পণ্ডিতবিহার

পণ্ডিতবিহার, (ইংরেজি: Pandit Vihara) ছিল উপমহাদেশের একটি প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় এবং বর্তমানে এটি সম্পূর্ণ বিলুপ্ত।[1] খিস্ট্রীয় আনুমানিক অষ্টম শতাব্দীতে পূর্ববঙ্গের (বর্তমান বাংলাদেশ) চট্টগ্রামে এ-বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছিলো ধারণা করা হয়। মূলত এ-বিশ্ববিদ্যালয় ছিল নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতোন একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, যা পূর্ববঙ্গে তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম বিষয়ে শিক্ষা ও মতবাদ প্রচারের কেন্দ্র হিসেবে পরিচালিত হতো।[2] ত্রয়োদশ শতাব্দির এক সংঘাতে বিহারের নালন্দা বিহার ধ্বংস হয়ে যায় এবং পরবর্তীতে পূর্ব দেশীয় বৌদ্ধ পণ্ডিত মণ্ডলীদের অনেকেই পণ্ডিতবিহারে আশ্রয় নিয়েছিলেন। পাল সাম্রজ্যের বৌদ্ধ ভিক্ষু এবং বৌদ্ধধর্মপ্রচারক অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান পণ্ডিতবিহারে কিছুকাল অবস্থান ও অধ্যয়ন করেছিলেন।[3]

পণ্ডিতবিহারে অধ্যাপকগণ তাদের অধ্যাপনা, অধ্যয়ন ও যোগ সাধনার পাশাপাশি অবসর-অবকাশে যে সকল গান-দোঁহা রচনা করেছিলেন তাই পরবর্তীকালে চর্যাপদ নামে বাংলা ভাষা ও কাব্যের আদি নিদর্শন হিসেবে স্বীকৃত লাভ করে।[3] পণ্ডিতবিহারের পূর্বে এবং পরবর্তীকালে আনুমানিক আঠারো শতকের মধ্যকাল পর্যন্ত অন্য কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম ইতিহাসে পাওয়া যায় না।[2]

অবস্থান

পণ্ডিতবিহারের অবস্থান সম্পর্কে বিভিন্ন মত প্রচলিত রয়েছে। প্রাপ্ত কিছু স্মারক নিদর্শন অনুযায়ী তিব্বতবৌদ্ধ সংস্কৃতি বিশেষজ্ঞ শরচ্চন্দ্র দাস প্রমুখ পণ্ডিত ও গবেষকবৃন্দের অনুমান, অষ্টম শতাব্দীতে চট্টগ্রাম মহানগরের বর্তমান জেনারেল হাসপাতাল সংলগ্ন পাহাড়ে এ-বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ছিল। অনেকের মতে ধারণা করা হয় চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার চক্রশালায় অথবা আনোয়ারা উপজেলার দেয়াঙ পাহাড়ের দক্ষিণাংশে ঝিওরী ও হাজিগাঁও গ্রামে[4] আবার অনেকের মতে সীতাকুণ্ড উপজেলার চন্দ্রনাথ পাহাড়ে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ছিল।[2] তবে অধিকাংশ মতের ভিত্তিতে দেয়াঙ পাহাড়েই বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ছিল বলে অনেক তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যায়।[4] ফেব্রুয়ারি ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দে আনোয়ারার দেয়াঙ পাহাড়স্থ ঝিওরী ও হাজিগাঁও গ্রামের সীমান্ত থেকে ৬৬টি পিতলের বুদ্ধমূর্তি আবিষ্কৃত হয়, যা এই স্থানে বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান সম্পর্কে প্রমাণ নিশ্চিত করে।[3]

