মাতঙ্গী
মাতঙ্গি (মঙ্গি) হলেন মহাবিদ্যার মধ্যে একটি, দশ তান্ত্রিক দেবী এবং হিন্দু ঐশ্বরিক মা পার্বতীর এক হিংস্র দিক। তিনি পার্বতীর তান্ত্রিক রূপ হিসাবে বিবেচিত কিন্তু তিনি সরস্বতীর সাথে খুব মিল। সরস্বতীর মতো মাতঙ্গি এবং তিনি বক্তৃতা, সংগীত, জ্ঞান এবং চারুকলা পরিচালনা করেন।
মাতঙ্গী দেবীর বিস্তারিত বর্ণনা
ভয়ঙ্করী ছিন্নমস্তার মূর্তি দেখে শিব অন্য দিক দিয়ে পালাবার চেষ্টা করলে সেদিকেও আর এক মূর্তির আবির্ভাব হল। ইনি মাতঙ্গী। শিব দেখলেন এক অপূর্ব দেবী- “শ্যামাঙ্গীং শশিশেখরাং ত্রিনয়নাং রত্নসিংহাসনস্থিতাম্। বেদৈর্বাহুদণ্ডৈঃ অসিখেটকপাশাঙ্কুশধরাম্।”
শ্যামবর্ণা অর্ধচন্দ্রধারিণী ও ত্রিনেত্রা। চারহাতে তরবারি, বর্শা (ঢাল), পাশ ও অঙ্কুশ ধারণ করে রত্নসিংহাসনে বসে আছেন। ইনি তমঃ প্রধানা।
শিবের নাম মাতঙ্গ, তার শক্তি মাতঙ্গী।তিনি অসুরদের মােহিত্যকারিনী আর ভক্তকে অভীষ্ট ফলদায়িনী। গৃহস্থ জীবনে সুখদায়িনী, পুরুষাৰ্থসিদ্ধি এবং বাকবিলাসে পারঙ্গম হওয়ার জন্য মাতঙ্গিনীর সাধনা শ্রেয়। দশমহাবিদ্যার মধ্যে এর স্থান নবম |
নবম মহাবিদ্যা,মাতঙ্গী - কর্তৃত্ব শক্তির দেবী। জাতিহীন দেবী (কালীকুল সম্প্রদায়ে), ললিতার প্রধানমন্ত্রী (শ্রীকুল সম্প্রদায়ে); তান্ত্রিক সরস্বতী।
নারদপঞ্চরাত্রের দ্বাদশ অধ্যায়ে শিবকে চণ্ডাল এবং শিবাকে উচ্ছিষ্ট চণ্ডালী নামে বলা হয়েছে , এনারই নাম মাতঙ্গী। পুরাকালে মাতঙ্গ নামে এক ঋষি নানা বৃক্ষশোভিত কদম্ববনে সমস্ত প্রাণীকে বশ করার সংকল্প নিয়ে ভগবতী ত্রিপুরাদেবীকে তুষ্ট করার জন্য কঠোর তপস্যা করেছিলেন। সেই সময় ত্রিপুরাদেবীর নেত্র থেকে উৎপন্ন তেজঃপুঞ্জ এক শ্যামলা নারীবিগ্রহের রূপ ধারণ করে। তার নাম হয় রাজমাতঙ্গিনী। ইনি দক্ষিণ ও পশ্চিম আমায়ের দেবী। রাজমাতঙ্গ, সুমুখী, বশ্যমাতঙ্গী ও কর্ণমাতঙ্গ এর অন্যান্য নাম। দেবী মাতঙ্গীর ভৈরবের নাম মাতঙ্গ। ব্ৰহ্মযামল তন্ত্রে একে মাতঙ্গ মুনির কন্যা বলা হয়েছে।
দশমহাবিদ্যার মধ্যে মাতঙ্গীর উপাসনা বাকসিদ্ধির জন্য বিশেষভাবে উপযুক্ত। পূরশ্চর্যাের্নবে বলা হয়েছে—
" অক্ষাবক্ষ্যে মহাদেবীং মাতঙ্গীং সৰ্বসিদ্ধিদাম । অস্যাঃ সেবনমাত্রেণ বাকসিদ্ধিং লভতে ধ্রুবম৷"
