আকীদা
আকীদা (আরবি: عقيدة, বহুবচন: আরবি: عقائد, আকা'ইদ, কখনো কখনো উচ্চারণ করা হয় আকীইদাহ, আক্বিদাহ) এটি একটি ইসলামী পরিভাষা যার অর্থ 'কিছু মূল ভিত্তির উপর বিশ্বাস'।
ইসলাম |
---|
এর ধারাবাহিক নিবন্ধের অংশ: |
|
আরো দেখুন
|
![]() |
বিশ্বাস বা ধর্মবিশ্বাস বুঝাতে মুসলিম সমাজে সাধারণত দুটি শব্দ ব্যবহৃত হয়: ঈমান ও আকীদা। কুরআন কারীম ও হাদীস শরীফে সর্বদা 'ঈমান' শব্দটিই ব্যবহার করা হয়েছে। 'আকীদা' ব্যবহৃত হয় নি। দ্বিতীয় হিজরী শতক থেকে তাবিয়ী (সাহাবীদের ছাত্র) ও পরবর্তী যুগের ঈমামগণ (ধর্মীয় নেতা) ধর্মবিশ্বাসের খুটিনাটি বিষয় আলোচনার জন্য 'ঈমান' ছাড়াও অন্যান্য কিছু পরিভাষা ব্যবহার করেন। এসকল পরিভাষার মধ্যে রয়েছে 'আল-ফিকহুল আকবার', 'ইলমুত তাওহীদ', 'আস-সুন্নাহ', 'আশ-শরীয়াহ', 'উসূলুদ্দীন', 'আল-আক্বীদাহ' ইত্যাদি।[1] এগুলোর মধ্যে 'আকীদাহ' শব্দটিই অধিক প্রচলিত।
ইসলামী আকীদার উৎস
ইসলামী আকীদার একমাত্র উৎস হচ্ছে ওহী। ইসলামী বিশ্বাস অনুসারে দু প্রকারের ওহী প্রেরিত হয়েছে : কিতাব (কুরআন) ও সুন্নাত (হাদীস)। কুরআন অনুসারে আল্লাহ রাসূলের প্রতি কিতাব ও হিকমত অবতীর্ণ করেছেন।[2] হিকমতকে রাসূলের সুন্নাহ হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়। কুরআনের সাথে সুন্নাহর পার্থক্য হল, সুন্নাহর শব্দাবলী আল্লাহর পক্ষ থেকে নয়। তবে উভয়টিরই তথ্যসমূহ আল্লাহর পক্ষ থেকে আগত।[3]
কর্ম বা আমলের বিষয়ে ইসলামের বিধান নির্ণয়ে কিয়াস বা অনুমানের উপরে নির্ভর করা যায়। কিন্তু ইসলামী বিশ্বাস গায়েব বা অদৃশ্য বিষয়ের উপর। মুসলিম পণ্ডিতদের মতে, এ সকল বিষয়ে মানুষ ওহীর নির্দেশনা ছাড়া অনুমান করে অথবা গবেষণা করে কোনো সমাধান দিতে সক্ষম নয়। এছাড়া ওহীর ব্যাখ্যা সেভাবেই করতে হয়, যেভাবে সাহাবী ও তাবেয়ীগণ ব্যাখ্যা করেছেন।
হাদীসের প্রকারভেদ
মুহাদ্দিসগণের পরিভাষায় যে হাদীসের মধ্যে ৫টি শর্ত পূরণ হয়েছে তাকে সহীহ হাদীস বলা হয় -
- হাদীসের সকল বর্ণনাকারী সৎ ও বিশ্বস্ত
- বর্ণনাকারীদের নির্ভুল বর্ণনার ক্ষমতা পূর্ণরূপে বিদ্যমান
- প্রত্যেক বর্ণনাকারী তার উর্ধ্বতন বর্ণনাকারী থেকে হাদীসটি স্বকর্ণে শুনেছেন বলে প্রমাণিত
- অন্যান্য প্রামাণ্য বর্ণনার বিপরীত নয় বলে প্রমাণিত
- সনদগত বা অর্থগত কোনো সুক্ষ্ম ত্রুটি নেই বলে প্রমাণিত
দ্বিতীয় শর্তে সামান্য দুর্বলতা থাকলে হাদীসটি হাসান বলে গণ্য হতে পারে। শর্তগুলোর অবর্তমানে হাদীসটি যয়ীফ বা দুর্বল অথবা মাউযূ বা বানোয়াট হাদীস বলে গণ্য হতে পারে।[1] ইসলামে দুর্বল ও বানোয়াট হাদীস আকীদা ও আমলের ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য নয়।
