বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ

বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ[1] ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে বাংলা সাহিত্যের উন্নতি এবং প্রসারের উদ্দেশ্যে স্থাপিত একটি প্রতিষ্ঠান। বাংলা ভাষার বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা, অন্যান্য ভাষায় রচিত গ্রন্থের অনুবাদ, দুর্লভ বাংলা রচনা সংরক্ষণ, গবেষণাগ্রন্থ প্রকাশ প্রভৃতি ক্ষেত্রে এই পরিষদ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে।

বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ-এর গৃহপ্রবেশ অনুষ্ঠানে সমবেত বিশিষ্ট জনেরা (৬ ডিসেম্বর ১৯০৮)

প্রতিষ্ঠাকাল

১৮৯৩ সালের ২৩ জুলাই এল. লিউটার্ডক্ষেত্রপাল চক্রবর্তী'র উদ্যোগে বেঙ্গল একাডেমি অব লিটারেচার স্থাপিত হয়। প্রথমদিকে একাডেমির কার্যাবলি, সভা, মুখপত্র শুধুমাত্র ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত হতো। পরে এই ব্যাপারে কোনো কোনো সদস্য আপত্তি প্রকাশ করলে উমেশচন্দ্র বটব্যালের প্রস্তাবানুসারে একাডেমির নাম পরিবর্তন করে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ করা হয়। এর যাত্রা শুরু হয় কলকাতার শোভাবাজারে বিনয়কৃষ্ণ দেব-এর বাসভবনে।[1]

বাংলা সাহিত্যের উন্নতি সাধন ছিল পরিষদের মূল উদ্দেশ্য। কিন্তু প্রথমদিকে এর প্রায় সব কাজই ইংরেজিতে সম্পন্ন হতো। এমনকি সভার মুখপত্র হিসেবে প্রকাশিত মাসিক পত্রিকা দি বেঙ্গল একাডেমি অব লিটারেচার-এর অধিকাংশই লিপিবদ্ধ হতো ইংরেজিতে। এই অসঙ্গতি দূর করার উদ্দেশ্যে উমেশচন্দ্র বটব্যালের প্রস্তাবানুসারে ১৮৯৪ সালের ১৮ ফেব্রয়ারি পরিষদের সভায় মুখপত্রটি দি বেঙ্গল একাডেমি অব লিটারেচার ও বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ - এ উভয় নামেই প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ১৮৯৪ সালের ২৯ এপ্রিলের সভায় পরিষদের নামটি বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ হিসেবে সর্বসম্মতক্রমে গৃহীত হয়। এরপর থেকে পরিষদের মুখপত্রটি সাহিত্য পরিষদ পত্রিকা নামে ত্রৈমাসিক পত্রিকা হিসেবে বাংলায় প্রকাশিত হতে থাকে।[1]

১৮৯৪ সালে পরিষদের সভাপতি ছিলেন রমেশচন্দ্র দত্ত, সহসভাপতি ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরনবীনচন্দ্র সেন এবং সম্পাদক ছিলেন এল লিওটার্ড, দেবেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী।

সংগঠন

পরিষদের নিজস্ব একটি কার্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য ১৮৯৯ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সভাপতিত্বে পরিষদের এক বিশেষ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরিষদের কার্যালয় ১৩৭/১ কর্নওয়ালিস স্ট্রিটে একটি ভাড়া বাড়িতে সরিয়ে নেওয়া হয়।

বিশ শতকের প্রথম দশকে পরিষদের কলেবর যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়। এ সময়ে এর সদস্য সংখ্যা ৫২৩ তে উন্নীত হয়। প্রখ্যাত সদস্যদের মধ্যে ছিলেন রমেশচন্দ্র দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নবীনচন্দ্র সেন, দেবেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, রায় যতীন্দ্রনাথ চৌধুরী, সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রজনীকান্ত গুপ্ত, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, দেবেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ, নরেন্দ্রনাথ মিত্র, অমৃতকৃষ্ণ মল্লিক, সুরেশচন্দ্র সমাজপতিদ্বিজেন্দ্রনাথ বসু। ১৯০৬ সালে পরিষদের এক বিশেষ অধিবেশনে কলকাতার বাইরে পরিষদের শাখা স্থাপনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এর পরপরই রংপুরে একটি শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়। কালক্রমে বাংলার বিভিন্ন জেলা শহরে এবং বাংলার বাইরেও ৩০টি শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়। চারুচন্দ্র ঘোষ, রজনীকান্ত গুপ্ত, হীরেন্দ্রনাথ দত্ত, সুরেশচন্দ্র সমাজপতি ও নগেন্দ্রনাথ বসু পরিষদের নিজ বাসগৃহ নির্মাণের জন্য কাসিমবাজারের মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দীর স্মরণাপন্ন হন। তিনি হালশীবাগানে সাত কাঠা জায়গা পরিষদকে দান করেন। ১৯০৯ সালের শেষদিকে পরিষদ স্থায়ী কার্যালয়ে স্থানান্তরিত হয়।[1]

