সুন্নি (ইসলাম)
সুন্নি মুসলিমরা ইসলাম অনুসারীদের মধ্যে সবচেয়ে বড় সম্প্রদায়। সুন্নিরা আরো পরিচিত আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা'য়াত (আরবি: اهل السنة والجماعة ") সংক্ষেপে আহল আস-সুন্নাহ (আরবি: أهل السنة) নামে। সুন্নি শব্দের উৎপত্তি সুন্নাহ (আরবি: سنة) শব্দ থেকে যা দ্বারা ইসলামের নবি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী ও কর্মকে বুঝায়। নবি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবিত অবস্থায় সুন্নি বা শিয়া বা অন্য কোনো নামে কোনো সম্প্রদায় ছিল না। সুন্নিরা ইসলামের সেই অংশের প্রতিনিধিত্ব করে যারা নবি মুহাম্মদের মৃত্যুর পর সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে নির্বাচিত খলিফা আবু বকরকে মেনে নিয়েছিল। তাই প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থায় ( খিলাফত) নির্বাচন বা ‘শুরা’ সুন্নি ইসলামের একটা বড় বৈশিষ্ট্য। অধিকাংশ সুন্নি আইনজ্ঞরা নিজেদের সুন্নি আইনের চারটি ঘরানার (হানাফি, মালিকি, শাফিয়ি, হানবালি) যে কোনো একটির অনুসরণ করেন। এর বাইরেও কয়েকটি সংখ্যালঘু সুন্নি মাযহাব রয়েছে।
ইসলাম |
---|
এর ধারাবাহিক নিবন্ধের অংশ: |
|
আরো দেখুন
|
|
জনসংখ্যা
মুসলিম জনসংখ্যার কত অংশ কোন প্রধান ধারার সাথে যুক্ত আছে তা নির্ণয় করা পরিসংখ্যানবিদদের কাছে বেশ কষ্টকর ছিল। যেমন, শিয়া সুন্নি সংক্রান্ত বিস্তারিত তথ্য অনেক দেশেই পর্যাপ্ত পরিমাণে নেই। যখন কোনো তথ্য পাওয়া যায় না তখন দেশটিকে সুন্নি তালিকার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তবুও বিভিন্ন সূত্র ব্যবহার করে একজন মোটামুটি এই অনুমানে পৌঁছাতে পারে যে শিয়ারা মোট মুসলিম জনসংখ্যার ১০-১৫%। যদিও আরেকটি গ্রহণযোগ্য হিসেবে দেখা গেছে শিয়াদের মোট পরিমাণ ৭.৫%।[1] প্রকৃতপক্ষে এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার তথ্যমতে শিয়াদের পরিমাণ মোট মুসলিম জনসংখ্যার এক-দশমাংশেরও কম।
সুন্নি মাযহাব
ইসলামী আইনকে শরিয়াহ বলা হয়। আর এই শরিয়াহ তৈরি হয় কুরআন, সুন্নাহ, ইজমা ও কিয়াসের ভিত্তিতে। সুন্নিদের যারা এই আইনসমূহের ব্যাখ্যা দেন তাদের মধ্যে কিছু বিষয়ে মতপার্থক্য আছে। সুন্নিদের প্রধান চারটি মাযহাব (schools of thought) হল :
- হানাফি মাজহাব (ইমাম আবু হানিফা কর্তৃক উপস্থাপিত)
পারসিক ইমাম আবু হানিফা (জন্ম ৬৯৯খ্রি. - মৃত্যু ৭৬৭ খ্রি.) হলেন হানাফি মাজহাবের প্রবক্তা। তিনি ইরাকে জন্মগ্রহণ করেন। অন্য মাজহাবগুলোর তুলনায় তার মাজহাবটিতে প্রজ্ঞা ও যুক্তির উপর অনেক বেশি গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ভারত, আফগানিস্তান, মধ্য এশিয়া; দক্ষিণ রাশিয়া, ককেশাস, বলকান উপদ্বীপের কিছু অংশে, ইরাক, সিরিয়া, মিশর, ইয়েমেন এবং তুরস্কের অধিকাংশ মুসলিম এই মাজহাব অনুসরণ করেন।
- মালিকি মাযহাব (ইমাম মালিক ইবনে আনাস কর্তৃক উপস্থাপিত)
মালিক ইবনে আনাস (জন্ম : ৭১১ খ্রিষ্টাব্দ/ ৯৩ হিজরি - মৃত্যু : ৭৯৫ খ্রিষ্টাব্দ/ ১৭৯ হিজরি) তার তত্ত্বগুলো সুসংগঠিত করেন মদিনাতে যেখানে তার সাথে পরিচয় ঘটেছিলো নবি মুহাম্মদের বেঁচে থাকা এক বৃদ্ধ সাহাবির সঙ্গে। সমগ্র আফ্রিকা (মিশর ব্যতিত) ও পুর্ব উপকূল জুড়ে এই মাজহাবের প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়।
