লাউড় রাজ্য

লাউড় রাজ্য পৌরাণিক যুগের কামরূপ রাজ্যের উপরাজধানী হিসেবে খ্যাত শ্রীহট্টের প্রাচীন রাজ্য। এর স্থপতি ছিলেন রাজা ভগদত্ত[1] পৌরাণিক যুগে সিলেটসহ বাংলার এক বিশাল ভূখণ্ড কামরুপ রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল।[2] পর্যায়ক্রমে ভগদত্ত রাজার বংশীয় ১৯ জন ঐতিহাসিক নৃপতি ভগদত্তের পরে শ্রীহট্ট অঞ্চলে রাজত্ব করেছেন।[1] ঐতিহাসিক মুমিনুল হকের মতে, প্রাচীন লাউড় রাজ্য কামরূপ থেকে পৃথক (৭৫০ খ্রিস্টাব্দ) হওয়ার পর প্রায় দশম শতকে লাউড় রাজ্য, জয়ন্তীয়াগৌড় রাজ্যে বিভক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে শাসিত হয়।

লাউড় রাজ্য
' পৌরাণিক যুগ'–১৭০০ খ্রিস্টাব্দ[1]
রাজধানী নবগ্রাম
সরকার রাজতন্ত্র
ঐতিহাসিক যুগ ধ্রুপদী যুগ
 - সংস্থাপিত পৌরাণিক যুগ
 - ভাঙ্গিয়া দেত্তয়া হয়েছে ১৭০০ খ্রিস্টাব্দ[1]
বর্তমানে অংশ  বাংলাদেশ
সতর্কীকরণ: "মহাদেশের" জন্য উল্লিখিত মান সম্মত নয়

ভৌগোলিক অবস্থান

পৌরাণিক যুগে শ্রীহট্ট ভূমি এ রাজ্যে গণ্য ছিল। লাউড় রাজ্যের চতুঃসীমা ছিল পশ্চিমে ব্রহ্মপুত্র নদ, পূর্বে জৈন্তিয়া, উত্তরে কামরূপ সীমান্ত ও দক্ষিণে বর্তমানে ব্রাম্মণবাড়িয়া পর্যন্ত। খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দীর পরবর্তী সময়ে সিলেট অঞ্চলের ভৌগোলিক রুপরেখার পরিবর্তন ঘটলে লাউড় রাজ্যের সীমানা বর্তমান সমগ্র সুনামগঞ্জ জেলা, হবিগঞ্জ জেলা এবং ময়মনসিংহ জেলার কিয়দাংশে সীমা বিস্তার হয়।[1][3]

