বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ[lower-alpha 1] হল ১৯৭১ সালে সংগঠিত দক্ষিণ এশিয়ার একটি বৈপ্লবিক স্বাধীনতা সংগ্রাম যা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করে।[3] স্বাধীনতা সংগ্রামটি ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের এবং যুদ্ধটি নয় মাস স্থায়ী হয়েছিল। যুদ্ধটির মাধ্যমে বিশ্ব বিশাল এক নির্মমতার স্বাক্ষী হয়, প্রায় এক কোটি মানুষ দেশত্যাগে বাধ্য হন এবং প্রায় ত্রিশ লক্ষ মানুষ শহীদ হন।[4]
২৬শে মার্চ ১৯৭১ সালে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে, যখন পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাঙালি বেসামরিক জনতা, শিক্ষার্থী, বুদ্ধিজীবী এবং সামরিক বাহিনীতে কর্মরত লোকজনের উপর অপারেশন সার্চলাইট নামে একটি সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে নৃশংসতা চালায়, যারা পাকিস্তানী সামরিক জান্তাকে ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের ১ম গণতান্ত্রিক নির্বাচনকে মেনে নিতে দাবি জানায়, যেখানে পূর্বাঞ্চলীয় দল জয়ী হয়েছে, বা পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তানকে আলাদা হিসেবে মেনে নিতে স্বীকৃতি জানায়।
বাঙ্গালী রাজনীতিবিদ এবং সেনাবাহিনীর অফিসার অপারেশন সার্চলাইটের জবাব হিসেবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। বাঙ্গালী সামরিক বাহিনীর সদস্য, আধাসামরিক এবং সাধারণ জনতা মিলে মুক্তিবাহিনী গঠন করে, যারা পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনা করে। পাকিস্তানী সেনাবাহিনী, ধর্মীয় মৌলবাদী[5][6] লোকের (রাজাকার, আল বদর এবং আল শামস) মদদে, পর্যায়ক্রমিক গণহত্যা এবং বাঙ্গালী বেসামরিক নাগরিকদের উপর নৃশংসতায় ঝাঁপিয়ে পরে, বিশেষ করে জাতীয়তাবাদী, বুদ্ধিজীবী, তরুণ এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর। [7][8][9][10][11] ভারতের রাজ্য পশ্চিম বঙ্গের কলকাতায় বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার গঠন করা হয়।
ভারত ৩রা ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে যুদ্ধে জড়িয়ে পরে, যখন পাকিস্তান ভারতের উত্তরাঞ্চলে বিমান আক্রমণ চালায়। দ্বি যুদ্ধ রণক্ষেত্রে আচ্ছন্ন হয়ে, পাকিস্তানী প্রতিরক্ষা শীঘ্রই ভেঙ্গে পড়ে। ১৬ই ডিসেম্বর, বাংলাদেশ এবং ভারতের মিত্র বাহিনী পাকিস্তানকে পরাজিত করে। ফলে এই আত্মসমর্পণ দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর সবচেয়ে বেশি সংখ্যক যুদ্ধবন্দীর সাক্ষী হয়।
বিদেশী প্রতিক্রিয়া
জাতিসংঘ
জাতিসংঘ যদিও অপারেশন সার্চলাইট এর সময় এবং এর পরবর্তী সময়ে মানবাধিকার লঙ্গনের জন্য নিন্দা প্রস্তাব আনে, তবুও তারা যুদ্ধ সংগঠিত হওয়ার পূর্বে রাজনৈতিকভাবে পদক্ষেপ নিতে অসমর্থ হয়েছিল।
১৯৭১ সালের মার্চে শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণার পর ভারত বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে বৈশ্বিক জনমত গড়ে তোলাতে রাজনৈতিক, গণতান্ত্রিক এবং মানবিক সাহায্যের জন্য বিশ্বব্যাপী প্রচারণা শুরু করে। বাঙালীদের উপর পাকিস্তানিদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে জনসচেতনতা গড়ে তুলতে ভারতের প্রধান মন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সফর করেন। যুদ্ধের দিকে বৈশ্বিক দৃষ্টি আকর্ষণ এবং ভারতের পক্ষে সামরিক কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণ, যুদ্ধের পরে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে প্রমাণিত হয়।[12] এমনকি, পাকিস্তানের পরাজয়ের পর, সদ্য স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশের স্বীকৃতিতে তৎক্ষণাৎ ভূমিকা রাখে।
