রাধারমণ দত্ত

রাধারমণ দত্ত (সিলেটি: ꠞꠣꠗꠣꠞꠝꠘ ꠖꠔ꠆ꠔ), জন্মসূত্রে রাধারমণ দত্ত পুরকায়স্থ, (১৮৩৩ - ১৯১৫) একজন বাংলা সাহিত্যিক, সাধক কবি, বৈঞ্চব বাউল, ধামালি নৃত্য-এর প্রবর্তক।[1] সংগীতানুরাগীদের কাছে তিনি রাধারমণ বলেই সমাধিক পরিচিত। বাংলা লোকসংগীতের পুরোধা লোককবি রাধারমণ দত্ত। তার রচিত ধামাইল গান সিলেটভারতের বাঙ্গালীদের কাছে পরম আদরের ধন। রাধা রমন নিজের মেধা ও দর্শনকে কাজে লাগিয়ে মানুষের মনে চিরস্থায়ী আসন করে নিয়েছেন। কৃষ্ণ বিরহের আকূতি আর না-পাওয়ার ব্যথা কিংবা সব পেয়েও না-পাওয়ার কষ্ট তাকে সাধকে পরিণত করেছে। তিনি দেহতত্ত্ব, ভক্তিমূলক, অনুরাগ, প্রেম, ভজন, ধামাইলসহ নানা ধরনের কয়েক হাজার গান রচনা করেছেন[2]

রাধারমণ দত্ত
ꠞꠣꠗꠣꠞꠝꠘ ꠖꠔ꠆ꠔ
জন্ম১৮৩৩ (১২৪০ বঙ্গাব্দ)
জগন্নাথপুর, সিলেট, বাংলাদেশ
মৃত্যু১৯১৫ (১৩২২ বঙ্গাব্দ)
অন্যান্য নামরাধারমণ দত্ত পুরকায়স্থ
পরিচিতির কারণবাংলা সাহিত্যিক, সাধক কবি, বৈঞ্চব বাউল, ধামালি নৃত্য-এর প্রবর্তক

জন্ম ও বংশ পরিচিতি

রাধারমণ দত্তের ১০০তম মৃত্যু বার্ষিকী (১৮৩৩-১৯১৫) উপলক্ষে ডাকটিকেট

শ্রীহট্ট বা সিলেট অঞ্চলের পঞ্চখণ্ডে ত্রিপুরাধিপতি 'ধর্ম ফাঁ' কর্তৃক সপ্তম শতকে মিথিলা হতে আনিত প্রসিদ্ধ পাঁচ ব্রাহ্মণের মধ্যে 'আনন্দ শাস্ত্রী' নামক বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব রাধারমণ দত্তের পুর্ব পুরুষ ছিলেন বলে অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধির ঐতিহাসিক গ্রন্থ শ্রীহট্টের ইতিবৃত্তে পাওয়া যায়। আনন্দ শাস্ত্রীর প্রৌপুত্র নিধিপতি শাস্ত্রীর পুত্র ভানু নারয়ন নামক ব্যক্তি তত্কালিন মণুকুল প্রদেশে "ইটা" নামক রাজ্যের স্থপতি। উক্ত ভানু নারায়ণের চার পুত্রের মধ্যে রামচন্দ্র নারায়ণ বা ব্রহ্ম নারাণের এক পুত্র ছিলেন প্রভাকর। মুঘল সেনাপতি খোয়াজ উসমান দ্বারা ইটা রাজ্য অধিকৃত হলে, এই রাজ বংশের লোকগণ পালিয়ে গিয়ে আশে পাশের বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় গ্রহণ করেন। এ সময় প্রভাকর দত্ত তার পিতার সাথে আলিসারকুল চলে যান এবং সেখানে কিছু দিন বসবাস করার পর জগন্নাথপুর রাজ্যে এসে আশ্রয় নেন। কিছু দিন পর জগন্নাথপুর রাজ্যের তত্কালীন অধিপতি রাজা বিজয় সিংহের অনুমতিক্রমে প্রভাকর জগন্নাথপুরের নিকটস্থ কেশবপুর গ্রামে বাড়ী নির্মাণ করে সেখানে বসবাস করেন। পরবর্তিতে রাজা বিজয় সিংহ প্রভাকরের পুত্র সম্ভুদাস দত্তকে মন্ত্রী পদে নিয়োগ দেন। অতপর বানিয়াচংয়ের রাজা গোবিন্দ খা বা হবিব খার সাথে বিবাদে জগন্নাথপুর রাজ বংশের বিপর্য্যয়ের কারণ, রাজআশ্রীত কর্মচারীরাও দৈন্য দশায় পতিত হন । এ সময় সম্ভুদাস দত্তের পুত্র রাধামাদব দত্ত অন্যের দ্বারাস্থ না হয়ে, অনন্যচিত্তে সাহিত্য চর্চায় মনোনিবেশ করেন। রাধামাধব দত্ত সংস্কৃত ভাষায় জয়দেবের বিখ্যাত গ্রন্থ 'গীত গোবিন্দ' বাংলা ভাষায় অনুবাদ করে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। এছাড়া তার রচিত ভ্রমর গীতিকা, ভারত সাবিত্রী, সূর্যব্রত পাঁচালি, পদ্ম-পুরাণ ও কৃষ্ণলীলা গীতিকাব্য উল্লেখযোগ্য। এই প্রসিদ্ধ কবি রাধামাধব দত্তই ছিলেন রাধারমণ দত্তের পিতা।[3] রাধারমণ দত্ত পুরকায়স্থের জন্ম ১৮৩৩ খ্রিষ্টাব্দে (১২৪০ বঙ্গাব্দ)। - ১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দ, ১৩২২ বাংলা

