আহলে হাদীস

আহলে হাদীস বা আহল-ই-হাদীস (ফার্সি) বা আসহাবুল হাদীস (আরবি: Ahl al-ḥadīth; أهل الحديث বা Aşḥāb al-ḥadīth; أصحاب الحديث) এর শাব্দিক অর্থ হল হাদীস বিশেষজ্ঞ। পারিভাষিক অর্থ, যারা হাদীস সংরক্ষণ করেছেন এবং গবেষণা করেছেন। হাদীসের শাব্দিক অর্থ হল বাণী। কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে আল্লাহ তা'আলা নিজেই কুরআনকে হাদীস বলে সম্বোধন করেছেন।[1][2][3][4] অর্থাৎ হাদীস বলতে সম্মিলিতভাবে কুরআনসুন্নাহ[5] উভয়টিই বোঝায়। আর যারা কুরআন ও সুন্নাহ তথা হাদিসের নিরপেক্ষ অনুসারী, তাদেরকে বলা হয় আহলে হাদীস। আলেমদের অভিমত, এরা হল মুসলিম উম্মাহর মধ্যকার এমন একটি দল যারা কুরআন এবং হাদীসের অনুসরণে মৃত্যু বরণ করেছেন। আজকাল অনেকেই নিজেদের আহলে হাদীস (আহল আল-হাদীস) বা সালাফি বলে দাবি করলেও, অনেকেই আবার একে ওয়াহাবি আন্দোলনের একটি প্রকরণ বলে দাবি করেন[6][7] এবং এর অনুসারীদের ওয়াহাবি[8] নামে চিহ্নিত করেন।[9][10][11]

তারা প্রসিদ্ধ চার মাযহাবের ইমাম, ইমাম আবু হানিফা (রহঃ), ইমাম মালিক (রহঃ), ইমাম শাফি (রহঃ), ইমাম হাম্বল (রহঃ) সহ সকল মুজতাহিদগণের ফতোয়াকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করেন, তবে কোনো একটি নির্দিষ্ট মাযহাব বা ইমামের মতামতকে এককভাবে অনুসরণ করেন না।

তাদের আরো বৈশিষ্ট্য দেখা যায়, তারা কুরআন এবং সহিহ হাদীসকে সর্ব প্রথম অনুসরণ করেন[12] এবং শুধুমাত্র অস্পষ্ট বিষয়গুলোতে ইমামগণ অর্থাৎ মুজতাহিদদের ফতোয়া পর্যালোচনা করে গ্রহণ করেন। আলেমগণ হাদীস শাস্ত্রের বিভিন্ন পদ্ধতিকে কাজে লাগিয়ে হাদীসের সনদ যাচাই বাছাইয়ের পর সহীহ, দুর্বল, জাল এভাবে হাদীসের শ্রেণি বিভাগ করেন।

ইতিহাস

আনুমানিক ইসলাম আগমনের তৃতীয়তম শতাব্দীর দিকে সমসাময়িক আইনশাস্ত্রের আলেমদের মতামত অপেক্ষা মুহাম্মাদ (সাঃ) এর মতাদর্শ বা হাদিসের উপর অধিক জোর প্রদানের মাধ্যমে এই মতবাদের সূচনা হয়।[12] ৯ম শতাব্দীতে মুতাজিলা মতবাদের বিরোধিতার মাধ্যমে এই মতবাদের উদ্ভব ঘটে।[13] কেভিন জাকুয়েসের মতে, আহলে হাদিসগণ খলিফা ইয়াজিদ কর্তৃক সঙ্ঘটিত হত্যাকাণ্ডের প্রতিক্রিয়া হিসেবে একটি ধর্মীয় ইতিবাচক ব্যাখ্যার উন্মেষ ঘটিয়েছেন।[14] অধ্যাপক 'সেরিল গ্লাসি' ইবনে হাজমকে আহলে হাদিস মতবাদের সবচেয়ে বড় দার্শনিক ও ধর্মতাত্ত্বিক বলে মনে করেন।[11] ইবনে তাইমিয়া[15], আল জাহাবি[16], আহমদ ইবনে হাম্বল, ইবনে কাইয়িম আল জাওয়াজিয়া[17], মুহাম্মাদ আল বুখারি, ইবনে হাজার আস্কালানি[18], কাজই আইয়াদসহ আরও অনেকেই এই মতবাদকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সমর্থন ও সহযোগিতা করেছেন। এই মতবাদের অনুসারীগণ নিজেদের রাশিদুন খলিফার মতবাদের অনুসারী বলে মনে করেন।

