ইতিহাস

ইতিহাস হল মানুষের অতীত ঘটনা ও কার্যাবলীর অধ্যয়ন।[1][2][3] বৃহৎ একটি বিষয় হওয়া সত্ত্বেও এটি কখনও মানবিক বিজ্ঞান এবং কখনও বা সামাজিক বিজ্ঞানের একটি শাখা হিসেবে আলোচিত হয়েছে। অনেকেই ইতিহাসকে মানবিক এবং সামাজিক বিজ্ঞানের মধ্যে একটি সেতুবন্ধন হিসেবে দেখেন। কারণ ইতিহাসে এই উভয়বিধ শাস্ত্র থেকেই পদ্ধতিগত সাহায্য ও বিভিন্ন উপাদান নেয়া হয়। একটি শাস্ত্র হিসেবে ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করতে গেলে অনেকগুলো উপবিভাগের নাম চলে আসে: দিনপঞ্জি, ইতিহাস-লিখন, কুলজি শাস্ত্র, পালিওগ্রাফি এবং ক্লায়োমেট্রিক্‌স। স্বাভাবিক প্রথা অনুসারে ইতিহাসবেত্তাগণ ইতিহাসের লিখিত উপাদানের মাধ্যমে বিভিন্ন ঐতিহাসিক প্রশ্নের উত্তর দেয়ার চেষ্টা করেন, যদিও কেবল লিখিত উপাদান হতে ইতিহাসে সকল তত্ত্ব উদ্ধার করা সম্ভব নয়। ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে যে উৎসগুলো বিবেচনা করা হয়, সেগুলোকে তিনটি শ্রেণীতে ভাগ করা হয়: লিখিত, মৌখিক এবং শারীরিক বা প্রত্যক্ষ করণ। ইতিহাসবেত্তারা সাধারণত তিনটি উৎসই পরখ করে দেখেন। তবে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য উৎস হিসেবে লিখিত উপাদান সর্বজন স্বীকৃত। এই উৎসটির সাথে লিখন পদ্ধতির ইতিহাস অঙ্গাঅঙ্গীভাবে জড়িত। হেরোডোটাসকে ইতিহাসের জনক হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।

হিস্টোরিয়া
নিকোলাওস গিজিসের আঁকা (১৮৯২)
ইতিহাস

ইতিহাস লিখনধারা

ইতিহাস লিখনধারার সম্পর্কিত বেশ কিছু অর্থ রয়েছে। প্রথমত, এটি দিয়ে বুঝানো হয় কীভাবে ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছে: পদ্ধতি ও অনুশীলনের বিকাশের গল্প। দ্বিতীয়ত, এটি বুঝায় কি সৃষ্টি করেছে: ইতিহাস লিখনরীতির নির্দিষ্ট বিষয়। তৃতীয়ত, এটি দিয়ে বুঝানো হয় কীভাবে ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছে: ইতিহাসের দর্শন। অতীতের বর্ণনার বিশ্লেষণ অনুযায়ী, তৃতীয় ধারণাটি প্রথম দুটি ধারণার সাথে সম্পর্কযুক্ত করা যায়, যা মূলত বর্ণনা, ব্যাখ্যা, বৈশ্বিক দৃষ্টিকোণ, সাক্ষ্য বা প্রমাণের ব্যবহার, বা অন্যান্য ইতিহাসবেত্তাদের উপস্থাপন পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করে। ইতিহাস কি একক বর্ণনা নাকি ধারাবাহিক বর্ণনা হিসেবে শিখানো হবে তা নিয়ে পেশাদারী ইতিহাসবেত্তাদের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে।[4][5]

ইতিহাসের দর্শন

ইতিহাসের দর্শন হল দর্শনের একটি শাখা যেখানে ঘটনাবলীর গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করা হয়, বিশেষ করে মানবীয় ইতিহাস।[6] এছাড়া এই শাখায় এর বিকাশের সম্ভাব্য পরমকারণমূলক সমাপ্তির কথা বিবেচনা করা হয়, যেমন মানবীয় ইতিহাসের পদ্ধতিতে কোন নকশা, কারণ, নীতি, বা সমাপ্তি রয়েছে কিনা। ইতিহাসের দর্শনকে ইতিহাস লিখনধারার সাথে গুলিয়ে ফেলা উচিত নয়। ইতিহাস লিখনধারায় ইতিহাসের পদ্ধতি ও অনুশীলন এবং ইতিহাসকে একটি নির্দিষ্ট একাডেমিক বিষয় হিসেবে এর বিকাশের উপর জোড় দেওয়া হয়।[7] আবার ইতিহাসের দর্শনকে দর্শনের ইতিহাসের সাথে গুলিয়ে ফেলা যাবে না, কারণ দর্শনের ইতিহাস হল একটি নির্দিষ্ট সময় ধরে দর্শনের ধারণাসমূহের বিকাশ।

