হামিদুর রহমান

মোহাম্মদ হামিদুর রহমান (২ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৩ - ২৮ অক্টোবর ১৯৭১) বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে চরম সাহসিকতা আর অসামান্য বীরত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ যে সাতজন বীরকে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সামরিক সম্মান “বীরশ্রেষ্ঠ” উপাধিতে ভূষিত করা হয় তিনি তাদের অন্যতম।[1][2] মাত্র ১৮ বছর বয়সে শহীদ হওয়া হামিদুর রহমান সাত জন বীর শ্রেষ্ঠ পদকপ্রাপ্ত শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ।[3]

মোহাম্মদ হামিদুর রহমান
জন্মফেব্রুয়ারি ২, ১৯৫৩
হামিদনগর (পূর্বতন খোরদা খালিশপুর), মহেশপুর, ঝিনাইদহ (পূর্বতন যশোর)
মৃত্যুঅক্টোবর ২৮, ১৯৭১
ধলই, শ্রীমঙ্গল, সিলেট
জাতীয়তাবাংলাদেশী
নাগরিকত্ব পাকিস্তান (১৯৭১ সালের পূর্বে)
 বাংলাদেশ
পরিচিতির কারণবীর শ্রেষ্ঠ
টীকা
৪নং সেক্টরে যুদ্ধ করেন (সৈনিক নাম্বার ৩৯০৪৩০১)

জন্ম ও শিক্ষাজীবন

মোহাম্মদ হামিদুর রহমানের জন্ম ১৯৫৩ সালের ২ ফেব্রুয়ারি তদানিন্তন যশোর জেলার (বর্তমানে ঝিনাইদহ জেলা) মহেশপুর উপজেলার খর্দ্দ খালিশপুর গ্রামে।[1][4][5] তার পিতার নাম আক্কাস আলী মন্ডল এবং মায়ের নাম মোসাম্মাৎ কায়মুন্নেসা। শৈশবে তিনি খালিশপুর প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং পরবর্তীকালে স্থানীয় নাইট স্কুলে সামান্য লেখাপড়া করেন।

কর্মজীবন

১৯৭০ সালে হামিদুর যোগ দেন সেনাবাহিনীতে সিপাহী পদে৷ তার প্রথম ও শেষ ইউনিট ছিল ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট৷ সেনাবাহিনীতে ভর্তির পরই প্রশিক্ষণের জন্য তাকে পাঠানো হলো চট্টগ্রামের ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট সেন্টারে৷ ২৫ মার্চের রাতে চট্টগ্রামের ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ওখানকার আরও কয়েকটি ইউনিটের সমন্বয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়৷

মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা

কবর

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আক্রমণের মুখে চাকরিস্থল থেকে নিজ গ্রামে চলে আসেন। বাড়ীতে একদিন থেকে পরদিনই মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার জন্য চলে যান মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ থানার ধলই চা বাগানের পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত ধলই বর্ডার আউটপোস্টে। তিনি ৪নং সেক্টরে যুদ্ধ করেন। ১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসে হামিদুর রহমান ১ম ইস্টবেঙ্গলের সি কোম্পানির হয়ে ধলই সীমান্তের ফাঁড়ি দখল করার অভিযানে অংশ নেন। ভোর চারটায় মুক্তিবাহিনী লক্ষ্যস্থলের কাছে পৌছে অবস্থান নেয়। সামনে দু প্লাটুন ও পেছনে এক প্লাটুন সৈন্য অবস্থান নিয়ে অগ্রসর হতে থাকে শত্রু অভিমুখে। শত্রু অবস্থানের কাছাকাছি এলে একটি মাইন বিস্ফোরিত হয়। মুক্তিবাহিনী সীমান্ত ফাঁড়ির খুব কাছে পৌছে গেলেও ফাঁড়ির দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্ত হতে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর মেশিনগানের গুলিবর্ষণের জন্য আর অগ্রসর হতে পারছিলো না। অক্টোবরের ২৮ তারিখে ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও পাকিস্তান বাহিনীর ৩০এ ফ্রন্টিয়ার রেজিমেন্টের মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ বাধে। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ১২৫ জন মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধে অংশ নেয়। মুক্তিবাহিনী পাকিস্তান বাহিনীর মেশিনগান পোস্টে গ্রেনেড হামলার সিদ্ধান্ত নেয়। গ্রেনেড ছোড়ার দায়িত্ব দেয়া হয় হামিদুর রহমানকে। তিনি পাহাড়ি খালের মধ্য দিয়ে বুকে হেঁটে গ্রেনেড নিয়ে আক্রমণ শুরু করেন। দুটি গ্রেনেড সফলভাবে মেশিনগান পোস্টে আঘাত হানে, কিন্তু তার পরপরই হামিদুর রহমান গুলিবিদ্ধ হন।[6] সে অবস্থাতেই তিনি মেশিনগান পোস্টে গিয়ে সেখানকার দুই জন পাকিস্তানী সৈন্যের সাথে হাতাহাতি যুদ্ধ শুরু করেন। এভাবে আক্রণের মাধ্যমে হামিদুর রহমান এক সময় মেশিনগান পোস্টকে অকার্যকর করে দিতে সক্ষম হন। এই সুযোগে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মুক্তিযোদ্ধারা বিপুল উদ্যমে এগিয়ে যান, এবং শত্রু পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে পরাস্ত করে সীমানা ফাঁড়িটি দখল করতে সমর্থ হন। কিন্তু হামিদুর রহমান বিজয়ের স্বাদ আস্বাদন করতে পারেননি, ফাঁড়ি দখলের পরে মুক্তিযোদ্ধারা শহীদ হামিদুর রহমানের লাশ উদ্ধার করে।[6] হামিদুর রহমানের মৃতদেহ সীমান্তের অল্প দূরে ভারতীয় ভূখন্ডে ত্রিপুরা রাজ্যের হাতিমেরছড়া গ্রামের স্থানীয় এক পরিবারের পারিবারিক গোরস্থানে দাফন করা হয়।[7] নীচু স্থানে অবস্থিত কবরটি এক সময় পানির তলায় তলিয়ে যায়। ২০০৭ সালের ২৭শে অক্টোবর বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক সরকার হামিদুর রহমানের দেহ বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেয়।[8] সেই অনুযায়ী ২০০৭ সালের ১০ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ রাইফেলসের একটি দল ত্রিপুরা সীমান্তে হামিদুর রহমানের দেহাবশেষ গ্রহণ করে, এবং যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে কুমিল্লার বিবিরহাট সীমান্ত দিয়ে শহীদের দেহাবশেষ বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়। ১১ই ডিসেম্বর রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানকে ঢাকার বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।[9][10]

