আবদুল হালিম চৌধুরী জুয়েল

আবদুল হালিম চৌধুরী জুয়েল যিনি শহীদ জুয়েল নামে সর্বাধিক পরিচিত (জন্ম: ১৮ জানুয়ারি ১৯৫০ - মৃত্যু: ৩১ আগস্ট, ১৯৭১) ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নিহত হওয়া গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ক্রিকেটার হিসেবেও পরিচিত ছিলেন। [1] বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন ঢাকার কিংবদন্তী ক্র্যাক প্লাটুন এর সদস্য ছিলেন তিনি। ১৯৭১ সালের ২৯ আগস্ট পাকিস্তানি সেনারা তাকে আটক করে। ধারণা করা হয় ৩১ আগস্ট পাকিস্তানি সেনারা ক্রিকেটার জুয়েলকে হত্যা করে। স্বাধীনতা যুদ্ধে তার সাহসিকতার জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে বীর বিক্রম খেতাব প্রদান করে। [2]

আবদুল হালিম চৌধুরী জুয়েল
মৃত্যু৩১ আগস্ট, ১৯৭১
জাতীয়তাবাংলাদেশী
নাগরিকত্ব পাকিস্তান (১৯৭১ সালের পূর্বে)
 বাংলাদেশ

জন্ম ও পরিবার

জুয়েলের জন্ম ১৯৫০ সালের ১৮ জানুয়ারি তার পৈতৃক বাড়ি মুন্সিগঞ্জ জেলার শ্রীনগর উপজেলার দক্ষিণ পাইকশা গ্রামে। তার বাবার আবদুল ওয়াজেদ চৌধুরী এবং মা ফিরোজা বেগম। রাজধানী ঢাকার টিকাটুলির ৬/১ কে এম দাস লেনেও তার বাবার বাড়ি ছিল, সেখানেই তার বেড়ে ওঠা। তিন ভাই ও চার বোনের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়।

শিক্ষাজীবন

১৯৭১ সালে জুয়েল ঢাকার জগন্নাথ কলেজের শিক্ষার্থী ছিলেন।

ক্রিকেটার জীবন

১৯৭১ সালের পূর্বে শহীদ জুয়েল ঘরোয়া লীগে আজাদ বয়েজে ও মোহামেডান ক্লাবে খেলেছেন। আজাদ বয়েজ ক্লাবের আক্রমণাত্মক ওপেনার ছিলেন শহীদ জুয়েল।[3] উইকেটকিপার হিসেবেও আলাদা অবস্থান ছিল তার। ১৯৬৯ সালে তিনি মোহামেডানে যোগ দেন। এটাই ছিল তার জীবনের শেষ ক্লাব। তিনি ঢাকা, ইস্ট পাকিস্তান ও ইস্ট পাকিস্তান হোয়াইটের হয়ে প্রথম শ্রেণীর সাতটি ম্যাচ খেলেন।

১৯৬৬ সালের ২১ মে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে জুয়েলের অভিষেক হয়। সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মাঠে আইয়ুব ট্রফিতে পাবলিক ওয়ার্কস ডিপার্টমেন্টের বিপক্ষে ঢাকার হয়ে তিন দিনের ম্যাচ খেলেন। প্রথম ইনিংসে ৩৮ ও দ্বিতীয় ইনিংসে ৪ রান করেন। তার ৩৮ ছিল দুই দলের মধ্যে সর্বাধিক রানের ইনিংস। ম্যাচটি ড্র হয়।

১৯৬৬ সালের ৫ অক্টোবর হায়দরাবাদের নিয়াজ স্টেডিয়ামে কায়দ-ই-আজম ট্রফিতে হায়দরাবাদ, খায়েরপুর ও কোয়েটার বিপক্ষে চার দিনের ম্যাচে তিনি ইস্ট পাকিস্তান দলের হয়ে খেলেন। প্রথম ইনিংসে ৪ করলেও দ্বিতীয় ইনিংসে ২৯ রান করেন। এ ম্যাচে ইস্ট পাকিস্তান ৫ উইকেটে জয়ী হয়।

১৯৬৯ সালের ২২ আগস্ট করাচির ন্যাশনাল স্টেডিয়ামে খেলেন করাচি হোয়াইট-এর বিপক্ষে। কায়দ-ই-আজম ট্রফির তিন দিনের ম্যাচে প্রথম ইনিংসে ৫ ও দ্বিতীয় ইনিংসে ২৭ রান করেন। ম্যাচটি ড্র হয়।

একই টুর্নামেন্টে ১৯৬৯ সালের ২৯ আগস্ট করাচির ন্যাশনাল স্টেডিয়ামে খায়েরপুরের বিপক্ষে খেলেন। তিন দিনের ম্যাচে প্রথম ইনিংসে ১৫ রান করেন। ইস্ট পাকিস্তান এ ম্যাচে ইনিংস ও ৫ রানে জয়ী হয়।

১৯৬৯ সালের ২ সেপ্টেম্বর কায়দ-ই-আজম ট্রফিতে করাচির ন্যাশনাল স্টেডিয়ামে হায়দরাবাদ হোয়াইট-এর বিপক্ষে তিনি খেলেন। তিন দিনের ম্যাচের প্রথম ইনিংসে ১২ ও দ্বিতীয় ইনিংসে ৯ রান করে। ইস্ট পাকিস্তান এ ম্যাচে ১৩৫ রানে জয়ী হয়।