বান্ধব, বিশিষ্ট, আজীবন, সহায়ক ও সাধারণ পরিষদে এই পাঁচ ধরনের সদস্যপদ রয়েছে। যে কোনো ব্যক্তি পরিষদের সাধারণ সদস্য নির্বাচিত হতে পারেন।

গবেষণা

বাংলা ভাষায় নানা বিষয়ের গবেষণায় পৃষ্ঠপোষকতা করে পরিষদ বিদ্বৎসমাজে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। সংস্কৃত, আরবি ও ইংরেজি ভাষা হতে বহু গ্রন্থ অনুবাদ ও প্রকাশ করা এবং দুষ্পাপ্য বাংলা গ্রন্থ, সাহিত্য ও গবেষণা নিয়মিত পুস্তকাকারে প্রকাশ করা পরিষদের অন্যতম প্রধান কাজ। পরিষদের প্রকাশিত গ্রন্থগুলির মধ্যে যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধির বাংলা শব্দকোষ, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, সংবাদপত্রে সেকালের কথা ও সাহিত্যসাধক চরিতমালা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।[1] যতীন্দ্রনাথ চৌধুরী ও রজনীকান্ত গুপ্তের বিশেষ আগ্রহে প্রাচীন বাংলা ও সংস্কৃত পুথি সংগ্রহের যে চেষ্টা নেওয়া হয়েছিল, তারই ফল হিসেবে পরিষদ গ্রন্থাগারে বর্তমানে পুথির সংখ্যা প্রায় সাত হাজার। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের একমাত্র পুথি পরিষদে সংরক্ষিত।

অবদান

গবেষণা কাজ ছাড়াও পরিষদ আরও কিছু বিষয়ে আগ্রহ দেখিয়েছিল। প্রাচীন মুদ্রা, প্রস্তরমূর্তি, ধাতুমূর্তি, তাম্রশাসন, প্রাচীন চিত্র, সাহিত্যিক ও বিশিষ্ট ব্যক্তিগণের ব্যবহৃত দ্রব্যাদি, হস্তলিপি পত্র ও দানপত্রাদি, প্রাচীন অস্ত্রশস্ত্র, পাণ্ডুলিপি (বিখ্যাত লেখকের রচনা) ও প্রাচীন দলিল প্রভৃতি বিভাগসমৃদ্ধ একটি চিত্রশালাও গঠন করা হয়েছে। বহু বছরের চেষ্টার ফলে পরিষদ একটি সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে, যেখানে রয়েছে বেশ কিছু দুর্লভ প্রাচীন পুস্তক। পরিষদের নিজস্ব সঞ্চয়, উপহার প্রাপ্ত ও দানলব্ধ পুস্তকাদি ছাড়া ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রমেশচন্দ্র দত্ত, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, বিনয়কৃষ্ণ দেব, ঋতেন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রেমসুন্দর বসু ও যতীন্দ্রনাথ পালের সাতটি মূল্যবান গ্রন্থ সংগ্রহ পরিষদ গ্রন্থাগারের অঙ্গীভূত হওয়ায় এটি হয়ে উঠেছে আরও সমৃদ্ধ। গ্রন্থাগারে পুস্তকের সংখ্যা প্রায় দেড় লক্ষ। গ্রন্থ প্রকাশ, পদক ও পুরস্কার দান, দুঃস্থ সাহিত্যিক ভাণ্ডার গঠন প্রভৃতি সদনুষ্ঠানে সহায়তা করার জন্য অনেক মহানুভব ব্যক্তি বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদে গচ্ছিত তহবিল স্থাপন করেছেন। পুলিনবিহারী দত্ত কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত দুস্থ সাহিত্যিক ভাণ্ডারের আয় হতে বহু দুঃস্থ সাহিত্যিক পরিবারকে অর্থ সাহায্য করা হয়েছে।[1]

আরো দেখুন

  • আন্তর্জাতিক বাংলা সাহিত্য পরিষদ

তথ্যসূত্র

  1. "বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ - বাংলাপিডিয়া"। সংগ্রহের তারিখ ২০১৭-০৯-১৮

বহিঃসংযোগ

This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.