পুরুষসূক্ত

পুরুষসূক্ত (সংস্কৃত: पुरुष सूक्त) হল ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের অন্তর্গত একটি স্তোত্র (৯০ সংখ্যক স্তোত্র)। এটি "পরব্রহ্ম" বা পুরুষের উদ্দেশ্যে উৎসর্গিত। এই স্তোত্রের মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষি হলেন নারায়ণ। হিন্দুরা বিশ্বাস করেন, এই সূক্ত সাধকের ঈশ্বর-অনুভূতি জাগ্রত করতে পারে।[1] এই স্তোত্রের একটি সংস্করণে ১৬টি শ্লোক পাওয়া যায়, যার মধ্যে প্রথম ১৫টি অনুষ্টুপ ছন্দে ও শেষ শ্লোকটি ত্রিষ্টুপ ছন্দে রচিত। এই স্তোত্রের অপর একটি সংস্করণে ২৪টি শ্লোক পাওয়া যায়। সম্ভবত মন্ত্রদ্রষ্টা নারায়ণের সম্মানে এই সংস্করণের প্রথম ১৮টি মন্ত্রের নাম "পূর্ব-নারায়ণ" এবং শেষ অংশের নাম "উত্তর-নারায়ণ"।

সায়নের ভাষ্য সমেত পুরুষসূক্তের প্রথম দুটি শ্লোক। ম্যাক্সমুলারের ঋগ্বেদ সংহিতা, দ্য সেক্রেড হিমস অফ দ্য ব্রাহ্মণস (পুনর্মুদ্রণ, লন্ডন, ১৯৭৪) বই থেকে।

অনুবাদ (মূলসহ)

সহস্র মাথা চোখ পা বিশিষ্ট পুরুষ বিশ্বভূবনকে পরিব্যাপ্ত ক'রে ১০ অঙ্গুলিতে অধিষ্ঠিত আছেন । ১ ( সহস্রশীর্ষা পুরুষঃ সহস্রাক্ষঃ সহস্রপাৎ । সঃ ভূমিং বিশ্বতো বৃত্বাত্যতিষ্ঠদ্দশাঙ্গুলম্ ।। ) যা কিছু আছে ছিলো হবে সব পুরুষই । অধিকন্ত অমৃতত্ব ও যা কিছু অন্নে জীবন ধারণ করে সেসকলের অধিকর্তৃ ।। ২ ( পুরুষ এবেদং সর্বং যদ্ভূতং যচ্চ ভব্যম্ । উতামৃতত্বস্যেশানো যদন্নেনাতিরোহতি )

বিষয়বস্তু

পুরুষসূক্তে ব্রহ্মাণ্ডের আধ্যাত্মিক একত্ব বর্ণিত হয়েছে। এই স্তোত্রে পুরুষ বা পরব্রহ্মের স্বরূপ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তাকে একাধারে সৃষ্ট জগতের বোধগম্য ও অনধিগম্য বলে উল্লেখ করা হয়েছে।[2] পুরুষসূক্ত অনুযায়ী, এই পুরুষের থেকেই মূল ক্রিয়ামূলক ইচ্ছাশক্তির (যাকে বিশ্বকর্মা, হিরণ্যগর্ভ বা প্রজাপতি মনে করা হয়) উদ্ভব হয়। এই ইচ্ছাশক্তিই মহাবিশ্ব ও মহাকালের পরিপ্রেক্ষিতে ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করে।[3] পুরুষসূক্তের সপ্তম শ্লোকটি সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে একটি সম্পর্ক দেখায়।

পুরুষ

সূক্তের দ্বিতীয় থেকে পঞ্চম শ্লোকে পুরুষের সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। তাকে জগতের সকল চৈতন্যময় জীব ও জড় বস্তুর মধ্যে অন্তর্নিহিত এক সত্ত্বা হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। কাব্যিক ভাষায় তার এক হাজার মাথা, এক হাজার হাত ও এক হাজার পায়ের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে এবং বলা হয়েছে এই বিশ্বাস স্বরূপ নিয়েও তিনি মাত্র দশ আঙুল পরিমিত স্থানে জগতকে আবদ্ধ করে আছেন। অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের সকল আবির্ভূত সত্ত্বাই পুরুষ স্বয়ং।[2] আরও বলা হয়েছে যে, তিনি তার সৃষ্টিরও বাইরে যেতে পারেন। সাকার রূপে পুরুষের বিশালত্ব এবং মনের অধিগম্য ক্ষেত্রের বাইরে তার অবস্থানকে সর্বেশ্বরবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয়। সবশেষে এই পুরুষের গৌরব বর্ণনা করতে গিয়ে বলা হয়েছে, তার গৌরব এই সূক্তে উল্লিখিত গৌরবের চেয়ে অনেক বেশি।

