দশাবতার

দশাবতার বিষ্ণু দশ প্রধান অবতার। বৈষ্ণব দর্শনে, কোনো বিশেষ উদ্দেশ্যে মর্ত্যে অবতীর্ণ পরম সত্ত্বাকে অবতার (সংস্কৃত: अवतार, avatāra) নামে অভিহিত করা হয়। বিষ্ণুর (বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে কৃষ্ণের) দশ মুখ্য অবতারের সমষ্টিগত নামই দশাবতার। এই দশাবতারের কথা জানা যায় গরুড় পুরাণ (১।৮৬।১০-১১) থেকে। এই দশ অবতার মানব সমাজে তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তির ভিত্তিতে সর্বাপেক্ষা অধিক গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হন।

বিষ্ণুর দশাবতার (উপরের বাম কোণ থেকে ঘড়ির কাঁটার দিকে) মৎস্য, কূর্ম, বরাহ, বামন, কৃষ্ণ, কল্কি, বুদ্ধ, পরশুরাম, রামনৃসিংহ, (মধ্যে) কৃষ্ণ

দশাবতারের অধিকাংশই অভিহিত হন লীলা-অবতার নামে। হিন্দু বিশ্বাস অনুসারে, প্রথম চার অবতারের আবির্ভাবকাল সত্যযুগ। পরবর্তী তিন অবতার ত্রেতাযুগে অবতীর্ণ হন। অষ্টম ও নবম অবতারের আবির্ভাবকাল যথাক্রমে দ্বাপরযুগকলিযুগ। দশম অবতার কল্কির আবির্ভাব ৪২৭,০০০ বছর পর কলিযুগের অন্তিম পর্বে ঘটবে বলে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে।[1] বিষ্ণু পুরাণ–এও বলা হয়েছে, কল্কি অবতারের আগমনের সঙ্গে সঙ্গেই কলিযুগের সমাপ্তি ঘটবে। কল্কি দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন করে এক নতুন সত্যযুগের সূচনা ঘটাবেন।[2]

ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ

অনুমিত হয়, ভাগবতধর্মের অধীনে বুদ্ধকে বিষ্ণুর অবতাররূপে গ্রহণ গুপ্তযুগে (৩৩০-৫৫০ খ্রিষ্টাব্দ) দুই ধর্মের সম্পর্কের নৈকট্যের ফলস্রুতি। এই কারণে মহাযান বৌদ্ধধর্মকে অনেক সময় বুদ্ধ-ভাগবতধর্ম বলা হয়ে থাকে।[3] উল্লেখ্য, গবেষকরা মনে করেন যে এই যুগেই হিন্দুধর্মে অবতারতত্ত্ব পূর্ণ বিকাশ লাভ করে।[4]

ঐতিহাসিক বিষ্ণুধর্মের বিবর্তনের ফলে বর্তমানকালের জটিল বৈষ্ণবধর্মের উদ্ভব। বিষ্ণু, নারায়ণ, বাসুদেব ও কৃষ্ণের আরাধনাকেন্দ্রিক এই ধর্মবিশ্বাস প্রতিষ্ঠালাভ করে ভগবদ্গীতার যুগে (খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দী-খ্রিষ্টীয় তৃতীয় শতাব্দী)।[5]

দ্বাদশ অলবর নামে পরিচিত সন্তেরা তাদের আধ্যাত্মিক সঙ্গীতের মাধ্যমে এই সম্প্রদায়কে সাধারণ মানুষের মধ্যে পৌঁছিয়ে দিয়েছিলেন। পূর্বকালের অলবরগণ বিষ্ণুর অবতারদের পৃথকভাবে তালিকাভুক্ত করেননি। এমনকি তারা কৃষ্ণকেও অবতাররূপে পৃথক করেননি। তামিল ভাষায় তাদের বিষ্ণুকৃষ্ণ স্তুতিগান নালয়িরা (দিব্য প্রবন্ধ) নামে পরিচিত।[6][7]