সহিহ হাদীসের প্রকারভেদ
বর্ণনাকারীদের সংখ্যার দিক থেকে মুহাদ্দিসগণ সহীহ বা বিশুদ্ধ হাদীসকে দুই ভাগে ভাগ করেছেন -
- যেসকল হাদীস সাহাবীগণের যুগ থেকে সংকলন পর্যন্ত সকল স্তরে অনেক বর্ণনাকারী বর্ণনা করেছেন তাকে মুতাওয়াতির বা অতি প্রসিদ্ধ হাদীস বলা হয়।
- যেসকল হাদীস সাহাবীগণের যুগ থেকে সংকলন পর্যন্ত কোনো যুগে অল্প কয়েকজন বর্ণনাকারী বর্ণনা করেছেন তাকে আহাদ বা খাবারুল ওয়াহিদ হাদীস বলা হয়।
আকীদার ক্ষেত্রের মুতাওয়াতির বা অতি প্রসিদ্ধ হাদীস দ্বারা সুনিশ্চিত জ্ঞান লাভ করা যায়। অন্যদিকে খাবারুল ওয়াহিদ হাদীস দ্বারা সুনিশ্চিত জ্ঞান লাভ করা না গেলেও তা কার্যকর ধারণা প্রদান করে। কর্ম বিষয়ক বৈধ, অবৈধ ইত্যাদি বিধিবিধানের ক্ষেত্রে এই ধরনের হাদীসের উপরে নির্ভর করা হয়। আকীদার মূল বিষয় প্রমাণের জন্য সাধারণত এরূপ হাদীসের উপর নির্ভর করা হয় না। তবে মূল বিষয়ের ব্যাখ্যায় এর উপর নির্ভর করা হয়।
কুরআনে উল্লেখিত বা মুতাওয়াতির হাদীসের মাধ্যমে জানা কোনো বিষয় অস্বীকার করলে তা কুফরী হিসেবে গণ্য হয়। আর খাবারুল ওয়াহিদের মাধ্যমে জানা বিষয় অস্বীকার করলে তা বিভ্রান্তি হিসেবে গণ্য হয়। মুসলিমরা বিশ্বাস করে কুরআন পুরোপুরিই 'মুতাওয়াতির'ভাবে বর্ণিত। কেউ একটি শব্দকেও সমার্থক কোনো শব্দ দিয়ে পরিবর্তন করেন নি। অন্যদিকে হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে সাহাবী তাবিয়ীগণ অর্থের দিকে বেশি লক্ষ্য রাখতেন। তারা প্রয়োজনে একটি শব্দের পরিবর্তে সমার্থক অন্য শব্দ ব্যবহার করতেন।[1]
বিশুদ্ধ হাদীসের উৎস
অল্প সংখ্যক মুহাদ্দিস কেবলমাত্র সহীহ হাদীস সংকলনের চেষ্টা করেন। অধিকাংশ মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও আলিম সনদসহ হাদীস উল্লেখ করলে তা সহীহ না বানোয়াট তা বলার প্রয়োজন মনে করতেন না।
আল্লামা ইবনুস সালাহ বলেন -
বুখারী ও মুসলিম গ্রন্থের বাইরে সহীহ হাদীস খুঁজতে হবে মাশহুর হাদীসের গ্রন্থগুলোতে, যেমন - আবূ দাঊদ, তিরমিযী, নাসাঈ, ইবনু খুযাইমা, দারাকুতনী ও অন্যান্যদের সংকলিত গ্রন্থ। তবে এ সকল গ্রন্থে যদি কোনো হাদীস উদ্ধৃত করে তাকে সুস্পষ্টত 'সহীহ' বলে উল্লেখ করা হয় তবেই তা সহীহ বলে গণ্য হবে, শুধুমাত্র এ সকল গ্রন্থে হাদীসটি উল্লেখ করা হয়েছে বলেই হাদীসটিকে সহীহ মনে করা যাবে না। কারণ এ সকল গ্রন্থে সহীহ এবং যয়ীফ সব রকমের হাদীসই রয়েছে।
আল্লামা ইবনু হাজার আসকালানী বলেন -