অধ্যয়নের ক্ষেত্র

যুগ নির্ধারণ

ইতিহাস এক নির্দিষ্ট সময়ে ঘটা ঘটনাবলী ও উন্নয়নকে কেন্দ্র করে লিখিত হয়। ইতিহাসবেত্তাগত সেই সময় বা যুগকে একটি নির্দিষ্ট নাম দিয়ে চিহ্নিত করেন।[8] ভৌগোলিক অবস্থানের উপর নির্ভর করে এই নামসমূহ ভিন্ন হতে পারে, যেমন সেই যুগের শুরুর সময় এবং সমাপ্তির সময়। শতাব্দী ও দশক হল বহুল ব্যবহৃত যুগ নির্দেশক এবং কালপঞ্জি অনুসারে এই যুগ নির্ধারিত হয়। বেশিরভাগ যুগ পূর্ববর্তী ঘটনার উপর নির্ভর করে নির্ধারিত হয় এবং এর ফলে এতে পূর্ববর্তী সময়ে ব্যবহৃত মৌলিক ধারণা ও বিচারবুদ্ধির প্রতিফলন দেখা যায়। যে পদ্ধতিতে যুগসমূহের নাম দেওয়া হয় তা এই যুগসমূহকে কোন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হচ্ছে এবং কীভাবে অধ্যয়ন করা হচ্ছে তাকে প্রভাবিত করে।[9]

সময়কালভিত্তিক

ভৌগোলিক অবস্থান

নির্দিষ্ট ভৌগোলিক অবস্থান, যেমন মহাদেশ, দেশশহরও ইতিহাস অধ্যয়নের ক্ষেত্র। ঐতিহাসিক ঘটনাবলী কেন ঘটেছিল তা জানা গুরুত্বপূর্ণ। এই কারণ জানার জন্য ইতিহাসবেত্তাগণ ভূগোল অধ্যয়ন করে থাকেন।

অঞ্চলভিত্তিক

অর্থনৈতিক ইতিহাস

যদিও অর্থনৈতিক ইতিহাস উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিক থেকে প্রতিষ্ঠা লাভ করে, বর্তমান সময়ে অর্থনীতি বিভাগে এই বিষয়ক একাডেমিক শিক্ষা দান করা হয় এবং তা প্রথাগত ইতিহাস বিভাগ থেকে ভিন্ন।[10] ব্যবসায় তত্ত্বে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান, ব্যবসায়িক কৌশল, সরকারি নিয়মকানুন, শ্রম বিভাগের সম্পর্কের ইতিহাস ও সমাজে এর প্রভাব বর্ণিত হয়। এছাড়া এতে নির্দিষ্ট কোম্পানি, নির্বাহী, ও উদ্যোক্তাদের জীবনী নিয়ে আলোচনা করা হয়। ব্যবসায় তত্ত্ব অর্থনৈতিক ইসিহাসের সাথে সম্পর্কিত এবং তা ব্যবসায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠ দান করা হয়।[11]

ধর্মের ইতিহাস

ধর্মের ইতিহাস শতাব্দীকাল ধরে ধর্মবহির্ভূত ও ধার্মিক দুই শ্রেণীর ইতিহাসবেত্তাদের কাছে প্রধান বিষয় হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, এবং সেমিনারি ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে তা শিখানো হচ্ছে। এই ধরনের ইতিহাস বিষয়ক প্রধান সাময়িকীসমূহ হল চার্চ হিস্ট্রি, দ্য ক্যাথলিক হিস্ট্রিক্যাল রিভিউ, এবং হিস্ট্রি অব রিলিজিওন্স।[12] সাধারণত এর বিষয়বস্তু হয়ে থাকে রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও শৈল্পিক দিক, এমনকি ধর্মতত্ত্ব ও প্রার্থনার বিধিও। এই বিষয়ের অধীনে পৃথিবীর যে সকল অঞ্চল ও এলাকায় মানুষ বসবাস করেছে, সে সকল অঞ্চল ও এলাকার ধর্ম নিয়ে অধ্যয়ন করা হয়।[13]

পরিবেশগত ইতিহাস

পরিবেশগত ইতিহাস হল ইতিহাসের একটি নতুন ক্ষেত্র, যা ১৯৮০ এর দশকে বিকাশ লাভ করে। এতে পরিবেশের ইতিহাস এবং পরিবেশের উপর মানুষের কর্মকাণ্ডের প্রভাব নিয়ে আলোকপাত করা হয়।[14]

বিশ্বের ইতিহাস

বিশ্বের ইতিহাস হল গত ৩০০০ বছর ধরে প্রধান প্রধান সভ্যতার বিকাশের অধ্যয়ন। বিশ্বের ইতিহাস মূলত শিক্ষার একটি ক্ষেত্র। বিষয়টি ১৯৮০ এর দশকের পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র,[15] জাপান[16] ও অন্যান্য দেশে বিশ্বায়নের ফলশ্রুতিতে জনপ্রিয়তা লাভ করে।

সংস্কৃতির ইতিহাস

সংস্কৃতির ইতিহাস হল সমাজে শিল্পকলা ও মানুষের চিত্র ও দৃশ্য ধারণার অধ্যয়ন। ১৯৮০ ও ১৯৯০ এর দশকে এটি সামাজিক ইতিহাসের স্থলাভিষিক্ত হয়। এটি মূলত নৃবিজ্ঞান ও ইতিহাসের সমন্বিত রূপ যেখানে ভাষা, জনপ্রিয় সাংস্কৃতিক প্রথা ও ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর সাংস্কৃতিক ব্যাখ্যা প্রদান করে থাকে। এতে অতীতে মানুষের জ্ঞানচর্চা, প্রথা ও শিল্পের নথি ও বর্ণনা পরীক্ষা করা হয়। অতীতে মানুষ কীভাবে তাদের স্মৃতি ধরে রেখেছিল তা সাংস্কৃতিক ইতিহাসের আলোচনার প্রধান বিষয়।[17]

সেনাবাহিনীর ইতিহাস

সেনাবাহিনীর ইতিহাস হল যুদ্ধবিগ্রহ, যুদ্ধ কৌশল, যুদ্ধ, অস্ত্র ও যুদ্ধের মনস্তত্ত্ব বিষয়ক ধারণা। ১৯৭০ এর দশকের পর থেকে আবির্ভূত হওয়া নব্য সেনাবাহিনীর ইতিহাস সেনাপ্রধানদের চেয়ে সৈন্যদের প্রতি বেশি আলোকপাত করে, বিশেষ করে রণকৌশলের চেয়ে তাদের মনস্তত্ত্ব এবং সমাজ ও সংস্কৃতিতে যুদ্ধ বিগ্রহের বিরূপ প্রভাব নিয়ে আলোচনা করে।[18]

ইতিহাসবেত্তা

পেশাদার ও অপেশাদার ইতিহাসবেত্তগণ পূর্ববর্তী ঘটনাবলী আবিষ্কার, সংগ্রহ, সংগঠিত ও উপস্থাপন করেন। তারা প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ, পূর্বের লিখিত মৌলিক উৎস ও অন্যান্য উপায়ে, যেমন স্থানের নামের তথ্য আবিষ্কার করেন। ইতিহাসবেত্তাদের তালিকায় ঐতিহাসিক যুগের কালক্রম অনুযায়ী তাদের বিভিন্ন শ্রেণিতে ভাগ করা হয়, বিশেষ করে তাদের ইতিহাস লেখার সময় অনুসারে কারণ তিনি যে সময়ে বর্তমান ছিলেন সেই সময়ের ইতিহাস না লিখে অন্য কোন সময়ের ইতিহাস রচনায় বিশেষজ্ঞ হতে পারেন। কালনিরূপক ও আখ্যানকারগণ যদিও ইতিহাসবেত্তা নন, কিছু ক্ষেত্রে তাদেরকেও ইতিহাসবেত্তাদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়ে থাকে।