সৃষ্টিতত্ত্ব

পুরুষসূক্তের পঞ্চম থেকে পঞ্চদশ শ্লোকে ঋগ্বেদের সৃষ্টিতত্ত্ব ব্যাখ্যা করা হয়েছে। সূক্ত অনুসারে, পুরুষের বিরাট নামক বিশ্বরূপ হল সৃষ্টির উৎস। বিরাটের মধ্যে সর্বব্যাপী জ্ঞানের আবির্ভাব ঘটে এবং বিরাট থেকে বৈচিত্র্যের সৃষ্টি হয়। শেষের দিকের শ্লোকগুলিতে বলা হয়েছে, পুরুষ নিজেকে আহুতি দিয়ে পক্ষী, বন্য ও গবাদি পশু, তিন বেদ, মন্ত্রের ছন্দ সৃষ্টি করেন। তার মুখ, বাহু, জঙ্ঘা ও পা থেকে চার বর্ণের জন্ম হয়। পুরুষের মন থেকে চন্দ্র[4] ও চোখ থেকে সূর্যের জন্ম হয়। তার মুখ ও নিঃশ্বাস থেকে ইন্দ্র ও অগ্নির জন্ম হয়। তার নাভি থেকে আকাশ, মাথা থেকে স্বর্গ, পা থেকে পৃথিবী ও কান থেকে অন্তরীক্ষের জন্ম হয়।[2] এই সৃষ্টিকর্মের মাধ্যমে মানুষ, জাগতিক ও মহাজাগতিক সকল সত্ত্বার মধ্যে একত্ব স্থাপিত হয়। কারণ, সবই সেই একক সত্ত্বা পুরুষের অংশসম্ভূত।[5]

যজ্ঞ

পুরুষসূক্তে বলা হয়েছে, পুরুষের কৃত যজ্ঞের মাধ্যমে এবং যজ্ঞ থেকে জগৎ সৃষ্টি হয়েছে। এই আদি যজ্ঞ থেকেই যাবতীয় সৃষ্টি রূপ ধারণ করেছে। সপ্তদশ শ্লোকে বলা হয়েছে যে, এই আদি যজ্ঞ থেকেই যজ্ঞের ধারণার উৎপত্তি হয়েছে। শেষ শ্লোকগুলিতে সকল সৃষ্টির আদিশক্তি রূপে যজ্ঞের গৌরব ঘোষিত হয়েছে।[6]

ব্যাখ্যা

বৈদান্তিকেরা পুরুষসূক্তকে উপাসনা, জ্ঞান, ভক্তি, ধর্ম ও কর্মের রূপক হিসেবে গ্রহণ করেন। আবার বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের ধারণাটির জন্য এটি বৈষ্ণব ভেদাভেদ দর্শনের মূল ভিত্তি হিসেবে দৃষ্ট হয়।[7] পুরুষের ধারণাটি সাংখ্য দর্শনেও পাওয়া যায়।

পুরুষসূক্তের উল্লেখ পাওয়া যায় অথর্ববেদ (১৯।৬), সামবেদ (৬।৪), যজুর্বেদ (বাজসনেয়ী ৩১।১-৬) ও তৈত্তিরীয় আরণ্যকের (৩।১২,১৩) মতো বৈদিক গ্রন্থে। শতপথ ব্রাহ্মণ, তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ, শ্বেতাশ্বেতর উপনিষদ্মুদগল উপনিষদে এর ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। আধুনিক হিন্দুধর্মে গায়ত্রী মন্ত্রের মতো যে অল্প কয়েকটি ঋগ্বৈদিক স্তোত্র প্রচলিত আছে, তার মধ্যে এটি একটি। বাজসনেয়ী সংহিতা (৩১। ১-৬), সামবেদ সংহিতা (৬।৪) ও অথর্ববেদ সংহিতায় (১৯।৬) এই সূক্তের অর্থব্যাখ্যা সহ উল্লেখ পাওয়া যায়। পৌরাণিক সাহিত্যের মধ্যে ভাগবত পুরাণ (২।৫।৩৫ থেকে ২।৬।১-২৯) ও মহাভারতে (মক্ষধর্মপর্ব ৩৫১ ও ৩৫২) এই শ্লোকের ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে।

আরও দেখুন

পাদটীকা

  1. The Significance of the Purusha sukta in Daily Invocations by Swami Krishnananda.
  2. The Purusha sukta in Daily Invocations by Swami Krishnananda
  3. Krishnananda. p. 19
  4. Madhavananda, Swami. Brihadaranyaka Upanishad. Advaita Ashram, Verse 1.5.14.
  5. Koller, p. 44.
  6. Koller, p. 45-47.
  7. Haberman, David L. River of Love in an Age of Pollution: The Yamuna River of Northern India. University of California Press; 1 edition (September 10, 2006). P. 34. আইএসবিএন ০৫২০২৪৭৯০৬.

তথ্যসূত্র

  • Coomaraswamy, Ananda, Rigveda 10.90.1: aty atiṣṭhad daśāṅgulám, Journal of the American Oriental Society, vol. 66, no. 2 (1946), 145-161.
  • Deo, Shankarrao (Member of India's Constituent Assembly and co-author of the Constitution of India), Upanishadateel daha goshti OR Ten stories from the Upanishads, Continental Publication, Pune, India, (1988), 41-46.
  • Koller, John M. The Indian Way: An Introduction to the Philosophies & Religions of India (2nd Edition). Pearson Education, 2006. আইএসবিএন ০১৩১৪৫৫৭৮৮.
  • Swami Amritananda's translation of Sri Rudram and Purushasuktam,, Ramakrishna Mission, Chennai.
  • Krishnananda, Swami. A Short History of Religious and Philosophic Thought in India. Divine Life Society.
  • Patrice Lajoye, "Puruṣa", Nouvelle Mythologie Comparée / New Comparative Mythologie, 1, 2013: http://nouvellemythologiecomparee.hautetfort.com/archive/2013/02/03/patrice-lajoye-purusha.html

বহিঃসংযোগ

This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.