জগন্নাথপুর উপজেলা
জগন্নাথপুর (সিলেটি: ꠎꠉꠘ꠆ꠘꠣꠕꠙꠥꠞ) বাংলাদেশের সিলেট বিভাগের সুনামগঞ্জ জেলার অন্তর্গত একটি উপজেলা। বাংলাদেশে উপজেলা ব্যবস্থা প্রবর্তনের পর ১৯৮৩ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর জগন্নাথপুর থানাকে উপজেলায় উত্তীর্ণ করা হয়।
জগন্নাথপুর | |
---|---|
উপজেলা | |
![]() বাংলাদেশে জগন্নাথপুর উপজেলার অবস্থান | |
![]() ![]() জগন্নাথপুর ![]() ![]() জগন্নাথপুর | |
স্থানাঙ্ক: ২৪°৪৬′ উত্তর ৯১°৩৩′ পূর্ব ![]() | |
দেশ | ![]() |
বিভাগ | সিলেট বিভাগ |
জেলা | সুনামগঞ্জ জেলা |
প্রতিষ্ঠা | ২৯ সেপ্টেম্বর ১৯৮৩ |
আসন | সুনামগঞ্জ-৩ |
সরকার | |
• সংসদ সদস্য | এম. এ. মান্নান (বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ) |
আয়তন | |
• মোট | ৩৬৮.২৭ কিমি২ (১৪২.১৯ বর্গমাইল) |
জনসংখ্যা (২০১১)[1] | |
• মোট | ২,৫৯,৪৯০ |
• জনঘনত্ব | ৭০০/কিমি২ (১৮০০/বর্গমাইল) |
সাক্ষরতার হার | |
• মোট | ৫৪% |
সময় অঞ্চল | বিএসটি (ইউটিসি+৬) |
প্রশাসনিক বিভাগের কোড | ৬০ ৯০ ৪৭ |
ওয়েবসাইট | প্রাতিষ্ঠানিক ওয়েবসাইট ![]() |
অবস্থান
জগন্নাথপুর ৩৫৫.৯১ কিলোমিটার জায়গা নিয়ে অবস্থিত। এই উপজেলার পূর্বে সিলেট জেলার বিশ্বনাথ ও ওসমানীনগর উপজেলা, উত্তরে ছাতক ও দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলা, পশ্চিমে দিরাই উপজেলা এবং দক্ষিণে হবিগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জ উপজেলা অবস্থিত।
প্রশাসনিক এলাকা

- জগন্নাথপুর পৌরসভা ১ টি ।
- ইউনিয়ন পরিষদ ৮ টি।
- জগন্নাথপুর ও দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলা নিয়ে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের ২২৬ সংখ্যক সুনামগঞ্জ-৩ সংসদীয় আসন গঠিত।
- উপজেলা কার্যনির্বাহী অফিসসহ রয়েছে বিভিন্ন সরকারি অধিদপ্তর।
উপজেলার আটটি ইউনিয়ন পরিষদ হল যথাক্রমে:
ইতিহাস
১১৯১ খ্রিষ্টাব্দে লাউড় রাজ্যের অধিপতি ছিলেন রাজা বিজয় মাণিক্য। তৎকালে তিনি জগন্নাথ মিশ্রকে দিয়ে বাসুদেব মন্দির প্রতিষ্ঠা করান। পরবর্তীতে এই স্থানকে জগন্নাথ মিশ্রের নামানুসারে “জগন্নাথপুর” বলে ঘোষণা করেন। আর সেই থেকে জগন্নাথপুর রাজা বিজয় মাণিক্যের রাজ্য বলে ঘোষিত। জগন্নাথপুরের পাণ্ডুয়া থেকে রাজা বিজয় মাণিক্য সেই সময় নিজ নামের সঙ্গে দুই স্ত্রীর নাম যুক্ত করে ১১৯১ খ্রিষ্টাব্দে সিক্কা মুদ্রা প্রকাশ করেছিলেন। এই সিক্কা মুদ্রাই রাজা বিজয় মাণিক্যের রাজ্যের প্রমাণ, যা কুবাজপুর গ্রামের মদনমোহন চৌধুরীর পরিবারদের কাছে সংরক্ষিত আছে।[2]। জগন্নাথপুর এককালে বর্তমান ভৌগোলিক সীমানার চেয়ে আরও বড় ছিল। দ্বাদশ শতাব্দী থেকে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত জগন্নাথপুর রাজ্য লাউড়ের শাখা-রাজ্য ছিল এবং বংশানুক্রমে লাউড়ের নৃপতিগণ কর্তৃক শাসিত হত। দিল্লি সম্রাটদের রেকর্ডে জগন্নাথপুর রাজ্য লাউড়ের এজমালি সম্পদ হিসেবে বিবেচিত এবং শ্রীহট্টের ইতিহাসে বর্ণিত আছে যে, উক্ত লাউড় রাজ্য সর্বদা মোগল সম্রাটদের কাছে স্বাধীন রাজ্য হিসেবে গণ্য ছিল। তাই জগন্নাথপুর রাজ্যের ইতিহাস আলোচনা করতে গেলে প্রাচীন লাউড় রাজ্যের কথা চলে আসে, কারণ এর পত্তনস্থলই হচ্ছে প্রাচীন লাউড়। প্রাচীন লাউড়ের পত্তন সম্পর্ক মূলত প্রাচীন কামরূপ।[2] বৌদ্ধ পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ (৬০২–৬৬৪) কামরূপ রাজার আমন্ত্রণে ৬৪০ খ্রিষ্টাব্দে এদেশে ভ্রমণে এলে শ্রীহট্টকে কামরূপ রাজ্যের অংশ বলে উল্লেখ করেন। উল্লেখ্য, বিভিন্ন বৌদ্ধগ্রন্থেও সিলেটকে সমুদ্র নিকটবর্তী বলা হয়েছে। এছাড়া নিধনপুরে প্রাপ্ত তাম্রলিপিগুলোও তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ।[3]
খ্রিস্টপূর্ব ত্রিশ শতাব্দীতে ভগদত্ত নামের জনৈক নৃপতি কামরূপে রাজত্ব করতেন। তার রাজ্য বিবরণে বলা হয় যে, তৎকালে লাউড়ের পাহাড়ে ভগদত্ত রাজার একটি শাখা-রাজধানী ছিল। তিনি যখনই এদেশে আসতেন সেখানেই অবস্থান করতেন এবং লাউড় থেকে দিনারপুর পর্যন্ত নৌকাযোগে ভ্রমণ করতেন। উপরে উল্লেখিত ঐতিহাসিক আলোচনায় প্রমাণ হয় যে, প্রাচীন শ্রীহট্টের নিম্নাঞ্চল তখনকার যুগে গভীর পানির নিচে নিমজ্জিত ছিল। উল্লেখ্য, মহাভারত গ্রন্থের সভাপর্বে লিখিত: “ভিম পণ্ডু বঙ্গদেশ জয় করিয়া তাম্রলিপ্ত এবং সাগরকুলবাসী ম্লেচ্ছদিগকে জয় করেন।” এই তথ্যের ভিত্তিতে ভূতত্ত্ব বিষয়ের পণ্ডিত বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বঙ্গে প্রবেশাধিকার গ্রন্থে মহাভারতে উল্লেখিত বঙ্গ উত্তর-পূর্ব বঙ্গদেশ অর্থে প্রাচীন লাউড় অঞ্চল বলেছেন। সুতরাং উল্লেখিত লাউড় শ্রীহট্টই নয়, বঙ্গ হতেও প্রাচীন। পুরাতাত্ত্বিক রমেশচন্দ্র দত্তের মতে ব্রহ্মপুত্রের তীরবর্তী কামরূপ রাজ্যের বিস্তৃতি প্রায় ২,০০০ মাইল। আসাম, মণিপুর, ময়মনসিংহ, শ্রীহট্ট, কাছাড় প্রভৃতি নিয়ে কামরূপ বিস্তৃত ছিল।