যুদ্ধে ভারতের অংশগ্রহণে, পাকিস্তান নিশ্চিত পরাজয় দেখতে পায়, এবং জাতি সংঘের কাছে মধ্যস্ততার সুপারিশ করে এবং ভারতকে যুদ্ধবিরতিতে যেতে চাপ দেয়। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ, ৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে দক্ষিণ এশিয়ার যুদ্ধবিগ্রহ বিষয়ে আলোচনায় বসে। দীর্ঘ আলোচনার পর ৭ ডিসেম্বর, জাতিসংঘ "তাৎক্ষণিক যুদ্ধ-বিরতি এবং সেনা প্রত্যাহার" অধ্যাদেশ জারি করে। যখন সংখ্যাগরিষ্ঠরা সমর্থন জানায়, তখন সোভিয়েত ইউনিয়ন এই অধ্যাদেশে দুইবার ভেটো দেয় এবং যুক্তরাজ্য এবং ফ্রান্স এই অধ্যাদেশ থেকে বিরত থাকে।
১২ই ডিসেম্বর, পাকিস্তান আসন্ন পরাজয় দেখে, নিরাপত্তা পরিষদকে পুনরায় উত্থাপন করতে জাতিসংঘের কাছে অনুরোধ জানায়। পাকিস্তানের ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী এবং বৈদেশিক মন্ত্রী, জুলফিকার আলী ভুট্টো, যুদ্ধ-বিরতির জন্য অধ্যাদেশ জারি করাতে নিউ ইয়র্ক সিটির দিকে দ্রুত অগ্রসর হন। পরিষদে চারদিন বিচারবিবেচনা চলে। এরই মধ্যে প্রস্তাবটি চূড়ান্ত হয়ে যায়, পূর্ব পাকিস্তানে সশস্ত্র বাহিনীকে আত্মসমর্পণ করে যুদ্ধ বিগ্রহ বন্ধ করতে হয়, এবং পদক্ষেপটি নিছক একাডেমিক রয়ে যায়। অধ্যাদেশে ব্যর্থতার জন্য ভুট্টো, হতাশ হয়ে পড়েন এবং জাতিসংঘের নিষ্ক্রিয়তার জন্য, তার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসে এবং পরিষদ ত্যাগ করেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার এক মাসের মধ্যে বেশিরভাগ জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্র বাংলাদেশকে তৎক্ষণাৎ স্বীকৃতি দেয়।[12]
ভুটান
১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর বিশ্বে ভুটানই সর্বপ্রথম সদ্য স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে (ভারত দ্বিতীয়)। ১৯৭৪ সালের জুনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান ভুটানের চতুর্থ রাজা জিগমে সিংয়ে ওয়াংচুক-এর রাজ্যাভিষেকে যোগ দেয়ার জন্য ভুটান সফর করেছিলেন।[13][14][15][16]
যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন
.jpg)


যুক্তরাষ্ট্র রাজনৈতিক এবং সামরিক উভয় দিক থেকে পাকিস্তানকে[17] সহায়তা প্রদান করে। যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি রিচার্ড নিক্সন তখনকার অবস্থাকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবে অভিহিত করে সে অবস্থায় হস্তক্ষেপ করতে অস্বীকৃতি জানায়। কিন্তু পাকিস্তানের নিশ্চিত পরাজয় বুঝতে পেরে নিক্সন বঙ্গোপসাগরে[18] যুদ্ধবিমান বাহিত ইউএসএস এন্টারপ্রাইজ প্রেরণ করেন। যুদ্ধবিমানবাহী জাহাজটি ১৯৭১ সালের ১১ ডিসেম্বর তাদের গন্তব্যে এসে পৌঁছায়।
বাংলাদেশকে কমনওয়েলথ ভুক্তদেশের স্বীকৃতি
বাংলাদেশ ১৯৭২ সালে কমনওয়েলথ অব নেশনস-এর সদস্যপদ গ্রহণ করে। একারণে (বাংলাদেশের স্বীকৃতি বিষয়ে) ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারী পাকিস্তান কমনওয়েলথের সদস্যপদ ত্যাগ করে। পরে অবশ্য, ১৯৭৫ সালে পাকিস্তান পুনরায় সদস্যপদ গ্রহণ করে। পাকিস্তান ১৯৭৪ সালের ২২ ফেব্রুয়ারী বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়। যদিও পাকিস্তান বাংলাদেশে দূতাবাস খুলে ১৯৭৬ সালে।[19]
সর্বপ্রথম বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানকারী দেশসমূহের তালিকা
দেশ[20] | স্বীকৃতিদানের তারিখ | |
---|---|---|
১ | ![]() | ৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ [21] |
২ | ![]() | ৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ |
৩ | ![]() | ১২ জানুয়ারি ১৯৭২ |
৪ | ![]() | ১২ জানুয়ারি ১৯৭২ |
৫ | ![]() | ১৩ জানুয়ারি ১৯৭২ |
৬ | ![]() | ১৬ জানুয়ারি ১৯৭২ |
৭ | ![]() | ২০ জানুয়ারি ১৯৭২ |
৮ | ![]() | ২২ জানুয়ারি ১৯৭২ |
৯ | ![]() | ২৫ জানুয়ারি ১৯৭২ |
১০ | ![]() | ২৬ জানুয়ারি ১৯৭২ |
