বিহু
বিহু অসমের জাতীয় উৎসব। বিহুর এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল এই উৎসব জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলে একসঙ্গে উদযাপন করেন।[1] বিহু মূলতঃ এক কৃষি ভিত্তিক উৎসব।[2]। মূলতঃ তিন প্রকার বিহু উৎসব পালিত হয়, এগুলি হল ব’হাগ বিহু বা রঙ্গালী বিহু, কাতি বিহু বা কঙ্গালী বিহু এবং মাঘ বিহু বা ভোগালী বিহু।
বিহু | |
---|---|
আনুষ্ঠানিক নাম | অসমীয়া: বিহু |
পালনকারী | অসমীয়া |
ধরন | কৃষিভিত্তিক উৎসৱ ভারতীয় উৎসৱ |
বিহু শব্দের উৎপত্তি
'বিহু' শব্দের উৎপত্তি সম্বন্ধে নানান মতবাদ আছে, কিন্তু কোনো মতই সর্বসম্মত নয়। কোনো পণ্ডিতের মতে সংস্কৃত 'বিষুবত' শব্দ থেকে বিহু শব্দের উদ্ভৱব হয়েছে।[3] বৈদিক 'বিষুবন' শব্দের অর্থ বছরের যে সময়ে দিন এবং রাত সমান হয়। অনেকের মতে, বিহু শব্দটি বৈ (উপাসনা) এবং হু (গরু) এই শব্দ দুটি থেকে এসেছে। বিষ্ণুপ্রসাদ রাভার মতে বিহু শব্দটি কৃষিজীবী ডিমাসা জনজাতির মধ্যে প্রচলিত শব্দ। তারা তাদের দেবতা ব্রাই শিবরাইকে শস্য উৎসর্গ করে শান্তি ও সমৃদ্ধির প্ররার্থনা করেন। বি শব্দটির অর্থ প্রার্থনা করা এবং শু শব্দের অর্থ শান্তি ও সমৃদ্ধি। বিশু শব্দ থেকে বিহু শব্দের উৎপত্তি। অন্যমতে হু শব্দটির অর্থ দান করা।[4]
বহাগ বিহু বা রঙ্গালী বিহু
অসমর মূল বিহু উৎসব বসন্তের শুরুতে উদযাপন করা হয়। রঙ্গালী বিহু যৌবনের উৎসব। বহাগ বা রঙ্গালী বিহু সাতদিন ধরে উদযাপন করা হয়। চৈত্র সংক্রান্তির দিন থেকে আরম্ভ করে পরের মাসে ৬ তারিখ পর্যন্ত এই উৎসব হয়ে থাকে। এই সাত দিনে প্রত্যেক দিনে বিহুর পৃথক নাম রয়েছে। একে সাত বিহু বলে জনা যায়। এই উৎসবে কৃষকেরা ধান উতপাদনের জন্য জমি প্রস্তুত করেন এবং মহিলারা পিঠা, নাড়ু প্রভৃতি প্রস্তুত করেন। এই বিহুর প্রথম দিন অর্থাৎ চৈত্র সংক্রান্তির দিন গরু বিহু নামে পরিচিত। এই দিন গরুদের পরিষ্কার করিয়ে পূজা করা হয়।পরের দিন মআনুহ বিহু বা মানুষ বিহু পালন করা হয়। এই দিন নতুন বস্ত্র পরিধান করে নতুন বছর উদযাপন করা হয়। পরের দিন দেবতার মূর্তিকে স্নান করিয়ে প্রার্থনা করা হয়ে থাকে। ব্রহ্মপুত্রের উত্তর পাড়ে 'গোঁসাই বিহু বলে এই উৎসব পালন করা হয়। এই সময় বিহুগীত সহযোগে বিহু নৃত্যের মাধ্যমে যুবক যুবতীরা উৎসব পালন করে থাকেন।
রঙ্গালী বা বহাগ বিহু অনুষ্ঠান
রঙ্গালী বা বহাগ বিহু হচ্ছে আনন্দের বিহু । বৈশাখ মাসের প্রথম দিন থেকেই গান-বাজনা ও বিহু নৃত্যের মাধ্যমে রঙ্গালী বিহু অনুষ্ঠান পালন করা হয় । রঙ্গালী বিহু মূঃলত অসমিয়া জাতির সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান কিন্তু এখানে অসমের বিভিন্ন জনজাতি যেমন: বড়ো, তিবা, কছাড়ি ইত্যাদি জনজাতিরা নিজেদের সাংস্কৃতি প্রকাশ করার সুযোগ পায় । অসমীয়া সংস্কৃতির বাদ্যযন্ত্র ঢোল, পেপা, বাশি ব্যবহার করে গাওয়া গান ও বিহু নর্তকদের নাচ বিহু মঞ্চকে সুমধুর করে তোলে । উল্লেখযোগ্য যে এই অনুষ্ঠানটি বিনামুল্যে উপভোগ করার সুবিধা দেওয়া হয় । এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ছোট- বড় সবাই নিজের প্রতিভা প্রকাশ করার সুযোগ পায়। সাধারনতঃ এই অনুষ্ঠান সন্ধ্যাকাল থেকে আরম্ভ হয় ও পরদিন সূর্য উদয় হওয়ার ঠিক পুর্বে সমাপ্ত করা হয়। আসামের বিভিন্ন স্থান থেকে আমন্ত্রিত শিল্পী দ্বারা গানের অনুষ্ঠান করা হয়। আগেকার বিহু অনুষ্ঠানে কেবল বিহু ও অসমীয়া গান গাওয়ার অনুমতি ছিল কিন্তু বর্ত্তমান দিনে স্থানভেদে হিন্দী, বাঙ্গালী ও নেপালী গান গাওয়ার প্রচলন হয়েছে।