১৯৭১ সালের ১৫ জানুয়ারি ঢাকা স্টেডিয়ামে বিসিসিপি ট্রফির তিন দিনের ম্যাচে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপক্ষে ইস্ট পাকিস্তান হোয়াইটের হয়ে খেলেন। প্রথম ইনিংস ৪৭ ও দ্বিতীয় ইনিংসে ৬৫ রান করেন। এটি ছিল তার সেরা পারফরম্যান্স। ম্যাচটি ড্র হয়।

২৬ জানুয়ারি ঢাকা স্টেডিয়ামে একই টুর্নামেন্টে তিনি পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনসের বিপক্ষে খেলেন। প্রথম ইনিংসে ৪ ও দ্বিতীয় ইনিংসে ০ রানে অপরাজিত থাকেন। তিন দিনের ম্যাচটি ড্র হয়।

সাতটি ম্যাচ খেলে তিনি ২১ দশমিক ৫৮ গড়ে ২৫৯ রান করেন। পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি ক্রিকেটারদের পক্ষে এই রান ছিল উল্লেখযোগ্য।[4]

জুয়েল জাতীয় অনূর্ধ-১৯ চ্যাম্পিয়নশিপেও খেলেছেন। ১৯৭০ সালের ২৫ থেকে ২৭ ডিসেম্বর ঢাকা স্টেডিয়ামে ইস্ট পাকিস্তান স্পোর্টস ফেডারেশনের হয়ে ঢাকা এডুকেশন বোর্ডের বিপক্ষে খেলেন। তিন দিনের ম্যাচের প্রথম ইনিংসে ২৫ রান করেন। ম্যাচটি ড্র হয়। ১৯৭০ সালের ৩০ ডিসেম্বর ঢাকা স্টেডিয়ামে তিনি লাহোর দলের বিপক্ষে ফাইনাল ম্যাচ খেলেন। তিন দিনের ফাইনালে প্রথম ম্যাচে ২৩ ও দ্বিতীয় ইনিংসে ৮ রান করেন। ম্যাচটি ড্র হয়।[4]

১৯৭০-৭১ মৌসুমে ক্রিকেট লিগে তিনি দুর্দান্ত খেলেন। প্রায় প্রতি ম্যাচেই বড় স্কোর গড়েন। কারদার সামার ক্রিকেটে সেঞ্চুরি করেন। কিন্তু তারপরও তার মূল্যায়ন যথাযথভাবে করা হয়নি। তবে পূর্ব পাকিস্তান ক্রিকেট দলের অপরিহার্য সদস্য হয়ে ওঠেন তিনি। সে সময় পূর্ব পাকিস্তান দলেও ছিল অবাঙালিদের প্রাধান্য। তন্মধ্যে যে ক’জন বাঙালি পূর্ব পাকিস্তান দলে স্থান করে নেন, তিনি তাদের একজন। ১৯৬৯ সালে পাকিস্তান সফরে আসে নিউজিল্যান্ড জাতীয় ক্রিকেট দল। এ সফরে কিউইরা তিনটি টেস্ট খেলে। এ সিরিজে খেলার জন্য জুয়েল পাকিস্তান ক্যাম্পে ডাক পেয়েছিলেন। কিন্তু মূল দলে তিনি সুযোগ পাননি।[4]

মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে মে মাসের শেষ দিকে ঢাকা থেকে পালিয়ে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের মেলাঘরে যান শহীদ জুয়েল। সেখানে তাকে মুক্তিবাহিনীর ক্র্যাক প্ল্যাটুনে অন্তর্ভুক্ত করে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। প্রশিক্ষণ শেষে ঢাকায় এসে গেরিলা অপারেশন শুরু করেন। ফার্মগেট ছাড়াও এলিফ্যান্ট রোডের পাওয়ার স্টেশন, যাত্রাবাড়ী ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশনে গেরিলা অপারেশনে যথেষ্ট সাহসিকতার পরিচয় দেন তিনি।

মুক্তিযুদ্ধ

মূলত ঢাকা কেন্দ্রিক বিভিন্ন স্থানে জুয়েল ও তার সহ গেরিলারা বিভিন্ন অপারেশনে অংশগ্রহণ করেন।

মৃত্যু

১৯ আগস্ট নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশনে গেরিলা অপারেশনের সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পাল্টা আক্রমণে জুয়েল আহত হন। ঢাকার বড় মগবাজার এলাকায় চিকিৎসারত অবস্থায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এ রাজাকারদের সহায়তায় ২৯ আগস্ট তাকে আটক করে। ৩১ আগস্ট পাকিস্তানি সেনারা তাকে হত্যা করে।

সম্মাননা

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তৎকালীন অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে শহীদ জুয়েলকে মরণোত্তোর সম্মাননা প্রদানের ঘোষণা দেয়। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সরকার জুয়েলকে মরণোত্তর বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত করে। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তার বীরত্বভূষণ সনদ নম্বর ১৪৮।

তথ্যসূত্র

বহি:সংযোগ

আরও পড়ুন

  1. বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ২ এবং স্বাধীনতাযুদ্ধে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা, মো. আবদুল হান্নান।
This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.