ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন

ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে ভারত উপমহাদেশে যে আর্থ-সামাজিক পরিবর্তন দেখা দেয় এবং রাজনৈতিক সচেতনতার বিকাশ ঘটে তারই ফল হিসেবে গঠিত প্রথম রাজনৈতিক সংগঠন। সর্বভারতীয় আদর্শে ও উদ্দেশ্যে গঠিত এ প্রতিষ্ঠানের বাংলা নাম ‘ভারত সভা’। ইতোপূর্বে প্রাথমিক প্রচেষ্টা হিসেবে কলকাতায় ২৫ সেপ্টেম্বর ১৮৭৫ সালে অমৃত বাজার পত্রিকা-র সম্পাদক শিশির কুমার ঘোষ ও তার ভাই মতিলাল ঘোষইন্ডিয়া লীগ’ প্রতিষ্ঠা করেন। জন্মলগ্ন হতে ইন্ডিয়া লীগ প্রাদেশিকতা ও সাম্প্রদায়িকতামুক্ত সর্বভারতীয় জনগণের কল্যাণ সাধনের আদর্শ ও দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কার্যক্ষেত্রে অবতীর্ণ হয়েছিল। কিন্তু নানা কারণে নেতৃবৃন্দের মাঝে মতবিরোধ দেখা দেয়, ফলে ইন্ডিয়া লীগ বেশিদিন টিকে থাকে নি। এর অল্পদিন পরই ১৮৭৬ সালের ২৬ জুলাই কলকাতায় সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জীর নেতৃত্বে তার বন্ধু আনন্দমোহন বসুইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন’ প্রতিষ্ঠা করেন। এ সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত অন্যান্য নেতৃবৃন্দ ছিলেন পন্ডিত শিবনাথ শাস্ত্রী, মনোমোহন ঘোষ, কৃষ্ণদাস পাল, মহারাজা নরেন্দ্রকৃষ্ণ প্রমুখ।

Inside the Indian Association or Bharat Sabha

উদ্দেশ্য

এ দুই সভার উদ্দেশ্য ও কার্য-প্রণালীর মাঝে বিশেষ পার্থক্য ছিল না। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা ও জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা ছিল উভয়ের লক্ষ্য। জন্মলগ্ন হতে ভারত সভার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল সর্বভারতীয় জনমত গঠন। ভারত সভা চারটি উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করে" যথা, (১) সারা দেশে জনমত গঠন করা, (২) রাজনৈতিক স্বার্থে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের অধিবাসীদের ঐক্যবদ্ধ করা, (৩) জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল শ্রেণীর মধ্যে সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলা ও ভারতের দুই প্রধান সম্প্রদায় হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে মৈত্রীর প্রসার ঘটানো এবং (৪) রাজনৈতিক আন্দোলনে স্বল্প শিক্ষিত ও সাধারণ জনগণ যাতে যোগ দেয় তার ব্যবস্থা করা। ভারতীয়দের সার্বিক কল্যাণ, স্বার্থরক্ষা ও জাতীয় চেতনাবোধ জাগরণই এ সভার মুখ্য লক্ষ্য ছিল।

সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী ও আনন্দমোহন বসুর মতো উদার মতাবলম্বী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ জাতীয়তাবাদকে সংকীর্ণ হিন্দু জাতীয়তাবাদের ঊর্ধ্বে রাখার চেষ্টা করেছিলেন। এর নিদর্শনস্বরূপ এ সভার দ্বিতীয় বার্ষিক অধিবেশনে নওয়াব মুহম্মদ আলী সভাপতির আসন গ্রহণ করেন। যে রাজনৈতিক জাগরণের ফলে ১৮৮৫ সালে সর্বভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ভারত সভার প্রতিষ্ঠাতা সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী সে কৃতিত্বের প্রধান দাবিদার। প্রকৃতপক্ষে ভারতসভা এবং সুরেন্দ্রনাথ ব্যানর্জী ছিলেন জাতীয়তাবাদের অগ্রদূত ও পথিকৃৎ।

