বাল্মীকি

বাল্মীকি (সংস্কৃত: वाल्मीकि) (খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০ অব্দ, উত্তর ভারত) [1] সংস্কৃত সাহিত্যের আদিকবি নামে কথিত। রামায়ণ মহাকাব্যের বর্ণনা অনুযায়ী, তিনিই এই কাব্যের রচয়িতা।[2] বাল্মীকিকে আদিকবি বা কবিগুরু বলার কারণ, প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী, তিনিই প্রথম সংস্কৃত কাব্যে শ্লোকের রচয়িতা। তাকে রামায়ণ ব্যতীত যোগবাশিষ্ঠ নামক অপর এক হিন্দু ধর্মগ্রন্থের রচয়িতাও মনে করা হয়। বাল্মীকিধর্ম রামায়ণযোগবাশিষ্ঠ গ্রন্থদ্বয়ে বর্ণিত বাল্মীকির শিক্ষা অবলম্বনে সংগঠিত একটি ধর্মীয় আন্দোলন।

রামায়ণ রচনা করছেন বাল্মীকি

খ্রিষ্টীয় প্রথম শতাব্দী থেকেই বাল্মীকিকে ধ্রুপদি সংস্কৃত সাহিত্যের জনক মনে করা হতে থাকে। অশ্বঘোষের বুদ্ধচরিত কাব্যে আছে:

"বাল্মীকির কণ্ঠস্বর এমন এক কাব্য উচ্চারণ করেছিল যা মহাদার্শনিক চ্যবনও রচনা করতে পারেন নি।"

এই উক্তি ও তার পূর্বাপর শ্লোকগুলির বক্তব্য থেকে বাল্মীকি ও চ্যবনের মধ্যে একটি পারিবারিক সম্পর্কের কথা অনুমিত হয়ে থাকে।[3][4]

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাল্মীকি কর্তৃক রামায়ণ রচনার নেপথ্য-আখ্যান অবলম্বনে বাল্মীকি-প্রতিভা গীতিনাট্যটি রচনা করেছিলেন।[5]

প্রথম জীবন

উত্তরকাণ্ড-এ বাল্মীকির প্রথম জীবনের একটি কাহিনি পাওয়া যায় । প্রথম জীবনে বাল্মীকি ছিলেন রাজপথের দস্যু । তিনি দস্যুবৃত্তি ক'রেই পরিবার পালন করতেন । একদিন দেবর্ষি নারদকে লুণ্ঠন করতে গেলে নারদ তাকে জিজ্ঞাসা করলেন যে তার পাপের ভাগী তার পরিবার হতে চায় কি-না । নারদের মন্ত্রণায় তিনি তার পরিবারের সদস্যদের এই প্রশ্ন করলে সকলেই জানান যে তার পাপের ভাগী তারা হতে চান না । মর্মাহত হয়ে দস্যু জীবনের পরম সত্য উপলব্ধি ক'রে তিনি নারদের নিকট ক্ষমা ভিক্ষা করেন । নারদ তাকে রাম নাম জপ করতে শেখান । দস্যু সাধনায় বসেন এবং ছয় হাজার বছর সাধনা ক'রে ব্রহ্মের বরে কবিত্বশক্তি পান । সাধনাকালে তার দেহ বল্মীকের স্তুপে ঢেকে গিয়েছিল ব'লে তার নামকরণ হয় বাল্মীকি[6] কৃত্তিবাস ওঝা বিরচিত রামায়ণের সূচনায় এই কাহিনির উল্লেখ রয়েছে। এরপর অনেকেই তার কাছ থেকে দীক্ষা নেন ও শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন।

বাল্মীকি রামায়ণ

বাল্মীকি রচিত মূল রামায়ণে ২৪,০০০ শ্লোক ছিল।[7] এই রামায়ণ ছয়টি (মতান্তরে সাতটি) কাণ্ড বা খণ্ডে বিভক্ত ছিল। রামায়ণের উপজীব্য অযোধ্যার রাজকুমার রামের জীবনকথা। খ্রিষ্টপূর্ব ৫০০ থেকে ১০০ অব্দের মধ্যে কোনো এক সময়ে এই মহাকাব্য রচিত হয়। এই মহাকাব্য মহাভারতের পূর্বসূরি।[8]

প্রথম শ্লোক

কথিত আছে, কোন একদিন মুনিবর বাল্মীকি শিষ্য ভরদ্বাজকে সাথে নিয়ে তমসা-তীর্থে স্নান করতে যাত্রা পথে প্রকৃতির অপরূপ নৈসর্গিক শোভা সন্দর্শনে বিমুগ্ধ হয়ে ইতস্তত বিচরণ করছেন। এক ব্যাধ বাল্মীকির সম্মুখেই এক ক্রৌঞ্চযুগলের মধ্যে পুরুষ ক্রৌঞ্চকে তীরবিদ্ধ করে । স্ত্রী ক্রৌঞ্চটি করুণ সুরে বিলাপ করতে থাকে । এই দৃশ্য দেখে ক্রুদ্ধ বাল্মীকির মুখ থেকে অভিশাপ বাণীর আকারে উচ্চারিত হয় সৃষ্টির প্রথম শ্লোক :

মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগমঃ শাশ্বতীঃ সমাঃ।
যৎ ক্রৌঞ্চমিথুনাদেকমবধীঃ কামমোহিতম্।।[9]