তালিকা

১. মৎস্য
মাছরূপে সত্যযুগে অবতীর্ণ
২. কূর্ম
কচ্ছপের রূপে সত্যযুগে অবতীর্ণ
৩. বরাহ
বন্য শূকরের রূপে সত্যযুগে অবতীর্ণ
৪. নৃসিংহ
অর্ধনরসিংহরূপে সত্যযুগে অবতীর্ণ
৫. বামন
খর্বকায় বামনের রূপে ত্রেতাযুগে অবতীর্ণ
৬. পরশুরাম
পরশু অর্থাৎ কুঠারধারী রামের রূপে ত্রেতাযুগে অবতীর্ণ
৭. রাম
অযোধ্যার যুবরাজ ও রাজা রূপে ত্রেতাযুগে অবতীর্ণ
৮. কৃষ্ণ
দ্বাপরযুগে জ্যেষ্ঠভ্রাতা বলরাম সহ অবতীর্ণ। ভাগবত পুরাণ অনুসারে দ্বাপরযুগে অনন্ত নাগের অবতার বলরাম রূপে কৃষ্ণের সঙ্গে অবতীর্ণ হন। অধিকাংশ বৈষ্ণব শাখাসম্প্রদায় বলরামকে বিষ্ণুর অবতার বলে মনে করেন। যে সকল সূত্রে বুদ্ধের কোনো উল্লেখ নেই সেখানে বলরামকেই বিষ্ণুর নবম অবতার রূপে দশাবতারের অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
৯. বলরাম
কোনো কোনো মতে বিষ্ণুর নবম অবতার। (এই স্থানে বলরাম সম্পর্কে জানতে নিচে বিকল্প তালিকা দেখুন।)
১০. কল্কি
এই ভবিষ্যৎ অবতার কলিযুগের শেষ পর্বে অবতীর্ণ হবেন বলে হিন্দুরা মনে করেন।
দশাবতার: (বামদিক থেকে) মৎস্য, কূর্ম, বরাহ, নৃসিংহ, বামন, পরশুরাম, রাম, বলরাম,বুদ্ধ, কল্কি; পুথিচিত্র।

বিকল্প তালিকা

গোয়ার শ্রীবালাজি মন্দিরের দরজায় দশাবতার চিত্র; (উপরের বামকোণ থেকে ঘড়ির কাঁটার দিকে) মৎস্যম নৃসিংহ, পরশুরাম, রাম, কৃষ্ণ, কল্কি, বামন, বুদ্ধরূপী বিঠোবা, বরাহ ও কূর্ম।

দক্ষিণ ভারতে বলরামকে দশাবতারের তালিকাভুক্ত করা হয়। এই মত অনুসারে, বুদ্ধের অবতারত্ব স্বীকৃত নয়।[8] [9] কোনো কোনো গ্রন্থে আবার কৃষ্ণকে অবতার তালিকার বাইরে রাখা হয়েছে।[10][11] একাধিক মধ্যযুগীয় ধর্মসম্প্রদায়ে কৃষ্ণ স্বয়ং ভগবান নামে পরিচিত। গৌড়ীয় বৈষ্ণব,[12] বল্লভ সম্প্রদায়,[13]নিম্বার্ক সম্প্রদায়ের মতে তিনি সকল অবতারের উৎস। নিম্বার্ক মতে, কৃষ্ণ আবার শুধু সকল অবতারের উৎসই নন, তিনি স্বয়ং বিষ্ণুরও উৎস। এই বিশ্বাসের মূলে রয়েছে "ভাগবতের একটি প্রসিদ্ধ উক্তি" (১।৩।২৮)।[14]