[2] সুতরাং, এদিক থেকে বিবেচনায় প্রতিপাদ হয় যে নৃপতি ভগদত্তের লাউড় রাজ্য মহাভারতকালের চেয়েও প্রাচীন। মহাকাব্য মহাভারতে প্রমাণ মেলে যে রাজা ভগদত্ত যুদ্ধে মহাবীর অর্জুন কর্তৃক নিহত হন। ভগদত্ত রাজার পরে তার পুত্রগণের মধ্যে ১৯ জন নৃপতি পর্যায়ক্রমে কামরূপ তথা লাউড়ে রাজত্ব করেন। ভাটেরায় প্রাপ্ত তাম্রফলকে বর্মান, ঈশানদেব তাদেরই বংশধর বলে ইতিহাসবেত্তাগণ উল্লেখ করেছেন। এই রাজাগণ চন্দ্রবংশীয় বলে খ্যাত। উক্ত ১৯ জন নৃপতির অনেকদিন পরে প্রাচীন লাউড় রাজ্যে নৃপতি বিজয় মাণিক্য আবির্ভুত হন। ১১৯১ খ্রিষ্টাব্দে বিজয় মাণিক্য জগন্নাথপুর রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন এবং ছিক্কা মুদ্রার প্রচার করেন।
অন্যদিকে ১৩০৩ খ্রিষ্টাব্দে ইয়েমেনদেশীয় তাপস হজরত শাহজালাল (রহ.) ৩৬০ জন সফরসঙ্গী নিয়ে প্রাচীন শ্রীহট্টের গৌড় রাজ্য জয় করেন। শাহজালালের এই সঙ্গী ও অনুসারীগণ ইসলামের পবিত্র বাণী নিয়ে শ্রীহট্টসহ বঙ্গদেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়েন। তারই ধারাবাহিকতায় ৩৬০ আউলিয়ার মধ্য থেকে পর্যায়ক্রমে হজরত শাহ কালাম উদ্দীন কোহাফার নেতৃত্বে ১২ জন আউলিয়া জগন্নাথপুর রাজ্যে আসেন।[4] আগত আউলিয়াদের নাম ও বর্তমানে অবস্থিত মাজার যথাক্রমে: ১. হজরত শাহ কালাম কোহাফা – শাহারপাড়া গ্রাম; ২. সৈয়দ শামস উদ্দিন – সৈয়দপুর গ্রাম, ৩. শাহ কালু – পীরেরগাঁও, ৪. শাহ চান্দ – চান্দভরাং, ৫. দাওর বখশ খতিব ও দিলওয়ার বখশ খতিব – দাওরশাহী বা দাওরাই গ্রাম, ৬. শাহ ফৈজ উদ্দিন বা ফেছন উদ্দিন – ফৈজি বা ফেছি গ্রাম, ৭. সৈয়দ শামস উদ্দিন বিহারি – আটঘর গ্রাম, ৮. শাহ মানিক – মণিহারা গ্রাম, ৯. শাহ জলাল উদ্দিন – কুসিপুর বা কুস্কিপুর গ্রাম, ১০. সৈয়দ বাহাউদ্দিন – মুকান বাজার, ১১. সৈয়দ রুকনুদ্দিন – কদমহটি, ১২. সৈয়দ তাজউদ্দিন – অরম্পুর, সৈয়দ জিয়া উদ্দিন - মুকান বাজার। উল্লেখ যে, মীরপুরে অবস্থানরত শাহ চান্দ পরবর্তিতে চান্দভরাং গ্রামে চলে যান এবং সেখানেই বর্তমানে তার মাজার অবস্থিত।[5]
উল্লিখিত বিজয় মাণিক্যের অনেক কাল পরে লাউড় ও জগন্নাথপুর রাজ্যে দিব্য সিংহ নামে নৃপতি রাজত্ব করেন। তখন লাউড়ের রাজধানী নবগ্রামে স্থানান্তর হয়। যে নবগ্রাম বৈষ্ণবীয় ধর্মাবতার অদ্বৈতের জন্মস্থান বলে আখ্যায়িত। রাজা দিব্য সিংহ রাজ্যভার তার পুত্র রামানাথকে দিয়ে শান্তি সাধনায় তার মন্ত্রীতনয় অদ্বৈতের আখড়া শান্তিপুরে চলে যান। সেখানে থেকে অদ্বৈতের উপদেশে বৈষ্ণবধর্ম গ্রহণ করেন এবং অদ্বৈত বাল্যলীলা গ্রন্থ রচনা করে কৃষ্ণদাস নামে খ্যাত হন। রাজা দিব্য সিংহের পুত্র রামানাথ সিংহের তিন পুত্র হয়। এই তিন পুত্রের মধ্যে একজন কাশীবাসী হন এবং এক পুত্রকে লাউড়ের রাজ সিংহাসনে বসিয়ে রামানাথ সিংহ তার অন্য পুত্র কেশবের সাথে