ইতিহাস ও বিলুপ্তি

পণ্ডিতবিহারের অধ্যক্ষ ছিলেন পটিয়ার চক্রশালা নিবাসী ব্রাহ্মণসন্তান তিলপাদ। "তিলপাদ" নামের উৎপত্তি সম্পর্কে জানা যায় যে, তার হিন্দু জীবনের যোগসাধন সঙ্গিনী তিল পিষে জীবন ধারণ করতেন বলে তিনি তিলপাদ নাম গ্রহণ করেছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করার পর প্রজ্ঞাভদ্র নাম গ্রহণ করেন এবং পণ্ডিতবিহারের অধ্যক্ষ পদে নিযুক্ত হন। মগধের প্রধান আচার্য নরতোপা পণ্ডিতবিহারে প্রজ্ঞাভদ্রের নিকট দীক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। লুই পা, শবর পা, লাড় পা, অবধূত পা, অমোঘনাথ, ধর্মশ্রী, মৈন, বুদ্ধজ্ঞান পা, অনঙ্গবজ্র প্রমুখ বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্য এবং পণ্ডিতগণ পরিদর্শকরূপে অথবা অধ্যাপকরূপে পণ্ডিতবিহারে বিহারে এসেছিলেন। গবেষকদের অনুমান, বিভিন্ন বৌদ্ধ পণ্ডিতগণ এই বিহারে সমবেত হয়েছিলেন বলে সম্ভবত পণ্ডিতবিহার নামকরণ হয়েছিল।[2]

পণ্ডিতবিহারের বিলুপ্তি হবার কারণ সম্পর্কে জানা যায় না। খিস্ট্রীয় আনুমানিক অষ্টম শতাব্দীতে পণ্ডিতবিহার বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্তিত্ব ছিলো বলে ধারণা করা হয়। ১০৫৯ খ্রিষ্টাব্দে ব্রহ্মদেশের রাজা অনর হট চট্টগ্রাম ও পট্টিকারা রাজ্য জয় করার পর তৎকালীন প্রচলিত মহাযান বৌদ্ধমত উচ্ছেদ করে হীনযান বা থেরবাদ বৌদ্ধমত প্রচার করতে শুরু করেন। পরবর্তীতে ১২৩০ খ্রিষ্টাব্দে সমতটের বৌদ্ধ রাজা দামোদর দেব (১২৩০-১২৫৩ খ্রিষ্টাব্দ) পট্টিকারাসহ চট্টগ্রাম জয় করেন এবং ১২৫৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত অত্র অঞ্চলে রাজত্ব করেন। ঐতিহাসিভাবে জানা যায় রাজা দামোদর দেবের রাজত্বকালীন সময়ে পণ্ডিতবিহারের অস্তিত্ব উজ্জ্বল ছিল।[3]

পরবর্তী শতাব্দীর ১৩৪০ খ্রিষ্টাব্দে সোনারগাঁওয়ের সুলতান ফখরুদ্দিন মোবারক শাহের (১৩৩৮-১৩৫০ খ্রিষ্টাব্দ) সেনাপতি কদলখাঁ গাজী চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকে আরাকানিদের বিতাড়িত করেন এবং চট্টগ্রামকে সর্বপ্রথম মুসলিম শাসন আওতায় নিয়ে আসেন। ১৫৮০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত চট্টগ্রাম ছিল বাংলার স্বাধীন সুলতান ও আফগান শাসনভুক্ত। ধারণা করা হয় এ সময়েই পণ্ডিতবিহারের অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়ে। আরাকানের ইতিহাস সূত্রে পাওয়া যায়, সে সময়েও আরাকানের রাজারা কখনো সাময়িককালের জন্য, কখনো সম্পূর্ণ মেয়াদে অধিকার করে চট্টগ্রাম অঞ্চল শাসন করেছিলেন। ১৫৮০ খ্রিষ্টাব্দে আরাকান রাজ মিনফালং আফগান সেনানী শাসক জামাল খান পন্নীকে পরাজিত করে সমগ্র চট্টগ্রাম অঞ্চল আরাকান রাজ্যভুক্ত করেন। সে সময়কাল থেকে ১৬৬৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ জানুয়ারি পর্যন্ত চট্টগ্রাম একাধারে আরাকানের রাজ্যভুক্ত ছিল। পণ্ডিতবিহারের অস্তিত্ব সে সময়কালেও ছিল বলে ঐতিহাসিকগণ ধারণা করেন। ১৬৬৬ খ্রিষ্টাব্দে বাংলার সুবেদার শায়েস্তা খাঁ নিজ পুত্র বুজুর্গ উমেদ খাঁকে তার প্রধান সেনাপতির দায়িত্ব প্রদান করেন এবং তাকে অভিযানে পাঠান চট্টগ্রাম অঞ্চলে। ১৬৬৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ জানুয়ারি মোগল যোদ্ধারা আনোয়ারা উপজেলার চাটিগাঁ দুর্গ দখল করে মগদের বিতাড়িত করেন। এ সকল যুদ্ধবিগ্রহে চট্টগ্রামের প্রাচীন বন্দর শহর দেয়াঙ ক্ষতিগ্রস্থ হয় এবং ধারণা করা কর এরই ফলস্বরূপ এবং কালের বিবর্তনে পণ্ডিতবিহারের বিলুপ্তি ঘটে।[3]