- শাফেয়ী মাজহাব (মুহাম্মদ ইবনে ইদরিস আশ-শাফি কর্তৃক উপস্থাপিত)
আল শাফি একজন মধ্যপন্থী হিসেবে বিবেচিত হন। তিনি প্রথমে ইরাকে ও পরে মিশরে শিক্ষালাভ করেন। ইন্দোনেশিয়া, মিশরের দক্ষিণ ভাগ, মালয়শিয়া এবং ইয়েমেনে এই মাজহাবের অনুসারীদের দেখা মেলে।
- হানবালি মাজহাব (আহমেদ ইবনে হাম্বল কর্তৃক উপস্থাপিত)
ইমাম আহমদ বিন হাম্বল(৭৮০-৮৫৫ খ্রি./ ১৬৪-২৪১ হিজরি) আশ-শাফির শিষ্য ছিলেন। তৎকালীন খলিফার সাথে কিছু মতভেদের কারণে তার উপর অনেক নির্যাতন করা হয়। আধুনিক সৌদি আরবের অনেকে এই মতের অনুসারী।
এই মাজহাবগুলোর মধ্যে অল্পবিস্তর পার্থক্য থাকলেও সুন্নিরা সব কয়টি পথকেই সঠিক মনে করেন। এই মাজহাবগুলো ছাড়াও আরো মাজহাব রয়েছে যাদের অনুসারী সংখ্যা খুবই নগণ্য কিংবা এরা কেউ বেঁচে নেই।
শরিয়াহকে ব্যাখ্যা করে বিশেষ আইন প্রণয়নকে ফিকহ বলে। মাজহাব হলো একটা বিশেষ উপায়ে ফিকহকে ব্যাখ্যা করার প্রচেষ্টা। এই ঘরানাগুলো বিশেষ কিছু প্রমাণ (শাফি ও হামবালি) কিংবা বিশেষ কিছু সাধারণ নীতিমালা (হানাফী ও মালিকী) এর উপর গুরুত্ব আরোপ করে। যেহেতু এই মাজহাবগুলো শরিয়াহ ব্যাখ্যা করার পদ্ধতিগত ভিন্নতা নির্দেশ করে, তাই প্রতিটি ধারাতেই কিছু না কিছু পার্থক্য আছে। সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের সাথে সাথে নতুন নতুন ফিকহ আইন তৈরি হয়। যেমন, একসময় তামাক সেবনে অনুৎসাহিত করা হতো এর উৎকট গন্ধের কারণে কিন্তু পরবর্তীতে গবেষণায় এর খারাপ দিকগুলো উন্মোচিত হওয়ায় এটিকে এখন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ফলাফল হলো শরিয়া অপরিবর্তিত থাকলেও ফিকহ সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হচ্ছে।
সুন্নীদের মতে মাজহাব ও ধর্মীয় উপদল একই বিষয় নয়। কারণ মাজহাবগুলো পরস্পরকে স্বীকৃতি দেয়। একটি বড় মুসলিম জনগোষ্ঠীতে চারটি মাজহাবের অনুসারী চিন্তাবিদই থাকতে পারে। এটা সম্পূর্ণ লোকজনের ব্যাপার যে তারা কোনটা পছন্দ করবে। অনেক সুন্নি মনে করেন যে, একজন মুসলিমের শুধু একটি মাজহাবই অনুসরণ করা উচিত। যদিও ব্যতিক্রমী পরিস্থিতিতে অন্য মাজহাব থেকেও বিধান নেওয়া যেতে পারে। কিছু সুন্নিরা আবার নির্দিষ্ট কোনো মাজহাব অনুসরণ করেন না। যেমন, আহলে হাদীসরা বিশেষ কোনো মাজহাব মেনে চলতে অস্বীকৃতি জানায়।
সুন্নি ধর্মতাত্ত্বিক ঐতিহ্য
বিভিন্ন যুগে মুসলিম চিন্তাবিদগণ স্রষ্টার প্রকৃতি, মানুষের স্বাধীন ইচ্ছা আছে কিনা ইত্যাদি দার্শনিক প্রশ্নের মুখোমুখী হয়েছেন। ধর্মতত্ত্ব ও দর্শনের বিভিন্ন মতানুসারীগণ বিভিন্নভাবে এই প্রশ্নের জবাব দিতে চেষ্টা করেছেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ধর্মতাত্ত্বিক ব্যাখ্যাগুলো হলো :
- আশয়ারিয়া, যা কিনা আবুল হাসান আশয়ারি কর্তৃক উপস্থাপিত। এই ব্যাখ্যাগুলো ইমাম গাজালি কর্তৃক বেশ সমাদৃত হয়।
- এই ধর্মতত্ত্বে মরমী জ্ঞানকে প্রজ্ঞার উপর স্থান দেওয়া হয়। তাদের মতে নৈতিক নিয়মসমূহ মানবিক প্রজ্ঞা থেকে তৈরি করা যায় না, বরং স্রষ্টার নির্দেশ, যেমনটা কুরআনে উল্লেখিত এবং হযরত মুহাম্মদ(সা.) এর জীবনাদর্শ (সুন্নাহ)-ই হলো সকল প্রকার নৈতিকতার উৎস।