তঙ্গীর স্থূলক্কপের প্রতীকনিয়মাদি পর্যালোচনা করলে ভালোভাবেই বােঝা যায় যে ইনি পূর্ণ বাগদেবতারই মূর্তি।
মাতঙ্গীর শ্যামবর্ণ হল পরাবাক বিন্দু। তাঁর ত্রিনয়ন হলেন সূর্য, চন্দ্র আর অগ্নি। তার চার বাহু চারটি বেদ। পাশ হল অবিদ্যা, অঙ্কুশ হল বিদ্যা, কর্মরাশি হল দণ্ড, শব্দ স্পর্শদি গুন হল কৃপাণ অর্থাৎ পঞ্চভূতাত্মক সৃষ্টির প্রতীক। কদম্ববন হল ব্ৰহ্মাণ্ডের প্রতীক।
দেবীর চতুর্হস্তে রয়েছে অঙ্কুশ, অসি, পাশ এবং খেটক। সত্ত্ব,রজ, তম, এই ত্রিবিধ অহঙ্কারের মধ্যে তৈজস বা রাজসিক অহঙ্কার থেকেই মনস্তত্ত্বের উদ্ভব।দেবী মাতঙ্গীর অধিষ্ঠান সেই মনস্তত্ত্বলোকের আজ্ঞাচক্রে।
দেবী তার দৈবী আকর্ষণে সাধকের রাজসিক আকর্ষণ শোষণ করে নেন, তাই তিনি শ্যামবর্ণা। দেবীর শীর্ষস্থ অর্ধচন্দ্র অতিরহস্যময়। এই চন্দ্র থেকে স্নিগ্ধ কিরণ ও সুধা বর্ষিত হয়ে সাধকের মনের সকল রাজসিক অহঙ্কার দূরীভূত হয়। সাধক প্রণবদেহ লাভ করে অন্তিম মোক্ষসাধনের জন্য তৎপর হয়ে ওঠে। দেবীর ত্রিনয়ন একাদিক্রমে চন্দ্র -সূর্য -অগ্নির প্রতীক। দেবীর রত্নসিংহাসন দিব্যশক্তিসমন্বিত সিংহবাহনের প্রতীক। দেবীর হাতে মায়াবন্ধনরূপ পাশ-ও রয়েছে, আবার পাশ ছিন্নকারী অসিও রয়েছে । দেবীর তীক্ষ্ণ অঙ্কুশ চিত্তবৃত্তির প্রত্যাহার এবং খেটক বা চর্ম আঘাত নিবারণী সহনশক্তির প্রতীক। এই দেবীর সাধনায় সাধকের বিচারবুদ্ধিতে, মেধায়, কাব্যপটুতায় তথা চৌষট্টিকলায় বিশেষ পারদর্শিতা আসে।
যোগরাজোপনিষদে ব্ৰহ্মলোককে কদম্বের মত গোলাকৃতিরূপে বর্ণনা করা হয়েছে— ‘কদম্বগোলকাকারং ব্ৰহ্মলোকং ব্ৰজন্তি তে। ' ভগবতী মাতঙ্গীর সিংহাসন শিবাত্মক মহামঞ্চ অথবা ত্রিকোন সূক্ষরূপে তাঁর মূর্তি হল। যন্ত্র আর পররূপে বা স্কুলারুপে শুধুমাত্র ভাবনা বা চিন্তন |
‘প্রাণতোষিণী তন্ত্র’ অনুসারে, একদা পার্বতী তাঁর বাপের বাড়ি যাওয়ার জন্য শিবের কাছে আর্জি জানান। শিব নিমরাজি হয়ে শর্ত দেন, দেবী কয়েক দিনের মধ্যে ফিরে না এলে তিনি স্বয়ং তাঁকে আনতে যাবেন। পার্বতী তাতে রাজি হন। কিন্তু বাপের বাড়ি থেকে ফিরতে তিনি দেরী করেন। শিব এক অলঙ্কার বিক্রেতার ছদ্মবেশে হিমালয়-গৃহে পৌঁছন এবং পার্বতীকে একটি শাঁখা বিক্রয় করেন। এবং সেই সঙ্গে তিনি পার্বতীর সঙ্গে দেহমিলন প্রার্থনা করেন। পার্বতী ক্ষিপ্ত হয়ে তাঁকে শাপ দিতে উদ্যত হন। কিন্তু