জগন্নাথপুরে আসেন। প্রায় পঞ্চদশ শতাব্দীর সময়কালে রামানাথের পুত্র কেশব সিংহ সেখানকার রাজা হন। উল্লেখ্য যে, এ সময়ে আজমিরীগঞ্জ এলাকায় বানিয়াচঙে অন্য একটি নবরাজ্যের আর্বিভাব ঘটে। এই নব্য আবিষ্কৃত রাজ্যের রাজার নামও কেশব ছিল। অচ্যুতচরণ চৌধুরী লিখেছেন যে, “নব্য আবিস্কৃত বানিয়াচং রাজ্যের রাজার নাম এবং জগন্নাথপুর রাজ্যের রাজার নাম এক থাকায়, অনেক লেখক ভ্রমে পতিত হইয়া জগন্নাথপুর ও বানিয়াচঙের রাজ পরিবারকে এক বংশের বলিয়া যেভাবে আখ্যায়িত করেন, আসলে ইহারা এক নহেন। বানিয়াচং রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা কেশব একজন বণিক ছিলেন। তিনি বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে এদেশে আসিয়াছিলেন এবং কালী নামের দেবীর পূজা নির্বাহের লক্ষ্যে দৈব্যে শ্রুত শুষ্কভূমির সন্ধান প্রাপ্ত হইয়া সেখানে অবতরণ করিয়া দেবীপূজা সমাধান করিয়া দৈবাভিপ্রায় মতে সেখানেই বসতি স্থাপন করেন। এছাড়া জগন্নাথপুর রাজ্যের কেশব রাজার পুত্রের নাম শনি, তাহার পুত্র প্রজাপতি, প্রজাপতির পুত্র দুর্বার। অন্যদিকে বানিয়াচঙের কেশব রাজার পুত্রের নাম দক্ষ, দক্ষের পুত্র নন্দন, তাহার পুত্র গণপতি ও কল্যাণ। সুতরাং ইহাদের বংশীয় ধারায়ও ইহা প্রতিপাদিত হয় যে, জগন্নাথপুরের কেশব ও বানিয়াচঙের রাজা কেশব দুই ব্যক্তি, উহারা এক নহেন।[2]
প্রায় পঞ্চদশ শতাব্দির কালে রামানাথের পুত্র কেশব সিংহ জগন্নাথপুরে রাজ্যত্ব করেন। মোগল সম্রাট আকবরের শাসনামলে (১৫৫৬-১৬০৫ খ্রি.) লাউড়ের রাজা গোবিন্দ সিংহ তার জ্ঞাতি ভ্রাতা জগন্নাথপুরের রাজা বিজয় সিংহের সঙ্গে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা নিয়ে বিরোধে লিপ্ত হয়েছিলেন। তখন ঐতিহাসিক লাউড় রাজ্যের রাজধানী সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার ‘হলহলিয়ায়' ছিল, এখানকার ধ্বংসাবশেষও তাই জানান দিচ্ছে। রাজ্যের ধ্বংসাবশেষ হলহলিয়া গ্রামে এখনো বিদ্যমান। এই রাজধানী প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন কেশব মিশ্র। তারা ছিলেন কাত্যান গোত্রীয় মিশ্র। তাদের উপাধি ছিল সিংহ। রাজা বিজয় সিংহ গোবিন্দ সিংহকে দায়ী করে তার বিরুদ্ধে সম্রাট আকবরের বিচার প্রার্থনা করেন। সম্রাট আকবর দিল্লি থেকে সৈন্য পাঠিয়ে গোবিন্দ সিংহকে দিল্লিতে ডেকে নেন। গোবিন্দ সিংহের অপর নাম ছিল জয় সিংহ। একই সময়ে ফাঁসির হুকুম প্রাপ্ত বানিয়াচং রাজ্যের জয় সিংহ নামের রাজা গোবিন্দ সিংহের সঙ্গে সম্রাট আকবরের কারাগারে আটক ছিলেন। ভুলবশত প্রহরীরা