ইতিহাস

কিংবদন্তি এবং ঐতিহাসিক ঘটনাবলী ও তথ্যাবলী থেকে জানা যায়, অতি প্রাচীনকালে সিলেটসহ বাংলার এক বিশাল ভূখণ্ড কামরূপ রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল[2] এবং এর রাজধানীর নাম ছিল প্রাগজ্যোতিষপুর। কামরূপ রাজ্যের শাসক ছিলেন রাজা ভগদত্ত। ঐতিহাসিকদের মতে সুনামগঞ্জের লাউড় পরগণায় রাজা ভগদত্তের উপরাজধানী ছিল। জনশ্রুতি ও পুরাকীর্তি ইত্যাদির ভিত্তিতে বলা হয় লাউড় সিলেটের প্রাচীন রাজ্য, যা বর্তমান সুনামগঞ্জ জেলার আওতায় পড়ে। পুরাকীর্তিসূত্রে ধারণা করা হয়, মহাভারত যুদ্ধে নিহত রাজা ভগদত্তের পরে তাঁর বংশীয় ১৯ জন ঐতিহাসিক নৃপতি লাউড় অঞ্চলে রাজত্ব করেছেন। নিধনপুরের তাম্রলিপি সূত্রে বলা হয় ভাস্করভর্মন খ্রিস্টীয় ৬৫০ অব্দ পর্যন্ত এ অঞ্চলের রাজত্ব করেন। ভাস্করবর্মনের পর স্লেচ্ছাদিনাথ শালস্থম্ভ (৬৫০-৬৭৫) দ্বারা বর্মনদের সিংহাসন অধিকৃত হয়। শালস্থম্ভের পর রাজা হর্ষবর্মন (রাজত্বকাল, ৭৩০-৭৫০) অত্র রাজ্যে রাজত্ব করেন। ব্রহ্মপুত্র পরবর্তী সমস্ত রাজ্যসমুহে হর্ষবর্মণের সময় বিরাট ধরনের অরাজকতা সৃষ্টির অভিমত [4] রয়েছে। এসময় সমস্ত বঙ্গদেশ ভিন্ন ভিন্ন খণ্ড রাজ্যে বিভক্ত হয়[2] এবং তখন সিলেটের প্রাচীন লাউড় রাজ্য কামরূপ থেকে বিভক্ত হয়ে একটি পৃথক স্বাধীন রাজ্য হিসেবে পরিণত হয়। দশম শতাব্দীতে লাউড়, গৌড় ও জয়ন্তীয়া এই তিন রাজ্যে বিভক্ত ছিল সিলেট। পরবর্তীকালে (দ্বাদশ শতাব্দীর শেষার্ধে) বিজয় মাণিক্য নামে জনৈক হিন্দু রাজা লাউড় রাজ্যে রাজত্ব করেন। এসময় রাজা বিজয় মাণিক্যের লাউড় রাজ্যের সীমানা বর্তমান সমগ্র সুনামগঞ্জ জেলা ও ময়মনসিংহ জেলা এবং হবিগঞ্জ জেলার কিয়দাংশ নিয়ে গঠিত ছিল। দ্বাদশ শতাব্দীর শেষার্ধে রাজা বিজয় মাণিক্য জগন্নাথপুরের পান্ডুয়ায় (পেরুয়া) একটি রাজ্য স্থাপন করেন। অঞ্চলের নামানুসারে নাম রাখেন পান্ডুয়া রাজ্য। রাজা বিজয় মাণিক্যের রাজত্ব কালে বঙ্গের ব্রাহ্মণরা রাজা বল্লান সেন কর্তৃক অপমানিত হয়ে লাউড় রাজ্যে আশ্রয় নেয়। রাজা বিজয় মাণিক্য জগন্নাথপুর অঞ্চলে বিভিন্ন স্থানে ঐ ব্রাহ্মদের স্থাপনা গড়ে দেন।[1][5] বিজয় মাণিক্যর পরে লাউড় ও জগন্নাথপুর রাজ্যে কে বা কারা শাসক ছিলেন তা অজ্ঞাত। তেরশত শতাব্দীর পর চৌদ্দ'শ সালের প্রথমার্ধে কাত্যায়ন গোত্রিয় দিব্য সিংহ নামে নৃপতি লাউড়ে রাজত্ব করেন। তখন লাউড়ের রাজধানী নবগ্রামে স্থানান্তর হ্য়। এ সময় লাউড় এবং জগন্নাথপুর রাজ্য অনেক জ্ঞানী পুরুষের আবির্ভাবে প্রফুল্লিত হয়েছিল। রাজ্যের রাজমন্ত্রী কুবেরাচার্য ছিলেন একজন সুপণ্ডিত ব্যক্তি। যার জ্ঞানের চর্চা ভারতবর্ষের অন্যতম বিদ্যাপীঠ নবদ্বীপ পর্যন্ত পরিব্যাপ্ত ছিল। এছাড়া উক্ত রাজ্যের নবগ্রামে মাধবেন্দ্রপুরী নামে আরেক জন জ্ঞানী সাধু পুরুষ বসবাস করতেন। এই মাদেবন্দ্রপুরির কাছে শিষ্যত্ব গ্রহণ করে লাউড়ের যুবরাজ রমানাথ বা রামা ও মন্ত্রীতনয় অদ্বৈত্যেচার্য সারা ভারতবর্ষে স্মরণীয় হয়ে আছেন। রমানাথ সিংহ উপযুক্ত হলে রাজা দিব্য সিংহ রাজ্যভার তাঁর পুত্র রমানাথকে দিয়ে, শান্তি সাধনায় তিনি তাঁর মন্ত্রীতনয় অদ্বৈত্যের আখড়া শান্তিপুরে চলে যান। সেখানে থেকে অদ্বৈত্যের উপদেশে বৈষ্ণবীধর্ম গ্রহণ করেন এবং সাহিত্য চর্চায় মনোযুগী হয়ে বাংলা ভাষায় বিঞ্চুভক্তি শাস্ত্র গ্রন্থ সহ আরও কয়েকটি গ্রন্থের অনুবাদ করেন। অতপর অদ্বৈত্য বাল্যলিলা গ্রন্থ রচনা করে কৃষ্ণদাস নামে আখ্যাত হন। রাজা দিব্য সিংহের পুত্র রামানাথ সিংহের তিন পুত্র ছিল। এই তিন পুত্রের মধ্যে একজন কাশীবাসি হন এবং এক পুত্রকে লাউড়ের রাজ সিংহাসনে বসিয়ে; রামানাথ সিংহ তাঁর অন্য পুত্র কেশবের সাথে জগন্নাথপুরে আসেন। জগন্নাথপুর এককালে বর্তমান ভৌগোলিক সীমানার চেয়ে আরো বড় ছিল। সেই দ্বাদশ শতাব্দী থেকে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত জগন্নাথপুর রাজ্য লাউড়ের শাখা-রাজ্য ছিল, এবং বংশানুক্রমে লাউড় নৃপতিগণ কর্তৃক শাসিত হ্য়। দিল্লী সম্রাটদের রেকর্ডে জগন্নাথপুর রাজ্য লাউড়ের এজমালি সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হত। শ্রীহট্রের ইতিবৃত্তে বর্ণিত যে, উক্ত লাউড় রাজ্য সকল সময় স্বাধীন ছিল। ঐতিহাসিক ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টারের মতে, সম্ভবত ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে লাউড় রাজ্য স্বাধীনতা হারায় এবং মোগলরা এর নিয়ন্ত্রক হন।[1][6][7]

