তাওরাত
তাওরাত/তোরাহ হচ্ছে হিব্রু ভাষায় লিখিত ইহুদীদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ। হিব্রু ভাষায় এর নাম তোরাহ্ । তোরাহ্ শব্দের অর্থ "আইন", "নিয়ম", বা "শিক্ষণীয় উপদেশ"। এটি ৫ টি পুস্তকের সমন্বয়ে গঠিত। তাই তাওরাতকে অনেকে মুসার "পঞ্চ পুস্তক" বলে থাকে। ইসলামী ধর্ম বিশ্বাস মতে তাওরাত মুহাম্মদের পূর্ববর্তী নবী মুসার উপর অবতীর্ণ একটি আসমানি কিতাব,যা এখন রহিত হয়ে গেছে ।
তাওরাত ইহুদীদের ধর্মীয় রীতি-বিধির মূল ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দলিল। এটি একটি হিব্রু শব্দ, যার অর্থ "শিক্ষা"। তাওরাত মূলত তাদের ধর্মগ্রন্থ তানাখের প্রথম অংশকে বোঝালেও, সার্বিকভাবে তোরাহ বলতে ইহুদিদের লিখিত ও মৌখিক শিক্ষা, যেমন - মিশনাহ, তালমুদ, মিদ্রাশ, ইত্যাদি ধর্মীয় অনুশাসনমূলক গ্রন্থকে একসাথে ইঙ্গিত করে।
ইহুদীরা মনে করেন তাওরাত/তোরাহ হলো মুসা নবীর নিকট ঈশ্বরের সরাসরি প্রদত্ত বাণী।
শব্দার্থ এবং নামসমুহ
হিব্রু শব্দ "তোরাহ" মূল শব্দটি ירה (ইউরহা) থেকে এসেছে, যার অর্থ দাড়ায় "নির্দেশনা/শিক্ষার জন্য"। এছাড়াও বিভিন্ন অনুবাদে তোরাহ শব্দের অর্থ হচ্ছে শিক্ষা, উপদেশমালা, নির্দেশাবলী, সর্বজন গ্রাহ্য নিয়মনীতি, ব্যাবস্থাপনা ইত্যাদি।
রাব্বাইয়ানিক ইহুদীবাদের লিখিত নিয়মনীতি ও মৌখিক নিয়মনীতি বোঝানোর জন্য "তোরাহ" শব্দটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ইহুদী ধর্ম পালন এবং ধর্মীয় শিক্ষার প্রচার ও প্রসার করার "তোরাহ" মূলগ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে।
বিকল্প নামসমূহ
খ্রিস্টান পন্ডিতরা "তোরাহ" কে হিব্রু বাইবেলের প্রথম পাচ গ্রন্থ পুরাতন বাইবেল হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন। ইসলাম ধর্মেও "তোরাহ"র অস্তিত্বকে স্বীকার করা হয় প্রথম আসমানী কিতাব "তাউরাত" হিসেবে।
সুচিপত্র
মহান সৃষ্টিকর্তা প্রভুর দ্বারা এই মহাবিশ্বের সৃষ্টির বিবরণ দিয়ে তোরাহ শুরু হয়, তারপর আদম থেকে নূহ নবী পর্যন্ত বংশ-তালিকা ও মহা প্লাবনের ঘটনাক্রম বর্ণনা করা হয়, এর সাথে রয়েছে ইব্রাহিম/আব্রাহাম নবীর বংশের বিবরণ এবং ইসরাইল জাতির সুচনালগ্ন ও প্রাচীন মিশর দেশে পুনর্বাসনের কাহিনী, এবং সিনাই উপত্যকায় তোরাহ নাযিলের কাহিনী। মিশর দেশ থেকে মুক্ত হয়ে কানান দেশে ইসরাইল জাতির ফিরে আসা এবং মুসা নবীর মৃত্যুর ঘটনার বিবরণ দিয়ে তোরাহ গ্রন্থটির উপসংহার টানা হয়।