সাধনা ও বৈরাগ্য

কবি রাধারমণের পারিবারিক ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় উপাসনার প্রধান অবলম্বন সংগীতের সংগে তার পরিচয় ছিল শৈশব থেকেই। খ্যাতিমান লোককবি জয়দেবের গীতগৌবিন্দ এর বাংলা অনুবাদ করেছিলেন তার পিতা রাধামাধব দত্ত। পিতার সংগীত ও সাহিত্য সাধনা তাকেও প্রভাবিত করেছিল।১২৫০ বঙ্গাব্দে রাধারমণ পিতৃহারা হন এবং মা সুবর্ণা দেবীর কাছে বড় হতে থাকেন। ১২৭৫ বঙ্গাব্দে মৌলভীবাজারের আদপাশা গ্রামে শ্রী চৈতন্যদেবের অন্যতম পার্ষদ সেন শিবানন্দ বংশীয় নন্দকুমার সেন অধিকারীর কন্যা গুণময়ী দেবীকে বিয়ে করেন। পিতার রচিত গ্রন্থ গুলো সে সময় তার জন্য পিতা আদর্শ হয়ে অন্তরে স্থান করে নিল। কালক্রমে তিনি একজন স্বভাবকবি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। রচনা করেন হাজার হাজার বাউল গান । লিখেছেন কয়েক শ ধামাইল গান। ধামাইল গান সমবেত নারীকন্ঠে বিয়ের অনুষ্ঠানে গীত হয়। বিশেষত সিলেট, কাছাড়, ত্রিপুরা ও ময়মসিংহ অঞ্চলে একসময় এর প্রচলন খুব বেশি ছিল[2]। রাধারমণ দত্ত একাধারে গীতিকার, সুরকার, ও শিল্পী ছিলেন। জানা যায়, সাধক রাধারমণ দত্ত ও মরমি কবি হাসন রাজার মধ্যে যোগাযোগ ছিল। অন্তরের মিল ছিল খুব বেশী। তাদের মধ্য বিভিন্ন সময় পত্রালাপ হতো কবিতায়। একবার হাসন রাজা রাধারমণের কুশল জানতে গানের চরণ বাঁধেন : রাধারমণ তুমি কেমন, হাছন রাজা দেখতে চায়। উত্তরে রাধারমণ লিখেনঃ- কুশল তুমি আছো কেমন - জানতে চায় রাধারমণ[1]। রাধারমণ একজন কৃঞ্চপ্রেমিক ছিলেন। কৃঞ্চবিরহে তিনি লিখেছেন অসংখ গান। এ সব গানের মধ্যে বিখ্যাত দুটি গান হচ্ছেঃ