দক্ষিণ এশিয়া

বিভিন্ন ইতিহাসবিদগণের তথ্য অনুযায়ী জানা যায় যে, ভারতীয় উপমহাদেশের ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে আহলে হাদীসগণ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।[19]

বাংলাদেশে বর্তমানে আহলে হাদীসদের দুটি সংগঠনকে দেখতে পাওয়া যায়, যারা ধর্ম প্রচারের কাজ করে থাকে। [20] একটি 'জমিয়তে আহলে হাদীস', যা ১৯৪৮ সালে ভারতবর্ষে প্রতিষ্ঠা লাভ করে,[21] ১৯৬০ সালে বাংলা একাডেমীর পুরষ্কার প্রাপ্ত প্রথম সাহিত্যিক আল্লামা আবদুল্লাহেল কাফি আল কোরায়েশীর মাধ্যমে এবং অন্য সংগঠনটি হল 'আহলে হাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ', যা ১৯৯৪ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবী বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব প্রতিষ্ঠা করেন।[22]

বৈশিষ্ট্য

আহলে হাদীসগণ সুফিবাদেরশিয়া মতবাদের[20] কঠোর বিরোধিতা করে থাকেন।[23] এছাড়াও তারা দাড়ি রাখাকে সুন্নাত নয় বরং ওয়াজিব মনে করেন এবং তাদের সালাত বা নামায আদায়ের পদ্ধতি প্রচলিত মাযহাবের নামায পড়ার পদ্ধতি থেকে কিছুটা ভিন্ন। তারা নামাজে দন্ডায়মান অবস্থায় বুকে হাত বাঁধেন, প্রথম দুই রাকআতে সূরা ফাতিহার পর সজোরে আমিন বলেন,[10] রুকু ও সিজদায় যাওয়ার আগে রফউল ইয়াদাইন (হাত উঠানো) করে থাকেন এবং নামাজ শেষে ইমামের নেতৃত্বে সম্মিলিত মোনাজাত করেন না। এদিক থেকে তাদের নামাযের পদ্ধতির সাথে মালিকি, শাফেয়ী এবং হাম্বলী মাযহাবের মিল খুুঁজে পাওয়া যায়। আহলে হাদীসদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল, তারা শির্ক এবং বিদ'আতের ব্যাপারে মানুষকে সচেতন করার মাধ্যমে সমাজে অর্থোডক্স ইসলামের আচারকে ধরে রাখার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখেন। ইবনু হিব্বান (রহঃ) আহলে হাদিসদের ৩টি আলামত বর্ননা করেছেনঃ ১. তারা হাদীসের উপর আমল করে। ২. তারা সুন্নাত তথা হাদীসের প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত থাকে। ৩. তারা সুন্নাত বিরোধিদের মূলোৎপাটন করে।[24]

লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য

নির্ভেজাল তাওহীদের প্রচার ও প্রতিষ্ঠা এবং জীবনের সর্বক্ষেত্রে কুরআন ও সুন্নাহ এর যথাযথ অনুসরণের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা। আক্বীদাআমলের সংশোধনের মাধ্যমে সমাজের সার্বিক সংস্কার সাধন আহলে হাদীস আন্দোলনের সামাজিক ও রাজনৈতিক লক্ষ্য।

পরিচিতি

ইসলামের সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) বলেছেন, "আমার উম্মাতের একটি দল অব্যাহতভাবে ক্বিয়ামাত পর্যন্ত সাহায্যপ্রাপ্ত হতে থাকবে এবং যারা তাদের অপদস্থ করতে চায় তারা তাদের কোন ক্ষতি করতে সক্ষম হবে না।"[25][26]

