাদক। এদের সহযোগীরা হল ‘কিন্নর’, এরা অর্ধেক মানুষ ও অর্ধেক ঘোড়া (গ্রিক পুরাণের ‘সেন্টর’দের সাথে মিল রয়েছে)। গন্ধর্বদের স্ত্রী সহকারীরা হল ‘অপ্সরা’। তারা অপরূপ সুন্দরী, লাস্যময়ী ও স্বাধীন, প্রধানত এরা ঘর তপস্যারত ঋষিদের ধ্যান ভঙ্গ করার জন্য বিখ্যাত। এছাড়াও ‘বিদ্যাধর’ নামে কিছু জীবের কথা রয়েছে, যারা স্বর্গের উড়ন্ত জাদুকর, এরা হিমালয় ও বিন্ধ্যের রহস্যময় নগরে বাস করে।
বৈদিক স্তোত্রের স্রষ্টা ও প্রাচীন কালের মহান প্রাজ্ঞ ব্যক্তিরা হলেন ঋষি। এই দলের প্রধানের হলেন ‘সপ্তর্ষি’ বা সাতজন ঋষি, যাঁরা সপ্তর্ষিমণ্ডলের সাতটি তারা দ্বারা চিহ্নিত। এঁদের নাম – মরীচি, অত্রি, অঙ্গিরা, পুলস্ত্য, পুলহ, ক্রতু ও বশিষ্ঠ। অন্যান্য ঋষিরা হলেন ‘কশ্যপ’ ও ‘দক্ষ’, যাঁরা দেবতা ও মানুষের মিলনে জাত, ‘নারদ’, যিনি বীণার আবিষ্কর্তা এবং অন্যতম বৈষ্ণব (বিষ্ণুর ভক্ত), ‘বৃহস্পতি’ ও ‘শুক্র’, যাঁরা যথাক্রমে দেবতা আর অসুরদের গুরু, ‘অগস্ত্য’, যিনি দক্ষিণ ভারতে বৈদিক ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রচার করেন। ‘পিতৃ’-রা হলেন পিতা বা পূর্বপুরুষের আত্মা, মৃত ব্যক্তিদের তর্পণের সাথে এরাই জড়িত।
অসুরেরা হল দুর্বৃত্ত বা অশুভ শক্তির অধিকারী জীব, যারা সর্বদাই ক্ষমতার লোভে দেবতাদের সাথে যুদ্ধ করতে চায়, এরা কোনো কোনো সময় আলোড়ন তৈরী করলেও কক্ষনো জয়ী হয় না (অসুর কথার অর্থ ‘দেবতা নয় যে’)। অসুরদের মধ্যে রয়েছে কশ্যপ ঋষির স্ত্রী দিতির পুত্রগণ ‘দৈত্য’ আর দনুর পুত্রগণ ‘দানব’। অসুরদের নানা গোষ্ঠীও রয়েছে, যেমন – কালকেয় ও নিবাতকবচ। এদের কয়েকজন উল্লেখযোগ্য নেতারা হলেন – বৃত্র, হিরণ্যকশিপু, বলি ইত্যাদি। এই অসুরেরা বেশিরভাগই বিষ্ণু অথবা ইন্দ্রের হাতে নিহত হয়। ‘রাক্ষস’রা হল পুলস্ত্যের পুত্র, এদের প্রধান নায়ক হল রাবণ, যাকে বিষ্ণুর অবতার রাম বধ করেন। এছাড়াও আরও কিছু জীব রয়েছে, যেমন ‘পিশাচ’, যারা বিধ্বংসী যুদ্ধক্ষেত্রে ও শ্মশানে হানা দেয়। ‘ভূত’ ও ‘প্রেত’ হল নগ্ন অতৃপ্ত আত্মা, যাদের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে, কিন্তু মৃত্যুর পর আত্মার শান্তি বা শ্রাদ্ধ হয়নি।
যুদ্ধ
দেবাসুর সংগ্রাম