দ্বিতীয় হিজরী শতাব্দী থেকে শুরু করে পরবর্তী সকল যুগের অধিকাংশ মুহাদ্দিসের রীতি ছিল যে, সহীহ, যয়ীফ, মাউযূ, বাতিল সকল প্রকার হাদীস সনদসহ সংকলন করা। তাঁদের মূলনীতি ছিল যে, সনদ উল্লেখ করার অর্থই হাদীসটি বর্ণনার দায়ভায় বর্ণনাকারীদের উপর ছেড়ে দেয়া, সংকলকের আর কোনো দায় থাকে না।
ইসলামী আকীদা বিষয়ক গ্রন্থ
ইসলামী আকীদা বিষয়ে প্রথম বই লেখেন ইমাম আবু হানিফা। বইটি "ফিকহুল আকবর" নামে পরিচিত।[4] আকীদা বিষয়ে অসংখ্য বই লেখা হয়েছে। এর মধ্যে প্রাচীন কয়েকটি বই হল - ইমাম আহমাদ লিখিত "আস-সুন্নাহ", ইমাম আবু দাউদ সুলাইমান লিখিত "আস-সুন্নাহ", ইমাম আবু জাফর ত্বহাবী লিখিত "আকীদাতু আহলিস সুন্নাহ", ইমাম ইবনে তাইমিয়া লিখিত "আল আক্বীদাতুল ওয়াসেত্বীয়া", ইমাম ইবনু রজাব হাম্বালী লিখিত "কিতাবুত তাওহীদ" ইত্যাদি। ইমাম ইবনে আবীল ইয আল-হানাফী ইমাম ত্বহাবীর লেখা আকীদার বইয়ের ব্যাখ্যাগ্রন্থ লিখেছেন যা "শারহুল আকীদা আত্-ত্বহাবীয়া" নামে পরিচিত।
বিশ্বাসের ছয়টি স্তম্ভ
ইসলামী দৃঢ় বিশ্বাস বা বিশ্বাসের ছয়টি স্তম্ভ এসেছে কুরআন ও সুন্নাহ থেকে (আরকান আল-ঈমান)[5]। যা সব মুসলমানদের দ্বারা গৃহীত হয়েছে। বিশ্বাসের স্তম্ভগুলো হল:
- আল্লাহকে বিশ্বাস
- ফেরেস্তাগণকে বিশ্বাস
- আল্লাহ তা'আলা কর্তৃক প্রেরিত কিতাবসমূহে বিশ্বাস (কুরআনসহ)
- আল্লাহ তা'আলা কর্তৃক প্রেরিত সকল নবী এবং রাসুলকে বিশ্বাস
- আখিরাত বা পরকালে বিশ্বাস
- তাকদীরে বিশ্বাস
উমার (রা.) বলেন,
একদিন আমরা আল্লাহর রাসূলের (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিকট বসেছিলাম, এমন সময় হঠাৎ এক ব্যক্তি আমাদের সামনে উপস্থিত হয় ..... এরপর বলল: "আমাকে ঈমান সম্পর্কে বলুন"। তিনি বললেন: "তা হচ্ছে এই- আল্লাহ্, তাঁর ফেরেশতাগণ, তাঁর কিতাবসমূহ, তাঁর রাসূলগণ ও আখেরাতের উপর ঈমান আনা এবং তাকদীরের ভাল-মন্দের উপর ঈমান আনা।"..... [সহীহ্ মুসলিম][6]
আল্লাহ সম্পর্কে ইসলামী আকীদা
একমাত্র স্রষ্টা ও প্রতিপালক
ইসলামী বিশ্বাস অনুযায়ী আল্লাহ্ মহাবিশ্বের সৃষ্টিকর্তা। কুরআনে বলা হয়েছে,
"তারা কি স্রষ্টা ছাড়া সৃষ্টি হয়েছে, না তারাই স্রষ্টা? তারা কি আসমান ও যমীন সৃষ্টি করেছে? বরং তারা দৃঢ় বিশ্বাস করে না।"[কুরআন 52:35–36]
ইসলামী বিশ্বাস অনুযায়ী আল্লাহ্ একমাত্র রব। রব (আরবি: ﺭﺏ) বলা হয় তাকে যিনি সৃষ্টি করেন, পরিচালনা করেন এবং মালিকানা যাঁর জন্য। কুরআনে বলা হয়েছে,
"...জেনে রাখুন, সৃষ্টি করা ও হুকুমের মালিক তিনি। বরকতময় আল্লাহ বিশ্বজগতের প্রতিপালক।"[কুরআন 7:54]
