হুমায়ুন আজাদ

হুমায়ুন আজাদ (২৮ এপ্রিল ১৯৪৭ - ১১ আগস্ট ২০০৪ খ্রিস্টাব্দ; ১৪ বৈশাখ ১৩৫৪ - ২৬ শ্রাবণ ১৪১১ বঙ্গাব্দ) ছিলেন বাঙালি কবি, ঔপন্যাসিক, ভাষাবিজ্ঞানী, সমালোচক, রাজনীতিক ভাষ্যকার, কিশোরসাহিত্যিক, গবেষক, এবং অধ্যাপক। তিনি বাংলাদেশের প্রধান প্রথাবিরোধী এবং বহুমাত্রিক লেখক, যিনি ধর্ম, মৌলবাদ, প্রতিষ্ঠান ও সংস্কারবিরোধিতা, নিরাবরণ যৌনতা, নারীবাদ ও রাজনীতি বিষয়ে সমালোচনামূলক বক্তব্যের জন্য ১৯৮০-এর দশক থেকে পাঠকগোষ্ঠীর দৃষ্টি আর্কষণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। আজাদের ৭টি কাব্যগ্রন্থ, ১২টি উপন্যাস ও ২২টি সমালোচনা গ্রন্থ, ৭টি ভাষাবিজ্ঞানবিষয়ক, ৮টি কিশোরসাহিত্য, ও অন্যান্য প্রবন্ধসংকলন মিলিয়ে ৬০টির অধিক গ্রন্থ তার জীবদ্দশায় এবং মৃত্যুর পরে প্রকাশিত হয়। ১৯৯২ সালে তার নারীবাদী গবেষণামূলক গ্রন্থ নারী প্রকাশের পর বিতর্কের সৃষ্টি করে এবং ১৯৯৫ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত সাড়ে চার বছর ধরে বইটি বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ ছিল। এটি তার বহুল আলোচিত গবেষণামূলক কাজ হিসাবেও স্বীকৃত। এছাড়াও তার পাক সার জমিন সাদ বাদ উপন্যাসটি পাঠকমহলে বিতর্কের সৃষ্টি করেছিলো। তার রচিত প্রবচন সংকলন ১৯৯২ সালে হুমায়ুন আজাদের প্রবচনগুচ্ছ নামে প্রকাশিত। তাকে ১৯৮৬ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার এবং ২০১২ সালে সামগ্রিক সাহিত্যকর্ম এবং ভাষাবিজ্ঞানে বিশেষ অবদানের জন্য মরণোত্তর একুশে পদক প্রদান করা হয়। তার রচিত কিশোরসাহিত্য ১৯৮৯ সালে প্রকাশিত আব্বুকে মনে পড়ে জাপানি ভাষায় অনূদিত হয়েছে ২০০৩ সালে।

হুমায়ুন আজাদ
অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ
জন্ম
হুমায়ুন কবীর

(১৯৪৭-০৪-২৮)২৮ এপ্রিল ১৯৪৭
মৃত্যু১১ আগস্ট ২০০৪(2004-08-11) (বয়স ৫৭)
মিউনিখ, জার্মানি
সমাধিরাঢ়িখাল
জাতীয়তা
শিক্ষাপিএইচডি
যেখানের শিক্ষার্থী
পেশা
  • কবি
  • ঔপন্যাসিক
  • গল্পকার
  • সমালোচক
  • ভাষাবিজ্ঞানী
  • অধ্যাপক
  • গবেষক
কার্যকাল১৯৭৩, ১৯৮০২০০৪
যুগআধুনিক
নিয়োগকারীবাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
পরিচিতির কারণপ্রথাবিরোধিতা
উল্লেখযোগ্য কর্ম
অলৌকিক ইস্টিমার
সব কিছু ভেঙে পড়ে
নিজের সঙ্গে নিজের জীবনের মধু
একটি খুনের স্বপ্ন
দাম্পত্য সঙ্গীলতিফা কোহিনূর (বি. ১৯৭৫; মৃত্যুপূর্ব ২০০৪)
সন্তান
  • মৌলি আজাদ
  • স্মিতা আজাদ
  • অনন্য আজাদ
পিতা-মাতা
  • আবদুর রাশেদ (পিতা)
  • জোবেদা খাতুন (মাতা)
পুরস্কার
স্বাক্ষর

আজাদ প্রথাগত ধ্যানধারা তিনি সচেতনভাবে পরিহার করতেন। তার সাহিত্যের বৈশিষ্ট্য ভাবগভীরতা, চিত্ররূপময়তা, প্রকৃতিপ্রেম, মানবপ্রেম, স্বদেশপ্রেম, রোম্যান্টিক সৌন্দর্যচেতনা, ভাব, ভাষা, ছন্দ ও আঙ্গিকের বৈচিত্র্য, বাস্তবচেতনা ও প্রগতিচেতনা এবং একই সঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষতা, সামরিক শাসন ও একনায়কতন্ত্রের বিরোধিতা, নারীবাদ, নিঃসংকোচ যৌনবাদ চর্চার জন্য পরিচিত। তার ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বিশ্বাস এবং ব্যক্তিগত অভীষ্ট তার সাহিত্যকে প্রভাবান্বিত করেছিল। কথাসাহিত্য ও প্রবন্ধের মাধ্যমে তিনি সমাজ, রাজনীতি ও রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে মতামত প্রকাশ করেছিলেন। তার লেখায় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে তীব্র আক্রমণের কারণে ২০০৪ সালে তিনি হত্যা প্রচেষ্টার শিকার হন

জীবন

প্রারম্ভিক জীবন

শৈশব ও কৈশোর (১৯৪৭ - ১৯৬২)