পুরস্কার ও সম্মাননা

মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সামরিক পদক বীরশ্রেষ্ঠ পদক দেয়া হয় সিপাহী হামিদুর রহমানকে। এছাড়া তার নিজের গ্রাম 'খোর্দ খালিশপুর'-এর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় হামিদনগর৷ এই গ্রামে তার নামে রয়েছে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়৷ ঝিনাইদহ সদরে রয়েছে একটি স্টেডিয়াম[11]।একটি ফেরিও তার নামে রাখা হয়েছে।[12] ১৯৯৯ সালে খালিশপুর বাজারে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে একটি কলেজ ৷ স্বাধীনতার ৩৬ বছর পর এই শহীদের স্মৃতি রক্ষার্থে তার গ্রামে লাইব্রেরি ও স্মৃতি জাদুঘর নির্মাণের কাজ শুরু করেছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়[13]১২ জুন ২০০৭ সালে এই কলেজ প্রাঙ্গণে ৬২ লাখ ৯০ হাজার টাকা ব্যয়ে শুরু হয় এই নির্মাণ কাজ৷

২০১৬ সালে কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের (টিএসসিসি) নাম পরিবর্তন করে বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের নামে বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান কেন্দ্রীয় মিলনায়তন নামকরণ করা হয়েছে[14]। 

আরও দেখুন

তথ্যসূত্র

  1. একাত্তরের বীরযোদ্ধাদের অবিস্মরণীয় জীবনগাঁথা, খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা সম্মাননা স্মারকগ্রহন্থ। জনতা ব্যাংক লিমিটেড। জুন ২০১২। পৃষ্ঠা 32। আইএসবিএন 9789843351449।
  2. দৈনিক প্রথম আলো, "তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না"| তারিখ: ১৬-১২-২০১২
  3. মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রনালয়
  4. "Birshreshtha Hamidur Rahman Laid To Rest"The Daily Star। ডিসেম্বর ১২, ২০০৭।
  5. একাত্তরের বীরযোদ্ধাদের অবিস্মরণীয় জীবনগাঁথা, খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা সম্মাননা স্মারকগ্রহন্থ। মতিঝিল, ঢাকা: জনতা ব্যাংক লিমিটেড (প্রকাশিত হয় জুন ২০১২)। ২০১২। পৃষ্ঠা ৩২। আইএসবিএন 978-984-33-5144-9।
  6. "বীর হামিদুরের ঘরে ফেরা"। Chutir Dine, Prothom Alo (Bengali ভাষায়)। Mahfuz Anam। ১৫ ডিসেম্বর ২০০৭। পৃষ্ঠা 4–6।
  7. "Bangladesh takes home teenage war hero"রয়টার্স। Dec 10 2007। সংগ্রহের তারিখ 28 February 2008 এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন: |তারিখ= (সাহায্য)
  8. "বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুরের দেহাবশেষ দেশে এনে সমাহিত করা হবে"। Prothom Alo (Bengali ভাষায়)। Mahfuz Anam। ২৮ অক্টোবর ২০০৭। পৃষ্ঠা 20।
  9. "Home they brought warrior dead: Bir Shreshtha Hamidur to be buried at Martyred Intellectuals' Graveyard today"The New Nation। December 11 2007। সংগ্রহের তারিখ February 28, 2008 এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন: |তারিখ= (সাহায্য)
  10. "Bangladesh buries teenage war hero with state honors"Reuters। December 11 2007। সংগ্রহের তারিখ December 29, 2009 এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন: |তারিখ= (সাহায্য)
  11. Staff। "Ershad denies calling any party hated"thefinancialexpress-bd.com। The Financial Express। সংগ্রহের তারিখ ১৮ জুন ২০১৫
  12. Star Report। "Ferry services go haywire"archive.thedailystar.net। The Daily Star। সংগ্রহের তারিখ ১৮ জুন ২০১৫
  13. Correspondent। "Birshrestha Hamidur museum opens"archive.thedailystar.net। The Daily Star। সংগ্রহের তারিখ ১৮ জুন ২০১৫
  14. "বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের নামে কেন্দ্রীয় মিলনায়তন"প্রথম আলো। সংগ্রহের তারিখ ২০১৭-০৩-২৩

বহিঃসংযোগ

This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.