কোনো কোনো তালিকা অনুসারে, বলরাম কৃষ্ণের জ্যেষ্ঠভ্রাতা এবং গৌতম বুদ্ধের স্থলে বিষ্ণুর নবম অবতার। ভাগবত পুরাণ –এর মতে দ্বাপরযুগে শেষনাগের অবতার রূপে বলরামের আবির্ভাব। অধিকাংশ বৈষ্ণব সম্প্রদায়ে তিনি অবতাররূপে পূজিত হন। এই সকল তালিকায় গৌতম বুদ্ধের নাম দেখা যায় না।

মহারাষ্ট্রগোয়ার ঐতিহ্য অনুসারে পঞ্চাঙ্গ ও বিভিন্ন মন্দির স্থাপত্যে বিঠোবা বিষ্ণুর নবম অবতার বুদ্ধরূপে গণ্য হন। মহারাষ্ট্রের সন্তকবিরাও বিঠোবাকে বুদ্ধের রূপে বন্দনা করেছেন।[15]

জয়দেবের দশাবতার স্তোত্র

জয়দেব রচিত প্রলয়পয়োধিজলে (গীতগোবিন্দম্ কাব্যের প্রথম সর্গের প্রথম গীত, দশাবতার স্তোত্র নামে সমধিক পরিচিত) স্তোত্রে দশটি পৃথক স্তবকে দশ অবতারের বিবরণদানের পর নিম্নোক্ত শ্লোকে দশাবতারের কীর্তির একটি সুসংবদ্ধ তালিকা প্রদান করা হয়েছে:

বেদানুদ্ধরতে জগন্তি বহতে ভূগোলমুদ্বিভ্রতে
দৈত্যং দারয়তে বলিং ছলয়তে ক্ষত্রক্ষয়ং কুর্বতে।
পৌলস্ত্যং জয়তে হলং কলয়তে কারুণ্যমাতন্বতে
ম্লেচ্ছান মূর্চ্ছয়তে দশাকৃতিকৃতে কৃষ্ণায় তুভ্যং নমঃ।।

অবতারের বৈজ্ঞানিক বিবর্তন

মৎস - পৃথিবীর তিনভাগ জল আর একভাগ স্থলে প্রথমে জলচর প্রাণীর আবির্ভাব ঘটে। কুর্ম - উভচর প্রাণী। জল ও স্থল, দুই জায়গাতেই প্রাণীর বসবাস শুরু হয়। বরাহ - কেবল স্থলে বসবাস করতে শেখে অনেক জীব। নৃসিংহ - মানব জাতির পূর্বতন পশুসুলভ অবস্থা, যখন মানুষ পূর্ণতা পায়নি। বামন - মানুষে ক্ষুদ্র বিকাশ। পরশুরাম - মানুষের আদিম পর্যায়। প্রকৃতির কোলে জীবের বাস। মানুষের জীবনযাপন জঙ্গলে। সেখান থেকেই বিবর্তনের শুরু। রাম - সমাজ বিকাশে প্রথম উন্নত পর্যায়। সমাজ, গোষ্ঠী, মানুষ-এই কৃষ্টিতে উৎকর্ষতা লাভ করে। কৃষ্ণ - নিয়ে এলেন রাজনীতি। মানুষের বিবর্তন, সমাজের ধারাবাহিক পরিবর্তন এবং টিকে থাকার লড়াইয়ে মানুষের কূটনীতিক আচরণের এই প্রথম বৈজ্ঞানিক আবির্ভাব। বুদ্ধ - জ্ঞান ছাড়া পৃথিবী বর্ণহীন, অন্ধকার। কুসংস্কার দূর করে জ্ঞানদীপ্তকরণের অবতার গৌতম বুদ্ধ। বিষ্ণুর নবম অবতার তিনি। কল্কি - আসন্ন। এখনও সমাজ শ্রীবিষ্ণুর এই অবতারের অপেক্ষায়। মানুষের মধ্যে থাকবে এমন শক্তি যা হবে ধ্বংস ও সৃষ্টির ধারক ও বাহক।[17]