অচিরেই তিনি শিবকে চিনতে পারেন। এবং জানান, যথা সময়ে তাঁদের মিলন সম্ভব হবে। এই মিলনের অভিপ্রায়ে পার্বতী চণ্ডালিনীর বেশ ধরেন এবং মিলিত হন। শিব তুষ্ট হয়ে তাঁকে বর প্রার্থনা করতে বলেন। দেবী চণ্ডালিনী রূপে পূজিতা হওয়ার বর চান। শিব তাঁকে তা-ই দান করেন এবং সেই প্রার্থনা পূরণ করেন।
স্বতন্ত্রতন্ত্র অনুসারে, পুরাকালে একবার বহুবৃক্ষসমন্বিত এক কদন্বকাননের সমস্ত প্রাণিকুলকে বশীভুত করার জন্য মাতঙ্গমুনি শতসহস্র বছর ধরে কঠিন তপস্যায় নিরত ছিলেন। সেই তপস্যার ফলে দেবী সুন্দরীর নেত্র থেকে সমুৎপন্ন তেজ স্বয়ং জননী কালিকার (কৃষ্ণ বর্ণা) রূপ ধারণ করে। সেই রূপই শ্যামবর্ণা হয়ে রাজমাতঙ্গীর রূপ ধারণ করেন।
কালিকাপুরাণ বা সারদাতিলকাদি কয়েকটি তন্ত্রে দেবী মাতঙ্গী এবং দেবী সরস্বতীকে অভিন্ন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তাই রূপভেদে দেবী মাতঙ্গীই আবার বীণা-বাদনরতা সরস্বতী ।
বিবিধ পুরাণশাস্ত্রে ষড়বিধ মাতঙ্গী দেবীর উল্লেখ পাওয়া যায়। তাঁরা হলেন - মাতঙ্গিনী, উচ্ছিষ্টা মাতঙ্গী, রাজ মাতঙ্গী, সুমুখী মাতঙ্গী, বশ্য মাতঙ্গী এবং কর্ণ মাতঙ্গী। দেবী উচ্ছিষ্ঠ-চণ্ডালিনী - দেবী মাতঙ্গী। মহাভয়ঙ্করী দেবী তুষ্ট হন এঁটো-কাঁটা আর নোংরায় দশ মহাবিদ্যার নবম মহাবিদ্যা মাতঙ্গী সম্পর্কে সবিশেষ কথা ভারতীয় পরম্পরায় উল্লিখিত হয় না। অথচ তিনি এক অতি চেনা দেবীরই রূপভেদ।
মাতঙ্গীর দেহবর্ণ সবুজ, তাঁর এক হাতে বীণা, অন্য হাতে তরবারি, মহাখর্পর এবং বরাভয়। তাঁর সঙ্গী হিসেবে টিয়াপাখিকে কল্পনা করা হয়।
মাতঙ্গীকে দেবী সরস্বতীরই আর এক রূপ বলে স্বীকার করে তন্ত্র ধর্ম। তিনি বিদ্যা ও সঙ্গীতের দেবী। কিন্তু দেবী সরস্বতীর স্নিগ্ধতা তাঁর মধ্যে নেই। অথচ ‘দশ-মহা-বিদ্যা-তন্ত্র’-এ তাঁকে পরমতম জ্ঞানের অধিষ্ঠাত্রী হিসেবে কল্পনা করা হয়েছে।এহ বাহ্য , মাতঙ্গী দেবীকে ঘিরে এক মহারহস্য আবর্তিত হয় ভারতীয় পরম্পরায়।
মাতঙ্গীকে ‘উচ্ছিষ্ট-চণ্ডালিনী’ বলে উল্লেখ করে অসংখ্য তন্ত্রগ্রন্থ। তাঁর পূজা ও ভোগ প্রদানের যে বিধান শাস্ত্রে রয়েছে, তা এই প্রকার— অপরিষ্কার হাতে এঁটো খাবার তাঁকে নিবেদন করতে হবে। অথচ ভারতীয় পরম্পরায় এমন অপরিচ্ছন্নতা কোনও দেবতার বেলাতেই কাঙ্ক্ষিত নয়।