- নিষাদ , তুই চিরকাল প্রতিষ্ঠা লাভ করবি না , কারণ তুই কামমোহিত ক্রৌঞ্চমিথুনের একটিকে বধ করেছিস ।[10][11] এ পংক্তিটিকে সংস্কৃত সাহিত্য সৃষ্টিধারার আদি কবিতা ভেবে বাল্মীকিকে ‘আদি-কবি’ও বলা হয়ে থাকে ।

ব্রহ্মা কর্তৃক শ্লোকের নামকরণ

এরপর মুনিবর শিষ্যগণকে নিয়ে আশ্রমে উপবিষ্ট আছেন এমন সময়ে ব্রহ্মা উপস্থিত হলেন। তিনি ব্রহ্মাকে ব্যাধ-বৃত্তান্ত বলে স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করে শোনান। ব্রহ্মা বললেন, “শোকের সময় এটি তোমার মুখ হতে নিঃসৃত হয়েছে। অতএব, এটি শ্লোক নামে অভিহিত হউক”। তুমি এরূপ শ্লোকে রামচরিত্যাখ্যায়ক রামায়ণ গ্রন্থ রচনা কর। সেই অনুসারে মুনিবর বাল্মীকি রামায়ণ রচনা করেন।

শোক থেকে উৎপন্ন এই সংস্কৃত সাহিত্যের প্রথম শ্লোক। পরবর্তীকালে এই শ্লোকের ছন্দেই বাল্মীকি সমগ্র রামায়ণ রচনা করেন। এই কারণে এই শ্লোকটিকে হিন্দু সাহিত্যের প্রথম শ্লোক, রামায়ণকে প্রথম কাব্য ও বাল্মীকিকে আদিকবি নামে অভিহিত করা হয়।

কুশ ও লবকে রামায়ণ শিক্ষা

এর কিছুকাল পরে রামের আদেশে লক্ষ্মণ গর্ভবতী জানকী অর্থাৎ সীতাকে তার তপোবনে পরিত্যাগ করে প্রস্থান করলে বাল্মীকি মুনি সীতাকে নিজের আশ্রমে থাকার জন্য বলেন। এরপর সীতাদেবী কুশলব নামক দুই যমজ সন্তান প্রসব করলে মুনিবর রাজকুমারদ্বয়কে অতি যত্নের সাথে লালন-পালন করাসহ শিক্ষা দিতে লাগলেন এবং তাদেরকে স্বরচিত রামায়ণ পাঠ করে গান করাতে শিখালেন। রাম অশ্বমেধ যজ্ঞের অনুষ্ঠান আয়োজন করলে মুনিবর তাতে নিমন্ত্রিত হয়ে কুশীলবসহ সেখানে গমন করেন এবং রামের নিকট তাদের পরিচয় দিয়ে সীতাসহ সবাইকে পুনরায় গ্রহণের জন্য প্রস্তাব করেন। রাম এতে সম্মত দেন। কিন্তু ঈশ্বরের বিধানে সীতা গৃহীতা না হয়ে পাতালে প্রবেশ করেন। রাম পুত্রদ্বয়কে গ্রহণ করলে বাল্মীকি মুনি তাদেরকে রামায়ণের অবশিষ্টাংশ শিক্ষা প্রদান করেন।

তথ্য সূত্র

  • http://www.valmikiramayan.net/
  • সরল বাঙ্গালা অভিধান, সুবলচন্দ্র মিত্র, নিউ বেঙ্গল প্রেস প্রাইভেট লিমিটেড, কলিকাতা, ১৯৯৫।

আরও দেখুন

পাদটীকা

  1. Julia Leslie, Authority and Meaning in Indian Religions: Hinduism and the Case of Valmiki, Ashgate (2003), p. 154. আইএসবিএন ০-৭৫৪৬-৩৪৩১-০
  2. Vālmīki, Robert P. Goldman (১৯৯০)। The Rāmāyaṇa of Vālmīki: An Epic of Ancient India1। Princeton University Press। পৃষ্ঠা 14–15। আইএসবিএন 069101485X।
  3. E. B. Cowell, tr., The Buddhacharita of Asvagosha, Book I, Verse 48. Clarendon Press (1894)
  4. Ilapvuluri Panduranga Rao, Valmiki, Sahitya Akademi, India (1994) - Makers of Indian Literature - আইএসবিএন ৮১-৭২০১-৬৮০-৮
  5. সুকুমার সেন, বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত, চতুর্থ খণ্ড, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ, কলকাতা, ১৯৯৬ সং, পৃ. ১৯২
  6. Suresh Chandra। Encyclopaedia of Hindu gods and goddesses। পৃষ্ঠা 262–3।
  7. Rāmāyaṇa is composed of about 480,002 words, a quarter of the length of the full text of the Mahabharata or about four times the length of the Iliad.
  8. Goldman, Robert P., The Ramayana of Valmiki: An Epic of Ancient India pp. 23
  9. Sacred-Texts.com IAST encoded transliteration (modified from original source to accurately reflect sandhi rules)
  10. বাল্মীকি রামায়ণ - রাজশেখর বসু
  11. Buck, William and van Nooten, B. A. Ramayana. 2000, page 7

বহিঃসংযোগ


This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.