গোবিন্দ সিংহের পরিবর্তে ওই জয় সিংহকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেন। বানিয়াচং রাজা গোবিন্দ সিংহের প্রাণ এভাবে রক্ষা পাওয়ায় তিনি কৌশলে আকবরের কাছ থেকে নানা সুযোগ গ্রহণ করেন। তিনি আকবরের কাছে প্রাণভিক্ষা চান এবং ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। গোবিন্দ সিংহের নাম হয় হাবিব খাঁ। আকবর গোবিন্দ সিংহকে তার হৃতরাজ্য পুনরায় দান করেন। জগন্নাথপুরের রাজা বিজয় সিং দেশে ফিরার কিছু দিন পর বানিয়াচং রাজ গোবিন্দ সিংহ ওরফে হাবিব খাঁ'র সাথে বিবাদে পরে হাবিব খাঁ'র গুপ্ত ঘাতকের হাতে নিহত হলে লাউড় এবং জগন্নাথপুর রাজ্যদ্বয় হাবিব খাঁ'র অধিকার ভুক্ত হয় । বানিয়াচং রাজ্যের সাথে হতা-হতীতে জগন্নাথপুর রাজ্যের রাজ বংশ ধ্বংশ হয়। প্রায় শতরে'শ শতকের পরে লাউড় জগন্নাথপুর রাজ্য স্বাধীনতা হারায় এবং বানিয়াচং রাজ বংশ পরে মোঘলরা এর নিয়ন্ত্রক হন। এ ভাবে প্রাচীন রাজ্যগুলো একসময় জমিদারী এস্টেটের অধিনে আসে । ইংরেজ শাসনামলে ১৮৭৭ খ্রিষ্টাব্দে সুনামগঞ্জকে মহকুমায় উন্নীত করা হলে প্রশাসনিক ব্যবস্থা প্রশারে ১৯২২ সালে জগন্নাথপুর থানা গঠিত হয়। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগে এই অঞ্চলদ্বয় পাকিস্তানে অন্তরভুক্ত হয়ে বাঙালীর স্বাধীনতা সংগ্রাম বিজয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রশাসনিক অঞ্চলে রূপান্তর হয় । পরবর্তীকালে উন্নীত থানা পরিষদ উপজেলা পরিষদে রূপান্তরিত হয়। [6][7]
বর্তমান জগন্নাথপুর উপজেলার হবিবপুর গ্রাম স্থাপিত হয় ১৮৩২ থেকে ১৮৩৪ সালের মধ্যে। এর স্থাপনা করেন এই গ্রামের প্রথম জমিদার নবাব ওয়াহিদ উল্লাহ (১৮১৩–১৮৮০)। তিনি ছিলেন মূলত একজন ব্যাবসায়ী৷ তিনি এই গ্রামের পত্তন করে এখানে জমিদারি চালাতে থাকেন। ১৮৭৪ সালে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন৷ তখন জমিদারির ভার নেন তার একমাত্র পুত্র নবাব ওয়াসিদ উল্লাহ (১৮৪২–১৯২৬)। তিনি খুব বুদ্ধিমান মানুষ ছিলেন এবং তাদের জমিদারি অনেক বিস্তার করেন। তিনি ন্যায়পরায়ণ ও প্রজাবান্ধব হিসেবে খ্যাত ছিলেন। ১৯২৬ সালে হঠাৎ পানিতে ডুবে তিনি মারা যান। ওয়াসিদ উল্লাহর মৃত্যুর পর জমিদারির ভার নেন তার পুত্র নবাব এবারত উল্লাহ (১৮৯৬–১৯৪১)। পিতার হঠাৎ মৃত্যুর পর তিনি ক্ষমতায় আরোহণ করেন। অল্প বয়স হওয়ায় তিনি খুব সাধারণ জীবনযাপন করতেন। এমনকি তিনি ক্ষমতায় ৩-৪ বছর থাকার পর তার অনেক সম্পত্তি প্রজাদের দান করে দেন। কিন্তু তিনি ক্ষমতায় বেশিদিন টিকে থাকত পারেননি। ১৯৪১ সালে তিনিও পানিতে ডুবে মারা যান। মৃত্যুকালে তার তিন পুত্র ও চার কন্যা ছিল। পুত্ররা হলেন যথাক্রমে: মৃত আবলুস উল্লাহ, মৃত আব্দুল হাশিম, মৃত আব্দুল গনি। নবাবের সন্তানেরা খুব ছোট হওয়ায় এবং আর কোনও নবাব না থাকায় নবাব এবারত উল্লাহর সকল সম্পত্তি বেদখল হয়ে যায়। এমনকি তিনি যে বাড়িতে থাকতেন তাও দখল করে নেয় গ্রামের কিছু উগ্র লোক।
মুক্তিযুদ্ধে জগন্নাথপুর
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ১৯৭১ সালের ৩১ আগস্ট জগন্নাথপুর উপজেলায় শান্তি সভার নামে রাজাকারেরা শ্রীরামসি হাইস্কুলে স্থানীয় শিক্ষক, কর্মচারী, ইউপি সদস্যসহ গণ্যমান্য ও সাধারণ লোকজনের একটি সমাবেশের আয়োজন করে। রাজাকারদের সহযোগিতায় পাকসেনারা উক্ত সভার ১২৬জন লোককে হত্যা করে এবং গ্রামটি জ্বালিয়ে দেয়। এছাড়া ৮ সেপ্টেম্বর পাকসেনারা এ উপজেলার রানীগঞ্জ বাজারে ৩০জন লোককে হত্যা করে এবং ১৫০টি দোকান জ্বালিয়ে দেয়।[8]
ভাষা ও সংস্কৃতি
অত্র এলাকার লোকজন সাধারণত সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলেন। জগন্নাথপুর লোকসংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ।
জনসংখ্যার উপাত্ত
বাংলাদেশ সরকারের জাতীয় পরিচয়পত্র সম্পর্কিত রেকর্ড অনুযায়ী বর্তমান (২০১০) জনসংখ্যা ২,২৫,২৭১ জন।
শিক্ষা
১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দে জগন্নাথপুর উপজেলায় সর্বপ্রথম উচ্চ বিদ্যালয় পাইলগাঁও ব্রজনাথ উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। এই উপজেলায় ১২০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ ২১টি উচ্চ বিদ্যালয় রয়েছে। উল্লেখযোগ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো হল: স্বরূপচন্দ্র সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়,সফাত উল্লাহ উচ্চ বিদ্যালয়, শাহজালাল কলেজ এবং জগন্নাথপুর কলেজ। উপজেলার কওমী মাদ্রাসার সংখ্যা ২০টি, সরকারি স্বীকৃতপ্রাপ্ত মাদ্রাসার সংখ্যা ১১টি।
অর্থনীতি

কৃষিপণ্যের মধ্যে ধান আর পাটের বিপুল আবাদ রয়েছে। এছাড়া আছে হাওর ভরা মাছ। পাশাপাশি উপজেলার প্রচুর লোক বহির্দেশে বসবাস করায় তাদের পাঠানো রেমিট্যান্সের উপরও এলাকার অর্থনীতি নির্ভরশীল। এছাড়া দরিদ্রদের জন্য সরকারি অবদানও রয়েছে। বোর মৌসুমে জগন্নাথপুর উপজেলার ২০ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে বোরো চাষাবাদ করা হয়। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ১ লাখ ২০ হাজার মেট্রিকটন।
যাতায়াত ও যোগাযোগ