কাতি বিহু বা কঙ্গালী বিহু

কার্তিক সংক্রান্তির দিনে কাতি বিহু উদযাপিত হয়৷ এইসময় আঊশ ধানের চাষ শেষ হয়। এই বিহুকে কঙ্গালী বিহুও বলা হয়ে থাকে। এই সময় কৃষকদের শস্যভান্ডার প্রায় শূন্য থাকে এবং শস্য মাঠে ফলনশীল অবস্থায় থাকে। এই বিহুতে তুলসী রোপন করে তার সামনে, ক্ষেতে, শস্য ভান্ডারে ও বাড়িতে মাটির তৈরী প্রদীপ বা সাকি জ্বালানো হয়। ফলনশীল ধানকে রক্ষা করার জন্য কৃষক একটি বাঁশদন্ড ঘুরিয়ে রোয়া-খোয়া নামক মন্ত্র উচ্চারণ করে অশুভ শক্তি ও পোকামাকড়কে দূরে সরানোর চেষ্টা করেন। বিকেলবেলায় গৃহপালিত পশুদের পিঠা খাওয়ানো হয়। এই বিহুতে লম্বা বাঁশদন্ডের ডগায় আকাশ বন্তি বা আকাশি গঙ্গা নামক প্রদীপ জ্বালিয়ে মৃতদের আত্মার স্বর্গের রাস্তা দেখানোর রীতিও প্রচলিত।[5]
মাঘ বিহু বা ভোগালী বিহু
মাঘ মাসে ভোগালী বিহু বা মাঘ বিহু পালন করা হয়। ভোগালী শব্দটি ভোগ বা খাদ্য থেকে এসেছে।[6] এই বিহু তিন দিন ধরে পালন করা হয়। পৌষ সংক্রান্তির দিনের বিকেলবেলায়, যা উরুকা নামেও পরিচিত, যুবকেরা নদীর তীরে মাঠে উৎপাদিত শস্যের খড় দিয়ে ভেলাঘর নামক কুটীর নির্মাণ করেন এবং তা দিয়ে রাত্রে মেজি নামক আগুন জ্বালিয়ে উৎসব পালন করেন। রাত্রিবেলায় তারা মেজির চারপাশে জড়ো হয়ে বিহুগীতের গান করেন, ঢোল আদি বাদ্যযন্ত্র বাজান এবং সমবেত ভাবে খাবার খান। পরের দিন সকালে তারা স্নান করে মূল মাজিতে আগুন জ্বালান এবং ঐ আগুনে পিঠা ও সুপুরি ছুঁড়ে দেন। এরপর তারা অগ্নির নিকট প্রার্থনা করেন। এরপর এলাকার ফলগাছগুলিতে শস্য বেঁধে দেওয়া হয়। এই দিন সারাদিন ধরে মোষের লড়াই, মোরগের লড়াই প্রভৃতি ক্রীড়া চলতে থাকে।[7]
আরো দেখুন
- বিহুগীত
- বিহু নৃত্য
- বিহুর বাদ্যযন্ত্র
- বিহুর খাদ্য
- বিহুর সাজ-পোশাক এবং অলংকার
তথ্য সংগ্রহ
- "Bihu Festival"। www.festivalsofindia.in। Pan India Internet Private Limited (PIIPL)। সংগ্রহের তারিখ ২০১৩-০৪-১৩।
- অসমর সংস্কৃতি- ড° লীলা গগৈ
- "Origin of the Word Bihu"। festivalsofindia.in। Pan India Internet Private Limited (PIIPL। সংগ্রহের তারিখ ২০১৩-০৪-১৩।
- http://focusa2z.com/digitization-of-culture-and-modern-bihu-in-assam/ ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ৬ মে ২০১৩ তারিখে Modern Bihu in Assam
- Goswami, Prafulladatta (1988) Bohag Bihu of Assam and Bihu songs, Publication Board, Assam. pp7-8
- Celebrating Nature's Bounty - Magh Bihu ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ১৭ জানুয়ারি ২০১২ তারিখে, Efi-news.com
- Sankalp India Foundation। "Bihu: A celebration of Assamese culture | Sankalp India Foundation"। Sankalpindia.net। সংগ্রহের তারিখ ২০১২-১২-১৯।
বাহ্যিক সংযোগ
![]() |
উইকিমিডিয়া কমন্সে বিহু সংক্রান্ত মিডিয়া রয়েছে। |
- oldwikisource:বিহু গীত (ৱিকি উত্সত বিহুগীতসমূহর লিপি সন্নিবিষ্ট করা আছে।)
- ইউটিউবে মুকলি বিহু নৃত্য প্রতিযোগিতার এটা দৃশ্য
- ইউটিউবে দেউরী বিহু নৃত্য প্রদর্শন
- ইউটিউবে মিচিং বিহু নৃত্য প্রদর্শন
- অসমীয়া সংস্কৃতির কণিকা- সম্পাদনা-ডঃ নারায়ণ দাস, ডঃ পরমানন্দ রাজবংশী- পৃষ্ঠা- ২৪০,২৪১,২৪২
- Rongali Bihu-the spring festival of Assam An article by Sawpon Dowerah
- Rongali Bihu through the ages An article by Debendra Prasad Das
- Bihu: The lifeline of Assamese culture An article by Journalist Md. Sabir Nishat