কমলপুর যুদ্ধ

কমলপুর যুদ্ধঃ বাংলাদেশ সামরিক বাহিনী জন্যে পাকিস্তান সেনাবাহিনী এর বিপক্ষে সংঘটিত হওয়া অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ এর স্বাধীনতার জন্যে নির্ভীক ঝাঁপিয়ে পড়ার অনন্য দৃষ্টান্ত এই কমলপুর যুদ্ধ। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কমলপুরে একটি সামরিক ঘাঁটি গড়ে তোলে (বর্তমান জামালপুরের বক্সীগঞ্জ উপজেলা), জেড ফোর্সের ১ম ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ঘাঁটিটি দখলের জন্যে ৪বার সরাসরি (সেটপিস) ও ২০ এর অধিক খন্ড যুদ্ধ (হিট অ্যান্ড রান) সংঘটিত হয়েছিল। ১২ই জুন, ১৯৭১ ছিল শুরু দ্বিতীয়টি ৩১শে জুলাই, ১৯৭১ এবং শেষহয় ৪ঠা ডিসেম্বরের আক্রমণের মধ্যদিয়ে যখন পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাদের সৈন্য প্রত্যাহার করে জামালপুর হেডকোয়ার্টারে স্থানান্তরিত করে। পরবর্তীতে মুক্তিবাহিনীর অপর এক আক্রমণে পাকিস্তানি সৈন্যদলকে পরাস্তকরে জামালপুরকে স্বাধীন করে।

কমলপুর যুদ্ধ
মূল যুদ্ধ: বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ
তারিখজুলাই ৩১ - ডিসেম্বর ০৪, ১৯৭১
অবস্থানকমলপুর, ঢাকা
যুধ্যমান পক্ষ

বাংলাদেশ


মুক্তিবাহিনী

 পাকিস্তান


পাকিস্তান সেনাবাহিনী

রাজাকার
জড়িত ইউনিট
জেড ফোর্স ৯৩ ব্রিগেড
শক্তি
১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ৩১ বালুচ
হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতি
১৯৭ জন ২২০ জন

প্রেক্ষাপট

পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে এবং জামালপুর হয়ে ময়মনসিংহ সড়ক সংযোগে কমলপুর ছিল অন্যতম শক্ত সীমান্ত ফাঁড়ি। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ওয়ার ম্যাপে বৃহত্তর টাংগাইল এবং ময়মনসিংহের দায়িত্বে ছিল মেজর জেনারেল জামশেদের ৩৬ অ্যাডহক ডিভিশন। ১৮৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই এলাকাটিতে ২ টি রাস্তা ছিলো ঢাকার দিকে মুক্তিবাহিনীর অগ্রসর হওয়ার। একটি হালুয়াঘাট-ময়মনসিংহ হয়ে, অন্যটি কামালপুর-জামালপুর দিয়ে। এটি আটকানোর দায়িত্বে ছিলো ব্রিগেডিয়ার কাদিরের পাক আর্মির ৯৩ ব্রিগেড- যার দুটি রেজিমেন্ট যথাক্রমে : ৩৩ পান্জ্ঞাব এবং ৩১ বালুচ। ৩৩ পান্জ্ঞাব অবস্থান নিয়েছিলো হালুয়াঘাটে আর ৩১ বালুচ অবস্থান নিয়েছিলো কামালপুর, নকশী আর বারোমারিতে।
কামালপুরে ৩১ বালুচের সাথে ছিলো ইস্ট পাকিস্তান সিভিল আর্মড ফোর্স আর আর ১ প্লাটুন রাজাকার। কামালপুর বিওপি(বর্ডার আউট পোষ্ট) এর সিও ছিলো ক্যাপটেন আহসান মালিক। প্রচুর শক্তিশালী অস্ত্র আর গোলাবারুদের পাশাপাশি ৮১ মি.মি. ৩ টি মর্টার ছিলো কামালপুর বিওপিতে। [1] সেখানে ছিল গোলা-নিরোধী ছাদ বিশিষ্ট কংক্রিট বাংকার/পরিখা যেগুলি প্রতিটি গভীর নালার মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ ও সাহায্য বিনিময়ে সক্ষম, নিরাপত্তার বেষ্টনী হিসাবে ছিল স্ব-নিয়ন্ত্রিত ফাঁদ ও ভূমিবিস্ফোরক এবং অন্ধকারের সময় পাকিস্তানের সৈন্যরা একেবারে ভিতরের নিরাপদ স্তরে ঢুকে যেত। [2]

