সুবীর নন্দী
সুবীর নন্দী (১৯ নভেম্বর ১৯৫৩ - ৭ মে ২০১৯)[1] ছিলেন একজন বাংলাদেশী সঙ্গীতশিল্পী। তিনি মূলত চলচ্চিত্রের গানে কন্ঠ দিয়ে খ্যাতি অর্জন করেন। চলচ্চিত্রের সঙ্গীতে তার অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে পাঁচবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রদান করেন।[2] তিনি মহানায়ক (১৯৮৪), শুভদা (১৯৮৬), শ্রাবণ মেঘের দিন (১৯৯৯), মেঘের পরে মেঘ (২০০৪) ও মহুয়া সুন্দরী (২০১৫) চলচ্চিত্রের গানে কন্ঠ দিয়ে পাঁচবার এই পুরস্কার লাভ করেন। সঙ্গীতে অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার ২০১৯ সালে তাকে দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদকে ভূষিত করে।[3]
সুবীর নন্দী | |
---|---|
![]() | |
জন্ম | হবিগঞ্জ, সিলেট, পূর্ব পাকিস্তান | ১৯ নভেম্বর ১৯৫৩
মৃত্যু | ৭ মে ২০১৯ ৬৫) | (বয়স
জাতীয়তা | বাংলাদেশী |
পেশা | সঙ্গীতশিল্পী |
দাম্পত্য সঙ্গী | পূরবী নন্দী |
পুরস্কার | একুশে পদক (২০১৯) জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (৫ বার) |
চলচ্চিত্রে নন্দীর গাওয়া উল্লেখযোগ্য গান হল ‘দিন যায় কথা থাকে’, ‘আমার এ দুটি চোখ পাথর তো নয়’, ‘পৃথিবীতে প্রেম বলে কিছু নেই’, ‘আমি বৃষ্টির কাছ থেকে কাঁদতে শিখেছি’, ‘হাজার মনের কাছে প্রশ্ন রেখে’, ‘তুমি এমনই জাল পেতেছ’, ‘বন্ধু হতে চেয়ে তোমার’, ‘কতো যে তোমাকে বেসেছি ভালো’, ‘পাহাড়ের কান্না দেখে’, ‘কেন ভালোবাসা হারিয়ে যায়’, একটা ছিল সোনার কইন্যা’, ‘ও আমার উড়াল পঙ্খীরে’। তার প্রকাশিত প্রথম গানের অ্যালবাম সুবীর নন্দীর গান (১৯৮১)। এছাড়া তার অন্যান্য অ্যালবামগুলো হল প্রেম বলে কিছু নেই, ভালোবাসা কখনো মরে না, সুরের ভুবনে, গানের সুরে আমায় পাবে (২০১৫) প্রকাশিত হয় এবং ভক্তিমূলক প্রণামাঞ্জলী।
প্রাথমিক জীবন
সুবীর নন্দীর ডাক নাম বাচ্চু। সুবীর নন্দী হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং থানায় নন্দী পাড়া নামক মহল্লায় এক কায়স্থ সম্ভ্রান্ত সঙ্গীত পরিবারে ১৯ নভেম্বর ১৯৫৩ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তার নানা বাড়ি শ্রীমঙ্গল উপজেলার বাদেআলিশা গ্রামে। তার পিতা সুধাংশু নন্দী ছিলেন একজন চিকিৎসক ও সঙ্গীতপ্রেমী। তার মা পুতুল রানীও গান গাইতেন কিন্তু রেডিও বা পেশদারিত্বে আসেন নি। ছোটবেলা থেকেই তিনি ভাই-বোনদের সঙ্গে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে তালিম নিতে শুরু করেন ওস্তাদ বাবর আলী খানের কাছে। তবে সঙ্গীতে তার হাতেখড়ি মায়ের কাছেই।