একমাত্র উপাস্য
মুসলিমরা আরও বিশ্বাস করে আল্লাহ্ই একমাত্র ইলাহ্ তথা সত্য উপাস্য। ইলাহ্ (আরবি: ﺍﻻﻟﻪ) অর্থ হলো: সম্মান ও বড়ত্বের কারণে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় যার ইবাদত করা হয়। আর ইবাদত বা উপাসনা সেই সব কাজকে বলা হয়, যা কোনো ইলাহ্-র সন্তুষ্টি লাভের আশায় অথবা তার অসন্তুষ্টির ভয়ে করা হয়। কুরআনে বলা হয়েছে,
" আর তোমাদের ইলাহ এক ইলাহ। তিনি ছাড়া কোন (সত্য) ইলাহ নেই। তিনি অতি দয়াময়, পরম দয়ালু।"[কুরআন 2:163]
মক্কার মূর্তিপুজারিরা লাত, মানাত, উজ্জাসহ বিভিন্ন মূর্তির উপাসনা করত। এগুলোর প্রসঙ্গে বলা হয়েছে,
"এগুলো কেবল কতিপয় নাম, যে নামগুলো তোমরা ও তোমাদের পিতৃপুরুষেরা রেখেছ। এ ব্যাপারে আল্লাহ কোন দলীল-প্রমাণ নাযিল করেননি। তারা তো কেবল অনুমান এবং নিজেরা যা চায়, তার অনুসরণ করে।..."[কুরআন 53:23]
নাম ও গুণাবলী
কুরআনে বা হাদীসে আল্লাহর অনেকগুলো সুন্দর নাম ও গুণের উল্লেখ রয়েছে। মুসলিমরা আল্লাহ্-র নাম ও গুণগুলোর কোনোটি অস্বীকার করে না, সৃষ্টবস্তুর সাথে সাদৃশ্য দেয় না, গুণগুলোর ধরন নির্ধারণ করে না। (এরকম বলে না যে - আল্লাহ্-র হাত মানুষের হাতের মত, মানুষ যেভাবে শুনে আল্লাহও সেভাবে শোনেন ইত্যাদি)[7]
ফেরেশতাদের সম্পর্কে ইসলামী আকীদা
ইসলামী বিশ্বাস অনুসারে আল্লাহ ফেরেশতাদেরকে নূর বা আলো দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। তারা আল্লাহর নির্দেশ পালনে রত আছেন। কুরআনে বলা হয়েছে,
"তারা অহঙ্কারবশতঃ তাঁর ইবাদত হতে বিমুখ হয় না এবং ক্লান্তিও বোধ করে না। তারা দিন-রাত তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে, তারা ক্লান্তও হয় না।"[কুরআন 21:19–20]
হাদীস অনুসারে জিব্রাইলের দিগন্ত জুড়ানো ছয়শত ডানা রয়েছে। কয়েকজন ফেরেশতার কাজ সম্পর্কে হাদীসে জানা যায়। যেমন- ওহী বহনের দায়িত্বে আছেন জিব্রাইল, শিংগায় ফুঁ দেওয়ার দায়িত্বে আছেন ইস্রাফিল, বৃষ্টি বর্ষণের দায়িত্বে আছেন মিকাইল, জাহান্নামের দায়িত্বে আছেন মালিক, মৃত্যুর দায়িত্বে আছেন মালাকুল মাউত।[8] এছাড়াও মুসলিমরা বিশ্বাস করে প্রত্যেক ব্যক্তির সাথে দুইজন করে ফেরেশতা থাকে। এ ফেরেশতাদ্বয় ব্যক্তির আমলসমূহ লিপিবদ্ধ করেন।
নবী-রসূল সম্পর্কে ইসলামী আকীদা
