সাহাবা

ইসলাম ধর্মে সাহাবী শব্দ (আরবি: الصحاب সহচর) দ্বারা মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সাথী বা সহচরদের নির্দেশ করে। এর বহুবচন শব্দ সাহাবা[1][2]

মুহাম্মাদ
বিষয়ের ধারাবাহিকের একটি অংশ
  • ইসলাম প্রবেশদ্বার
  • মুহাম্মাদ প্রবেশদ্বার

সংজ্ঞা

‘সাহাবী’ শব্দটি আরবী ভাষার ‘সুহবত’ শব্দের একটি রূপ। একবচনে ‘সাহেব’ ও ‘সাহাবী’ এবং বহুবচনে ‘সাহাব’ ব্যবহৃত হয়। আভিধানিক অর্থ সংগী, সাথী, সহচর, এক সাথে জীবন যাপনকারী অথবা সাহচর্যে অবস্থানকারী। ইসলামী পরিভাষায় ‘সাহাবা’ শব্দটি দ্বারা রাসূলুল্লাহর সা. মহান সংগী-সাথীদের বুঝায়। ‘সাহেব’ শব্দটির বহুবচনের আরো কয়েকটি রূপ আছে। তবে রাসূলুল্লাহর সা. সংগী-সাথীদের বুঝানোর জন্য ‘সাহেব’-এর বহুবচনে ‘সাহাবা’ ছাড়া ‘আসহাব’ ও ‘সাহব’ও ব্যবহৃত হয়ে থাকে।

আল্লামা ইবনে হাজার রাহ. ‘আল–ইসাবা ফী তাময়ীযিস সাহাবা’ গ্রন্থে সাহাবীর সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন: "সাহাবী সেই ব্যক্তি যিনি রাসূলুল্লাহর সা. প্রতি ঈমান সহকারে তাঁর সাক্ষাৎ লাভ করেছেন এবং ইসলামের ওপরই মৃত্যুবরণ করেছেন।"

সাহাবীর উল্লেখিত সংজ্ঞাটি ইমাম বুখারী, ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বলসহ অধিকাংশ পণ্ডিতের নিকট সর্বাধিক সঠিক বলে বিবেচিত। অবশ্য সাহাবীর সংজ্ঞার ক্ষেত্রে আরো কয়েকটি অপ্রসিদ্ধ মতামতও আছে। যেমন, কেউ কেউ সাক্ষাতের (আল-লিকা) স্থলে চোখে দেখার (রু’ইয়াত) শর্ত আরোপ করেছেন। কিন্তু তাতে এমন সব ব্যক্তি বাদ পড়ে যাবেন যাঁরা মুমিন হওয়া সত্ত্বেও অন্ধত্বের কারণে রাসূলুল্লাহকে সা. চোখে দেখার সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। যেমনঃ আবদুল্লাহ ইবন উম্মে মাকতুম রা.। অথচ তিনি অতি মর্যাদাবান সাহাবী ছিলেন।

হযরত সাঈদ ইবনুল মুসায়্যিব বলেনঃ

সাহাবী হওয়ার জন্য শর্ত হচ্ছে, এক বা দু’বছর রাসূলুল্লাহর সা. সাহচর্য অথবা তাঁর সাথে দু’একটি গাযওয়া বা যুদ্ধে অংশগ্রহণ। কিছু সংখ্যক উলামায়ে উসূল ও উলামায়ে ইলমুল কালাম-এর মতে, সাহাবী হওয়ার জন্য শর্ত হচ্ছে, রাসূলুল্লাহর সা. দীর্ঘ সাহচর্য ও সুন্নাতে নববীর সা. অনুসরণের ক্ষেত্রে তাঁর পরিচিতি ও খ্যাতি। কেউ কেউ আবার বয়ঃপ্রাপ্ত হওয়ার শর্ত আরোপ করেছেন। একদল আলিমের মতে যে ব্যক্তি বয়ঃপ্রাপ্ত হওয়ার পর এক নজর রাসূলুল্লাহকে সা. দেখেছেন, তিনি সাহাবী। আর যিনি বয়ঃপ্রাপ্ত হওয়ার পূর্বে রাসূলুল্লাহকে সা. দেখেছেন, তিনিও সাহাবী।

তবে এ হিসেবে যে, রাসূল সা. তাকে দেখেছেন। তিনি রাসূলকে সা. দেখেছেন সে হিসেবে নয়। কিন্তু হাদীস বর্ণনার দিক দিয়ে এমন ব্যক্তি সাহাবী নন, বরং তাবঈর মর্যাদা লাভ করবেন। প্রশ্ন হতে পারে, যদি কেউ রাসূলুল্লাহর সা. ইনতিকালের পর দাফনের পূর্বে তাকে দেখে থাকেন, যেমনটি ঘটেছিল প্রখ্যাত আরবী কবি ‘আবু জুয়ারিব আল-হুজালীর’ ক্ষেত্রে- তাঁর ব্যাপারে কি সিদ্ধান্ত হবে? আলিমদের মধ্যে এ ব্যাপারে মতবিরোধ আছে। তবে গ্রহণযোগ্য মত হলো, এমন ব্যক্তি সাহাবীদের দলভুক্ত হবেন না।

সাহাবীদের মর্যাদা

সাহাবীদের পরস্পরের মধ্যে মর্যাদা হিসেবে স্তরভেদ থাকতে পারে।

‘হাফেজ ইবন আবদিল বার’ সাহাবীদের মর্যাদা বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেনঃ রাসূলুল্লাহর সা. সুহবত ও তাঁর সুন্নাতের হিফাজত ও ইশায়াতের দুর্লভ মর্যাদা আল্লাহ তা’আলা এইসব মহান ব্যক্তির ভাগ্যে লিখে রেখেছিলেন। এ কারণেই তাঁরা ‘খায়রুল কুরুন’ ও খায়রু উম্মাতিন’ এর মর্যাদার অধিকারী হয়েছেন।

হাফেজ আবু বকর ইবন খতীব আল-বাগদাদী বলেনঃ ‘‘উল্লেখিত ভাব ও বিষয়ের হাদীস ও আখবারের সংখ্যা অনেক এবং         সবই ‘নাসসুল কুরআনের’ ভাবের সাথে সংগতিপূর্ণ। অর্থাৎ তাতে সাহাবীদের সুমহান মর্যাদা, আদালাত, পবিত্রতা ইত্যাদি ভাব ব্যক্ত হয়েছে। আল্লাহ ও রাসূল কর্তৃক তাদের আদালাতের ঘোষণা দানের পর পৃথিবীর আর কোন মানুষের সনদের মুখোপেক্ষী তাঁরা নন। আল্লাহ ও রাসূল সা. তাঁদের সম্পর্কে কোন ঘোষণা না দিলেও তাঁদের হিজরাত, জিহাদ, সাহায্য, আল্লাহর রাহে ধন-সম্পদ ব্যয়, পিতা ও সন্তানদের হত্যা, দ্বীনের ব্যাপারে উপদেশ, ঈমান ও ইয়াকীনের দৃঢ়তা ইত্যাদি কর্মকাণ্ড এ কথা প্রমাণ করতো যে, আদালাত, বিশ্বাস, পবিত্রতা ইত্যাদি ক্ষেত্রে কিয়ামত পর্যন্ত পৃথিবীতে যত ন্যায়পরায়ণ ও পবিত্র ব্যক্তিই জন্মগ্রহণ করুন না কেন, তাঁরা ছিলেন সকলের থেকে উত্তম।’’

কোন কোন সাহাবীর জীবদ্দশায় রাসূল সা. তাদেরকে জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছেন। তবে মুসলিম পণ্ডিতদের অনেকে সাহাবীদের সকলেই জান্নাতী বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন। ইবনে হাজার ‘আল–ইসাবা’ গ্রন্থে স্পেনের ইমাম ইবন হাযামের মন্তব্য উদ্ধৃত করেছেন। তিনি বলেনঃ ‘আস-সাহাবাতু কুল্লুহুম মিন আহলিল জান্নাতী কাতআন- সাহাবীদের সকলেই নিশ্চিতভাবে জান্নাতী।’

রাসূল সা. তার সাহাবীদের গালি দেওয়া বা হেয় প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যে সমালোচনা করতে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেছেনঃ ‘‘আল্লাহ, আল্লাহ! আমার পরে তোমরা তাদেরকে সমালোচনার লক্ষ্যে পরিণত করো না। তাদেরকে যারা ভালোবাসে, আমার মুহাব্বতের খাতিরেই তারা ভালোবাসে, আর যারা তাদেরকে হিংসা করে, আমার প্রতি হিংসার কারণেই তারা তা করে।’’

পবিত্র কুরআনের একাধিক আয়াত ও অসংখ্য হাদীসে সাহাবীদের মর্যাদা ও ফজীলত বর্ণিত হয়েছে।

‘‘মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল; তার সহচরগণ, কাফিরদের প্রতি কঠোর এবং নিজেদের পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল। আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি কামনায় তুমি তাদেরকে রুকু ও সিজদায় অবনত দেখবে। তাদের মুখমণ্ডলে সিজদার চিহ্ন থাকবে, তাওরাতে তাদের বর্ণনা এরূপই এবং ইন্‌জীলেও।’’ (সূরা আল–ফাতহঃ ২৯)[3]

‘‘মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে যারা প্রথম অগ্রগামী এবং যারা নিষ্ঠার সাথে তাদের অনুসরণ করে, আল্লাহ তাদের প্রতি প্রসন্ন এবং তারাও তাতে সন্তুষ্ট এবং তিনি তাদের জন্য প্রস্তুত করেছেন জান্নাত, যার নিম্নদেশে নদী প্রবাহিত, যেখোনে তারা চিরস্থায়ী হবে। এটা মহা কামিয়াবী।’’ (সূরা আত–তাওবাঃ১০০)

‘‘এ সম্পদ অভাবগ্রস্ত মুহাজিরদের জন্য যারা নিজেদের ঘরবাড়ী ও সম্পত্তি হতে উৎখাত হয়েছে। তারা আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি কামনা করে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাহায্য করে। তারাই তো সত্যাশ্রয়ী। মুহাজিরদের আগমনের পূর্বে যারা এই নগরীতে (মদীনা) বসবাস করেছে ও ঈমান এনেছে তারা মুহাজিরদের ভালোবাসে এবং মুহাজিরদের যা দেওয়া হয়েছে তার জন্য তারা অন্তরে আকাঙ্ক্ষা পোষণ করে না, আর তারা তাদেরকে নিজেদের ওপর প্রাধান্য দেয় নিজেরা অভাবগ্রস্ত হলেও।’’ (সূরাআল–হাশরঃ ৮–৯)

 এ আয়াতে প্রথম মুহাজির ও পরে আনসারদের প্রশংসা করা হয়েছে।

এমনিভাবে সূরা আল ফাত্‌হঃ ১৮, সূরা আল ওয়াকিয়াঃ ১০, এবং সূরা আল আনফালের ৬৪ নাম্বারআয়াতসহ বিভিন্ন আয়াতে কোথাও প্রত্যক্ষ আবার কোথাও পরোক্ষভাবে সাহাবায়ে কিরামের প্রশংসা এসেছে।

অনুরূপভাবে রাসূলুল্লাহ সা. নিজেও তাঁর সাহাবীদের শানে বক্তব্য রেখেছেন। তাঁদের সম্মান, মর্যাদা ও স্থান নির্ধারণ করে ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। যেমন হযরত আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেনঃ

‘‘আমার উম্মাতের মধ্যে সর্বোত্তম লোক হচ্ছে আমার যুগের লোকেরা। তারপর তার পরের যুগের লোকেরা, তারপর তার পরের যুগের লোকেরা। তারপর এমন একদল লোকের আবির্ভাব হবে যাদের কসম হবে তাদের সাক্ষ্যের অগ্রগামী। তাদের কাছে সাক্ষী চাওয়ার আগেই তারা সাক্ষ্য দেবে।’’

‘‘তোমরা আমার সাহাবীদের গালি দেবেনা, কসম সেই সত্তার যাঁর হাতে আমার জীবন, তোমাদের কেউ যদি উহুদ পাহাড় পরিমাণ সোনাও ব্যয় করো তবুও তাদের যে কোন একজনের ‘মূদ’ বা তার অর্ধেক পরিমাণ যবের সমতুল্য হবে না।’’

রাসূলুল্লাহ সা. থেকে ইবন আব্বাস রা. বর্ণনা করেছেনঃ

‘‘তোমাদেরকে আল্লাহর কিতাবের যা কিছু দেওয়া হয়েছে, তার ওপর আমল করতে হবে। তা তরক করা সম্পর্কে তোমাদের কারো কোন ওজর-আপত্তি গ্রহণযোগ্য হবে না। যদি আল্লাহর কিতাবে কোন সিদ্ধান্ত না পাওয়া যায় তাহলে আমার সুন্নাতে খোঁজ করতে থাক। যদি তাতেও না পাওয়া যায় তাহলে আমার সাহাবীদের কথায় তালাশ করতে হবে। আমার সাহাবীরা আকাশের তারকা সদৃশ। তার কোন একটিকে তোমরা গ্রহণ করলে সঠিক পথ পাবে। আর আমার সাহাবীদের পারস্পরিক ইখতিলাফ বা মতপার্থক্য তোমাদের জন্য রহমত স্বরূপ।’’

সাঈদ ইবনুল মুসায়্যিব উমার ইবনুল খাত্তাব রা. থেকে বর্ণনা করেছেন। রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেনঃ

‘‘আমার পরে আমার সাহাবীদের পারস্পরিক মতপার্থক্য সম্পর্কে আমার ‘রব’- প্রভুকে জিজ্ঞেস করলাম। আল্লাহ আমার কাছে ওহী পাঠালেনঃ হে মুহাম্মাদ, তোমার সাহাবীরা আমার কাছে আকাশের তারকা সদৃশ। তারকার মত তারাও একটি থেকে অন্যটি উজ্জ্বলতর। তাদের বিতর্কিত বিষয়ের কোন একটিকে যে আঁকড়ে থাকবে, আমার কাছে সে হবে হিদায়াতের ওপরে।’’

ইমাম শাফঈ হযরত আনাস ইবন মালিকের সনদে একটি হাদীস বর্ণনা করেছেন। রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেনঃ আল্লাহ আমাকে ও আমার সাহাবীদেরকে মনোনীত করেছেন। তাদের সাথে আমার বৈবাহিক সম্পর্ক কায়েম করে দিয়েছেন এবং তাদেরকে আমার আনসার বানিয়ে দিয়েছেন। শেষ যামানায় এমন একদল লোকের আবির্ভাব হবে যারা তাদের অবমাননা করবে। সাবধান, তোমরা তাদের ছেলে-মেয়ে বিয়ে করবে না তাদের কাছে ছেলে-মেয়ে বিয়েও দেবে না। সাবধান, তাদের সাথে নামায পড়বে না, তাদের জানাযাও পড়বে না। তাদের ওপর আল্লাহর লা’নত।

মিশকাত শরীফে একটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে। রাসূল সা. বলেছেনঃ আমার উম্মাতের মধ্যে একটি ফিরকাই নিশ্চিত জান্নাতী হবে। জিজ্ঞেস করা হলো, তারা কে? বললেনঃ যারা আমার ও আমার সাহাবীদের আদর্শের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে।

অন্য একটি হাদীসে রাসূল সা. বলেছেনঃ ‘আমার উম্মাতের মধ্যে সাহাবীদের স্থান তেমন, যেমন খাবারের মধ্যে লবণের স্থান।’

সাহাবীদের সংখ্যা

সাহাবীদের সংখ্যা যে কত তা সঠিকভাবে নির্ণয় করা যায় না। ইমাম আবু যারআ আর-রাযী বলেছেন, রাসূল সা. যখন ইনতিকাল করেন, তখন যারা তাকে দেখেছেন এবং তার কথা শুনেছেন এমন লোকের সংখ্যা নারী-পুরুষ মিলে এক লাখেরও ওপরে। তাদের প্রত্যেকেই রাসূলুল্লাহর সা. হাদীস বর্ণনা করেছেন। তাহলে যে সকল সাহাবী কোন হাদীস বর্ণনা করেননি তাদের সংখ্যা যে কত বিপুল তা সহজেই অনুমেয়। আবু যারআর একথার সমর্থন পাওয়া যায় বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত হযরত কা’ব ইবন মালিকের একটি বক্তব্য দ্বারা। তিনি তাবুক অভিযান বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেছেন,

‘‘মানুষের সংখ্যা অনেক। কোন দফতর বা দিওয়ান তা গণনা করতে পারবে না।’’

তথ্যসূত্র

  1. "Sahaba" (ইংরেজি ভাষায়)। livingislam.org।
  2. "Sharh al-`Aqeedah at-Tahaawiyyah", by Ahmad ibn Muhammad al-Tahawi, p.526-528 (ইংরেজি ভাষায়)
  3. [কুরআন 48:29]

আর দেখুন

This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.