হিব্রু ভাষায় তোরাহ র পাঁচটি বইয়ের নিজস্ব নাম দিয়ে শুরু হয়েছে; ইংরেজী ভাষায় ব্যবহৃত প্রত্যেকটি নাম প্রাচীন গ্রীসের ভাষা থেকে এসেছে বলে মনে করা হয়। তাওরাত-এর মধ্যে হিব্রু বাইবেলের প্রথম পাঁচটি বই পড়ে। এই পঞ্চ পুস্তকের নাম নিম্নরূপ।
- বেরেসিট (בְּרֵאשִׁית,অর্থ "সব কিছুর শুরুতে")- আদি পুস্তক
- শিমট (שִׁמוֹת,অর্থ "নামসমূহ")- যাত্রাপুস্তক
- ভাইকরা (ויקרא,অর্থ "তিনি ডেকেছেন")- লেবীয় পুস্তক
- বেমিদবার (במדבר, অর্থ "মরুভুমির মাঝে")- গণনাপুস্তক
- ডেভারিম (דברים, অর্থ "বাণী বা আদেশনামা)- দ্বিতীয় বিবরণ
আদি পুস্তক
মৌলিক সৃষ্টির ইতিহাস বর্ণনা করার মধ্য দিয়ে আদিগ্রন্থের শুরু হয়, প্রথম মানব আদম থেকে শুরু করে নুহ নবী পর্যন্ত বংশতালিকা ও ঘটনার বিবরণ এখানে উল্লেখ করা হয় (অধ্যায় ১-১১)। এছাড়াও এক-ইশ্বরবাদের তিন পিতৃপ্রজন্ম যথাক্রমে ইব্রাহিম, ইসহাক এবং ইয়াকুব (ইসরাইল), এবং চার মাতৃপ্রজন্ম যথাক্রমে সারাহ, রেবেকা এবং লেহ ও রাখেল এর সময়কার ঘটনাবলি সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়। এখানে সৃষ্টিকর্তা প্রভু এই প্রজন্মকে কানান দেশের অধিকারী করার জন্য প্রতিজ্ঞা করেন, কিন্তু জেনেসিসের শেষের দিকে ইয়াকুব পুত্র ইউসুফ মিশর দেশে বসবাস করতে থাকেন এবং মিশরীয় জাতিকে মহা দুর্ভিক্ষ থেকে রক্ষা করেন, তারপর তিনি সেখানকার রাজ সভায় গুরুত্বপুর্ণ দায়িত্ব পালন করেন (অধ্যায় ১২-৫০)।
যাত্রাপুস্তক
মুসা নবী কর্তৃক ইসরাইলের জাতিকে মিশর দেশের দাসত্ব থেকে মুক্ত করে সিনাই উপত্যকা পর্যন্ত নিয়ে আসার ঘটনা দিয়ে যাত্রাগ্রন্থের শুরু হয় (অধ্যায় ১-১৮)। তারপর কিভাবে ইসরাইলের লোকেরা ইশ্বরের আদেশ মেনে নেয়, নিজেদেরকে শত্রু থেকে রক্ষা করে, মুসা নবী সরাসরি প্রভুর কাছ থেকে তোরাহ লাভ করেন এবং নিজ জাতিকে এর নিয়মনীতি শিক্ষা দেন এ বিষয়ে বিষদ বর্ণনা করা হয় (অধ্যায় ১৯-২৪)। এছাড়াও ইসরাইলের জাতি স্বর্ণ দিয়ে গোবাছুর তৈরি করে সর্বপ্রথম তোরাহ-র নিয়ম ভঙ্গ করে এ বিষয়ে এখানে উল্লেখ আছে (অধ্যায় ৩২-৩৪)। ইহুদী ধর্মের জন্য কিভাবে পবিত্র উপাসনার স্থান নির্মাণ করতে হবে এ বিষয়ে ভালোভাবে বর্ণনা করার মধ্য দিয়ে এক্সোডাস/যাত্রাগ্রন্থ শেষ হয় (অধ্যায় ২৫-৩১;৩৫-৪০)
