হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও

হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও (জন্ম : ১৮ এপ্রিল, ১৮০৯ – মৃত্যু : ২৬ ডিসেম্বর, ১৮৩১)একজন ইউরেশীয় কবি, যুক্তিবাদী চিন্তাবিদশিক্ষক। তরুণ হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও মাত্র সতেরো বছর বয়সে কলকাতা হিন্দু কলেজের শিক্ষক নিযুক্ত হন। তিনি ইংরেজি সাহিত্যইতিহাস পড়াতেন এবং তার পাঠদানের পদ্ধতি ছিল তার ধ্যান-ধারণার মতোই গতানুগতিকতামুক্ত। প্রকৃতপক্ষে, শিক্ষক হিসেবে তার কর্মকাণ্ড শ্রেণিকক্ষে সীমাবদ্ধ ছিল না। ছাত্রদের আগ্রহ সৃষ্টিকারী যে-কোনো বিষয়ে তিনি তার ছাত্রদের সঙ্গে কলেজ প্রাঙ্গণের বাইরেও, প্রায়ই তার নিজের বাসায়, আলোচনা করতে সদা-ইচ্ছুক ছিলেন। বাস্তবে, তার আলোচনার বিষয়বস্তুর পরিসীমা ছিল বহুবিস্তৃত : সাহিত্য, ইতিহাস, দর্শন এবং বিজ্ঞাননব্যবঙ্গ দল গঠন তাকে ভারতের জাতীয়তাবাদের ইতিহাসে অমর করে রেখেছে।

হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও
কলকাতার এসপ্ল্যানেড অঞ্চলে হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিওর মর্মর মূর্তি
জন্ম(১৮০৯-০৪-১৮)১৮ এপ্রিল ১৮০৯
মৃত্যু২৬ ডিসেম্বর ১৮৩১(1831-12-26) (বয়স ২২)
নাগরিকত্বব্রিটিশ ভারত
পেশাশিক্ষক, কবি ও নৃত্যশিল্পী
পরিচিতির কারণকবি, যুক্তিবাদী, চিন্তাবিদ ও শিক্ষক

প্রাথমিক জীবন

নব্যবঙ্গ দল (ইয়ং বেঙ্গল) ও হিন্দু কলেজ

অল্পদিনের মধ্যেই তিনি ছাত্রদের মধ্যে এত উৎসাহের সঞ্চার করতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, তার সহায়তায় ১৮২৮ সালে তারা ‘অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন’ নামে তাদের নিজস্ব একটি সাহিত্য ও বিতর্ক সংঘ প্রতিষ্ঠা করে। এ সংঘ শ্রেণিকক্ষের বাধানিষেধের বাইরে ডিরোজিওর পরিচালনায় তরুণদের মনোযোগ আকর্ষণকারী বিভিন্ন বিষয়ে স্বাধীনভাবে আলোচনা করার একটি সাধারণ মিলনস্থানের সংস্থান করে। অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন ছিল এক সফল উদ্যোগ এবং মানিকটোলার এক বাগান বাড়িতে এর পাক্ষিক সভাগুলি অনুষ্ঠিত হতো। এ সব সভায় বহু ছাত্র এবং কিছু উদারমনা ও জনহিতৈষী ইউরোপীয় ব্যক্তি যোগ দিতেন। এর সাফল্য ছাত্রদের কলকাতার বিভিন্ন এলাকায় একই ধরনের সংঘ প্রতিষ্ঠা করতে উৎসাহিত করেছিল। ডিরোজিও অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হলেও সদস্য হিসেবে অন্য সংঘগুলির অধিকাংশের সঙ্গেই জড়িত ছিলেন এবং সেগুলির কর্মকাণ্ডে সক্রিয়ভাবে আগ্রহী ছিলেন। ডিরোজিওর শিক্ষাবলি ছাত্রদের মধ্যে সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গির জন্ম দেয় এবং তারা বিদ্যমান অবস্থা সম্পর্কে সন্দেহ ও অসন্তোষ প্রকাশ করতে শুরু করে। ডেভিড হিউমজেরেমি বেনথামের যুক্তিবাদী দর্শন ও টমাস পেইনের মতো প্রগতিবাদী চিন্তাবিদদের প্রভাবে তারা সবকিছুই যুক্তির মাপকাঠিতে বিচার করতে শুরু করে। ধর্মের প্রতি তাদের মনোভাব ছিল ভল্টেয়ারের মতো। হিন্দু ধর্মকে খোলাখুলিভাবে নিন্দা করতেও তারা ইতস্তত করে নি। ডিরোজিওর শিক্ষাবলি হিন্দু সমাজে দারুণ উত্তেজনার সৃষ্টি করেছিল। ডিরোজিওর বিরুদ্ধে গোঁড়া হিন্দু পরিবার থেকে আগত ছাত্রদের অধিকাংশের মধ্যে ধর্ম বিষয়ে প্রচলিত মতের বিরুদ্ধ বিশ্বাস সৃষ্টির অভিযোগ করা হয়। ব্যাপারটা রাধাকান্ত দেব এর (১৭৮৪-১৮৬৭) নেতৃত্বে রক্ষণশীল হিন্দুদের কর্তৃত্ত্বাধীন হিন্দু কলেজের ব্যবস্থাপনা পরিষদের নজরে আনা হয়। ১৮৩১ সালের এপ্রিল মাসে ডিরোজিওকে হিন্দু কলেজ থেকে বরখাস্ত করা হয়। তার পদচ্যুতি অবশ্য প্রগতিবাদী আন্দোলনকে দমন করতে পারে নি। প্রকৃতপক্ষে ডিরোজিও এ ঘটনার পর নিজের মতামত প্রকাশে আগের চেয়ে বেশি স্বাধীন হয়ে পড়েন। তিনি তার ছাত্রদের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রাখেন। ইউরেশীয় সম্প্রদায়ের কল্যাণ সাধনের কাজেও ডিরোজিও সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন এবং ‘দি ইস্ট ইন্ডিয়ান’ নামে একটি ইংরেজি দৈনিক সংবাদপত্র সম্পাদনা করতে শুরু করেন। সে সময় তিনি তার কিছু তরুণ হিন্দু শিষ্যকে সাংবাদিকতা পেশা গ্রহণে এবং এ গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম ব্যবহার করে তাদের প্রগতিবাদী ধারণাগুলি প্রচার করতে উৎসাহিত করেন। এভাবে ১৮৩১ সালের মে মাসে কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়দি ইনকোয়ারার’ নামে একটি ইংরেজি সাপ্তাহিক পত্রিকা এবং পরের মাসে দক্ষিণারঞ্জণ মুখোপাধ্যায়রসিককৃষ্ণ মল্লিকজ্ঞানাম্বেষণ’ নামে বাংলায় (পরে ইংরেজিতেও) একটি সংবাদপত্র প্রকাশ করতে শুরু করেন। দৃশ্যত ডিরোজিওর নির্দেশনায় এসব পত্রিকার মাধ্যমে তরুণ প্রগতিবাদীরা হিন্দু রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে তীব্র আক্রমণ চালায়।