বারাণসীর লোককথা অনুযায়ী, মাতঙ্গী দেবীর উপাসনা যুক্ত ছিল চণ্ডাল সম্প্রদায়ের সঙ্গে। সে কারণে, তাঁর চণ্ডালিনী রূপটি গড়ে ওঠে। তাঁকে শ্মাশানবাসী, ভস্ম মাখা শিবের যোগ্য শক্তি বলে মনে করা হয়। এই কারণেই তিনি উচ্ছিষ্ট ভক্ষণকারিণী, অপরিচ্ছন্না।
কিন্তু মাতঙ্গীর উপাসনা মানুষকে ক্লিন্নতা থেকে মুক্ত করে। যদিও এই দেবীর পূজা পদ্ধতি অতি গোপন এবং ভয়াবহ। ‘গূহ্যাতিগূহ্য তন্ত্রম্’ অনুসারে মাতঙ্গী উপাসনা ডামরীশক্তিকে জাগ্রত করে, সাধকের পক্ষে সেই ভায়নক শক্তিকে সামলানো সব সময়ে সম্ভব হয় না। ডামরীকে মাতঙ্গীর উপদেবী বলে অনেকেই মনে করেন। ডামরীও অপরিচ্ছন্না এবং অনেক সময়েই উচ্ছিষ্টসেবী।
শ্ৰীশ্ৰীচণ্ডীর সপ্তম অধ্যায়ে মাতঙ্গীদেবীর ধ্যানে বলা হয়েছে যে তিনি রত্নময় সিংহাসনে বসে কাকাতুয়ার মধুর শব্দ শুনছেন। তিনি শ্যামবর্ণা। তিনি তার একটি পা পদ্মের ওপর রেখেছেন। তার শিরে অৰ্দ্ধচন্দ্র এবং গলায় কলহার ফুলের মালা পরে রয়েছেন। বীনা বাদনরতা দেবী মাতঙ্গীর পরিধানে সুবদ্ধ চােলি সুশোভিত। তিনি রক্তবর্ণ শাড়ী পরিহিতা আর হাতে শঙ্খপাত্র ধরে আছেন, তার মুখমণ্ডলে মধুপানের মৃদু আভা এবং ললাটে সুন্দর টিপ শোভা পাচ্ছে। এর বল্লকী (বীণা) ধারণ নাদের প্রতীক। কাকাতুয়ার পড়া গ্ৰহীং’ বর্ণের উচ্চারণ বীজমন্ত্রের প্রতীক। পদ্মফুল হচ্ছে বর্ণাত্মক সৃষ্টির প্রতীক। শঙ্খপাত্র হল ব্ৰহ্মরন্ধ এবং মধু অমৃতের প্রতীক | রক্তবর্ণ শাড়ী অগ্নি অথবা জ্ঞানের প্রতীক। বাগদেবীর অর্থে মাতঙ্গী যদি ব্যাকরণ রূপ হন তো শুকপাখী হল শিক্ষার প্রতীক। চার হাত চার বেদের প্রতীক। এভাবে তান্ত্রিকদের ভগবতী মাতঙ্গী মহাবিদ্যা, বৈদিকদের সরস্বতীই। তন্ত্রশাস্ত্রে এর পূজার বিস্তারিত বর্ণনা আছে।
ॐ रक्षांसि यत्रोग्रविषाश्च नागा यत्रारयो दस्युबलानि यत्र | दावानलो यत्र तथाब्धिमध्ये तत्र स्थिता त्वं परिपासि विश्वम् ||
আবার , মতঙ্গাসুরকে বিনাশ করার জন্য দেবীকে মাতঙ্গী বলা হয় ।
“ মাতঙ্গী মদশীলত্বাৎ মতঙ্গাসুরনাশিনী । সর্বাপত্তারিনী দেবী মাতঙ্গী পরিকির্তিতা ।। ”
স্নেহময়ী জ্ঞানমুর্তি নবমা দেবী সমস্থ বিপদ থেকে ভক্তকে ত্রাণ করেন । মাতৃ সাধন পথের পথিকের আছে - ঘৃণা , লজ্জা , ভয় , শঙ্কা , জুগুপ্সা , কুল , শীল এবং জাতি —এই অষ্টপাশ।