ত্রিভুবনের অধিকার নিয়ে দেবতা ও অসুরদের মধ্যে বারোটি বিধ্বংসী যুদ্ধ সংঘটিত হয়, যথা – বরাহ, নৃসিংহ, তারকবধ, অন্ধকবধ, ত্রিপুর, সমুদ্র মন্থন, বামন, ধ্বজাপাত, আদিবক, কোলাহল, বৃত্রসংহার ও হলাহল। প্রথম যুদ্ধে বরাহ কারণ-সমুদ্রে হিরণ্যাক্ষকে বধ করে তার পাপ নিবারণ করেন। দ্বিতীয় যুদ্ধে নৃসিংহ হিরণ্যকশিপু নামে দৈত্যকে বধ করেন। তৃতীয় যুদ্ধে কার্তিক বজ্রাঙ্গের পুত্র তারকাসুরকে বধ করেন। হিরণ্যাক্ষের পালিত পুত্র অন্ধককে চতুর্থ যুদ্ধে হত্যা করেন বিষ্ণু। পঞ্চম যুদ্ধে তারকাসুরের তিন পুত্রকে দেবতারা হারাতে ব্যর্থ হলে শিব তাদের হত্যা করেন। সমুদ্র মন্থনে ইন্দ্র মহাবলিকে পরাস্ত করেন। বামন অবতারে বিষ্ণু ত্রিভুবনকে অধিকারে নিয়ে মহাবলিকে পাতালে বন্দি করেন। অষ্টম যুদ্ধে ইন্দ্র নিজে বিপ্রচিত্ত ও মায়ার দ্বারা অদৃশ্য তার অনুগামীদের বধ করেন। নবম যুদ্ধে ইক্ষ্বাকুর প্রপৌত্র কাকুষ্ঠের সহায়তায় ইন্দ্র আদিবককে বোধ করেন। কোলাহল যুদ্ধে শুক্রাচার্যের দুই অসুরপুত্রকে বোধ করেন শিব। একাদশ যুদ্ধে বিষ্ণুর মন্ত্রণায় ইন্দ্র দানবরাজ বৃত্রকে হত্যা করেন। দ্বাদশ যুদ্ধে অসুরদের হারাতে ইন্দ্রকে সাহায্য করেন নহুষের ভাই রাজি।
অস্ত্রশস্ত্র

হিন্দু পুরাণে তথা প্রাচীন গ্রন্থগুলোতে কিছু অতিপ্রাকৃত অস্ত্রশস্ত্রের কথা বলা হয়েছে, যেগুলোর এক-একটা এক বিশেষ দেবতা (যেমন ইন্দ্রের বজ্র) অথবা বিশেষ নায়কেরা ব্যবহার করতেন। এই অস্ত্রগুলি মানুষের ব্যবহৃত সাধারণ অস্ত্রশস্ত্র থেকে (তরোয়াল, গদা, ঢাল, তির, ধনুক, ছুরি, বর্শা ইত্যাদি) থেকে অনেকটাই আলাদা। অনেকক্ষেত্রেই দেখা যায়, মানুষ কিংবা রাক্ষসেরা তাদের তপস্যাফল হিসেবে দেবতা নয়তো ঋষিদের কাছ থেকে দিব্যাস্ত্রগুলো উপহার পেয়েছে।
হিন্দুধর্মে দেবতাদের অনেক ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করতে দেখা যায়, যেমন – আগ্নেয়াস্ত্র, ব্রহ্মাস্ত্র, গরুড়াস্ত্র, কৌমদকী, নারায়ণাস্ত্র, পশুপতাস্ত্র, শিবধনু, সুদর্শন চক্র, ত্রিশূল, বৈষ্ণবাস্ত্র, বরুণাস্ত্র ও বায়বাস্ত্র।
যদিও এদের কিছু অস্ত্রকে বর্ণনা অনুযায়ী সাধারণ অস্ত্রের সাথে তুলনা করা যায়, (যেমন – শিবধনু হল একটি ধনুক, সুদর্শন চক্র হল একটি চাকতি আর ত্রিশূল হল বর্শাজাতীয় কিছু), আবার কিছু অস্ত্র আছে, যা সম্পূর্ণ অলৌকিক ও দিব্য – ব্রহ্মাস্ত্র ও আগ্নেয়াস্ত্র। (সংস্কৃতে ‘অস্ত্র’ বলতে সেসব হাতিয়ারকে বোঝানো হয়, যা শত্রুর দিকে ছুঁড়ে দেওয়া হয়, কিন্তু ‘শস্ত্র’জাতীয় হাতিয়ারগুলো ছোঁড়া হয় না।) আরও কিছু অস্ত্রের কথা আছে, যেগুলোকে ব্যবহার করতে বিরাট জ্ঞানের দরকার হয়, লক্ষণীয়, এই দিব্যাস্ত্র-গুলোকে শিল্পকলা, সাহিত্য এমনকি চলচ্চিত্রেও ধনুকে জুড়ে দেওয়ার দৈব তির হিসেবে দেখানো হয়।