হুমায়ুন আজাদ ২৮ এপ্রিল ১৯৪৭ সালে তার মাতামহের বাড়ি, তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের (বর্তমানে বাংলাদেশ) অধীন বিক্রমপুরের কামারগাঁয় জন্ম নেন; যেটি বর্তমানে মুন্সিগঞ্জ জেলার শ্রীনগর উপজেলার অন্তর্গত।[1] তার জন্ম নাম ছিল হুমায়ুন কবীর। ১৯৮৮ সালে ২৮ সেপ্টেম্বর নাম পরিবর্তনের মাধ্যম তিনি বর্তমান নাম ধারণ করেন।[2] তার বাবা আবদুর রাশেদ প্রথম জীবনে বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা[2] ও পোস্টমাস্টারির চাকুরি করতেন,[3] পরে ব্যবসায়ী হন। মা জোবেদা খাতুন ছিলেন গৃহিণী।[2] তিন ভাই এবং দুই বোনের মধ্যে আজাদ ছিলেন পিতামাতার দ্বিতীয় পুত্রসন্তান।[বিদ্র 1] ছেলেবেলায় তার ১৫ বছর বয়স পর্যন্ত তিনি রাড়িখাল গ্রামে বেড়ে ওঠেন।[5] পরবর্তীতে তার লেখার বিভিন্ন ভাবে রাড়িখাল গ্রামের বর্ণনা উঠে এসেছে; এবং এ গ্রাম নিয়ে তিনি "রাড়িখাল : ঘুমের ভেতরে নিবিড় শ্রাবণধারা" নামে একটি লেখা প্রকাশ করেন।[4] আজাদের মতে তার শৈশব ও কৈশর ছিল তার জীবনের শ্রেষ্ঠ খণ্ড, যে সময়ের কথা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে তার ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না (১৯৮৫), নিজের সঙ্গে নিজের জীবনের মধু (২০০০), শ্রাবণের বৃষ্টিতে রক্তজবা (২০০২) এবং বিভিন্ন লেখায় উঠে এসেছে।[6] আজাদের গ্রামের মাইল দুয়েক দক্ষিণে রয়েছে পদ্মা নদী, রাতের বেলায় নদীতে স্টিমার চলার ধ্বনি শৈশবে তাকে প্রভাবিত করায় তিনি তার প্রথম কাব্যগ্রন্থের নাম দেন অলৌকিক ইস্টিমার (১৯৭৩)।[7]

১৯৫২ সালে আাজাদ দক্ষিণ রাড়িখাল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ইনফ্যান্ট (তৎকালীন প্রথম শ্রেণী) শ্রেণীতে ভর্তি হন,[8] সেখানে তিন বছর ইনফ্যান্ট থেকে দ্বিতীয় শ্রেণী পর্যন্ত অধ্যয়ন করেন।[9] যদিও ১৯৫৫ সালে তৃতীয় শ্রেণী বাদ দিয়ে তিনি সরাসরি চতুর্থ শ্রেণীতে ভর্তি হন রাড়িখালের স্যার জে সি বোস ইনস্টিটিউশনে[10] ছেলেবেলা থেকেই তিনি ছিলেন মেধাবী। এ বিদ্যালয় থেকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের অধীনে ১৯৬২ সালে ম্যাট্রিকুলেশন (মাধ্যমিক) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।[2][11]

যৌবন (১৯৬২ - ১৯৮৭)

১৯৬৭ সালে হুমায়ুন আজাদ, পেছনে মাঝে

১৯৬২ সালে উচ্চশিক্ষার জন্য আজাদ ঢাকায় চলে আসেন। মানবিক বিভাগে পড়ার ইচ্ছা থাকলেও বাবার ইচ্ছায় ১৯৬২ সালের সেপ্টেম্বরে তিনি ঢাকা কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণীতে ভর্তি হন।[12] ১৯৬৪ সালে ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন।[2] এরপর একই বছর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদে বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৬৭ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতক ডিগ্রি এবং ১৯৬৮ সালে একই বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।[2] উভয় পরীক্ষায় তিনি প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হন।[13] ২০১৬ সালে তার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের এক বন্ধু স্মৃতিচারণ করে বলেছেন, আজাদ লেখাপড়ায় খুবই মনোযোগী ছিলেন এবং তিনি বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারে বই পড়ে অনেক সময় ব্যয় করতেন।[14]

১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দে ২২ বছর বয়সে তার কর্মজীবন শুরু হয় চট্টগ্রাম কলেজে প্রভাষক হিসাবে।[15] সেখানে কিছুকাল কর্মরত থাকার পর ১৯৭০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসাবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন।[16] একই বছর ১২ ডিসেম্বর তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসাবে যোগ দেন।[17] ১৯৭৩ সালে তার প্রথম সমালোচনাগ্রন্থ রবীন্দ্রপ্রবন্ধ/রাষ্ট্র ও সমাজচিন্তা[18] এবং একইবছর সেপ্টেম্বরে কাব্যগ্রন্থ অলৌকিক ইস্টিমার প্রকাশিত হয়। সে বছরের সেপ্টেম্বরে তিনি কমনওয়েলথ বৃত্তি নিয়ে ভাষাবিজ্ঞান পড়তে স্কটল্যান্ডে চলে যান।[19] ১৯৭৬ সালে তিনি স্কটল্যান্ডের এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভাষাবিজ্ঞানে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন।[2] তার গবেষণার বিষয় ছিল বাংলা ভাষায় সর্বনামীয়করণ। এই গবেষণাপত্র ১৯৮৩ সালে প্রোনোমিনালাইজেশন ইন বেঙলি নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্য ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড থেকে প্রকাশিত হয়। এডিনবরায় গবেষণাকালীন সময়ে তিনি রবার্ট ক্যাল্ডরের সহযোগিতায় কবি জীবনানন্দ দাশ এবং নিজের কিছু কবিতা অনুবাদ করেছিলেন, যেগুলি "লিডস বিশ্বিদ্যালয় জার্নাল" এবং এডিনবরার বিশ্ববিদ্যালয়ের "চ্যাপম্যান" সাময়িকপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল।[18]

১৯৭৮ সালের ১ নভেম্বর আজাদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সহযোগী অধ্যাপক হিসাবে যোগদান করেন[2][19] এবং পরবর্তীকালে বাংলা বিভাগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৬ সালে তিনি অধ্যাপক পদে উন্নীত হন।[2]

১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দে তার পিতৃবিয়োগ ঘটে।[20] এরপর, ২০০৩ সালে মৃত্যুবরণ করেন তার মা জোবেদা খাতুন।[21]

ভাষাবিজ্ঞান গবেষণা

১৯৬০-এর দশকে আজাদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের ছাত্র থাকাকালীন পশ্চিমের ভাষাবিজ্ঞানী চম্‌স্কি-উদ্ভাবিত রূপান্তরমূলক সৃষ্টিশীল ব্যাকরণ তত্ত্বটি আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি ডিগ্রির জন্য আজাদ এই তত্ত্বের কাঠামোর ওপর ভিত্তি করে বাংলা ভাষার রূপমূলতত্ত্ব তথা বাক্যতত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করেন। এর মাধ্যমে বাংলার ভাষাবিষয়ক গবেষণায় আধুনিক ভাষাবৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সূত্রপাত ঘটে। তার পিএইচডি অভিসন্দর্ভের নাম ছিল Pronominalization In Bengali (অর্থাৎ বাংলা সর্বনামীয়করণ)। পরবর্তীতে ১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দে একই শিরোনামের এটি ইংরেজি ভাষায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্য ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড থেকে প্রকাশিত হয়। এরপর ১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বাংলা ভাষার বাক্যতত্ত্বের ওপর বাক্যতত্ত্ব নামে একটি বই বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশ করেন। একই সালে বাংলা একাডেমি থেকে তিনি বাঙলা ভাষা শিরোনামে দুই খণ্ডের একটি দালীলিক সঙ্কলন প্রকাশ করেন, যাতে বাংলা ভাষার বিভিন্ন ক্ষেত্রের ওপর বিগত শতাধিক বছরের বিভিন্ন ভাষাবিদ ও সাহিত্যিকের লেখা গুরুত্বপূর্ণ ভাষাতাত্ত্বিক রচনা সংকলিত হয়। এই তিনটি গ্রন্থ বাংলা ভাষাবিজ্ঞানে গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন হিসাবে বিবেচিত। তিনি পরবর্তীকালে তুলনামূলক ও ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞান (১৯৮৮) ও অর্থবিজ্ঞান (১৯৯৯) শিরোনামে দুইটি সংক্ষিপ্ত প্রাথমিক পাঠ্যপুস্তক লেখেন। ১৯৯০-এর দশকের শেষের দিকে তিনি বাংলা ভাষার একটি পূর্ণাঙ্গ ব্যাকরণ রচনার ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তবে মৃত্যুর কারণে তার এই আগ্রহ বাস্তবায়িত হয় নি।

সৃষ্টিকর্ম

হুমায়ুন আজাদের কবিতার মাধ্যমে সাহিত্যচর্চার শুরু হয়েছিলো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হবার পর তবে বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণীতে থাকাকালীন[18] তার "ঘড়ি বলে টিক টিক" শিরোনামে প্রথম লেখা প্রবন্ধ ছাপা হয়েছিল দৈনিক ইত্তেফাকের শিশুপাতা কচিকাঁচার আসরে। শৈশবে পরবর্তীতে তিনি এই পত্রিকায় একাধিক প্রবন্ধ লিখেছিলেন।[22] তার প্রকাশিত মৌলিক কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা ৭। তার প্রকাশিত-অপ্রকাশিত কবিতাসমূহ জীবদ্দশায় হুমায়ুন আজাদের শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৯৩) ও কাব্যসংগ্রহ (১৯৯৮) এবং মৃত্যুর পরে কাব্যসমগ্র (২০০৫) বইয়ে প্রকাাশিত হয়। তিনি ১২টি উপন্যাস লিখেছেন। তার উপন্যাসসমূহ উপন্যাসসমগ্র ১ (২০০১)[23], উপন্যাসসমগ্র ২ (২০০২) এবং উপন্যাসসমগ্র ৩ (২০০৩) বইয়ে প্রকাশিত হয়েছে। তিনি যাদুকরের মৃত্যু (১৯৯৭) নামে ১টি মৌলিক ছোটগল্পের বই লিখেছেন। এছাড়াও তার ৮টি কিশোরসাহিত্য, এবং ৮টি ভাষাবিজ্ঞান বিষয়ক বই রয়েছে।

কবিতা

প্রথম কাব্যগ্রন্থ অলৌকিক ইস্টিমার (১৯৭৩)