প্রস্তুতি

১৯৭১ সালের ৩১শে জুলাই দিবাগত রাত্রে (১লা অগাস্ট রাত) জিয়াউর রহমান এর নির্দেশ মোতাবেক মেজর মইনুল হোসেন এর নেতৃত্বে উত্তর ও পূর্ব দিক থেকে ডেল্টা এবং ব্রাভো শত্রুপক্ষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। মেজর মইন এতোদ্রুত এমন মিশনে রাজী ছিলেননা, তার মতে কামালপুরের মত যথেষ্ট শক্তিশালী পাকিস্তানী ঘাটিতে সেটপিস যুদ্ধের মাধ্যমে আক্রমন করার সক্ষমতা জেড ফোর্সের বা তার ব্যাটালিয়নের নেই।মেজর মইনের প্ল্যান ছিলো হিট অ্যান্ড রান গেরিলা পদ্ধতিতে পাকিস্তান ফোর্সকে দুর্বল এবং নাজেহাল করা। কিন্তু জিয়া সিদ্ধান্ত পাল্টালেন না যার মূল কারণ ছিল হাইকমান্ডের নির্দেশ এবং ঘাঁটিটির স্ট্রাটেজিক গুরুত্ব। মেজর মইনের ১ম বেংগল ব্যাটালিয়নে সৈন্য ছিলো সর্বসাকুল্যে ৮৫০ জন। জেড ফোর্সের ১ম সম্মুখ সমর কামালপুর অপারেশনে জিয়াউর রহমান নিজে উপস্থিত ছিলেন যুদ্ধ সমন্বয় করার জন্য।

যুদ্ধের বিবরণ

৩১ জুলাই রাত ৩:০০ এর দিকে জিয়া এবং মেজর মইন ১ম বেংগল ব্যাটালিয়ন নিয়ে পাকিস্তান আর্মির ঘাঁটি থেকে প্রায় ১১০০-১২০০ গজ দুরে অবস্থান নেন (সেদিনরাতে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিলো।)।

  • ক্যাপটেন মাহবুব শত্রু ঘাঁটির পেছনে অবস্থান নিলেন তার কোম্পানিসহ,
  • ক্যাপ্টেন হাফিজ ও ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন ৬০০ গজ ইনসাইড এনিমি লাইন অগ্রসর হয়ে পাটক্ষেতে অবস্থান নিলেন,
  • মেজর মইন তার ওয়ারলেস অপারেটর এবং ফ্লা: লে: লিয়াকত সহ পাটক্ষেতে অবস্থান নিলেন,
  • টিলায় মেজর জিয়া হাল্কা কামান ও হেভী মেশিনগান সহ অবস্থান নিলেন,
  • কাট অফ পার্টি হিসেবে একটি বাহিনী কামালপুর-বকশীগন্জ্ঞ সড়কে মাইন পুতে রেখে কামালপুর-শ্রীবর্দি জংশন এবং উঠানীপাড়ায় অবস্থান নেন যাতে বকশীগন্জ্ঞ থেকে হঠাৎ কোন পাকিস্তানী রিইনফোর্সমেন্ট ৩১ জুলাই রাতে কামালপুরে আসতে না পারে।

জিয়ার অবস্থান থেকে কামানের গোলা বর্ষনের মাধ্যমেই যুদ্ধ শুরু হয়। রাত সাড়ে ৩ টায় ক্যাপটেন সালাউদ্দিন মমতাজ তার ২ প্লাটুন সৈন্য নিয়ে শত্রুঘাঁটিতে ঢুকে পড়েন। এটি ছিল জেড ফোর্সের ১ম অপারেশন এবং সম্পূর্ণ নতুন সদস্য নিয়ে গঠিত বাহিনী অপেক্ষাকৃত ধীর হয়ে পড়ে গোলাগুলির বাস্তব শব্দে কিছুটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, পরিস্থিতি বিবেচনায় ক্যাপটেন সালাউদ্দিন মমতাজ অসামান্য নেতৃত্বের পরিচয় দেয়। সামনে থেকে দলকে এগিয়ে নিয়ে যায়, তার উচ্চ এবং উদ্দামী কন্ঠ জোয়ানদের মাঝে নিয়ে আসে গতি। উচ্চ কন্ঠে বলতে থাকেন,

আভি তক ওয়াক্ত হ্যায় , শালালোক সারেন্ডার করো , নেহিত জিন্দা নেহী ছোড়েঙ্গা

ইয়াইয়া খান এখন এমন বুলেট তৈরি করতে পারেনাই যা মমতাজকে ভেদ করবে

যদি মরতেই হয়, এক পাকসেনা সাথে নিয়ে যাও। বাংলার মাটিতে শহিদ হও

সালাউদ্দিন মমতাজের অসীম সাহসে আর তার মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচন্ড আক্রমনে পাকিস্তানীদের ১ম ডিফেন্স কর্ডন শেল প্রুফ বাংকারে ঢুকে পড়ে। এ সময় সালাউদ্দিন মমতাজ আরও সাহসী হয়ে উঠে ২০-২৫ জনকে নিয়ে বিওপির কমিউনিটি সেন্টারে ঢুকে পড়েন। আচমকা মেশিন গানের একটি গুলি থামিয়ে দেয় শহিদ বীরউত্তম ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজকে, বাংলার মাটিতে লুটিয়ে পড়েন শুধু দুর্ভাগ্য স্বাধীন বাংলার সূর্য দেখা হয়নি। সালাউদ্দিন মমতাজ নিহত হবার খবর জানতে পেরে মেজর মইন ওয়ারলেসে ক্যাপ্টেন মাহবুবকে কমান্ড করেন পেছন থেকে আক্রমনের জন্য। কিন্তু ক্যাপ্টেন মাহবুবের সাড়া না পেয়ে তিনি ঝোপ ঝাড় গাছের আড়াল থেকে খোলা জায়গায় চলে আসেন যাতে ওয়ারলেস ভালোভাবে কাজ করতে পারে। দুর্ভাগ্য- সাথে সাথেই একঝাক মেশিনগানের গুলি এসে তার ওয়ারলেস অপারেটর শহীদ হন।এ সময় তার ওয়ারলেস সেটটিও অকেজো হয়ে যায়। মেজর মইন হতভম্ব হয়ে এসময় চিৎকার করে নির্দেশ দিতে থাকেন। খুব দ্রুত ভোরের আলো ফুটে ওঠে। এসময় তারা দেখতে পান চারদিকে হতাহতের ছড়াছড়ি। ক্যাপটেন হাফিজ আহত হয়ে মাটিতে পড়ে আছেন। লে: মান্নানও আহত হয়েছিলেন।জিয়া এসময় উদ্ধারকাজে যোগ দেন। গোলাগুলি চলা অবস্থাতেই জিয়া, মইন, লিয়াকতরা মিলে হাফিজ, মান্নান সহ অন্য আহত যোদ্ধাদের উদ্ধার করে পিছু হটেন।
অন্যদিকে ২ টি ১২০ মি. মি. মর্টার আর বেশকিছু সেনা সহ বকশীগন্জ্ঞ থেকে কামালপুরের দিকে আসতে থাকা ৩ টি লরী উড়ে যায় কাট অফ পার্টির পুতে রাখা মাইনে। তাদের অ্যামবুশে ১০ জন পাকসেনা নিহত এবং ১০-১১ জন আহত হয়। ১ মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন, ২/৩ জন আহত হন।

ফলাফল

যুদ্ধোত্তর বিশ্লেষণে মুলত ৪টি কারণ প্রতীয়মান হয় পরাজয়ের কারণ হিসাবেঃ

  1. ২৮ জুলাই সন্ধ্যায় রেকী করার সময় ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজ, লে: মান্নান, সুবেদার আবদুল হাই, সুবেদার হাশেম, নায়েক শফি ভুলে কামালপুর বিওপির অবজার্ভেশন পোস্টে ঢুকে পড়েন এবং ২ জন পাকিস্তানী সেনার সামনে পড়ে যান। ২ জনকেই মেরে ফেললেও সেটাই বিপদ বাড়িয়ে দেয়। ৩১ বালুচ সতর্ক হয়ে যায়। এর জের ধরে ২৯ জুলাই স্বয়ং লে: জে: নিয়াজী কামালপুরে আসেন। বলাই বাহুল্য এর ফলে তারা সেনাসংখ্যা এবং গোলাবারুদ প্রচুর বাড়িয়েছিলো যা যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মেজর মইন তীব্রভাবে টের পান।
  2. ভারতীয় সেনাবাহিনী যে ওয়ারলেস সেট গুলো দিয়েছিলো জেড ফোর্সকে সেগুলো নিম্নমানের এবং ত্রুটিপূর্ন ছিলো বলে মেজর মইন জেনারেল মানেকশ কে অভিযোগ করেছিলেন। মেজর মইনের মতে ক্যাপ্টেন মাহবুবকে সময় মত ওয়ারলেসে কমান্ড করতে পারলে ক্ষয়ক্ষতি অনেক কম হতো এবং শত্রুপক্ষের ক্যাসুয়ালটি আরো বেশী হতো। অতি দরকারের সময় ওয়ারলেস কাজ না করা ছিলো খাঁড়ার উপর মড়ার ঘা।
  3. যুদ্ধের সেই সময়টায় মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিলো এবং আগের কয়েকদিন বৃষ্টি হওয়ায় পাটক্ষেতে ১ ফুট পানি জমে গিয়েছিলো। এ ধরনের যুদ্ধে ক্রলিং এবং কুইক মুভের যে প্রয়োজন হয় তার বিপরীতে এই ব্যাপারটাকে "ক্রুশাল লুজিং ফ্যাক্টর" হিসেবে বিবেচনা করেছেন মেজর মইন।
  4. কামালপুর যুদ্ধে ঘোর অন্ধকার আর মুষলধারে বৃষ্টির কারণে যু্দ্ধ প্রায় মিনিট ৩০ দেরীতে শুরু হয়। কিন্তু এদিকে জেড ফোর্সের প্রিএইচ আওয়ার বোমা গুলোও বিস্ফোরিত হতে থাকে। ফলে নিজেদের বোমাতেও ১ম বেংগল ধরাশায়ী হয়েছিলো সে রাতে।

আক্রমণ থেকে প্রত্যক্ষভাবে জয় না পেলেও এই আক্রমণে ৫০ এর অধিক পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয় এবং তাদের মনোবলের উপর ছিল বড় ধরনের ধাক্কা একই সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যে ছিল উৎসাহের প্রতীক।

এটি এতই শক্তিশালী ঘাঁটি, যে এই ঘাঁটিতে সর্বমোট ৪ বার নিয়মিত বাহিনী পর্যায়ে সরাসরি সেটপিস যুদ্ধ হয়েছে.....

  • ৩১ জুলাই
  • ২২ অক্টোবর
  • ১৪ নভেম্বর
  • ২৪ নভেম্বর

৪ ডিসেম্বর হিট অ্যান্ড রান হয়েছে মোট ২০ বার! প্রথম গেরিলা হিট টি হয়েছিলো ১২ জুন।
পুরো মুক্তিযুদ্ধে কামালপুর অভিযানে সর্বমোট ১৯৭ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছেন, আহত হয়েছেন অসংখ্য, অন্যদিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেজর আইয়ুব সহ ২২০ জন সেনা নিহত হয়েছেন।
বীর উত্তম থেকে বীর প্রতীক মিলিয়ে সর্বমোট ২৯ জন মুক্তিযোদ্ধা সাহসীকতা পদক পেয়েছেন কেবল কামালপুর যুদ্ধের জন্যই, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এমন উদাহরন আর একটিও নেই।

আরও দেখুন

তথ্যসূত্র

  1. মেজর সিদ্দিক সালিক। উইটনেস টু সারেন্ডার। ইউনিভার্সিটি প্রেস। পৃষ্ঠা ১৮১–১৮২। আইএসবিএন 9840513745।
  2. "সিগনিফিকেন্স অব আর্মড ফোর্সেস ডে"। ডেইলিস্টার আর্কাইভ। ২০০৯-১১-২৩। সংগ্রহের তারিখ ২০১৩-০৫-১৯

বহিঃসংযোগ

  • মে. জে. মইনুল হোসেন চৌধুরী (অব.) (২০১৩-০৩-০১)। এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য স্বাধীনতার প্রথম দশক (১৯৭১-১৯৮১)। মাওলা ব্রাদার্স। আইএসবিএন 984-410-175-1।
  • মেজর সিদ্দিক সালিক। উইটনেস টু সারেন্ডার। ইউনিভার্সিটি প্রেস। পৃষ্ঠা ১৮১–১৮২। আইএসবিএন 9840513745।
  • মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রনালয়ের ওয়েবসাইট
This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.