  • ১) ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল বলেন, "সাহায্যপ্রাপ্ত এই দলটি যদি আসহাবুল হাদিস না হয়, তবে এই দল কারা তা আমি জানি না।"[27]
  • ২) ইমাম বুখারীর উস্তাদ ইমাম আলী ইবনুল মাদানী বলেছেন, "তারা হচ্ছেন আছহাবুল হাদিস।"[28]
  • ৩) মুহাম্মাদ ইবনু ইসমাঈল (রাহঃ) বলেন, "আলী ইবনুল মাদীনী বলেছেন, সাহায্যপ্রাপ্ত সেই সম্প্রদায়টি হলো আহলুল হাদীস।"[29][30]

সমালোচনা

২০১৮ সালের ২২ মার্চ যুক্তরাষ্ট্র সফরে দ্য ওয়াশিংটন পোস্টকে দেওয়া সৌদি প্রিন্স ডিনাইস কুশনার ইজ ইন হিজ পকেট শীর্ষক ৭৫ মিনিটের এক সাক্ষাৎকারে মুহাম্মদ বিন সালমান বলেন, "স্নায়ুযুদ্ধের সময়ে বিদেশি মসজিদমাদ্রাসায় বিনিয়োগ করেছিল সৌদি আরব। তৎকালীন মিত্র দেশগুলোই সৌদি আরবকে এ কাজ করতে বলেছিল। মূলত তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন যেন মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বিভিন্ন দেশে প্রভাব বিস্তার করতে না পারে, সে জন্যই এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল।" এই কর্মকাণ্ডের ফলে মূলত পশ্চিমারাই লাভবান হয়েছিল। [31][32][33][34] প্রসঙ্গত, পশ্চিমাদের (ইহুদিখ্রিষ্টান) ইসলামের জাতশত্রু হিসেবে মনে করা হয়।