ছদ্মইতিহাস

ছদ্মইতিহাস হল এমন লিখিত রূপ যার সারমর্ম ঐতিহাসিক প্রকৃতির, কিন্তু ইতিহাস লিখনধারার চিরাচরিত রূপ থেকে ভিন্ন এবং এতে পরিণতি ভিন্ন হয়ে থাকে। এটি ঐতিহাসিক নেতিবাচকতার সাথে সম্পৃক্ত এবং জাতীয়, রাজনৈতিক, সেনাবাহিনী ও ধর্ম বিষয়ে নতুন, কল্পনাপ্রসূত ও বিরোধপূর্ণ ঐতিহাসিক প্রমাণের মাধ্যমে উপসংহার টেনে থাকে।[19]

আরও দেখুন

  • ইতিহাসের রূপরেখা

তথ্যসূত্র

  1. Joseph, Brian (Ed.); Janda, Richard (Ed.) (২০০৮)। The Handbook of Historical Linguistics (ইংরেজি ভাষায়)। Blackwell Publishing (প্রকাশিত হয় ৩০ ডিসেম্বর ২০০৪)। পৃষ্ঠা 163। আইএসবিএন 978-1-4051-2747-9।
  2. "What Is History? A Collection of Definitions" (ইংরেজি ভাষায়)। thoughtco। সংগ্রহের তারিখ ৩০ নভেম্বর ২০১৭
  3. "What is History & Why Study It?" (ইংরেজি ভাষায়)। ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২১ জানুয়ারি ২০১৪
  4. Ernst Breisach, Historiography: Ancient, medieval, and modern (University of Chicago Press, 2007).
  5. Georg G. Iggers, Historiography in the twentieth century: From scientific objectivity to the postmodern challenge (2005).
  6. E.g. W. H. Walsh, Introduction to the Philosophy of History (1951) ch.1 s.2.
  7. Collini, Stefan (অক্টোবর ১৯৮৫)। "What is Intellectual History?"History Today (ইংরেজি ভাষায়)। ৩৫ (১০)। সংগ্রহের তারিখ ৩০ নভেম্বর ২০১৭
  8. Marwick, Arthur (১৯৭০)। The Nature of History (ইংরেজি ভাষায়)। The Macmillan Press LTD। পৃষ্ঠা 169।
  9. Tosh, John (২০০৬)। The Pursuit of History (ইংরেজি ভাষায়)। Pearson Education Limited। পৃষ্ঠা 168–169।
  10. Robert Whaples, "Is Economic History a Neglected Field of Study?," Historically Speaking (April 2010) v. 11#2 pp 17-20, with responses pp 20-27
  11. Franco Amatori, and Geoffrey Jones, eds. Business History Around the World (2003) online edition
  12. Cochrane, Eric (১৯৭৫)। "What Is Catholic Historiography?"। Catholic Historical Review (ইংরেজি ভাষায়)। 61 (2): 169–190। জেস্টোর 25019673
  13. Gajano, Sofia Boesch; Caliò, Tommaso (১৯৯৮)। "Italian Religious Historiography in the 1990s"। Journal of Modern Italian Studies (ইংরেজি ভাষায়)। 3 (3): 293–306।
  14. Hughes, J. D. (২০০৬)। What is Environmental History
  15. Ainslie Embree and Carol Gluck, eds., Asia in Western and World History: A Guide for Teaching (M.E. Sharpe, 1997)
  16. Akita, Shigeru (Spring ২০১০)। "World History and the Emergence of Global History in Japan"। Chinese Studies in History। 43 Issue 3: 84–96।
  17. The first World Dictionary of Images: Laurent Gervereau (ed.), "Dictionnaire mondial des images", Paris, Nouveau monde, 2006, 1120p, আইএসবিএন ৯৭৮-২-৮৪৭৩৬-১৮৫-৮. (with 275 specialists from all continents, all specialities, all periods from Prehistory to nowadays) ; Laurent Gervereau, "Images, une histoire mondiale", Paris, Nouveau monde, 2008, 272p., আইএসবিএন ৯৭৮-২-৮৪৭৩৬-৩৬২-৩
  18. Pavkovic, Michael; Morillo, Stephen (২০০৬)। What is Military History? (ইংরেজি ভাষায়)। Oxford: Polity Press (প্রকাশিত হয় ৩১ জুলাই ২০০৬)। পৃষ্ঠা 3–4। আইএসবিএন 978-0-7456-3390-9।
  19. Novikov, S. P. (২০০০)। "Pseudohistory and pseudomathematics: fantasy in our life"। Russian Mathematical Surveys (ইংরেজি ভাষায়)। 55

বহিঃসংযোগ

This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.