গদ্যের জন্য বেশি জনপ্রিয় হলেও হুমায়ুন আজাদ আমৃত্যু কাব্যচর্চা করে গেছেন। তিনি ষাটের দশকের আধুনিক কবিদের সমপর্যায়ী একজন কবি ছিলেন। সমসাময়িক কালের পরিব্যাপ্ত হতাশা, দ্রোহ, ঘৃণা, বিবমিষা, প্রেম ইত্যাদি তার কবিসত্বার প্রধান বিষয়। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থের নাম অলৌকিক ইস্টিমার যা প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৭৩-এর জানুয়ারিতে। কাব্যগ্রন্থটি তিনি উৎসর্গ করেন ১৯৬৮-১৯৭২-এর তার নিজেরই কাটানো রাত-দিনগুলোর উদ্দেশে। তার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ জ্বলো চিতাবাঘ প্রথম প্রকাশিত হয় মার্চ ১৯৮০ সালে। ১৯৮৫ সালে প্রকাশিত সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে, তৃতীয় কাব্যগ্রন্থটি তিনি সমসাময়িক দুই বাঙালি লেখক হুমায়ূন আহমেদ এবং ইমদাদুল হক মিলনকে উৎসর্গ করেছেন। প্রত্যুত্তরে ইমদাদুল হক মিলন তার বনমানুষ উপন্যাসটি হুমায়ুন আজাদকে উৎসর্গ করেন। ১৯৮৭ সালের মার্চে প্রকাশিত হয় তার চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ যতোই গভীরে যাই মধু যতোই ওপরে যাই নীল। তার পঞ্চম কাব্যগ্রন্থ আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে প্রকাশিত হয় ফেব্রুয়ারি ১৯৯০ সালে। এর আট বছর পর ফেব্রুয়ারি ১৯৯৮ সালে প্রকাশিত হয় তার ষষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ কাফনে মোড়া অশ্রুবিন্দু। কাব্যগ্রন্থটি আজাদ তার 'প্রিয় মৃতদের জন্য' উৎসর্গ করেন। সপ্তম এবং শেষ কাব্যগ্রন্থ পেরোনোর কিছু নেই প্রকাশিত হয় ফেব্রুয়ারি, ২০০৪ সালে। জীবদ্দশায় তার সাতটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। তবে আজাদের মৃত্যুর পর ফেব্রুয়ারি, ২০০৫ সালে এই সাতটি কাব্যগ্রন্থ সহ আরো কিছু অগ্রন্থিত ও অনূদিত কবিতা নিয়ে কাব্যসমগ্র প্রকাশিত হয়। নব্বইয়ের দশক থেকে ঢাকার আগামী প্রকাশনী তার গ্রন্থাবলীর প্রধান প্রকাশক।

কথাসাহিত্য

২০০০ সালে প্রকাশিত কিশোর-উপন্যাস নিজের সঙ্গে নিজের জীবনের মধু যে উপন্যাসটিকে হুমায়ুন আজাদ বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের পথের পাঁচালীর সঙ্গে তুলনা করেছিলেন

মূলত কবি, গবেষক ও প্রাবন্ধিক হলেও হুমায়ূন আজাদ ১৯৯০-এর দশকে ঔপন্যাসিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। ২০০৪ সালে মৃত্যু অবধি তার প্রকাশিত উপন্যাসের সংখ্যা ১২টি। তার ভাষা দৃঢ়, কাহিনির গঠন সংহতিপূর্ণ এবং রাজনৈতিক দর্শন স্বতঃস্ফূর্ত। সামাজিক-ধর্মীয় নিপীড়ন, রাজনৈতিক প্রণোদনা, প্রেম, তার রচনার প্রধান বিষয় ছিলো। ভাষা-ভঙ্গী ও কাহিনি- দুই দিক দিয়েই তার লেখায় আক্রমণাত্মক দৃষ্টিভঙ্গি প্রত্যক্ষ করা যায়।

১৯৯৪ সালে তিনি ঔপন্যাসিক হিসেবে নিজেকে আত্মপ্রকাশ করেন প্রথম উপন্যাস ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইল-এর মধ্যে দিয়ে। বাংলাদেশের সামরিক শাসন প্রেক্ষাপটে রচিত উপন্যাসটি তিনি উৎসর্গ করেছেন উপন্যাসের প্রধান চরিত্র রাশেদকে, তার বাবার নামও ছিলো রাশেদ, তিনি উপন্যাসের উৎসর্গ পাতায় এভাবে লিখেছিলেন, 'উৎসর্গ পরলোকগত পিতা, আমি একটি নাম খুঁজছিলাম, আপনার নামটিই-রাশেদ-মনে পড়লো আমার'।[24] ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত হয় নারী-পুরুষের মধ্যেকার শারীরিক ও হৃদয়সম্পর্কের নানা আবর্তন এবং পরিণতির আখ্যানমূলক উপন্যাস সব কিছু ভেঙে পড়ে[25] সব কিছু ভেঙে পড়ের পর তিনি মানুষ হিসেবে আমার অপরাধসমূহ উপন্যাস লিখেছিলেন যেটি ছিলো একজন সরকারি কর্মকর্তার তার বন্ধুর স্ত্রীকে বিয়ে করা নিয়ে এবং তিনি এ-উপন্যাসটি বাংলাদেশের খ্যাতিমান আইনজীবী ব্যারিস্টার আমির উল ইসলামকে উৎসর্গ করে লিখেছিলেন।

২০০২ সালে প্রকাশিত ১০,০০০, এবং আরো ১টি ধর্ষণ ছিলো বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজে একটি মেয়ের জীবনে ধর্ষণ আসা নিয়ে যে তার ধর্ষণের ফসল বাচ্চাকে হত্যা করে, ২০০৪ সালে প্রকাশিত পাক সার জমিন সাদ বাদ ছিলো ধর্মীয় মৌলবাদ নিয়ে এবং একটি খুনের স্বপ্ন উপন্যাস ছিলো একজন তরুণের অপর একটি তরুণীর জন্য ভালোবাসার কাহিনী নিয়ে; দুটো উপন্যাসই ছিলো স্পষ্টতই বক্তব্যমুখী। পাক সার জমিন সাদ বাদে তিনি মৌলবাদে দীক্ষিত এক পুরুষকে সবার শেষে প্রেমের কাছে পরাজিত করান, দেখান যে কণকলতা নামের তরুণীর জন্য উপন্যাসের প্রধান নায়ক অপরাধ-জগৎ থেকে বেরিয়ে আসে আর একটি খুনের স্বপ্নতে তিনি নায়িকা সুফিয়ার জন্য নায়কের একতরফা প্রেমকেই করে তুলেছিলেন প্রধান উপজীব্য বিষয় যে নায়ক পরে নায়িকাকেই খুন করার চিন্তা করে।