উপজেলার উল্লেখযোগ্য সড়কগুলো হল: বিশ্বনাথ-জগন্নাথপুর বাইপাস সড়ক, ভবের বাজার-সৈয়দপুর-নয়াবন্দর-গোয়ালাবাজার সড়ক, জগন্নাথপুর-কুবাজপুর-পাইলগাওঁ-কুশিয়ারা নদী-ইনায়েতগঞ্জ-হবিগঞ্জ সড়ক, পাগলা-জগন্নাথপুর-রানীগঞ্জ-আউশকান্দি বিশ্বরোড। উপজেলার পাকা রাস্তাগুলো হল: জগন্নাথপুর-ভবের বাজার-মীরপুর-বিশ্বনাথ সড়ক, জগন্নাথপুর-শিবগঞ্জ বাজার সড়ক, জগন্নাথপুর-পাগলা সড়ক, ভবের বাজার-সৈয়দপুর-শাহারপাড়া-নয়াবন্দর-গোয়ালাবাজার সড়ক, নয়াবন্দর-দাওরাই বাজার-পাঠকুরা বাজার সড়ক, মীরপুর-রসুলগঞ্জ বাজার সড়ক, পাইলগাওঁ হাই স্কুল-কাতিয়া-বড় ফেচী বাজার-বেগমপুর সড়ক, জগন্নাথপুর-কলকলিয়া-তেলিকোনা সড়ক। এছাড়া প্রস্তাবিত অনেক সড়ক রয়েছে।
কৃতি ব্যক্তিত্ব
- হজরত শাহ কালাম কোহাফা
- রাজা বিজয় মাণিক্য
- রাজা দিব্য সিংহ
- রাধারমণ দত্ত, বৈষ্ণব কবি ও বাংলার ধামাইল গানের জনক
- সৈয়দা শাহার বানু, ভাষা সৈনিক
- সুহাসিনী দাস, সাংবাদিক
- আব্দুস সামাদ আজাদ, রাজনীতিবিদ
- আনোয়ার চৌধুরী, বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ।
- অধ্যাপক আসাদ্দর আলী, সাহিত্যিক (বাংলা একাডেমি পদকপ্রাপ্ত)
- সৈয়দ শাহনুর, সুফি সাধক, মরমি গীতিকার
- আছিম শাহ সুফি সাধক, মরমি গীতিকার
- ব্রজেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরী প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ।
- সহুল উদ্দিন আহমদ ছইল মিয়া প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব।
- আজিজুর রহমান দারা সাবেক তুখুর ছত্রনেতা প্রবাসী
আরও দেখুন
তথ্যসূত্র
- বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়ন। "এক নজরে জগন্নাথপুর"। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার। জুন ২৮, ২০১৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ মে ২৭, ২০১৯।
- শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত উত্তরাংশ, তৃতীয় ভাগ, পঞ্চম খণ্ড, দ্বিতীয় অধ্যায়, অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধি; প্রকাশক: মোস্তফা সেলিম; উৎস প্রকাশন, ২০০৪
- সিলেটের গীতিকা, সমাজ ও সংস্কৃতি, ডঃ আবুল ফতেহ ফাত্তাহ
- শ্রীহট্রের ইসলাম জ্যোতি মুফতি আজহার উদ্দিন আহমদ সিদ্দিকী
- ইসকন্দর গীতি, পীর শাহ মোহাম্মদ ইসকন্দর মিয়া।
- সিলেট বিভাগের ইতিবৃত্ত: প্রাচীন ইতিহাসে সিলেট বিভাগ নিবন্ধ, মোহাম্মদ মুমিনুল হক, গ্রন্থ প্রকাশকাল: সেপ্টেম্বর ২০০১
- http://dainikamadershomoy.com/todays-paper/62363/
- বাংলাপিডিয়ায় জগন্নাথপুর উপজেলা।