১৮৭৬ সালে ব্রিটিশ সরকার ভারতীয় সিভিল সর্ভিস পরীক্ষার্থীদের বয়স ২১ বছর হতে কমিয়ে ১৯ বছর করে যে বিধি প্রবর্তন করে তারই প্রতিবাদ দিয়ে ভারত সভার কাজ শুরু হয়। এ বিধি সারা ভারতে এক গভীর অসন্তোষের সৃষ্টি করে। কারণ ১৯ বছর বয়সে কোন ভারতীয় ছাত্রের পক্ষে সুদূর বিলেতে গিয়ে নতুন পরিবেশে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া দুরূহ হয়ে পড়বে। ভারত সভা সুরেন্দ্র নাথের নেতৃত্বে এ আদেশের প্রতিবাদ করে এবং সিভিল সার্ভিসকে ভারতীয়করণের দাবি জানায় ও আন্দোলন গড়ে তোলে। এছাড়া দেশীয় মুদ্রণযন্ত্র আইন, অস্ত্র আইন, শুল্কনীতি প্রভৃতির বিরুদ্ধে আন্দোলনে ভারত সভা নেতৃত্ব দেয়। ভারত সভা আরও কয়েকটি বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যথা : ১। প্রতিনিধিত্বমূলক শাসন-পরিষদ গঠন ২। স্বায়ত্ব-শাসন প্রবর্তন, ৩। প্রজাস্বত্ব আইন পাস এবং ৪। মদ্যপান নিবারণকল্পে আন্দোলন পরিচালনা করা ইত্যাদি। এ সকল আন্দোলনের ফলে সরকার বাধ্য হয়ে ভারতীয়দের অণুকূলে নতুন আইন পাস এবং কোনও কোনও ক্ষেত্রে পুরনো আইন সংশোধন করতে বাধ্য হয়। ভারত সভার পক্ষে সুরেন্দ্রনাথ ভারতের অনেক গুরুত্বপূর্ণ শহর ভ্রমণ করেন ও বক্তৃতার মাধ্যমে রাজনৈতিক ঐক্য ও ভারতীয় জাতীয়তাবাদের বীজ বপন করেন।

ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার পূর্বেই সুরেন্দ্রনাথ রাজনৈতিক ও সামাজিক উদ্দেশ্য নিয়ে ১৮৮৩১৮৮৫ সালে কলকাতায় ‘ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কনফারেন্স’ নামে এক মহাসভা আহ্বান করেন। সর্বভারতীয় কল্যাণ ও রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা ছিল এ মহাসভার উদ্দেশ্য। ভারত সভার নেতৃবৃন্দ ছিলেন এ মহাসম্মেলনের উদ্যোক্তা। ইতিমধ্যে ১৮৮৫ সালে অ্যালান অক্টেভিয়ান হিউম নামে জনৈক ভারতদরদী অবসরপ্রাপ্ত সিভিলিয়ানের উদ্যোগে ২৮ ডিসেম্বরে বোম্বাইতে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৮৬ সালে কলকাতায় কংগ্রেসের দ্বিতীয় অধিবেশন চলাকালে ভারত সভা নিজ কার্য পরিচালনার সঙ্গে সঙ্গে কংগ্রেসের কার্যক্রমের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে। ১৮৮৮ সালে ভারত সভার উদ্যোগে কলকাতা প্রথম বঙ্গীয় প্রাদেশিক সম্মেলন অণুষ্ঠিত হয়। বাংলা, বিহার ও আসাম হতে বহু প্রতিনিধি এতে যোগদান করেন এবং এ সকল প্রদেশে ভারত সভার শাখা সমিতি স্থাপিত হয়। এটা সত্য যে, কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার পর এবং কংগ্রেসের কর্মকান্ড ক্রমাগত প্রসারের ফলে ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের গুরুত্ব কিছুটা হ্রাস পায়।

বঙ্গভঙ্গ

বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে স্বদেশী আন্দোলন শুরু হলে ভারত সভা সে আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করে। স্বদেশী দ্রব্য ব্যবহার ও বিদেশী পণ্য বর্জনের জন্য ভারত সভার নেতৃবৃন্দ সারা দেশে তুমুল আন্দোলন গড়ে তোলেন। ভারত সভার পক্ষে্য একটি ‘জাতীয় ভাণ্ডার’ প্রতিষ্ঠিত হয়। এর মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল দুটি ক. বিভক্ত পূর্ব ও পশ্চিম বঙ্গের একতার নিদর্শনস্বরূপ একটি মিলন মন্দির স্থাপন; খ. দেশীয় শিল্প প্রধানত চড়কা ও তাতের বহুল প্রসার। ভারত সভাসহ কংগ্রেস নেতৃবৃন্দের প্রবল আন্দোলনের ফলে ১৯১১ সালের ১২ ডিসেম্বর ব্রিটিশ সরকার বঙ্গভঙ্গ রদ ঘোষণা করে। ভারতের রাজধানী কলকাতা হতে দিল্লিতে স্থানান্তরিত হয়। অতঃপর ভারত সভা বাংলার উদারপন্থি ও চরমপন্থি রাজনৈতিক দলের মিলনকেন্দ্র হয়ে ওঠে। ১৯২১ সালে মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলনের পূর্ব পর্যন্ত উভয় দল একযোগে প্রাদেশিক রাজনীতি ও সমাজ উন্নয়নমূলক কাজে রত থাকে। ভারত সভা সরকারি অনাচার ও নির্যাতনের তীব্র প্রতিবাদ করে এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নমূলক সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন কার্যক্রমের সঙ্গে সহযোগিতা করে। ১৯৪৭ য়ে ভারতের স্বাধীনতার পর ‘ভারত সভা’ বিভিন্ন সমাজ সেবামূলক কাজে আত্মনিয়োগ করে।

তথ্যসূত্র

    বহিঃসংযোগ

    This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.