হুমায়ুন আজাদ ফালি ফালি ক’রে কাটা চাঁদ (২০০১) উপন্যাসে শিরিন নামের এক কল্পিত ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন নারীর অবতারণা করেছেন যে মনে করে যে মানসিক সম্পর্ক রাখা একটি গভীর আস্থার ব্যাপার, উপন্যাসটি ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী নারীবাদের একটি চিত্র তুলে ধরে। শিরিনের স্বামী রয়েছে যার নাম দেলোয়ার কিন্তু সে একদা খালেদ নামের এক পুরুষের সঙ্গে দৈহিক সম্পর্কে লিপ্ত হয় নিজের এক প্রকারের ইচ্ছের বিরুদ্ধেই, শিরিন পরে তার স্বামী দেলোয়ারের সঙ্গে বাস করবেনা বলে সিদ্ধান্ত নেয় এবং খালেদ তাকে প্রেম প্রস্তাব দিলে সেটাও প্রত্যাখ্যান করে।[26] এছাড়াও নিজের সঙ্গে নিজের জীবনের মধু উপন্যাসটি ছিলো একটি কিশোর-উপন্যাস যেখানে একটি কিশোর গ্রামীণ পরিবেশে বড় হয়; নিজের সঙ্গে নিজের জীবনের মধু উপন্যাসটিকে তিনি বাংলাসাহিত্যের অন্যতম প্রধান উপন্যাস মনে করতেন। তুলনা করতে গিয়ে এই উপন্যাসকে বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের পথের পাঁচালীর উপন্যাসের তুলনায় অনেক ভালো উপন্যাস বলে মনে করেছিলেন। পথের পাঁচালীর অপু‘ চরিত্রর চেয়ে নিজের সঙ্গে নিজের জীবনের মধুর জলকদর চরিত্রকে অনেক বেশি শিল্পোত্তীর্ণ চরিত্র মন্তব্য করেছিলেন তিনি; তিনি আরো বলেছিলেন যে, জলকদরের ভিতর দিয়ে তিনি নিজের কৈশোরজীবনকে দেখেছিলেন।[26]

প্রবন্ধ

নারী (১৯৯২)

১৯৯২ সালে প্রকাশিত নারী স্বাধীন বাংলাদেশে নারীবাদ বিষয়ক প্রথম বই।[27] এই প্রবন্ধগ্রন্থের জন্য তিনি মৌলবাদীদের তীব্র রোষানলে পড়েন। ফলে ১৯৯৫ সালের ১৯ নভেম্বর তৎকালীন বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক বইটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় এবং প্রায় সাড়ে চার বছর পরে ২০০০ সালের ৭ মার্চ উচ্চবিচারালয় বইটির নিষিদ্ধকরণ আদেশ বাতিল করে।[28] ফেব্রুয়ারি ২০০৩ সালে প্রকাশিত আমরা কি এই বাঙলাদেশ চেয়েছিলাম গ্রন্থে স্বাধীনতাপরবর্তী বাংলাদেশের তিরিশ বছরের শাসনব্যবস্থার ত্রুটি-বিচ্যূতি এবং সাধারণ মানুষের শোষণ-বঞ্চনা, নিগ্রহ ও আশাভঙ্গের কথা তুলে ধরা হয়েছে। ইতিহাসমূলক এই গ্রন্থের ভাষা সাহিত্যিক হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে লেখকের পর্যবেক্ষণ বস্তুনিষ্ঠ ও বিশ্লেষণ নিরাবেগী।[29]

ব্যক্তিগত জীবন

হুমায়ুন আজাদ ১৯৬৮ সালে এমএ পড়ার সময় লতিফা কোহিনুর নামের এক তরুণীর সঙ্গে পরিচিত হন এবং ১৯৭৫ সালের ১২ই অক্টোবর তাদের বিয়ে হয় টেলিফোনে, আজাদ তখন স্কটল্যান্ডে আর লতিফা বাংলাদেশে ছিলেন।[বিদ্র 2] তাদের দুই কন্যা মৌলি আজাদ, স্মিতা আজাদ এবং এক পুত্র অনন্য আজাদ। জ্যেষ্ঠ কন্যা মৌলি আজাদ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের সহকারী সচিব হিসাবে দ্বায়িত্বরত।

রাজনৈতিক সমালোচনা

১৯৮০-র দশকের শেষভাগ থেকে হুমায়ুন আজাদ সমসাময়িক রাজনীতি নিয়ে গণমাধ্যমে বক্তব্য রাখতে শুরু করেন। এ সময় তিনি 'খবরের কাগজ' নামীয় সাপ্তাহিক পত্রিকায় সম্পাদকীয় নিবন্ধ লিখতে শুরু করেন। সামরিক শাসনের বিরোধিতা দিয়ে তার রাজনৈতিক লেখালিখির সূত্রপাত। ২০০৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত আমরা কি এই বাঙলাদেশ চেয়েছিলাম গ্রন্থটি প্রধানত রাষ্ট্রযন্ত্রের ধারাবাহিক সমালোচনা। ১৯৭১-এ প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশে রাষ্ট্রযন্ত্রের ব্যভিচারের প্রামাণিক দলিল এই গ্রন্থটি।

বিশ্বাস ও দর্শন

আজাদ ধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন না এবং তিনি সরাসরি ধর্মের সমালোচনা করে লেখেননি তবে ধর্মীয় মৌলবাদের প্রত্যক্ষ বিরোধিতা করতেন এবং এটি বিভিন্ন ভাবে তার লেখায় প্রকাশ পেয়েছে।[31] তিনি বাংলাদেশের সমাজে চলা রক্ষণশীলতা এবং প্রথার বিরোধিতা করতেন। কবিতা, উপন্যাস ও রচনা সর্বত্রই তিনি ছিলেন প্রথাবিরোধী ও সমালোচনামুখর। সর্বপ্রথম গুস্তাভ ফ্লবেয়ারের আদলে ১৯৯১ প্রকাশিত প্রবচনগুচ্ছ এদেশের শিক্ষিত পাঠক সমাজকে আলোড়িত করতে সক্ষম হয়েছিল। হুমায়ুন আজাদের লেখালেখিতে উদারপন্থা, বিজ্ঞানমনস্কতার এবং একই সঙ্গে দ্রোহের ছাপ স্পষ্ট ছিলো। তবে তিনি নিজেই ছিলেন তার চিন্তা-চেতনা ও বিশ্বাসের প্রধান মুখপাত্র। একটি বৈষম্যহীন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা তার স্বপ্ন ছিল। সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিকেই তিনি মুক্ত মানবের মুক্ত সমাজ গড়ার পক্ষে অনুকূল বলে মনে করতেন।[32]