আরও দেখুন

পাদটীকা

  1. B-Gita 8.17 ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২৯ এপ্রিল ২০০৯ তারিখে "And finally in Kal-yuga (the yuga we have now been experiencing over the past 5,000 years) there is an abundance of strife, ignorance, irreligion and vice, true virtue being practically nonexistent, and this yuga lasts 432,000 years. In Kali-yuga vice increases to such a point that at the termination of the yuga the Supreme Lord Himself appears as the Kalki avatara"
  2. Klostermaier (2007) p. 495
  3. Hāṇḍā, Omacanda (১৯৯৪)। Buddhist Art & Antiquities of Himachal Pradesh: Up to 8th Century A.D.। Columbia, Mo: South Asia Books। পৃষ্ঠা p. 40। আইএসবিএন 81-85182-99-X।
  4. Faculty For Indian History (Prabha IAS-IPS Coaching Centre) Arumbakkam, Chennai, INDIAN HISTORY - 2003 exams test papers। "CIH - Read history make history"। www.chandraiashistory.com। ২০০৮-০৯-১৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৮-০৮-০১19) The crystallization of the Avatara Concept and the worship of the incarnations of Vishnu were features of Bhagavatism during the answer (d) Gupta period line feed character in |শেষাংশ= at position 288 (সাহায্য)
  5. Beck, Guy L. (১৯৯৩)। Sonic theology: Hinduism and sacred sound। Columbia, S.C: University of South Carolina Press। পৃষ্ঠা p. 170। আইএসবিএন 0-87249-855-7।
  6. Annangaracariyar, P.B. (১৯৭১)। Nalayira tivviyap pirapantam। Kanci: VN Tevanatan।
  7. Seth, K.P. (১৯৬২)। "Bhakti in Alvar Saints"। The University Journal of Philosophy
  8. Britannica list of dashavatara
  9. English-Tamil dictionary
  10. The Religion of the Hindus By Kenneth W Morgan, D S Sarma p.55
  11. Iconography of Balarama By N.P. Joshi p.25
  12. Kennedy, M.T. (১৯২৫)। The Chaitanya Movement: A Study of the Vaishnavism of Bengal। H. Milford, Oxford university press।
  13. Flood, Gavin D. (১৯৯৬)। An introduction to Hinduism। Cambridge, UK: Cambridge University Press। পৃষ্ঠা 341। আইএসবিএন 0-521-43878-0। সংগ্রহের তারিখ ২০০৮-০৪-২১"Early Vaishnava worship focuses on three deities who become fused together, namely Vasudeva-Krishna, Krishna-Gopala and Narayana, who in turn all become identified with Vishnu. Put simply, Vasudeva-Krishna and Krishna-Gopala were worshiped by groups generally referred to as Bhagavatas, while Narayana was worshipped by the Pancaratra sect."
  14. Essential Hinduism S. Rosen, 2006, Greenwood Publishing Group p.124 আইএসবিএন ০-২৭৫-৯৯০০৬-০
  15. Jamanadas, K. (২০০১)। "Vitthala of Pandharpur is Buddha"। Tirupati Balaji was a Buddhist Shrine। Dalit E-Forum। সংগ্রহের তারিখ ২০০৮-০৯-২০
  16. কবি জয়দেব ও শ্রীগীতগোবিন্দ, হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, ১৩৮৪, পৃষ্ঠা ১৯২
  17. "সংরক্ষণাগারভুক্ত অনুলিপি"। ১২ ডিসেম্বর ২০১৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

তথ্যসূত্র

  • Klostermaier, Klaus K. (২০০৭)। A survey of Hinduism। Albany: Sate University of New York Press। আইএসবিএন 0-7914-7081-4।
  • Sikand, Yoginder (২০০৪)। Muslims in India since 1947: Islamic perspectives on inter-faith relations। London: RoutledgeCurzon। আইএসবিএন 0-415-31486-0।

বহিঃসংযোগ

সাধারণ

গবেষণা

This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.