তথ্যসূত্র

  1. সূরা আল-মুরসালাত (৭৭:৫০)
  2. সূরা আল-জাসিয়া (৪৫:৬)
  3. সূরা আন-নিসা (৪:৮৭)
  4. সূরা আয-যুমার (৩৯:২৩)
  5. সহিহ মুসলিম (ইসলামিক ফাউন্ডেশন) : ১৮৭৮
  6. Alex Strick Van Linschoten and Felix Kuehn, An Enemy We Created: The Myth of the Taliban-Al Qaeda Merger in Afghanistan, pg. 427. New York: Oxford University Press, 2012. আইএসবিএন ৯৭৮০১৯৯৯২৭৩১৯
  7. Anatol Lieven, Pakistan: A Hard Country, pg. 128. New York: PublicAffairs, 2011. আইএসবিএন ৯৭৮১৬১০৩৯০২৩১
  8. Rabasa, Angel M. The Muslim World After 9/11 By Angel M. Rabasa, p. 275
  9. Olivier Roy; Antoine Sfeir, সম্পাদকগণ (২০০৭-০৯-২৬)। The Columbia World Dictionary of Islamism। Books.google.com.my। সংগ্রহের তারিখ ২০১২-০৯-২৪
  10. Hewer, C. T. R.। Understanding Islam: The First Ten Steps। Books.google.com.my। সংগ্রহের তারিখ ২০১২-০৯-২৪
  11. Glasse, Cyril (২০০১)। The New Encyclopedia of Islam (revised সংস্করণ)। AltaMira Press। পৃষ্ঠা 31।
  12. "Ahl al-Hadith"। Oxford Islamic Studies। সংগ্রহের তারিখ ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৫
  13. A Brief History of Islam by Karen Armstrong, Phoenix, London
  14. Jaque, R. Keven (২০০৪)। Martin, Richard C., সম্পাদক। Encylopedia of Islam and the Muslim World। Thomson Gale। পৃষ্ঠা 27।
  15. The Right Way- By Imam Ibn Taymiyyah, Darrussalam publishers KSA
  16. al-Dhahabi, Muhammad ibn Ahmad। al-Mu`allimi, সম্পাদক। Tadhkirah al-Huffadh (Arabic ভাষায়)। 1। India। পৃষ্ঠা 4।
  17. Jonathan A.C. Brown। "Salafism - Islamic Studies - Oxford Bibliographies"। Oxford Bibliographies। সংগ্রহের তারিখ ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৫
  18. Al-`Asqalani, Ahmad ibn `Ali (২০০৫)। Abu Qutaybah al-Firyabi, সম্পাদক। Fath al-Bari (Arabic ভাষায়)। 1 (first সংস্করণ)। Riyadh: Dar al-Taibah। পৃষ্ঠা 290। আইএসবিএন 1-902350-04-9।
  19. "কাফী, মুহম্মদ আবদুল্লাহ-হিল - বাংলাপিডিয়া"। বাংলাপিডিয়া। সংগ্রহের তারিখ ১৫ এপ্রিল ২০১৯ line feed character in |শিরোনাম= at position 28 (সাহায্য)
  20. Olivier, Roy; Sfeir, Antoine, সম্পাদকগণ (২০০৭)। The Columbia World Dictionary of Islamism। Columbia University Press। পৃষ্ঠা 27।
  21. Roy, Olivier, The Failure of Political Islam, by Olivier Roy, translated by Carol Volk, Harvard University Press, 1994, p.118-9
  22. "আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ"। আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ। সংগ্রহের তারিখ ১৫ এপ্রিল ২০১৯
  23. Arthur F Buehler, Sufi Heirs of the Prophet: the Indian Naqshbandiyya and the Rise of the Mediating Sufi Shaykh, pg. 179. Part of the Studies in Comparative Religion series. Columbia: University of South Carolina Press, 1998. আইএসবিএন ৯৭৮১৫৭০০৩২০১১
  24. সহিহ ইবনু হিব্বান,আল-ইহসান,হা/৬১২৯, অন্য একটি কপির হাদীস নং ৬১৬২
  25. ইবনে মাজাহ হা/৬; জামে আত তিরমিযি হা/২১৯২
  26. "সুনানে ইবনে মাজাহ, অধ্যায়ঃ ভূমিকা পর্ব, হাদিস নম্বরঃ ৬"। তাওহীদ পাবলিকেশন। সংগ্রহের তারিখ ১৫ এপ্রিল ২০১৯
  27. ইমাম হাকেম, মারিফাতু উলমিল হাদিস, পৃ: ২।
  28. তিরমিযি হা/২১৯২।
  29. তিরমিযি হা/২১৯২; মারিফাতু উলুমিল হাদীস হা/৬।
  30. "সূনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত), অধ্যায়ঃ ৩১ (কলহ ও বিপর্যয়), হাদিস নম্বরঃ ২১৯২"। হুসাইন আল-মাদানী। সংগ্রহের তারিখ ১৫ এপ্রিল ২০১৯
  31. "ওয়াহাবিবাদ নিয়ে যা বললেন সালমান"। প্রথম আলো। সংগ্রহের তারিখ ২৮ এপ্রিল ২০১৮
  32. "পশ্চিমাদের কথায় ওয়াহাবিবাদ প্রচার করে সৌদি"। কালের কণ্ঠ। সংগ্রহের তারিখ ২৮ এপ্রিল ২০১৮
  33. "রুশ প্রভাব ঠেকাতে পশ্চিমাদের কথায় ওয়াহাবিবাদের প্রচার: সৌদি প্রিন্স"। bdnews24.com। সংগ্রহের তারিখ ২৮ এপ্রিল ২০১৮
  34. "পশ্চিমাদের কথাতেই ওয়াহাবিবাদ প্রচার করেছে সৌদি :প্রিন্স"। সমকাল। সংগ্রহের তারিখ ২৮ এপ্রিল ২০১৮

আরও দেখুন

বহিঃসংযোগ

    This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.