কিছু অস্ত্রের নাম এদের ক্রিয়াপদ্ধতির সাথে জড়িত, অথবা নামটি প্রকৃতির কোনো শক্তির সাথে সম্পর্কিত। মহাভারতে আছে, যখন নাগাস্ত্র (নাগ মানে সাপ) ছোঁড়া হয়েছিল, তখন আকাশ থেকে অসংখ্য সাপ নেমে এসে শত্রুকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছিল। একইভাবে আগ্নেয়াস্ত্র শত্রুকে আগুনে পুড়িয়ে দিতে ব্যবহৃত হয়, আবার বরুণাস্ত্র কাজে লাগে আগুন নেভাতে আর বন্যা আনতে। ব্রহ্মাস্ত্রের মতো কিছু অস্ত্র বিশেষ ব্যক্তি বা বস্তুকে উদ্দেশ্য করে ছোঁড়া যায়।
অস্ত্র বাদে সুরক্ষার জন্য ব্যবহৃত হত, এমন কিছু পৌরাণিক জিনিস হল – ঢাল, কবচ, কুণ্ডল, মুকুট ইত্যাদি।
মহাপ্লাবন
শতপথ ব্রাহ্মণের মতো কিছু হিন্দু গ্রন্থে ‘মহাপ্লাবন’-এর কথা বলা আছে।[6] অন্যান্য অনেক ধর্ম ও সংস্কৃতিতে বর্ণিত মহাপ্লাবনের সাথে হিন্দু মহাপ্লাবনের যথেষ্ট মিল রয়েছে। ভগবান বিষ্ণু একটি মাছের রূপ (মৎস্য অবতার) ধারণ করে মনুকে আসন্ন বিধ্বংসী মহাপ্লাবনের কথা জানান এবং তাকে রক্ষা করেন। এই ভাবে তিনি ধার্মিক মনু এবং সমস্ত পশুপাখি-গাছপালাকে বাঁচিয়ে পাপপূর্ণ পৃথিবীকে ভয়ানক বন্যা ও জলোচ্ছ্বাসে বিনষ্ট করেন ও নতুন যুগের সূচনা করেন।[7]
এই মহাপ্লাবনের পরই ‘মনুস্মৃতি’ লেখা হয় বলে বিশ্বাস। বেদ-নির্ভর এই গ্রন্থে ধর্মতত্ত্ব, নীতিকথা এবং বর্ণাশ্রমে বিভক্ত সমাজব্যবস্থার কথা রয়েছে।[8][9]
ইক্ষ্বাকু বংশ
মনুর পুত্র ইক্ষ্বাকু প্রথম আদর্শ মানুষ হিসেবে সূর্যবংশের প্রতিষ্ঠা করেন। এই বংশেই সত্যবাদী হরিশ্চন্দ্র এবং পুরুষোত্তম শ্রীরামের মতো রাজারা জন্ম নিয়েছিলেন।
ভারতবর্ষ
দুষ্মন্ত ও শকুন্তলার পুত্র ভরত প্রথমবার সারা বিশ্ব জয় করেন এবং তাঁর নাম অনুসারে ঐক্যবদ্ধ বিজিত ভূমির নাম রাখা হয় ‘ভারতবর্ষ’। তাঁর বংশের নাম হয় চন্দ্রবংশ। এই বংশেই মহাভারতের পাণ্ডব ও কৌরবরা জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
আরও দেখুন
- বৈদিক পুরাণ
- হিন্দু দেবদেবী
- হিন্দু ধর্মগ্রন্থ
- হিন্দু মহাকাব্য
- গণেশ
- ভারতের ইতিহাস
তথ্যসূত্র
- Jacqueline Suthren Hirst, Myth and history, inThemes and Issues in Hinduism, edited by Paul Bowen. Cassell, 1998.
- "সংরক্ষণাগারভুক্ত অনুলিপি"। ২১ জুলাই ২০১২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১০ নভেম্বর ২০১৬।
- http://www.swaminarayan.org/faq/hinduism.htm
- "সংরক্ষণাগারভুক্ত অনুলিপি"। ৬ অক্টোবর ২০১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১১ নভেম্বর ২০১৬।
- Shirgaonkar, Varsha. "Mythical Symbols of Water Charities." Journal of the Asiatic Society of Mumbai 81 (2007): 81.
- The great flood – Hindu style (Satapatha Brahmana)
- Sunil Sehgal (১৯৯৯)। Encyclopaedia of Hinduism: T-Z, Volume 5। Sarup & Sons। পৃষ্ঠা 401। আইএসবিএন 81-7625-064-3।
- Matsya Britannica.com
- Klaus K. Klostermaier (২০০৭)। A Survey of Hinduism। SUNY Press। পৃষ্ঠা 97। আইএসবিএন 0-7914-7082-2।
গ্রন্থপঞ্জি
- Dowson, John (১৮৮৮)। A Classical Dictionary of Hindu Mythology and Religion, Geography, History, and Literature। Trubner & Co., London।
- Buitenen, J. A. B. van; Dimmitt, Cornelia (১৯৭৮)। Classical Hindu mythology: a reader in the Sanskrit Puranas। Philadelphia: Temple University Press। আইএসবিএন 0-87722-122-7।
- Campbell, Joseph (২০০৩)। Myths of light: Eastern Metaphors of the Eternal। Novato, California: New World Library। আইএসবিএন 1-57731-403-4।
- Dallapiccola, Anna L. (২০০২)। Dictionary of Hindu Lore and Legend। আইএসবিএন 0-500-51088-1।
- Pattanaik, Devdutt (2003). Indian mythology: tales, symbols, and rituals from the heart of the Subcontinent. Inner Traditions/Bear & Company. আইএসবিএন ০-৮৯২৮১-৮৭০-০.
- Walker, Benjamin (১৯৬৮)। Hindu World: An Encyclopedic Survey of Hinduism। London: Allen & Unwin।
- Wilkins, W.J. (১৮৮২)। Hindu mythology, Vedic and Purānic। Thacker, Spink & co.।
- Williams, George (২০০৩)। Handbook of Hindu mythology। ABC-Clio Inc। আইএসবিএন 1-57607-106-5।
- Macdonell, Arthur Anthony (১৯৯৫)। Vedic mythology। Delhi: Motilal Banarsidass। আইএসবিএন 81-208-1113-5।
বহিঃসংযোগ
- Clay Sanskrit Library publishes classical Indian literature, including the Mahabharata and Ramayana, with facing-page text and translation. Also offers searchable corpus and downloadable materials.
- Sanskrit Documents Collection: Documents in ITX format of Upanishads, Stotras etc.