পুনঃপ্রতিষ্ঠা

ঐতিহাসিক পণ্ডিতবিহার বিশ্ববিদ্যালয় পুনঃপ্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা গৃহীত হয়েছে। যার ফল স্বরুপ ২০১২ সালে বর্তমান বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের বিশেষ প্রতিনিধি দল সরেজমিন আনোয়ারার দেয়াঙ পাহাড় অঞ্চলে পণ্ডিতবিহারের ঐতিহাসিক ধ্বংসাবশেষ পরিদর্শন করেছেন। মূলত চীন, জাপান, থাইল্যান্ড ও শ্রীলংকার যৌথ অর্থায়নে প্রায় দেড়শ একর পাহাড়ি ভূমিতে এই বিশ্ববিদ্যালয়টি পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে যেটির দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মতোন পূর্ণাঙ্গ রূপ দেয়া হবে।[3][5]

আরো পড়ুন

  • উদ্দিন, জামাল (২০০৯)। চট্টগ্রামের ইতিহাস, জনবসতি, নামকরণের যৌক্তিকতা, কাল নির্ণয় ও পণ্ডিতবিহার বিশ্ববিদ্যালয় (গবেষণা গ্রন্থ) (২০০৯ সংস্করণ)। চট্টগ্রাম: বলাকা প্রকাশন

তথ্যসূত্র

  1. উদ্দিন, জামাল (২০০৯)। চট্টগ্রামের ইতিহাস, জনবসতি, নামকরণের যৌক্তিকতা, কাল নির্ণয় ও পণ্ডিতবিহার বিশ্ববিদ্যালয় (গবেষণা গ্রন্থ) (২০০৯ সংস্করণ)। চট্টগ্রাম: বলাকা প্রকাশন
  2. মোহাম্মদ খালেদ, সম্পাদক (নভেম্বর ১৯৯৫)। "শিক্ষা"। হাজার বছরের চট্টগ্রাম (দৈনিক আজাদী ৩৫ বর্ষপূর্তি বিশেষ সংখ্যা) (মুদ্রণ) (প্রথম সংস্করণ)। চট্টগ্রাম: এম এ মালেক। পৃষ্ঠা ১৭৭।
  3. জামাল উদ্দিন (জানুয়ারি ১৫, ২০১২)। "চট্টগ্রাম পণ্ডিতবিহার বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা"দৈনিক সমকাল। চট্টগ্রাম। সংগ্রহের তারিখ আগস্ট ২১, ২০১৬
  4. জামাল উদ্দিন (সেপ্টেম্বর ২২, ২০১৪)। "ভারতবর্ষে বৌদ্ধধর্মের প্রসার ও বিলুপ্তির ইতিহাস- আশ্রয়স্থল চট্টগ্রাম পণ্ডিত বিহার"nirvanapeace.com। nirvanapeace.com। সংগ্রহের তারিখ আগস্ট ২১, ২০১৬ঝিওরী গ্রাম থেকে দু’মাইল উত্তরে খিলপাড়া ও কৈনপুরা গ্রামে ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দে আরও কয়েকটি বুদ্ধমূর্তি ও প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়। এ মূর্তিগুলোই ইতিহাসবিদদের সামনে পণ্ডিতবিহার বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থানস্থল যে দেয়াঙ পাহাড় তার প্রমাণ অনেকাংশে নিশ্চিত করে দেয়।
  5. মোহাম্মদ মোরশেদ হোসেন (জানুয়ারি ১২, ২০১২)। "আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে আনোয়ারায়"প্রথম আলো। আনোয়ারা: archive.prothom-alo.com। সংগ্রহের তারিখ আগস্ট ১৯, ২০১৬

বহিঃসংযোগ

This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.