[4] বাবার চাকরি সূত্রে তার শৈশবকাল চা বাগানেই কেটেছে। পাঁচ-ছয় বছর বয়স পর্যন্ত বাগানেই ছিলেন। চা বাগানে খ্রিস্টান মিশনারিদের একটি বিদ্যালয় ছিল, সেখানেই পড়াশোনা করেন। তবে পড়াশোনার অধিকাংশ সময়ই তার কেটেছে হবিগঞ্জ শহরে। হবিগঞ্জ শহরে তাদের একটি বাড়ি ছিল, সেখানে ছিলেন। পড়েছেন হবিগঞ্জ গভঃ হাইস্কুলে। তারপর হবিগঞ্জ বৃন্দাবন কলেজে। মুক্তিযুদ্ধের সময় সুবীর নন্দী দ্বিতীয় বর্ষে পড়তেন।[5]
কর্মজীবন
১৯৬৩ সালে তৃতীয় শ্রেণী থেকেই তিনি গান করতেন। এরপর ১৯৬৭ সালে তিনি সিলেট বেতারে গান করেন। তার গানের ওস্তাদ ছিলেন গুরু বাবর আলী খান। লোকগানে ছিলেন বিদিত লাল দাশ।[6] সুবীর নন্দী গানের জগতে আসেন ১৯৭০ সালে ঢাকা রেডিওতে প্রথম রেকর্ডিং এর মধ্য দিয়ে। প্রথম গান 'যদি কেউ ধূপ জ্বেলে দেয়' -এর গীত রচনা করেন মোহাম্মদ মুজাক্কের এবং সুরারোপ করেন ওস্তাদ মীর কাসেম। ৪০ বছরের দীর্ঘ ক্যারিয়ারে গেয়েছেন আড়াই হাজারেরও বেশি গান। বেতার থেকে টেলিভিশন, তারপর চলচ্চিত্রে গেয়েছেন অসংখ্য জনপ্রিয় গান। চলচ্চিত্রে প্রথম গান করেন ১৯৭৬ সালে আব্দুস সামাদ পরিচালিত সূর্যগ্রহণ চলচ্চিত্রে। ১৯৭৮ সালে আজিজুর রহমান পরিচালিত অশিক্ষিত চলচ্চিত্রে রাজ্জাকের ঠোঁটে তার গাওয়া 'মাস্টার সাব আমি নাম দস্তখত শিখতে চাই' গানটি জনপ্রিয়তা অর্জন করে।[7] ১৯৮১ সালে তার একক অ্যালবাম সুবীর নন্দীর গান ডিসকো রেকর্ডিংয়ের ব্যানারে বাজারে আসে। তিনি গানের পাশাপাশি দীর্ঘদিন ব্যাংকে চাকরি করেছেন।[8] এছাড়া তার প্রেম বলে কিছু নেই, ভালোবাসা কখনো মরে না, সুরের ভুবনে, গানের সুরে আমায় পাবে (২০১৫) প্রকাশিত হয় এবং প্রণামাঞ্জলী নামে একটি ভক্তিমূলক গানের অ্যালবামও প্রকাশিত হয়।[7]
মৃত্যু
নন্দী দীর্ঘদিন ফুসফুস, কিডনি ও হৃদরোগে ভুগছিলেন। ১৪ই এপ্রিল তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে শুরু করে। ৩০ এপ্রিল তাকে সিঙ্গাপুর নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেখানে ৫ ও ৬ই মে পরপর দুইদিন হার্ট অ্যাটাকের পর তিনি ২০১৯ সালের ৭ই মে ৬৫ বছর বয়সে সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন।[9]
কর্ম
স্টুডিও অ্যালবাম
- দুখের পর সুখ
- প্রেম বলে কিছু নেই
- ভালোবাসা কখনো মরে না
- সুরের ভুবনে
- গানের সুরে আমায় পাবে (২০১৫)
চলচ্চিত্র
তিনি অসংখ্য চলচ্চিত্রের গানে কণ্ঠ দিয়েছেন। তার মধ্যে রয়েছে:
- সূর্যগ্রহণ (১৯৭৬)
- অশিক্ষিত (১৯৭৮)
- দিন যায় কথা থাকে (১৯৭৯)
- মহানায়ক (১৯৮৪)
- চন্দ্রনাথ (১৯৮৪)
- শুভরাত্রি (১৯৮৫)