তিনি বাল্যাবধি ঈশ্বরে বিশ্বাসী ও ধর্মানুরাগী ছিলেন। শাস্ত্রীয় পুস্তকাদীর চর্চা ও সাধু সন্ন্যাসীর সংস্পর্শে এসে তিনি শাক্ত, শৈব, বৈষ্ণব ইত্যদি নানা মত ও পথের সঙ্গে পিরিচিত হন। কবির সংসারজীবন সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য পাওয়া যায় নি। শুধু জানা যায়, রাধারমণ-গুণময় দেবীর ৪ ছেলে ছিল। তাদের নাম- রাজবিহারী দত্ত, নদীয়াবিহারী দত্ত, রসিকবিহারী দত্ত ও বিপিনবিহারী দত্ত। কিন্তু দুঃখের বিষয় একমাত্র পুত্র বিপিনবিহারী দত্ত ছাড়া বাকি ৩ পুত্র এবং স্ত্রী গুণময় দেবী অকালে মারা যান। স্ত্রী ও পুত্রদের পরলোক গমনে কবি রাধারমণ দত্ত সংসারজীবন সম্পর্কে উদাসীন হয়ে পড়েন। ১২৯০ বঙ্গাব্দে ৫০ বছর বয়সে কবি চলে যান মৌলভীবাজার জেলাধীন ঢেউপাশা গ্রামে সাধক রঘুনাথ ভট্টাচার্যের কাছে। তিনি তার কাছে শিষ্যত্ব লাভ করেন। শুরু হয় কবির বৈরাগ্য জীবন। আরম্ভ করেন সাধনা। গৃহত্যাগ করে জগন্নাথপুর উপজেলার নলুয়ার হাওরের পাশে একটি আশ্রম তৈরি করেন। এখানে চলে তার সাধন-ভজন। কবি নিজেই গেয়েছেন ঃ

শ্যামের বাঁশিরে ঘরের বাহির করলে আমারে
যে যন্ত্রণা বনে যাওয়া গৃহে থাকা না লয় মনে ॥

নলুয়ার হাওরের আশ্রম দিবা রাত্র সাধনা ও ইষ্ট নামে মগ্ন এবং অসংখ্য ভক্ত পরিবেষ্টিত হয়ে থাকতেন। ধ্যান মগ্ন অবস্হায় তিনি গান রচনা করে গেয়ে যেতেন। ভক্তরা শুনে শুনে তা স্মৃতিতে ধরে রাখত এবং পরে তা লিখে নিত[1][2]

রাধারমণের গীতি সংগ্রাহক

বিভিন্ন সংগ্রাহকদের মতে, রাধারমণে গানের সংখ্যা তিন হাজারেরও উপরে। সাধক রাধারমণের গানের বেশ কিছু গানের বই বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত হয়েছে। অধ্যাপক যতীন্দ্র মোহন ভট্টাচার্য প্রথমে রাধারমণ দত্তের গান সংগ্রহের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। কলিকাতা থেকে বাউল কবি রাধারমণ নামে ৮৯৮ টি গান নিয়ে একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। মোহাম্মদ মনসুর উদ্দীন তার হারামনি গ্রন্থের সপ্তম খণ্ডে রাধারমণের ৫১ টি গান অন্তর্ভুক্ত করেন। সিলেটের মোদন মোহন কলেজের সাহিত্য পরিষদ থেকে 'রাধারমণ সঙ্গীত' নামে চৌধুরী গোলাম আকবর সাহিত্যভূষনের সংগ্রীহিত একটি গ্রন্থ ১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয়েছে[1][2]। ঢাকার অ্যার্ডন পাবলিকেন্স প্রকাশ করেছে সুমনকুমার দাশ সম্পাদিত ‘অগ্রন্থিত রাধারমণ’ বইটি। দীর্ঘকাল পর রাধারমণের অগ্রন্থিত গান সংগ্রহ হওয়ায় এ গ্রন্থটি বোদ্ধামহলে প্রশংসা কুড়ায়। এছাড়া গুরুসদয় দত্ত, নির্মলেন্দু ভৌমিক, আবদুল গাফফার চৌধুরী, কেতকী রঞ্জন গুণ, মুহাম্মদ আব্দুল হাই, হুছন আলী, সৈয়দ মুর্তাজা আলী, নরেশ চন্দ্র পাল, যামিনী কান্ত র্শমা, মুহম্মদ আসদ্দর আলী, মাহমুদা খাতুন, ডঃ বিজন বিহারী পুরকাস্থ, সৈয়দ মোস্তফা কামাল, মোঃ আজিজুল হক চুন্নু, জাহানারা খাতুন, নরেন্দ্র কুমার দত্ত চৌধুরী, অধ্যাপক সুধীর চন্দ্র পাল, অধ্যাপক দেওয়ান মোঃ আজরফ, নন্দলাল শর্মা, শামসুল করিম কয়েস, শুভেন্দু ইমামসহ আরও অনেক বিদগ্ধজন রাধারমণ দত্তের গান সংগ্রহ করেছেন।[4] রাধারমণের আর কয়েকটি জনপ্রিয় গানঃ


 

|

|}



This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.