হত্যা প্রচেষ্টা

বাংলাদেশে যখন মৌলবাদ বিস্তার লাভ করতে থাকে, বিশেষ করে ২০০১ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত, তখন ২০০৪-এ প্রকাশিত হয় হুমায়ুন আজাদের পাক সার জমিন সাদ বাদ উপন্যাসটি। এই গ্রন্থটি প্রকাশিত হলে দেশের মৌলবাদী গোষ্ঠি তার প্রতি ক্রুদ্ধ হয়, এবং বিভিন্ন স্থানে হুমায়ুন আজাদের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালায়। তিনি এই বইটিতে ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধীতাকারী রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীকে ফ্যাসিবাদী সংগঠন হিসেবে উল্লেখ করেন পরোক্ষভাবে এবং এর কঠোর সমালোচনা করেন। আর তারই জের ধরে ২০০৪ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমিতে অনুষ্ঠিত বইমেলা থেকে বেরিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নিজের বাসায় যাওয়ার পথে ঘাতকদের আক্রমণের শিকার হন তিনি। বিদেশে নিবিড় চিকিৎসার মাধ্যমে তিনি কিছুটা সুস্থ হন। জামাত-উল-মুজাহিদীন বাংলাদেশ (বা সংক্ষেপে জেএমবি) নামক ইসলামি জঙ্গি সংগঠনের একজন শীর্ষনেতা শায়খ আব্দুর রহমান পরবর্তিতে হুমায়ুন আজাদ এবং একইসাথে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এম ইউনুসকে হত্যার নির্দেশ দেবার কথা স্বীকার করে।[33] এই হত্যা প্রচেষ্টার মামলা দ্রুত শেষ করার জন্য উচ্চ আদালত ফেব্রুয়ারি ২০১৪তে আদেশ প্রদান করে।

সমালোচনা

২০০৪ সালের ২৫ জানুয়ারি বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন সংসদ সদস্য দেলোয়ার হোসেন সাঈদী জাতীয় সংসদে হুমায়ুন আজাদের পাক সার জমিন সাদ বাদ (২০০৪)[34] বইটিকে ইসলাম বিরোধী আখ্যায়িত করে বক্তব্য দেন এবং এ ধরনের লেখকদের লেখা বন্ধ করতে 'ব্ল্যাসফেমি আইন' (ধর্ম অবমাননা আইন) প্রণয়নের জন্য তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।[35] এই বইটিতে হুমায়ুন আজাদ তীব্র ব্যঙ্গাত্মক ভাষায় বাংলাদেশের মৌলবাদীগোষ্ঠী স্বরূপ চিত্রিত করেন।

পুরস্কার এবং সম্মাননা

পুরস্কার এবং মনোনয়নের তালিকা
সংগঠন অনুষ্ঠানের তারিখ বিভাগ কাজের শিরোনাম/বিষয় ফলাফল সূত্র
বাংলা একাডেমি পুরস্কার ১৯৮৬ সামগ্রিক অবদান - বিজয়ী [36]
অগ্রণী ব্যাংক-শিশু সাহিত্য পুরস্কার ১৯৮৬ শিশু সাহিত্য - বিজয়ী
মার্কেন্টাইল ব্যাংক পুরস্কার ২০০৪ বিজয়ী
একুশে পদক ২০১২ ভাষা ও সাহিত্য - বিজয়ী মরণোত্তর[37]

মৃত্যু

২০০২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি জার্মান কবি হাইনরিখ হাইনের উপর কাজ করার জন্য জার্মান সরকারের নিকট একটি বৃত্তির আবেদন করেছিলেন। ২০০৪-এর ৭ আগস্ট জার্মান কবি হাইনরিখ হাইনের ওপর গবেষণা বৃত্তি নিয়ে জার্মানি যান।[38]

২০০৪ খ্রিষ্টাব্দের ১১ আগস্ট রাতে একটি পার্টি থেকে প্রত্যাবর্তনের পর আবাসস্থলে আকস্মিকভাবে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন হুমায়ুন আজাদ। ১২ আগস্ট ফ্ল্যাটের নিজ কক্ষে তাকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। হুমায়ুন আজাদের মৃত্যুর পর জার্মান সরকারের তত্ত্বাবধানে মিউনিখে তার এপার্টমেন্টে পাওয়া সব জিনিসপত্র ঢাকায় তার পরিবারের কাছে হস্তান্তর করে। ওই জিনিসপত্রের ভেতরেই পাওয়া যায় তার হাতের লেখা তিনটি চিঠি। চিঠি তিনটি আলাদা তিনটি পোস্ট কার্ডে লিখেছেন বড় মেয়ে মৌলিকে, ছোট মেয়ে স্মিতাকে এবং একমাত্র ছেলে অনন্য আজাদকে। অনুমান করা হয়, ওই লেখার অক্ষরগুলোই ছিল তার জীবনের শেষ লেখা।[39] তার মরদেহ কফিনে করে জার্মানি থেকে ঢাকায় আনা হয়। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদে জানাযার নামাজ শেষে তার মরদেহ রাড়িখালে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানেই তাকে সমাহিত করা হয় এবং পরে তার কবর সিমেন্ট দিয়ে পাকা করে একটি বইয়ের মত করে বানানো হয়।[40]