- শুভদা (১৯৮৬)
- পরিণীতা (১৯৮৬)
- রাজলক্ষী শ্রীকান্ত (১৯৮৭)
- রাঙা ভাবী (১৯৮৯)
- পদ্মা মেঘনা যমুনা (১৯৯১)
- স্নেহ (১৯৯৪)
- বিক্ষোভ (১৯৯৪)
- মায়ের অধিকার (১৯৯৬)
- আনন্দ অশ্রু (১৯৯৭)
- শ্রাবণ মেঘের দিন (১৯৯৯)
- চন্দ্রকথা (২০০৩)
- মেঘের পরে মেঘ (২০০৪)
- শ্যামল ছায়া (২০০৪)
- হাজার বছর ধরে (২০০৫)
- শত্রু শত্রু খেলা (২০০৭)
- চন্দ্রগ্রহণ (২০১৮)
- আকাশ ছোঁয়া ভালোবাসা (২০০৮)
- অবুঝ বউ (২০১০)
- দুই পুরুষ (২০১১)
- মাটির পিঞ্জিরা (২০১৩)
পুরস্কার ও সম্মাননা
তথ্যসূত্র
- "চলে গেলেন সুবীর নন্দী"। দৈনিক প্রথম আলো। ৭ মে ২০১৯। সংগ্রহের তারিখ ৭ মে ২০১৯।
- গৌতম পাণ্ডে (৩১ আগস্ট ২০১৫)। "সুবীর নন্দী-কান্তার গানে মুগ্ধ শ্রোতা"। দৈনিক জনকণ্ঠ। ঢাকা, বাংলাদেশ। সংগ্রহের তারিখ ১৩ মার্চ ২০১৬।
- "একুশে পদক ২০১৯ পাচ্ছেন ২১ বিশিষ্ট নাগরিক"। দৈনিক কালের কণ্ঠ। ৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯। সংগ্রহের তারিখ ৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯।
- মিজানুর রহমান মিথুন (১ জুন ২০১৪)। "কণ্ঠ জাদুকর সুবীর নন্দী"। দৈনিক যায় যায় দিন। ঢাকা, বাংলাদেশ। সংগ্রহের তারিখ ১৩ মার্চ ২০১৬।
- রওশন আরা বিউটি (১ মে ২০১৪)। "সুবীর নন্দী : গানই যাঁর ধ্যান-জ্ঞান"। দৈনিক আজাদী। ঢাকা, বাংলাদেশ। সংগ্রহের তারিখ ১৩ মার্চ ২০১৬।
- "আমার প্রাপ্তি বেশি, বিসর্জন কম: সুবীর নন্দী"। ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৮।
- "সুবীর নন্দীর সুর সাধনার অবসান"। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম। ৭ মে ২০১৯। সংগ্রহের তারিখ ৭ মে ২০১৯।
- অর্চি অতন্দ্রিলা (১২ মে ২০১৩)। "বিবিসির সাথে গান-গল্পঃ সুবীর নন্দী"। বিবিসি বাংলা। সংগ্রহের তারিখ ১৩ মার্চ ২০১৬।
- "সুবীর নন্দী আর নেই"। দৈনিক সমকাল (ইংরেজি ভাষায়)। ৭ মে ২০১৯। সংগ্রহের তারিখ ৭ মে ২০১৯।
- "জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রাপ্তদের নামের তালিকা (১৯৭৫-২০১২)"। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশন। সংগ্রহের তারিখ ১৫ এপ্রিল ২০১৯।
- "২০১৫ সালের 'জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার' ঘোষণা"। দৈনিক জনকণ্ঠ। ঢাকা, বাংলাদেশ। ১৯ মে ২০১৭। সংগ্রহের তারিখ ১৫ এপ্রিল ২০১৯।
- "Music heals the wounds of soul: Subir Nandi"। ঢাকা মিরর। ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১১। সংগ্রহের তারিখ ১৬ জুলাই ২০১৬।
বহিঃসংযোগ
- ইন্টারনেট মুভি ডেটাবেজে সুবীর নন্দী (ইংরেজি)