তথ্যসুত্র

  1. শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত পূর্বাংশ, দ্বিতীয় ভাগ, প্রথম খণ্ড, প্রথম অধ্যায়, অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধি; প্রকাশক: মোস্তফা সেলিম; উৎস প্রকাশন, ২০০৪।
  2. Ancient India" Ramesh Chandra Majumdar, Chapter 3, p267, Motilal Banarsidass Publishers, Eighth Edition: Delhi, 1977
  3. সরকারি ওয়েব সাইট ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২০ নভেম্বর ২০১১ তারিখে, জেলা তথ্য বাতায়ন
  4. সুহাস চট্টোপাধ্যায়ের "ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতি", "উত্তর-পূর্ব ভারতের সংস্কৃতি, (কামরূপ)" পৃষ্ঠা: ৪৩০, এম ডি প্রকাশনা, নতুন দিল্লী, ১৯৯৮।
  5. সিলেট বিভাগের ইতিবৃত্ত: প্রাচীন ইতিহাসে সিলেট বিভাগ নিবন্ধ, মোহাম্মদ মুমিনুল হক, গ্রন্থ প্রকাশকাল: সেপ্টেম্বর ২০০১
  6. Essays on north-east India: presented in memory of professor V. Venkata Rao By V. Venkata Rao, North Eastern Hill University. Dept. of History
  7. A Statistical Account of Sylhet, W. W. Hunter
This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.