টিকা

  1. আমার বাবার নাম আবদুর রাশেদ, মায়ের নাম জোবেদা খাতুন। আমি তাঁদের দ্বিতীয় পুত্র, ও তৃতীয় সন্তান। তাঁদের প্রথম পুত্রটি জন্মের পরেই ম'রে গিয়েছিলো, আমি তাই প্রথম পুত্ররূপে গণ্য হয়েছি..।: (প্রাথমিক উৎস)[4]
  2. ১৯৬৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে এম.এ. ক্লাশে পড়ার সময় আমার মা বাবার প্রথম পরিচয় হয়।. . .মাকে পাবার জন্য বাবা ছিলেন এককথায় নাছোড়বান্দা। মা প্রথম প্রথম রাগ করলেও ধীরে ধীরে ঘনিষ্ঠতা বেড়ে যায়। . . .শুনেছি মা’র পরিবার প্রথমদিকে বাবাকে খুব বেশি পছন্দ করেনি কিন্তু যখন তারা দেখেছে বাবা মা’র প্রতি একনিষ্ঠ তখন নানা সম্মতি দিয়েছিলেন এবং তার জন্য বাবাকে অপেক্ষা করতে হয়েছে দীর্ঘ ৭বছর। তাদের যে বিয়ে হয়েছে তাও অনেকটা প্রচলিত প্রথার বাইরে গিয়েই। ১৯৭৫-এর ১২ অক্টোবর মা ও বাবার দুই পরিবারের সম্মতিতে টেলিফোনের মাধ্যমে বিয়ে হয়।. . .বাবা বিয়ের দিন ছিলেন স্কটল্যান্ডে আর মা ঢাকায়।: (প্রাথমিক উৎস)[30]

তথ্যসূত্র

  1. আজাদ ২০১১, পৃ. ১১: আজাদের জন্ম কিন্তু দক্ষিণ রাড়িখাল গ্রামে নয় (অনেকেই তাই-ই ভাবেন), তার নানান বাড়ি কামারগাঁয়ে।; উদ্দিন ও বুলবুল ২০০৪, পৃ. : আমি জন্মেছিলাম আমার নানাবাড়িতে তখন নানাবাড়িতে জন্ম নেয়াই রীতি ছিলো, আমাদের গ্রাম থেকে পশ্চিমে একটি গাছপালাছায়াঢাকা গ্রামে, কামারগাঁয়ে।
  2. মুহম্মদ সাইফুল ইসলাম (২০১২)। "আজাদ, হুমায়ুন"ইসলাম, সিরাজুল; মিয়া, সাজাহান; খানম, মাহফুজা; আহমেদ, সাব্বীরবাংলাপিডিয়া: বাংলাদেশের জাতীয় বিশ্বকোষ (২য় সংস্করণ)। ঢাকা, বাংলাদেশ: বাংলাপিডিয়া ট্রাস্ট, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটিআইএসবিএন 9843205901। ওসিএলসি 883871743
  3. উদ্দিন ও বুলবুল ২০০৪, পৃ. ৩৬।
  4. উদ্দিন ও বুলবুল ২০০৪, পৃ. ৯।
  5. আজাদ ২০১১, পৃ. ১২: ..সেই বাল্যকাল তথা রাড়িখালের মাত্র ১৫ বছর জীবনযাপন ছিল তাঁর জীবনের সবচেয়ে সুখকর অধ্যায়।; উদ্দিন ও বুলবুল ২০০৪, পৃ. : ১৫ বছর পর্যন্ত আমি বড় হয়েছি আমাদের গ্রামে রাড়খিালে।
  6. উদ্দিন ও বুলবুল ২০০৪, পৃ. ১১: আমার বাল্যকাল আমার লেখায় নানাভাবে এসেছ, ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না, নিজের সঙ্গে নিজের জীবনের মধু, শ্রাবণের বৃষ্টিতে রক্তজবা এবং আরো নানা বইতে আমি আমার বাল্যকালকে ধ'রে রাখতে চেয়েছি। (প্রাথমিক উৎস)
  7. উদ্দিন ও বুলবুল ২০০৪, পৃ. ১২: আমাদের গ্রামের মাইল দুয়েক দক্ষিণ দিয়ে বয়ে যায় পদ্মা, তখন বিশার ছিলো; এপার থেকে ওপার ১২ মাইল শুনেছি। ওই পদ্মানদী দিয়ে রাতের বেলা ইস্টিমার যেতো, ভাগ্যকূলে ভিড়তো; কতো রাতে ঘুম ভেঙে গেছে আমার ইস্টিমারের সিঁটিতে। ঘুম ভেঙে মনে হতো কোন সুদূর থেকে ভেসে আসে এই ধ্বনি, আমি জেগে জেগে স্বপ্ন দেখতে থাকতাম। আমার প্রথম কবিতার বইয়ের নাম রেখেছিলাম অলৌকিক ইস্টিমার, কেননা আজো আমি পদ্মায় মধ্যরাতের জা হাজের সিঁটি শুনি। (প্রাথমিক উৎস)
  8. উদ্দিন ও বুলবুল ২০০৪, পৃ. ১২-১৩: আমি ওই প্রথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হই সবচেয়ে নিচের ক্লাশে, তার নাম ছিলো 'ইনফ্যান্ট ক্লাশ'..।
  9. উদ্দিন ও বুলবুল ২০০৪, পৃ. ১৬।
  10. উদ্দিন ও বুলবুল ২০০৪, পৃ. ১৬-১৭।
  11. উদ্দিন ও বুলবুল ২০০৪, পৃ. ২৩।
  12. উদ্দিন ও বুলবুল ২০০৪, পৃ. ৪০: প্রবেশিকা পাঠ করার পর আমি ঠিক করেছিলাম এইসএসসিতে মানবিক পড়বো।.. আমি ঢাকা কলেজে বিজ্ঞানে এইসএসসি শ্রেণীতে ভর্তি হই; ১৯৬২ সালের সেপ্টেম্বরে। (প্রাথমিক উৎস)
  13. উদ্দিন ও বুলবুল ২০০৪, পৃ. ৪২।
  14. টুলু মতিন (হুমায়ুন আজাদের বন্ধু) (১২ আগস্ট ২০১৬)। "Humayun Azad and me in the university life."swapno71.com। ১৫ আগস্ট ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৬ নভেম্বর ২০১৭
  15. উদ্দিন ও বুলবুল ২০০৪, পৃ. ৪৪।
  16. উদ্দিন ও বুলবুল ২০০৪, পৃ. ৪৫।
  17. উদ্দিন ও বুলবুল ২০০৪, পৃ. ৪৮।
  18. উদ্দিন ও বুলবুল ২০০৪, পৃ. ৬৩।
  19. উদ্দিন ও বুলবুল ২০০৪, পৃ. ৫০।
  20. উদ্দিন ও বুলবুল ২০০৪, পৃ. ১০।
  21. "প্রথাবিরোধী লেখক হুমায়ুন আজাদ'র প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলী"। ১১ আগস্ট ২০১৭। সংগ্রহের তারিখ ৩১ ডিসেম্বর ২০১৯ অজানা প্যারামিটার |wensite= উপেক্ষা করা হয়েছে (সাহায্য)
  22. উদ্দিন ও বুলবুল ২০০৪, পৃ. ৩৬: কচিকাচার আসরে আমি কবিতা পাঠাই, সেগুলি ছাপা না হওয়াতে আমি ঘড়ি সম্পর্কে "ঘড়ি বলে টিক টিক" নামে একটি প্রবন্ধ পাঠাই। দেখি সেটা ছাপা হয়েছে, অনেক কিছু সংশোধন ক'রে। পরে আমার অনেক প্রবন্ধ একটির নাম মনে পড়ছে "ভাওয়ালের কবি গোবিন্দ দাস" ছাপা হয় কচিকাচার আসরে। (প্রাথমিক উৎস)
  23. "উপন্যাসসমগ্র-১, হুমায়ুন আজাদ"rokomari.com
  24. আজাদ, হুমায়ুন (ফেব্রুয়ারি ১৯৯৪)। ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইলআগামী প্রকাশনী। পৃষ্ঠা ৫।
  25. ড. জাহারাবী রিপন (আগস্ট ১১, ২০০৮)। "সব কিছু ভেঙে পড়ে : জীবনবাদী শিল্পদ্রষ্টা হুমায়ুন আজাদ"। মুন্সিগঞ্জ.কম। সংগ্রহের তারিখ নভেম্বর ৪, ২০১৭
  26. "সাহস ও সৃষ্টির অদম্য লেখক হুমায়ুন আজাদ"arts.bdnews24.com
  27. মৌলি আজাদ (১৬ জুলাই ২০১৫)। "আমার বাবা হুমায়ুন আজাদ"দৈনিক ইত্তেফাক। সংগ্রহের তারিখ ১৪ নভেম্বর ২০১৭
  28. মৌলি আজাদ (১২ আগস্ট ২০১৫)। "হুমায়ুন আজাদ, ভেতর-বাহিরে"ntvbd.com। সংগ্রহের তারিখ ১৪ নভেম্বর ২০১৭
  29. রাশিদ আসকারী (মার্চ ৩, ২০১৫)। "আমরা কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম?"jjdin.com। ঢাকা: যায় যায় দিন। সংগ্রহের তারিখ জুলাই ১০, ২০১৫
  30. মৌলি আজাদ ২০১১, পৃ. ১৯।
  31. "প্রথাবিরোধী যোদ্ধা হুমায়ুন আজাদ"ntvbd.com। ২৮ এপ্রিল ২০১৭। সংগ্রহের তারিখ ২ নভেম্বর ২০১৭
  32. "হুমায়ুন আজাদ"। gunijan.org.bd। সংগ্রহের তারিখ ২০১৪-০১-০৭
  33. "জেএমবি নেতার স্বীকারোক্তি"। বিবিসি। সংগ্রহের তারিখ ২০১৪-০১-০৬
  34. (পাক সার জমিন সাদ বাদ পাকিস্তানের জাতীয় সঙ্গীতের প্রথম চরণ)
  35. "হুমায়ুন আজাদ সম্পর্কে সংসদে সাঈদীর বক্তব্য জানতে চেয়ে চিঠি"। icsforum.org। ১১ আগস্ট ২০১৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৪-০১-০৭
  36. "বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার"banglaacademy.portal.gov.bdবাংলা একাডেমি। সংগ্রহের তারিখ ১১ অক্টোবর ২০১৯
  37. একুশে পদকপ্রাপ্ত সুধীবৃন্দ ও প্রতিষ্ঠান (PDF)। সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়। পৃষ্ঠা ২। ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৪ তারিখে মূল (PDF) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৩ জুন ২০১৪
  38. "হুমায়ুন আজাদ"। samakal.com.bd। ৬ আগস্ট ২০১৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৪-০১-০৭
  39. "হুমায়ুন আজাদক"। thedailysangbad.com। ৪ মার্চ ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৪-০১-০৭
  40. "বাবার স্বপ্ন ছিল সেক্যুলার বাংলাদেশ : মৌলি আজাদ"ntvbd.com। ১২ আগস্ট ২০১৫। সংগ্রহের তারিখ ২ নভেম্বর ২০১৭

উৎস

  • আজাদ, মৌলি (২০১১)। "বাবার বেড়ে ওঠা"। আমার বাবা (প্রথম সংস্করণ)। ঢাকা: আগামী প্রকাশনী (প্রকাশিত হয় ফেব্রুয়ারি ২০১১)। পৃষ্ঠা ১১। আইএসবিএন 978-98404-1380-5।
  • উদ্দিন, জামাল; বুলবুল, শরীফা, সম্পাদকগণ (২০০৪)। এই বাঙলার সক্রেটিস (প্রথম সংস্করণ)। চট্টগ্রাম: বলাকা (প্রকাশিত হয় ফেব্রুয়ারি ২০০৪)। পৃষ্ঠা ৮। আইএসবিএন 984-84330-1-5।

বহিঃসংযোগ

This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.