কাজী হায়াৎ
কাজী হায়াৎ (জন্ম ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৭) বাংলাদেশের একজন খ্যাতিমান চলচ্চিত্র পরিচালক, চিত্রনাট্যকার এবং অভিনেতা। তিনি ১৯৭৪ সালে পরিচালক মমতাজ আলীর সাথে সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ শুরু করেন এবং ১৯৭৬-১৯৭৭ মৌসুমে বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার আলমগীর কবিরের সাথে সীমানা পেরিয়ে ছবিতেও সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন। ১৯৭৯ সালে দি ফাদার ছবিটি পরিচালনার মধ্যে দিয়ে পূর্ণ-পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। তিনি তার বেশিরভাগ ছবিতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সমসাময়িক জনদুর্ভোগের চিত্র ফুঁটিয়ে তোলেন।
কাজী হায়াৎ | |
---|---|
![]() ২০১৭ সালে চলচ্চিত্র পরিচালক কাজী হায়াৎ | |
জন্ম | কাজী হায়াৎ ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৭ |
জাতীয়তা | বাংলাদেশী |
পেশা | চলচ্চিত্র পরিচালক, চিত্রনাট্যকার, অভিনেতা |
কার্যকাল | ১৯৭৪ – বর্তমান |
দাম্পত্য সঙ্গী | রমিসা হায়াৎ |
সন্তান | কাজী মারুফ (পুত্র) |
পুরস্কার | পূর্ণ তালিকা |
কাজী হায়াৎ অর্ধশতাধিক চলচ্চিত্র পরিচালনা করেছেন।[1] তার পরিচালিত অন্যতম চলচ্চিত্রসমূহ হল দাঙ্গা (১৯৯২), ত্রাস (১৯৯২), চাঁদাবাজ (১৯৯৩), সিপাহী (১৯৯৪), দেশপ্রেমিক (১৯৯৪), লাভ স্টোরি: প্রেমের গল্প (১৯৯৫), আম্মাজান (১৯৯৯), ইতিহাস (২০০২), কাবুলিওয়ালা (২০০৬) এবং ওরা আমাকে ভাল হতে দিল না (২০১০)।
কাজী হায়াৎ তার চলচ্চিত্র জীবনে আন্তর্জাতিক, জাতীয় ও অন্যান্য চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ সর্বমোট ৭৩টি চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেছেন। তিনি চারটি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উত্সবে অংশগ্রহণ করেন। দাঙ্গা চলচ্চিত্রের জন্য আফ্রো-এশিয়ো সরিডরি কমিটি এ্যাওয়ার্ড কর্তৃক প্রদেয় শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। চলচ্চিত্র পরিচালনা এবং লেখনীর জন্য তিনি চারটি ভিন্ন ভিন্ন বিভাগে নয়টি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার এবং লেখনীর জন্য তিনটি বাচসাস পুরস্কার লাভ করেন।
জীবনী
কাজী হায়াৎ ১৯৪৭ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি গোপালগঞ্জ জেলায় অবস্থিত কাশিয়ানী উপজেলার ফুকরা ইউনিয়নের তারাইল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
চলচ্চিত্র জীবন
কাজী হায়াৎ প্রথমে ১৯৭৪ সালে মমতাজ আলীর সাথে সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করেন। পরে আলমগীর কবিরের সাথে সীমানা পেরিয়ে (১৯৭৭) ছবিতে সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করেন।[2] তিনি পূর্ণ-পরিচালক হিসেবে ১৯৭৯ সালে দি ফাদার ছবিটি পরিচালনা করেন।[3] এতে অভিনয় করেন প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন জন নেপিয়ার অ্যাডামস, বুলবুল আহমেদ ও সুচরিতা। এই ছবির "আয় খুকু আয়" গানটি খুব জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। পরের বছর নির্মাণ করেন দিলদার আলী। এরপর একে একে নির্মাণ করেন খোকন সোনা (১৯৮২), রাজবাড়ী (১৯৮৪), মনা পাগলা (১৯৮৪ ), পাগলী (১৯৮৫), বেরহম (১৯৮৫)। ১৯৮৭ সালে এটিএম শামসুজ্জামান ও তার যৌথ লেখনীতে আফতাব খান টুলু পরিচালনা করেন দায়ী কে?। ছবিটির জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ কাহিনীকারের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন এবং এটিএম শামসুজ্জামান শ্রেষ্ঠ অভিনেতা পুরস্কার লাভ করেন।[4] এছাড়া কাজী হায়াৎ শ্রেষ্ঠ কাহিনীকারের জন্য এবং এটিএম শামসুজ্জামান শ্রেষ্ঠ সংলাপ রচয়িতার জন্য বাচসাস পুরস্কার লাভ করেন। আশির দশকের শেষের দিকে তিনি নির্মাণ করেন যন্ত্রণা (১৯৮৮) এবং আইন-আদালত (১৯৮৯)।
নব্বইয়ের দশকের শুরুতে তিনি রচনা ও পরিচালনা করেন অপরাধ-নাট্যধর্মী দাঙ্গা (১৯৯২), ত্রাস (১৯৯২), এবং চাঁদাবাজ (১৯৯৩)। ত্রাস ছবিটির জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকার ও শ্রেষ্ঠ সংলাপ রচয়িতার জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন এবং চাঁদাবাজ ছবিটির জন্য শ্রেষ্ঠ কাহিনীকারের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন। ১৯৯৪ সালে নির্মাণ করেন সিপাহী ও দেশপ্রেমিক। একজন চলচ্চিত্র পরিচালকের সংগ্রামী জীবনের বাস্তবতা নিয়ে নির্মিত দেশপ্রেমিক ছবিতে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন আলমগীর, মান্না, চম্পা। ছবিটি আগুনের পরশমণি চলচ্চিত্রের সাথে যৌথভাবে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রের পুরস্কার লাভ করে এবং কাজী হায়াৎ শ্রেষ্ঠ পরিচালক ও শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকারের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন। পরের বছর রমিসা হায়াতের কাহিনীতে তিনি প্রযোজনা ও পরিচালনা করেন রোম্যান্টিক-নাট্যধর্মী লাভ স্টোরি: প্রেমের গল্প (১৯৯৫)। এতে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন রোজী সিদ্দিকী, পল্লব, ও রাইসুল ইসলাম আসাদ।
১৯৯৭ সালে কাজী হায়াৎ রচনা ও পরিচালনা করেন দেশদ্রোহী, লুটতরাজ, পাগলা বাবুল এবং ১৯৯৮ সালে নির্মাণ করেন তেজী। ১৯৯৯ সালে রচনা ও পরিচালনা করেন আম্মাজান, জবরদখল ও ধর। আম্মাজান ছবিতে নাম ভূমিকায় অভিনয় করেন শবনম[5] এবং তার ছেলের ভূমিকায় অভিনয় করেন মান্না। এই চলচ্চিত্রের জন্য কাজী হায়াৎ শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকারের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন। ছবিটি শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে বাচসাস পুরস্কার লাভ করে এবং কাজী হায়াৎ শ্রেষ্ঠ সংলাপ রচয়িতার পুরস্কার অর্জন করেন।
২০০০ সালে নির্মাণ করেন জখম, কষ্ট, ঝড়, ধাওয়া, ও বর্তমান। পরের বছর নির্মাণ করেন ক্রোধ, আব্বাজান, পাঞ্জা, তান্ডবলীলা। ২০০২ সালে তিনি রচনা, প্রযোজনা ও পরিচালনা করেন ইতিহাস। এই ছবিতে অভিষেক হয় তার পুত্র কাজী মারুফের[6] এবং চিত্রনায়িকা রত্নার।[7] এই ছবির জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ পরিচালক বিভাগে এবং তার পুত্র মারুফ শ্রেষ্ঠ অভিনেতা বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন।[8] এছাড়া কাজী হায়াৎ শ্রেষ্ঠ সংলাপ রচয়িতার জন্য এবং কাজী মারুফ শ্রেষ্ঠ অভিনেতার জন্য বাচসাস পুরস্কার অর্জন করেন। পরের বছর তিনি আবার তার পুত্র মারুফকে নিয়ে নির্মাণ করেন অন্ধকার এবং মান্নাকে নিয়ে মিনিস্টার।
২০০৪ সালে তিনি রচনা ও পরিচালনা করেন অন্য মানুষ। এতে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন কাজী মারুফ ও শাবনূর। পরের বছর নির্মাণ করেন সমাজকে বদলে দাও। ২০০৬ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত কাবুলিওয়ালা ছোটগল্প অবলম্বনে নির্মাণ করেন কাবুলিওয়ালা। এতে নাম ভূমিকায় অভিনয় করেন মান্না, এবং অন্যান্য প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন প্রার্থনা ফারদিন দিঘী, সুব্রত বড়ুয়া ও দোয়েল।[9] ২০০০ এর দশকের শেষের দিকে তার পুত্র মারুফকে নিয়ে নির্মাণ করেন ক্যাপ্টেন মারুফ (২০০৭) ও শ্রমিক নেতা (২০০৯)।
২০১০ এর দশকের শুরুতে তিনি নির্মাণ করেন অশান্ত মন (২০১০), আমার স্বপ্ন (২০১০), বড় লোকের দশদিন গরিবের একদিন (২০১০), ওরা আমাকে ভাল হতে দিল না (২০১০), ও পিতা পুত্রের গল্প (২০১১)। ২০১২ সালে তিনি নির্মাণ করেন মানিক রতন দুই ভাই।[10] পরের বছর নির্মাণ করেন ইভটিজিং।[11] পরে তার পুত্র মারুফকে নিয়ে নির্মাণ করেন সর্বনাশা ইয়াবা (২০১৪) ও ছিন্নমূল (২০১৬)। ছিন্নমূল কাজী হায়াতের পঞ্চাশতম চলচ্চিত্র।[12]
পরিচালিত চলচ্চিত্রসমূহ
- দি ফাদার (১৯৭৯)
- দিলদার আলী (১৯৮০)
- খোকন সোনা (১৯৮২)
- রাজবাড়ী (১৯৮৪)
- মনা পাগলা (১৯৮৪ )
- পাগলী (১৯৮৫)
- বেরহম (১৯৮৫)
- যন্ত্রণা (১৯৮৮)
- আইন-আদালত (১৯৮৯)
- দাঙ্গা (১৯৯১)
- ত্রাস (১৯৯২)
- চাঁদাবাজ (১৯৯৩)
- সিপাহী (১৯৯৪)
- দেশপ্রেমিক (১৯৯৪)
- লাভ স্টোরি: প্রেমের গল্প (১৯৯৫ )
- দেশদ্রোহী (১৯৯৭)
- লুটতরাজ (১৯৯৭)
- পাগলা বাবুল (১৯৯৭)
- তেজী (১৯৯৮)
- আম্মাজান (১৯৯৯)
- জবরদখল (১৯৯৯)
- ধর (১৯৯৯)
- জখম (২০০০)
- কষ্ট (২০০০)
- ঝড় (২০০০)
- ধাওয়া (২০০০)
- বর্তমান (২০০০)
- ক্রোধ (২০০১)
- আব্বাজান (২০০১)
- পাঞ্জা (২০০১)
- তান্ডবলীলা (২০০১)
- ইতিহাস (২০০২)
- মিনিস্টার (২০০৩)
- অন্ধকার (২০০৩)
- অন্য মানুষ (২০০৪)
- সমাজকে বদলে দাও (২০০৫)
- কাবুলিওয়ালা (২০০৬)
- ক্যাপ্টেন মারুফ (২০০৭)
- শ্রমিক নেতা (২০০৯)
- অশান্ত মন (২০১০)
- আমার স্বপ্ন (২০১০)
- বড় লোকের দশদিন গরিবের একদিন (২০১০)
- ওরা আমাকে ভাল হতে দিল না (২০১০)
- পিতা পুত্রের গল্প (২০১১)
- মানিক রতন দুই ভাই (২০১২)
- ইভটিজিং ( ২০১৩)
- সর্বনাশা ইয়াবা (২০১৪)
- ছিন্নমূল (২০১৬)
সম্মাননা
চলচ্চিত্র পুরস্কার
- বিজয়ী: শ্রেষ্ঠ কাহিনীকার - দায়ী কে? (১৯৮৭)
- বিজয়ী: শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকার ও শ্রেষ্ঠ সংলাপ রচয়িতা - ত্রাস (১৯৯২)
- বিজয়ী: শ্রেষ্ঠ কাহিনীকার ও শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকার - চাঁদাবাজ (১৯৯৩)
- বিজয়ী: শ্রেষ্ঠ পরিচালক ও শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকার - দেশপ্রেমিক (১৯৯৪)
- বিজয়ী: শ্রেষ্ঠ পরিচালক ও শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকার - ইতিহাস (২০০২)
- বাচসাস পুরস্কার
আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উত্সবে অংশগ্রহণ
- তেহরান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উত্সব ইরান ১৯৯২
- চলচ্চিত্র দাঙ্গা ও চাঁদাবাজ
আন্তর্জাতিক সম্মাননা
- পিয়ান ইয়ান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উত্সব উত্তর কোরিয়া ১৯৯১।
- বিজয়ী: শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র দাঙ্গা ১৯৯১
আরও দেখুন
তথ্যসূত্র
- বাবু, মাজহার (১৪ আগস্ট ২০১৫)। "৫০তম ছবির কাজ শুরু করেছেন কাজী হায়াৎ"। এনটিভি অনলাইন। সংগ্রহের তারিখ ১৮ জুলাই ২০১৭।
- "কাজী হায়াতকে অভিনন্দন"। জাগো নিউজ। ১ এপ্রিল ২০১৫। সংগ্রহের তারিখ ১৮ জুলাই ২০১৭।
- ফারজানা, মিথিলা (১৭ এপ্রিল ২০১০)। "চিত্র পরিচালক কাজী হায়াৎ"। বিবিসি নিউজ। সংগ্রহের তারিখ ১৮ জুলাই ২০১৭।
- "আজীবন অভিনয় করতে চান এটিএম"। যায়যায়দিন। ১৬ মার্চ ২০১৬। সংগ্রহের তারিখ ১৮ জুলাই ২০১৭।
- "Shabnam to return to films after 12 years"। দ্য ডেইলি স্টার। Dhaka, Bangladesh। ৬ জুলাই ২০১১। সংগ্রহের তারিখ ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১১।
- "কাজী মারুফ নতুনরূপে"। দৈনিক মানবজমিন। ঢাকা, বাংলাদেশ। ১৮ মে ২০১৫। সংগ্রহের তারিখ ১৮ জুলাই ২০১৬।
- কামরুজ্জামান মিলু (২২ মে ২০১৬)। "নতুন রত্না"। দৈনিক মানবজমিন। ঢাকা, বাংলাদেশ। সংগ্রহের তারিখ ১৮ জুলাই ২০১৬।
- আবদুল্লাহ আল মানি (ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০১৫)। "ইতিহাস (২০০২)"। বাংলা মুভি ডেটাবেজ। সংগ্রহের তারিখ ১৮ জুলাই ২০১৭।
- "'Kabuliwala' comes alive on celluloid"। দ্য ডেইলি স্টার। ঢাকা, বাংলাদেশ। ৩ আগস্ট ২০০৬। সংগ্রহের তারিখ ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১১।
- "ডিপজল-মারুফ কাজী হায়াতের 'মানিক রতন'"। দৈনিক মানবজমিন। ঢাকা, বাংলাদেশ। ৫ মে ২০১১। সংগ্রহের তারিখ ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১১।
- "কাজী হায়াৎ-এর ইভ টিজিং"। বাংলাদেশ প্রতিদিন। ঢাকা, বাংলাদেশ। ১৪ এপ্রিল ২০১১। সংগ্রহের তারিখ ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১১।
- কবির, আলমগীর (৩ জানুয়ারি ২০১৭)। "কাজী হায়াৎ-এর ৫০তম চলচ্চিত্রে মৌসুমী"। দৈনিক নয়া দিগন্ত। ঢাকা, বাংলাদেশ। সংগ্রহের তারিখ ১৮ জুলাই ২০১৭।