১১ | ![]() | ২৬ জানুয়ারি ১৯৭২ |
১২ | ![]() | ২৬ জানুয়ারি ১৯৭২ |
১৩ | ![]() | ২৬ জানুয়ারি ১৯৭২ |
১৪ | ![]() | ২৬ জানুয়ারি ১৯৭২ |
১৫ | ![]() | ২৬ জানুয়ারি ১৯৭২ |
১৬ | ![]() | ২৬ জানুয়ারি ১৯৭২ |
১৭ | ![]() | ১ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ |
১৮ | ![]() | ৪ ফেব্রুয়ারী ১৯৭২ |
১৯ | ![]() | ৪ ফেব্রুয়ারী ১৯৭২ |
২০ | ![]() | ৪ ফেব্রুয়ারী ১৯৭২ |
২১ | ![]() | ৪ ফেব্রুয়ারী ১৯৭২ |
২২ | ![]() | ৪ ফেব্রুয়ারী ১৯৭২ |
২৩ | ![]() | ৪ ফেব্রুয়ারী ১৯৭২ |
২৪ | ![]() | ৪ ফেব্রুয়ারী ১৯৭২ |
২৫ | ![]() | ৪ ফেব্রুয়ারী ১৯৭২ |
২৬ | ![]() | ৮ ফেব্রুয়ারী ১৯৭২ |
২৭ | ![]() | ১১ ফেব্রুয়ারী ১৯৭২ |
২৮ | ![]() | ১১ ফেব্রুয়ারী ১৯৭২ |
২৯ | ![]() | ১১ ফেব্রুয়ারী ১৯৭২ |
৩০ | ![]() | ১১ ফেব্রুয়ারী ১৯৭২ |
৩১ | ![]() | ১২ ফেব্রুয়ারী ১৯৭২ |
৩২ | ![]() | ১৪ ফেব্রুয়ারী ১৯৭২ |
৩৩ | ![]() | ১৪ ফেব্রুয়ারী ১৯৭২ |
৩৪ | ![]() | ১৬ ফেব্রুয়ারী ১৯৭২ |
৩৫ | ![]() | ২০ ফেব্রুয়ারী ১৯৭২ |
পাদটীকা
তথ্যসূত্র
- বাংলাদেশের ঐতিহাসিক অভিধান, পৃষ্ঠা ২৮৯
- মস, পেটার (২০০৫)। সেকেন্ডারি সোশ্যাল স্টাডিজ ফর পাকিস্তান। করাচি: অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস। পৃষ্ঠা 93। আইএসবিএন 9780195977042। সংগ্রহের তারিখ ১০ জুন ২০১৩।
- Library of Congress
- en, Samuel; Paul Robert Bartrop, Steven L. Jacobs. Dictionary of Genocide: A-L. Volume 1: Greenwood. p. 34. আইএসবিএন ৯৭৮-০-৩১৩-৩২৯৬৭-৮.
- "Leading News Resource of Pakistan"। Daily Times। ১৭ মে ২০১০। সংগ্রহের তারিখ ১৮ জুলাই ২০১৩।
- "New Year 2013"। The Daily Star। সংগ্রহের তারিখ ১৮ জুলাই ২০১৩।
- Bangladesh Genocide Archive | Collaborators and War Criminals. Genocidebangladesh.org. Retrieved 12 July 2013.
- New York Times, 30 July 1971
- The Wall Street Journal, 27 July 1971.
- Daily Sangram, 15 September 1971
- "Letters To The Editor | We are mere throwaways?"। thedailystar.net। সংগ্রহের তারিখ ৫ অক্টোবর ২০১৪।
- "The Recognition Story"। Bangladesh Strategic and Development Forum। ২৫ জুলাই ২০১১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৭ আগস্ট ২০১১।
- "Constitution Issued: Rahman Resigns"। Altus, Oklahoma, USA: The Altus Times-Democrat, via Google News। Associated Press। ১১ জানুয়ারি ১৯৭২।
- "Bangladesh-Bhutan Relations"। Embassy of Bangladesh in Bhutan। ৬ জুলাই ২০১১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১০।
- Lal Babu Yadav (১৯৯৬)। Indo-Bhutan relations and China interventions। Anmol Publications Pvt. Ltd.। পৃষ্ঠা 198। আইএসবিএন 978-81-7488-218-9।
- Narendra Kr. Singh (২০০৩)। Encyclopaedia of Bangladesh। Anmol Publications Pvt. Ltd.। পৃষ্ঠা 151–56। আইএসবিএন 978-81-261-1390-3।
- "Nixon and Pakistan: An Unpopular Alliance"। Miami, Florida, USA: The Miami News, via Google News। Reuters। ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১।
- Scott, Paul (২১ ডিসেম্বর ১৯৭১)। "Naval 'Show of Force' By Nixon Meant as Blunt Warning to India"। Bangor Daily News। Google News।
- "কোন কোন দেশ বাংলাদেশকে কখন স্বীকৃতি দিয়েছে"। ইচ্ছে। সংগ্রহের তারিখ ২৩ জুলাই ২০১৮।
- "Recognition of Bangladesh in 1971: Accountability to History"। Center for Bangladesh Genocide Research। ২২ মার্চ ২০১৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১০ এপ্রিল ২০১৭।
- "Bhutan, not India, was first to recognize Bangladesh - Times of India"। The Times of India। সংগ্রহের তারিখ ২০১৭-০৩-২১।