অসমীয়া ভাষা
অসমীয়া ভাষা (অসমীয়া উচ্চারণে অখ়মীয়া) (Assamese) প্রায় দেড় কোটি মানুষের মাতৃভাষা। এদের অধিকাংশই ভারতের অসম রাজ্যে বাস করেন। এছাড়াও ভারতের অঙ্গরাজ্য পশ্চিমবঙ্গ, মেঘালয় ও অরুণাচল প্রদেশ এবং সার্বভৌম রাষ্ট্র ভুটান এবং বাংলাদেশেও অসমীয়া প্রচলিত। পূর্ব ভারতীয় মাগধী প্রাকৃত থেকে অসমীয়া ভাষার উৎপত্তি হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। ১৮২৬ সালে অসম ব্রিটিশ শাসনের অধীনে আসে এবং ১৮৩৬ সালে বাংলা ভাষাকে অসমের রাষ্ট্রভাষা করা হয়। এর প্রায় ৩৬ বছর পরে ১৮৭২ সালে অসমীয়া ভাষা রাজ্যটির সরকারি ভাষা হিসেবে ফিরে আসে। বর্তমানে অসমীয়া ভারতের অসম রাজ্যের সরকারি ভাষা এবং রাজ্যের সমস্ত কর্মকাণ্ডে এটি ব্যবহৃত হয়।
অসমীয়া | |
---|---|
অসমীয়া Ôxômiya | |
![]() | |
দেশোদ্ভব | ভারত |
অঞ্চল | অসম, অরুণাচল প্রদেশ, নাগাল্যান্ড - (অসমীয়া অথবা অসমীয়ার একটি সংলাপ বৈভাষিক) এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের কিছু অন্যান্য অংশ এবং পুনে - মহারাষ্ট্র, উত্তরপ্রদেশ, দিল্লি এবং অন্যদের মধ্যে বেঙ্গালুরু, কর্ণাটক, ও কলকাতা [1] |
মাতৃভাষী | ১৬.৮ মিলিয়ন (২০০০)
|
ইন্দো-ইউরোপীয়
| |
অসমীয়া লিপি | |
সরকারি অবস্থা | |
সরকারি ভাষা | ![]() |
নিয়ন্ত্রক সংস্থা | অসম সাহিত্য সভা (আসামের সাহিত্য / অলঙ্কৃত মহাসভা ) |
ভাষা কোডসমূহ | |
আইএসও ৬৩৯-১ | as |
আইএসও ৬৩৯-২ | asm |
আইএসও ৬৩৯-৩ | asm |
লিঙ্গুয়াস্ফেরা | 59-AAF-w |
লিখন পদ্ধতি
অসমীয়া ভাষা বাংলা লিপির একটি সামান্য পরিবর্তিত সংস্করণে লেখা হয়। লিপিটির নাম অসমীয়া লিপি। বাংলা লিপির মতই এতে ১১টি স্বরবর্ণ আছে, তবে ব্যঞ্জনবর্ণ ও অন্যান্য চিহ্ন আছে ৫৪টি। গুপ্ত লিপি থেকে বিবর্তিত হয়ে লিপিটির উৎপত্তি। অসমে প্রাচীনকাল থেকেই লেখালেখির চর্চা আছে। মধ্যযুগে এখানকার রাজাদের আদেশনামা, ভূমি প্রদানপত্র, এবং তাম্রফলকে অসমীয়া লেখা দেখতে পাওয়া যায়। পূর্বে সাঁচি গাছের বাকলে অসমের একটি নিজস্ব লিপিতে ধর্মীয় গ্রন্থ ও কাহিনী লিখিত হত। হেমকোষ নামের অভিধানে অসমীয়া শব্দের যে সংস্কৃতভিত্তিক বানান ব্যবহৃত হয়েছিল, সেগুলিই এখন প্রমিত বানানে পরিণত হয়েছে।
ব্যাকরণ
অসমীয়া ব্যাকরণের সাথে অন্যান্য ইন্দো-আর্য ভাষাগুলির ব্যাকরণের প্রচুর মিল আছে। এগুলির মত অসমীয়া ভাষাও সংশ্লেষণাত্মক ভাষা, অর্থাৎ ধাতুর সাথে অন্ত্যপ্রত্যয় জোড়া লাগিয়ে শব্দ তৈরি করা হয় এবং বিভক্তির মাধ্যমে ব্যাকরণিক সম্পর্ক নির্দেশ করা হয়।
বিশেষ্য ও বিশেষণ
অসমীয়া বিশেষ্যগুলি নিচের ব্যাকরণিক ক্যাটাগরিগুলির জন্য চিহ্নধারণ করে:
- বচন: একবচন ও বহুবচন
- লিঙ্গ: পুংলিঙ্গ এবং স্ত্রীলিঙ্গ
- কারক: কর্তৃকারক, কর্মকারক, সম্বন্ধ কারক, সম্প্রদান কারক, করণকারক, এবং অধিকরণ কারক। সব কারকের জন্য অণুসর্গ রয়েছে। সকর্মক ক্রিয়ার কর্তার জন্য অসমীয়া কারকচিহ্ন ব্যবহার করে। অন্যান্য ইন্দো-আর্য ভাষার সাথে অসমীয়া ভাষার পার্থক্য হল এটি সকল কালের জন্য সকর্মক ও কিছু অকর্মক কর্তায় কারক চিহ্ন ব্যবহার করে।
- সম্বোধনসূচক ও তুচ্ছতা/ঘনিষ্ঠতাবাচক সর্বনামের ব্যবহার।
- করণিক লিঙ্গবাচক চিহ্ন হয় না।
ক্রিয়া
ক্রিয়াগুলি কর্তৃবাচ্যে কর্তার সাথে এবং কর্মবাচ্যে কর্মের সাথে বচন, পুরুষ ও লিঙ্গে সাযুজ্য রক্ষা করে। ক্রিয়াগুলির নিম্নলিখিত ব্যাকরণিক ক্যাটেগরি বিদ্যমান:
- পুরুষ: ১ম, ২য়, এবং ৩য়
- বচন: একবচন ও বহুবচন
- কাল: বর্তমান, অতীত ও ভবিষ্যৎ
- প্রকার: পুরাঘটিত ও অ-পুরাঘটিত
- ভাব: নির্দেশক, আদেশাত্মক, সাপেক্ষ, অভিপ্রায়ার্থক
- বাচ্য: কর্তৃবাচ্য ও কর্মবাচ্য
- ক্রিয়ামূলের পূর্বে একটি উপসর্গ যোগ করে নিষেধন সম্পাদন করা হয়।
পদক্রম
অসমীয়া ভাষার স্বাভাবিক পদক্রম হল কর্তা-কর্ম-ক্রিয়া। বিশেষক পদগুলি বিশেষ্যের আগে বসে। গৌণ কর্ম প্রত্যক্ষ কর্মের আগে বসে।
উপভাষা
অসমীয়ার চারটি প্রধান উপভাষা রয়েছে[2]। নিচে অসমীয়ার উপভাষাগুলির একটি তালিকা দেয়া হল:
- কেন্দ্রীয় অসমীয়া; বর্তমান নগাঁও জেলা ও তার আশেপাশের এলাকায় প্রচলিত।
- পূর্ব অসমীয়া; এটি শিবসাগর, অবিভক্ত দরং, অবিভক্ত লখিমপুর জেলা ও তার আশেপাশের জেলাগুলিতে প্রচলিত।
- কামরূপী অসমীয়া; এটি অবিভক্ত কামরূপ, নলবাড়ি, বরপেটা, দরং, কোকরাঝার, এবং বঙাইগাঁও জেলাগুলিতে প্রচলিত।
- গোয়ালপাড়িয়া অসমীয়া; এটি গোয়ালপাড়া, ধুবুরি, কোকরাঝার, এবং বঙাইগাঁও জেলায় প্রচলিত।
এছাড়াও অসমে এবং নাগাল্যান্ডে নাগামিজ নামের একটি অসমীয়া-ভিত্তিক একটি ক্রেওল ভাষা প্রচলিত।
অসমীয়া ভাষার মান্য বা প্রমিত রূপ পূর্ব উপভাষাটির উপর ভিত্তি করে নির্মিত। ১৯শ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ব্রিটিশ আমলে শিবসাগরে প্রচলিত উপভাষাটিকে সরকারী ভাষা করা হয়। এই উপভাষাটিই এখানকার খ্রিস্টান মিশনারিরা ব্যবহার করতেন। বর্তমানে আসামের মধ্যভাগে গৌহাটি ও তার আশেপাশের এলাকায় প্রচলিত কেন্দ্রীয় উপভাষাটিই মান্য রূপ হিসেবে স্বীকৃত। অসমের স্কুলগুলিতে ও সংবাদপত্রে যে ভাষা ব্যবহার করা হয়, তাতে অসমীয়ার বিভিন্ন উপভাষার প্রভাব রয়েছে।
অসমীয়া ভাষার ভাষাতত্ত্ব
অসমীয়া ভাষার ভাষাতত্ত্বের উপর প্রকাশনার সংখ্যা বেশি নয়। তবে আধুনিক ভারতীয় ভাষাগুলির উপর বৈজ্ঞানিক গবেষণার প্রাথমিক প্রচেষ্টাগুলির অনেকগুলিই অসমীয়া ভাষার উপর সম্পাদিত হয়েছিল। ১৯২০ সালে প্রকাশিত ফরাসি ভাষাবিজ্ঞানী জুল ব্লখের লা ফর্মাসিওঁ দ্য লা লং মারাথ ছিল কোন আধুনিক ইন্দো-আর্য ভাষার উপর সম্পাদিত প্রথম পূর্ণাঙ্গ ভাষাবৈজ্ঞানিক গ্রন্থ। এর কিছু পরেই ১৯২৬ সালে ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রকাশ করেন বাংলা ভাষার উপর তার মহাগ্রন্থ দি অরিজিন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অভ দ্য বেঙ্গলি ল্যাঙ্গুয়েজ। এরই ধারাবাহিকতায় ৩য় রচনা হিসেবে ১৯৩৫ সালে সুনীতিকুমারেরই নির্দেশনায় বাণীকান্ত কাকতি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে Assamese, Its Formation and Development নামের পিএইচডি অভিসন্দর্ভটি প্রকাশ করেন।
অসমীয়া ভাষাকে অতীতে বাংলা ভাষার একটি উপভাষা হিসেবে ভুল করা হয়েছিল। এই ভুলের প্রেক্ষিতে ১৮৩৬ সালে ব্রিটিশ সরকার অসমের স্কুল ও আদালতে বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠা করেন এবং অসমীয়া ভাষার ব্যবহার নিষিদ্ধ করেন। অসমবাসীর আন্দোলনের পর ১৮৭২ সালে অসমীয়াকে পুনরায় অঞ্চলটির সরকারি ভাষা করা হয়।
প্রথম যে ভাষাবিদ অসমীয়াকে বাংলা অপেক্ষা একটি স্বতন্ত্র ভাষা হিসেবে গণ্য করেছিলেন, তিনি ছিলেন সম্ভবত নেথান ব্রাউন। ১৮৪৬ সালে প্রকাশিত Grammatical Notes on the Assamese Language গ্রন্থের ভূমিকায় তিনি এ ব্যাপারে লেখেন।
তথ্যসূত্র
- http://www.lisindia.net/Assamese/Assa_demo.html
- Moral, Dipankar. A phonology of Asamiya Dialects : Contemporary Standard and Mayong, PhD Thesis, Deccan College, Pune 1992.