- স্রষ্টার প্রকৃতি সম্পর্কে তারা মুতাজিলাদের অবস্থানকে বর্জন করে (যে তত্ত্বমতে কুরআনে স্রষ্টা সংক্রান্ত সকল ভৌত গুণ রূপক)।[2] আশারিয়া জোর দেয় যে, বরং এই সকল গুণ সঠিক, কারণ কুরআন ভুল হতে পারে না, তবে স্রষ্টার উপর মোটা দাগের নরত্ব আরোপ করে এগুলো উপলব্ধি করা সম্ভব নয়।
- আশারিয়া মানবীয় স্বাধীন ইচ্ছার বিপরীতে স্রষ্টার সর্বময় ক্ষমতার উপর জোর দেয়। তারা বিশ্বাস করে যে, কুরআন সৃষ্ট নয় এবং তা অনাদিকাল থেকে বিদ্যমান।
- মাতুরিদি (আবু মনসুর আল মাতুরিদি কর্তৃক উপস্থাপিত) যতদিন পর্যন্ত না মধ্য এশিয়ার তুরস্কের (যারা আগে আশআরি ও আল-শাফির অনুসারী ছিল) গোষ্ঠীগুলো এই ধারণা গ্রহণ করে ততদিন পর্যন্ত এই মতবাদের অনুসারীরা খুবই সংখ্যালঘু ছিল। গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে একটি হলো সেলজুক তুর্ক, যারা তুরস্কে চলে গিয়েছিল, যেখানে কিনা পরবর্তীতে উসমানীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।[3] তাদের প্রতিষ্ঠিত আইনি ব্যবস্থা গোটা সাম্রাজ্যে প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল।
- মাতুরিদিরা দাবি করত যে স্রষ্টার অস্তিত্ব মানবীয় প্রজ্ঞা থেকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব।
- আতারিয়াহ বা হানবালি, নির্দিষ্ট কোনো প্রচারকারীর নাম পাওয়া যায় না, তবে ইমাম আহমেদ ইবনে হানবালি এই মতবাদগুলো সজীব রাখার ব্যাপারে ঐতিহাসিক ভূমিকা রেখেছেন।
হাদিসের প্রতি সুন্নি দৃষ্টিভঙ্গি
যে কুরআন আজ আমরা দেখি সেটা আনুমানিক ৬৫০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সহচারীদের দ্বারা সংকলিত হয় এবং তা সমগ্র মুসলিমদের দ্বারা স্বীকৃত হয়। তৎকালীন আরবরা দৈনন্দিন জীবনে এমন অনেক কিছুর সম্মুখীন হতো যেগুলো সরাসরি কুরআনে ছিল না। এক্ষেত্রে তারা হযরত মুহাম্মদ (সা.) ও তার সহাচারীদের জীবনাদর্শ অনুসরণ করতো। হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর এই জীবনাদর্শ (বাণী ও কর্ম)-কে হাদিস বলা হয়। মুসলিম চিন্তাবিদরা এইসকল হাদিসের বর্ণনাকারীদের ধারা অনুসরণ করে ও তাদের বিশ্বস্ততা যাচাই করে হাদিসের গ্রহণযোগ্যতা নির্ধারণ করে থাকেন। সুন্নিরা সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম নামে দুটি হাদিসগ্রন্থকে বাকিগুলোর তুলনায় অধিকতর গ্রহণযোগ্য মনে করেন। যদিও ছয়টি হাদিস সংকলন মুসলিমদের কাছে বিশেষ গুরত্ব বহন করে। এগুলো হলো :
এছাড়াও আরো কিছু কম পরিচিত হাদিস সংকলন বিদ্যমান। যেমন :
- মুয়াত্তা মালিক
- মুসনাদে আহমাদ
- সহিহ ইবনে খুযায়মাহ
- মুস্তাদারাকে আল হাকিম
- মুসান্নাফে আবদুল রাজ্জাক
- মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা
আরও দেখুন
তথ্যসূত্র
- ""How Many Shia Are in the World?""। IslamicWeb.com। সংগ্রহের তারিখ ২০০৬-১০-১৮।
- Bülent Þenay। "Ash'ariyyah Theology, Ashariyyah"। BELIEVE Religious Information Source। সংগ্রহের তারিখ ২০০৬-০৪-০১।
- "Maturidiyyah"। Philtar। ২০০৬-০২-২৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৬-০৪-০১।
বহিঃসংযোগ
- Philosophia Islamica
- University of Southern California, Compendium of Muslim Texts
- Fiqh al-Akbar by Imam Abu Hanifah
- Searchable Ar-Risala by Imam Shafi'i
- Foundations of the Sunnah, by Imam Ahmad ibn Hanbal
- Sunni Path