ইসলামী বিশ্বাস অনুসারে, আল্লাহ তাআলা প্রত্যেক জাতির জন্য একজন মানুষকে রাসূল (বার্তাবাহক) করে পাঠিয়েছেন যারা তাদেরকে তাওহীদের আহ্বান জানান। আল্লাহ তাদেরকে যে বাণী দিয়ে প্রেরণ করেছেন তারা তার কোনো অংশ গোপন বা পরিবর্তন করেননি। ভিন্ন রাসূলের ক্ষেত্রে বিধিবিধান ও আইন-কানুন ভিন্ন হতে পারে। এক রাসূলের উম্মতের উপর যে ইবাদাত ফরজ করা হয়েছে তা অন্য রাসূলের উম্মতের উপরে ফরজ করা হয়নি। আবার এক রাসূলের উম্মতের উপরে যে বিষয়গুলো হারাম করা হয়েছে তা অন্য রাসূলের উম্মতের জন্য হয়তো হালাল করা হয়েছে। কুরআন ও হাদীসে রাসূলদের মধ্যে কারো কারো নাম জানা যায়। যেমন- মুহাম্মদ, ঈসা, দাউদ, মূসা, ইব্রাহিম, নূহ। তবে সব নবী-রাসূলদের নাম ও তাদের বর্ণনা জানানো হয়নি।[9]
কুরআন অনুসারে সর্বশেষ রাসূল হচ্ছেন মুহাম্মদ।[10] ইসলামী বিশ্বাস অনুযায়ী, আল্লাহ তাকে অন্য নবীদের উপর বেশ কিছু বিশেষত্ব দিয়েছেন। তাকে সমস্ত জিন ও মানুষের নবী হিসেবে পাঠিয়েছেন।[11]
আসমানী গ্রন্থ সম্পর্কে ইসলামী আকীদা
মুসলিমরা বিশ্বাস করে, আসমানী কিতাবসমূহ আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিল হয়েছে। কুরআনে বলা হয়েছে,
"কোনো মানুষের এ মর্যাদা নেই যে, আল্লাহ তার সাথে সরাসরি কথা বলবেন, ওহীর মাধ্যম, পর্দার আড়াল অথবা কোন দূত পাঠানো ছাড়া। তারপর আল্লাহর অনুমতি সাপেক্ষে তিনি যা চান তাই ওহী প্রেরণ করেন। তিনি তো মহীয়ান, প্রজ্ঞাময়।"[কুরআন 42:51]
তাওরাতের ব্যাপারে কুরআনে বলা হয়েছে,
"আর আমি তার জন্য ফলকসমূহে লিখে দিয়েছি প্রত্যেক বিষয়ের উপদেশ এবং প্রত্যেক বিষয়ের বিস্তারিত ব্যাখ্যা।"[কুরআন 7:185]
কিতাবসমূহের মধ্যে কয়েকটির নাম কুরআনে বলা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে- কুরআন, তওরাত, ইঞ্জিল, যাবুর, সহিফায়ে ইব্রাহিম ও সহিফায়ে মূসা।[12]
মুসলিমদের বিশ্বাস অনুসারে, শেষ আসমানী কিতাব কুরআন পূর্বের কিতাবসমূহের সত্য বিষয়গুলোর সত্যায়ন করে, ঐ কিতাবগুলোতে যেসব বিকৃতির অনুপ্রবেশ ঘটেছে সেগুলোকে প্রত্যাখ্যান করে।
তাকদীর সম্পর্কে ইসলামী আকীদা
এ মহাবিশ্বে যা কিছু ঘটবে আল্লাহ তাআলা তার পূর্বজ্ঞান অনুসারে সেসব কিছু নির্ধারণ করে রেখেছেন এরূপ বিশ্বাসকে তাকদীর বলা হয়। মুসলিমরা বিশ্বাস করে,
- আল্লাহ তাআলা প্রত্যেকটি বিষয় সম্পর্কে জানেন এবং তিনি লওহে মাহফুজে আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টির পঞ্চাশ হাজার বৎসর পূর্বে সবকিছু লিখে রেখেছেন।
- কোনো কিছুই আল্লাহর ইচ্ছার বাইরে ঘটে না।
- সবকিছুর জাত-বৈশিষ্ট্য আল্লাহরই সৃষ্টি।
- মানুষের ইচ্ছা ও ক্ষমতা আল্লাহর ইচ্ছা ও ক্ষমতার অনুবর্তী।
আখিরাত/পরকাল সম্পর্কে ইসলামী আকীদা
মুসলিমরা বিশ্বাস করে, পার্থিব জীবন শেষ হয়ে মৃত্যু ও কবর জীবনের মাধ্যমে অন্য জগত শুরু হবে। একসময় কিয়ামত সংঘটিত হবে, তারপর পুনরুত্থান, হাশর ও হিসাব-নিকাশের পর ফলাফল প্রাপ্ত হয়ে জান্নাতীরা জান্নাতে এবং জাহান্নামীরা জাহান্নামে যাবে।
কবর
ইসলামী বিশ্বাস অনুসারে, মৃত ব্যক্তিকে দাফনের পর তাকে তার রব, দীন ও শেষনবী সম্পর্কে জিজ্ঞাসা বা প্রশ্ন করা হবে। মানুষ তাদের কর্ম অনুসারে কবরে শাস্তি বা শান্তি ভোগ করবে।[13] মৃত ব্যক্তি কবর জীবনের শাস্তি অথবা শান্তি প্রাপ্ত হবে, যদিও তাকে ভূগর্ভস্থ করা না হয়।
কিয়ামতের পুর্বাভাস
ইসলাম অনুসারে কিয়ামত বা মহাপ্রলয়ের পূর্বে এর পুর্বাভাস বা আলামত প্রকাশ পাবে। আলেমগণ এ আলামতগুলোকে দু’ভাগে বিভক্ত করেছেন:
1. ছোট আলামত: ছোট পুর্বাভাসগুলোর মধ্যে রয়েছে - ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞতা বেড়ে যাবে, বড় বড় অট্টালিকা নিয়ে রাখালদের গর্ব করা, নারীদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া, অধিক হত্যা হওয়া, ব্যভিচার ও অন্যায় কাজ অধিক মাত্রায় হওয়া, নবুয়তের মিথ্যা দাবিদারদের আত্মপ্রকাশ, ইউফ্রেটিস নদী থেকে স্বর্ণের পাহাড় আবিষ্কৃত হওয়া ইত্যাদি।
2. বড় আলামত: বড় পুর্বাভাস দশটি। যেগুলো এখনো প্রকাশিত হয় নি। ইসলামী বিশ্বাস অনুসারে কিয়ামতের পূর্বে ইমাম মাহদী ও দাজ্জালের আগমন ঘটবে। ঈসা আ. আকাশ থেকে অবতরণ করবেন। তিনি খৃষ্টানদের ক্রুশ ভেঙ্গে দিবেন, দাজ্জাল ও শুকর হত্যা করবেন। জিযিয়া করের আইন রহিত করবেন। ইসলামী শরী‘আত অনুসারে বিচার পরিচালনা করবেন। একসময় ইয়াজুজ-মাজুজ বের হবে। তাদের ধ্বংসের জন্য তিনি দুআ করবেন, তারপর তারা মারা যাবে। তিনটি বড় ভূমিকম্প হবে। পূর্বে একটি, পশ্চিমে একটি, জাযিরাতুল আরবে একটি। আকাশ থেকে প্রচণ্ড ধোঁয়া নেমে এসে সকল মানুষকে ঢেকে নিবে। পশ্চিম আকাশে সূর্য উদিত হবে। একটি অদ্ভুত চতুস্পদ জন্তু বের হবে। ইয়ামানের আদন থেকে ভয়ানক আগুন বের হয়ে মানুষদের শামের দিকে নিয়ে আসবে।[14]
কিয়ামত, হাশর, হাউয
ইসলামী আকীদা অনুসারে, ইসরাফীল শিঙ্গায় ফুৎকার দিলে কিয়ামত হবে, অর্থাৎ বিশ্বজগৎ ধ্বংস হবে। প্রথম ফুৎকার দেওয়ার সাথে সাথেই আল্লাহ যা জীবিত রাখবেন তাছাড়া সকল সৃষ্টজীব মারা যাবে। দ্বিতীয় ফুৎকার দেওয়ার সাথে সাথেই পৃথিবী সৃষ্টি থেকে কিয়ামত পর্যন্ত যত সৃষ্টজীবের আর্বিভাব হয়েছিল, তারা সকলেই জীবিত হয়ে উঠে দাঁড়াবে।[15]
এরপর তাদের হিসাব-নিকাশের জন্য ময়দানে একত্রিত করা হবে। এই একত্রিত করাকে হাশর বলা হয়। ময়দানে অবস্থানকালে সূর্য তাদের নিকটবর্তী হবে। এ উত্তপ্ত ও কঠিন অবস্থান দীর্ঘ হওয়ায় শরীর থেকে নির্গত ঘামে হাবু-ডুবু খাবে তাদের (ভালো-মন্দ) কর্ম অনুপাতে।[16]
ইসলামী বিশ্বাস অনুযায়ী, হাউয নামের একটি সুপ্রশস্ত পানির ধারা আল্লাহ্ নবীকে হাশরের মাঠে দান করেছেন। হাউযের পানি দুধের চেয়ে সাদা, বরফের চেয়ে ঠাণ্ডা, মধুর চেয়ে অধিক মিষ্টি, মিশকের চেয়ে সুগন্ধি। যে ব্যক্তি তা থেকে একবার পানি পান করবে, সে আর কখনও পিপাসার্ত হবে না।[3]
শাফায়াত
মানুষ বিচার দিবসের ভয়াবহ বিপদ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যে তাদের রবের নিকট সুপারিশ পেশ করার চেষ্টা করবে। শেষনবী তাদের জন্য সুপারিশ করবেন। কিয়ামতের দিন পাপীদের ক্ষমা করা ও পুণ্যবানদের মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য সুপারিশ করা হবে। নবী-রাসুল, ফেরেশতা ও নেককার ব্যক্তিরা সুপারিশ করার অনুমতি পাবে। কুরআন ও সিয়াম সুপারিশ করবে বলেও হাদিসে উল্লেখ আছে। যে ব্যক্তিদের প্রতি স্বয়ং আল্লাহ সন্তুষ্ট রয়েছেন, তাদের ছাড়া অন্য কারো জন্য কেউ সুপারিশ করবে না[17]।
মীযান, পুল সিরাত, কানত্বারাহ্
আল্লাহ বিচার দিবসে মীযান স্থাপন করবেন, বান্দাদের আমল মাপার ও তাদের কর্মের প্রতিদান প্রদানের জন্য।[18] এর দুটি পাল্লা ও রশি রয়েছে।
ইসলামী বিশ্বাস অনুযায়ী পুল সিরাত হলো জাহান্নামের উপর স্থাপিত পুল, যা অন্ধকারাছন্ন ভয়ের পথ। এর উপর দিয়ে মানুষ জান্নাতের দিকে অতিক্রম করবে। কেউ অতি দ্রুত অতিক্রম করবে আবার কেউ অনেক ধীর গতিতে তাদের কর্ম অনুসারে। পুল সিরাতের দুই ধারে হুকের মত অসংখ্য কাঁটা থাকবে। পুল সিরাত হবে তরবারীর চেয়ে ধারালো, চুলের চেয়ে সূক্ষ্ম ও পিচ্ছিল জাতীয়। অনেকে মুখ থুবড়ে জাহান্নামের তলদেশে নিক্ষিপ্ত হবে।[19]
মুমিনেরা পুলসিরাত অতিক্রম করে কানত্বারাতে অবস্থান করবে। এখানে জান্নাতে যাওয়ার পূর্বে একে অপরের কাছ থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করে পরিশুদ্ধ হবে। এরপর জান্নাতে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হবে।[14]
জান্নাত, জাহান্নাম
মুসলিমরা বিশ্বাস করে জান্নাত ও জাহান্নাম বর্তমানে বিদ্যমান রয়েছে এবং সর্বদা থাকবে। জান্নাতবাসীদের নি‘আমত শেষ হবে না, অনুরূপ জাহান্নামীদের মধ্যে যার ব্যাপারে আল্লাহ চিরস্থায়ী শাস্তির ফায়সালা করেছেন তার শাস্তি কখনও শেষ হবে না।
ইসলাম অনুসারে, জান্নাত হলো অতিথিশালা, যা আল্লাহ মুত্তাকীদের জন্য তৈরি করে রেখেছেন। সেখানে রয়েছে প্রবাহিত নদী, সুউচ্চ কক্ষ, মনোলোভা রমণীগণ। আরো রয়েছে এমন সব সামগ্রী যা কোনো দিন কোনো চক্ষু দেখে নি, কোনো কর্ণ শ্রবণ করে নি, আর কোনো মানুষের অন্তরেও কোনো দিন কল্পনায় আসে নি। জান্নাতে মুমিনদের জন্য সব চাইতে বড় নি‘আমত হলো আল্লাহকে স্বচক্ষে দেখা। সবচেয়ে উন্নত ও উত্তম জান্নাত হল, জান্নাতুল ফিরদাউস আল-আ‘লা। এর ছাদ হলো আল্লাহর ‘আরশ। জান্নাতের সুগন্ধি চল্লিশ বৎসর দূরত্বের রাস্তা থেকে পাওয়া যাবে। জান্নাতের আটটি দরজা রয়েছে, প্রত্যেক দরজার পার্শ্বের দৈর্ঘ্য ‘মক্কা’ থেকে ‘হাজর’ এর দূরত্বের সমান। জান্নাতে নূন্যতম মর্যাদার অধিকারী যে হবে তার জন্য দুনিয়া ও আরো দশ দুনিয়ার পরিমাণ জায়গা হবে।
আর জাহান্নাম হল শাস্তির ঘর যা আল্লাহ কাফির ও অবাধ্যদের জন্য তৈরি করে রেখেছেন। তার পাহারাদার হবে নিষ্ঠুর ও নির্দয় ফিরিশতারা। কাফিরদের খাদ্য হবে যাক্কুম (কাঁটাযুক্ত) আর পানীয় হবে পুঁজ, দুনিয়ার আগুনের তুলনায় ৭০ গুণ তাপমাত্রার আগুনে তাদের শাস্তি দেয়া হবে। জাহান্নামের সাতটি দরজা হবে। [14]
আরো পড়ুন
- সালেহ ইবন ফাওযান আল-ফাওযান। আল-ইরশাদ ইলা সহিহ আল-ই'তিকাদ [ছহীহ আক্বীদার দিশারী]। শাইখ আব্দুল্লাহ শাহেদ আল মাদানী কর্তৃক অনূদিত। মাকতাবাতুস সুন্নাহ।
তথ্যসূত্র
- "প্রথম অধ্যায় : পরিচিতি, উৎস ও গুরুত্ব"। কুরআন সুন্নাহর আলোকে ইসলামী আকীদা। আস-সুন্নাহ পাবলিকেশন্স। ২০০৭।
- কুরআন 4:113
- কুরআনুল কারীম (অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত তাফসীর)। কুরআন মুদ্রণ কমপ্লেক্স। পৃষ্ঠা ১২৪, ৪৭৯, ২৯০০–২৯০১।
- Glasse, Cyril (2001).New Encyclopedia of Islam (Revised Edition ed.). Rowman & Littlefield Publishers. p.105.
- Joel Beversluis (ed.) Sourcebook of the World's Religions: An Interfaith Guide to Religion and .... New World Library. pp.68–90
- "৪০ হাদিস, ২"। ihadis.com।
- "আল্লাহর প্রতি ঈমান"। ইসলামকিউএ.ইনফো।
- "ফিরিশতাদের প্রতি ঈমান"। ইসলামকিউএ.ইনফো।
- কুরআন 40:78
- কুরআন 33:40
- "রাসূলদের প্রতি ঈমান"। ইসলামকিউএ.ইনফো।
- "আসমানী কিতাবের প্রতি ঈমান"। ইসলামকিউএ.ইনফো।
- "মিশকাতুল মাসাবিহ, ১৩১"। ihadis.com।
- ইলমী গবেষণা ডীনশীপ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, মদিনা মুনাওয়ারা (২০০৬)। "পঞ্চম রুকন : শেষ দিবসের ওপর ঈমান"। ঈমানের রুকনসমূহ। মোহাম্মাদ ইবরাহীম আবদুল হালীম কর্তৃক অনূদিত। ইসলাম হাউজ।
- কুরআন 39:68
- "রিয়াদুস সলেহিন, ৪০৭"। ihadis.com।
- কুরআন 21:28
- কুরআন 21:47
- "সুনানে ইবনে মাজাহ, ৪২৮০"। ihadis.com।