প্রভাব

বহিস্কার ও মৃত্যু

হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিওর সমাধি

সমাজ সংস্কার বিষয়ে প্রথাগত চিন্তাধারার বিরুদ্ধে যাওয়ায় হিন্দু কলেজের শিক্ষক পদ থেকে ডিরোজিওকে অপসারণ করার প্রস্তাব রাখা হয়। এই প্রস্তাব ৬-১ ভোটে অনুমোদিত হয়। বহিস্কৃত হবার পরে ডিরোজিও অর্থকষ্টে পড়েন। ১৮৩১ সালের ২৬শে ডিসেম্বর তিনি কলেরায় মারা যান। গির্জা ও খ্রিষ্টধর্ম সম্পর্কে তার অভিমতের কারণে পার্ক স্ট্রিটের গোরস্থানে তাকে সমাহিত করতে বাঁধা দেওয়া হয়। গোরস্থানের ঠিক বাইরে তাকে সমাহিত করা হয়।১৮৩১ সালের ডিসেম্বর মাসে ডিরোজিওর আকস্মিক মৃত্যু প্রগতিবাদীদের উদ্দেশ্য সাধনের পথে গুরুতর আঘাত হানে। তবুও এ অসামান্য শিক্ষক তার তরুণ হিন্দু ছাত্রদের মনে সংস্কারমুক্তির যে চেতনা উদ্দীপ্ত করেছিলেন তা পরবর্তী প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করেছিল এবং বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির উপর স্থায়ী প্রভাব ফেলেছিল।

আরও দেখুন

তথ্যসূত্র

    • সংসদ বাঙ্গালি চরিতাভিধান-চতুর্থ সংস্করণ-প্রথম খন্ড-অঞ্জলি বসু আইএসবিএন ৮১-৮৫৬২৬-৬৫-০
    • রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ-শিবনাথ শাস্ত্রী, নিউ এজ্‌ পাবলিসার্স পাঃ লিঃ
    • THOMAS EDWARDS, Henry Derozio: The Eurasian Poet, Teacher and Journalist, Calcutta, 1884;
    • SUSOBHAN C SARKAR, ‘Derozio and Young Bengal’, in AC GUPTA (ed), Studies in Bengal Renaissance, Jadavpur, 1958;
    • EW MADGE, Henry Derozio: The Eurasian Poet and Reformer, Calcutta, 1967; N
    • S BOSE, Indian Awakening and Bengal, 3rd Ed, Calcutta, 1976.

    আরও দেখুন

    বহিঃসংযোগ

    This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.