লেবীয় পুস্তক
ইসরাইলের জাতি কিভাবে পবিত্র উপাসনার স্থান ব্যবহার করবে এ বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়ার মধ্য দিয়ে লেবীয়-গ্রন্থ শুরু হয় (অধ্যায় ১-১০)। পবিত্র-অপবিত্র বস্তু সম্পর্কে ধারণা প্রদান (অধ্যায় ১১-১৫), যার মধ্যে আছে কিভাবে পশু উতসর্গ করতে হবে, প্রায়শ্চিত্ত করার নিয়মাবলি (অধ্যায় ১৬), এবং বিভিন্ন মানবিক নৈতিকতা ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান পরিচালনা করার নিয়মনীতি বর্ণনা করা হয় (অধ্যায় ১৭-২৬)।
গণনাপুস্তক
ইসরাইলের জাতি সিনাই উপত্যকায় নিজেদেরকে জাতি হিসেবে দৃঢ় ও সংঘবধ্য করার কাহিনী (অধ্যায় ১-৯), সিনাই উপত্যকা থেকে কানান দেশের উদ্দেশ্যে যাত্রা করার কাহিনী গণনাগ্রন্থে উল্লেখ করা হয় (অধ্যায় ১০-১৩)। মিশর দেশ থেকে মুক্ত হয়ে প্রায় ৪০ বছর মরু প্রান্তরে ঘুরে বেড়ানোর জন্য ইসরাইল জাতির নিজেদের মধ্যে নানারকম অবিশ্বাস জন্ম নেয়, কারণ তারা তখন পর্যন্ত কানান দেশে প্রবেশ করতে পারেনি। মুসা নবীর জীবদ্দশায় তারা কানান দেশ লাভ করতে পারেনা, পরবর্তীতে তারা কানান দেশে প্রবেশ করার সুযোগ লাভ করে (অধ্যায় ১৪-৩৫)।
দ্বিতীয় বিবরণ
দ্বিতীয় বিবরণ গ্রন্থ হচ্ছে মুসা নবী কর্তৃক বর্ণীত নির্দেশনা সমূহ। এখানে বলা হয়, ইসরাইলের জাতি যেন কখনো মুর্তি পুজা না করে, কানান দেশের রাস্তা যেন অনুসরণ না করে এবং ইশ্বরের নাম যেন উতখাত না করে। এখানে মুসা নবী ইসরাইলের জাতিকে সৎ পথে পরিচালনা করার জন্য বিভিন্ন আদেশ ও নিয়মনীতি প্রণয়ন করে (অধায় ১-২৮)। ড্যুটারনমি/নির্দেশনা-গ্রন্থ এর শেষভাগে মুসা নবী পর্বত থেকে প্রতিশ্রুত ভুমি দেখতে পান ও মারা যান। জীবনের শেষ ভাগে এসে মুসা নবী জশুয়া কে ইসরাইলের নেতৃত্ব প্রদান করেন যাতে তারা কানান দেশের অধিকারী হতে পারে (অধায় ২৯-৩৪)।
বসবাস
বর্তমানে বেশিরভাগ ইহুদিরা ইসরাইল রাষ্ট্রে( অবৈধ ভাবে দখলকৃত) বসবাস করছে। জাতিসংঘের বেশিরভাগ রাষ্ট্র এই দেশকে দখলদার রাষ্ট্র হিসাবে জানে। মুসলিম দেশ হিশাবে মিশর প্রথম এই রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেয়। তবে বেশিরভাগ মুসলিম দেশ ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয় নাই। ইসরাইল ফিলিস্তিনিদের দেশ দখল করে আজ তাদেরই উপর নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে।