হায়া (ইসলাম)
হায়া (আরবি: هيا, বাংলা: শালীনতা, শিষ্টাচার, আত্মসংযম, লাজুকতা, আত্মসম্মান, অস্বস্তিবোধ, লজ্জাশীলতা, সম্মান, শ্লীলতা, সংকোচ, দ্বিধা) হল একটি আরবি শব্দ যার অর্থ হল "প্রাকৃতিক বা অন্তর্নিহিত লাজুকতা বা শালীনতাবোধ"[1], শব্দটি প্রধানত ইসলামে শালীনতা বা ইসলামী পরিভাষায় শালীনতাবোধ বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। ইসলামে, হায়া হল একটি গুণ যা মুসলিমদেরকে কুরুচিপূর্ণ বা ঘৃণ্য যে কোন কিছুকে এড়িয়ে চলার পথে পরিচালনা করে।[2][3][4][5][6]
উসুল আল ফিকহ |
---|
ফিকহ |
আহকাম |
ধর্মতত্ত্বীয় উপাধি |
|
শব্দতত্ত্ব
হায়া শব্দটি মূল আরবি শব্দ হায়াত হতে উৎসারিত, যার অর্থ জীবন। শব্দটির ব্যাপক অর্থ হল একটি খারাপ বা অস্বস্তিকর অনুভূতি যা লজ্জা বোধের সঙ্গে সম্পর্কিত,যার কারণ কোন অযোগ্য বা শিষ্টাচার-বহির্ভূত আচরণ"। আরবিতে হায়ার বিপরীতার্থক শব্দ হল বাযা (بذاءة, অশ্লীলতা) বা ফাহাশ (فاحشة, বেহায়াপনা বা লাম্পট্য)।
ধর্মীয় পাণ্ডুলিপিতে হায়া
কুরআন
কুরআনে হায়া শব্দটি দুইবার উল্লেখ করা হলেও তা সরাসরি কোথাও নির্দেশিত হয় নি:
আল্লাহ পাক নিঃসন্দেহে মশা বা তদুর্ধ্ব বস্তু দ্বারা উপমা পেশ করতে হায়া(লজ্জা)বোধ করেন না। বস্তুতঃ যারা মুমিন তারা নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করে যে, তাদের পালনকর্তা কর্তৃক উপস্থাপিত এ উপমা সম্পূর্ণ নির্ভূল ও সঠিক। আর যারা কাফের তারা বলে, এরূপ উপমা উপস্থাপনে আল্লাহর মতলবই বা কি ছিল। এ দ্বারা আল্লাহ তা’আলা অনেককে বিপথগামী করেন, আবার অনেককে সঠিক পথও প্রদর্শন করেন। তিনি অনুরূপ উপমা দ্বারা অসৎ ব্যক্তিবর্গ ভিন্ন কাকেও বিপথগামী করেন না।
— আল-বাকারা ২:২৬
অতঃপর বালিকাদ্বয়ের একজন হায়া(লজ্জা)-জড়িত পদক্ষেপে তাঁর কাছে আগমন করল। বলল, আমার পিতা আপনাকে ডাকছেন, যাতে আপনি যে আমাদেরকে পানি পান করিয়েছেন, তার বিনিময়ে পুরস্কার প্রদান করেন। অতঃপর মূসা যখন তাঁর কাছে গেলেন এবং সমস্ত বৃত্তান্ত বর্ণনা করলেন, তখন তিনি বললেন, ভয় করো না, তুমি জালেম সম্প্রদায়ের কবল থেকে রক্ষা পেয়েছ।
— আল-কাসাস ২৮:২৪
হাদিস
হাদিসের অনুচ্ছেদসমূহে প্রায়শই হায়া শব্দটি উল্লেখ করা হয়েছে, যেখানে শব্দটি লাজুকতা, শালীনতা ও শিষ্টাচার বোঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে।[1][2][3][4][5][6]
আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ঈমানের ষাটেরও অধিক শাখা আছে। আর লজ্জা হচ্ছে ঈমানের একটি শাখা।
— সহীহ বুখারীঃ ০৮/০৯, (মুসলিম ১/১২ হাঃ ৩৫, আহমাদ ৯৩৭২) (আধুনিক প্রকাশনীঃ ৮, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৮)
আবদুল্লাহ ইবনু ইউসুফ (রহঃ) ... আবদুল্লাহ ইবনু উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, একদিন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক আনসারীর পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি তাঁর ভাইকে তখন (অধিক) লজ্জা ত্যাগের জন্য নসীহত করছিলেন অর্থাৎ এ সময় লোকটি (তার ভাইকে) লজ্জা সম্পর্কে ভৎর্সনা করছিল এবং বলছিল যে, তুমি অধিক লজ্জা করছ, এমনকি সে যেন এ কথাও বলছিল যে, এটা তোমাকে ক্ষতির সম্মুখীন করেছে।। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেনঃ তুমি তাকে তার অবস্থার উপর ছেড়ে দাও। কারণ নিশ্চয়ই হায়া (লজ্জা) ঈমানের অঙ্গ। আরেক বর্ননায় তিনি বলেন: হায়া (লজ্জাশীলতা) কল্যাণ ছাড়া কোন কিছুই নিয়ে আনে না।
— বুখারীঃ ২৩, ৫৬৮৭, ৬১১৮
আবূ কুরায়ব (রহঃ) ... আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ হায়া (লজ্জা) ঈমানের অঙ্গ; ঈমানের স্থান হল জান্নাতে। অশ্লীলতা হল অবাধ্যতা ও অন্যায়াচারের/অত্যাচারের (জুলুমের) অঙ্গ; অন্যায়াচারণের/অত্যাচারের (জুলুমের) স্থান হল জাহান্নামে।
— সহীহ, সহীহাহ ৪৯৫, রাওযুন নাযীর ৭৪৬, তিরমিজী হাদিস নম্বরঃ ২০০৯, ২০১৫
আহমাদ ইবন মানী‘ (রহঃ) ..... আবূ উমামা রাদিয়াল্লাহু আনহু সূত্রে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেনঃ হায়া (লজ্জাশীলতা) এবং রুদ্ধবাক হওয়া ঈমানের দু’টি শাখা। অশ্লীলতা (লজ্জাহীনতা) ও বাক্যবাগিশ হওয়া মুনাফেকীর দু’টি শাখা।
— ঈমান ইবনু আবী শাইবা ১১৮, মিশকাত, তাহকীক ছানী ৪৭৯৬, তিরমিজী হাদিস নম্বরঃ ২০২৭
আহমদ ইবনু ইউনুস (রহঃ) ... আবূ মাসউদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ পুর্বেকার নাবীদের কর্তব্য থেকে মানুষ যা বর্জন করেছে তার একটি হল, যদি তুমি হায়াই (লজ্জাই) ছেড়ে দাও তবে তুমি যা চাও তা কর।
— বুখারী, ৫৬৯০
আলী ইবনু জায়দ (রহঃ) ... আবূ সাঈদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ গৃহে অবস্থানরত কুমারী মেয়েদের চেয়েও বেশী হায়াবান (লাজুক) ছিলেন।
— বুখারী ২৫১০, ৫৬৮৯)
মুহাম্মদ ইবন আবদুল আ‘লা সানআনী প্রমুখ (রহঃ) ... আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, অশ্লীলতা কোন বস্তর কেবল ক্লেদ বৃদ্ধিই করে আর হায়া (লজ্জা) কোন জিনিষের কেবল শ্রী বৃদ্ধি ঘটায়।
— ইবনু মাজাহ ৪১৮৫, তিরমিজী হাদিস নম্বরঃ ১৯৭৪
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ "প্রতিটি ধর্মের একটি প্রাকৃতিক চরিত্র রয়েছে। ইসলামের প্রাকৃতিক চরিত্র হল হায়া (লজ্জা)" অথবা "প্রত্যেক দীনের বা ধর্মের একটি প্রাকৃতিক চরিত্র রয়েছে। ইসলামের চরিত্র শালীনতা (হায়া)।"
— (আবু দাউদ, আল-মুয়াত্তা)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ আমি তোমাদেরকে মহান আল্লাহর প্রতি লাজুক হওয়ার উপদেশ দিচ্ছি, যেভাবে তোমরা তোমাদের সম্প্রদায়ের একজন ধার্মিক ব্যক্তিকে দেখে লজ্জা পাও।
— আবু দাউদ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ "আল্লাহ অন্যান্য লোকের চেয়ে তোমাদের হায়া (লজ্জা) লাভ করার অধিক হকদার।"
— আবু দাউদ
' আল্লাহ পরাক্রমশালী এবং মহিমান্বিত, সহনশীল, লাজুক এবং গোপন্কারী। তিনি লাজুকতা এবং গোপনীয়তা ভালবাসেন।'"
— Sunan an-Nasa'i Vol. 1:406
আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রাঃ) বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ "হায়া ও ইমান একে অপরের সঙ্গী। যখন তাদের মধ্যে একজনকে তুলে নেওয়া হয়, তখন অন্যটিও চলে যায়।"
— (বায়হাকি)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ "এই পৃথিবী থেকে হায়া এবং বিশ্বস্ততা সর্বপ্রথম উঠে যাবে, অতএব, আল্লাহর কাছে এগুলো বেশি বেশি চাইতে থাকো।"
— (বায়হাকি)
গুরুত্ব
হায়া ইসলামে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, কেননা এটি ইমানের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর মাঝে অন্যতম।
তথ্যসূত্র
- "The Islamic Dress Code (part 2 of 3): Awrah & Mahrams - New Muslims"। www.newmuslims.com। সংগ্রহের তারিখ ৬ ডিসেম্বর ২০১৮।
- "Haya (Shyness)"। missionislam.com। missionislam.com। সংগ্রহের তারিখ ৬ ডিসেম্বর ২০১৮।
- "Haya in Islam: Cultivating Modesty in an Immoral World"। muslimink.com। সংগ্রহের তারিখ ৬ ডিসেম্বর ২০১৮।
- "Modesty (part 1 of 3): An Overview"। islamreligion.com। সংগ্রহের তারিখ ৬ ডিসেম্বর ২০১৮।
- "Modesty (part 1 of 3): An Overview"। islamreligion.com। সংগ্রহের তারিখ ৬ ডিসেম্বর ২০১৮।
- "Haya (Shyness)"। www.islamicbulletin.org। সংগ্রহের তারিখ ৬ ডিসেম্বর ২০১৮।