মসজিদ আল-হারাম

মসজিদ আল-হারাম (আরবি: المسجد الحرام) ইসলামের সবচেয়ে পবিত্র স্থান যা কাবাকে ঘিরে অবস্থিত।[2] সৌদি আরবের মক্কা শহরে এর অবস্থান। মুসলিমরা নামাজের সময় কাবার দিকে মুখ করে দাঁড়ায়। হজ্জউমরার জন্যও মসজিদুল হারামে যেতে হয়।

মসজিদ আল-হারাম
পবিত্র মসজিদ
মসজিদ আল-হারাম
সৌদি আরবে অবস্থান
স্থানাঙ্ক: ২১.৪২২° উত্তর ৩৯.৮২৬° পূর্ব / 21.422; 39.826
অবস্থান মক্কা, সৌদি আরব[1]
প্রতিষ্ঠিত ইসলাম পূর্ব যুগ
শাখা/ঐতিহ্য ইসলাম
প্রশাসন সৌদি আরব সরকার
পরিচালনা
স্থাপত্য তথ্য
ধারণক্ষমতা ৯,০০,০০০ মুসল্লি (হজ্জের সময় ৪০,০০,০০০ তে উন্নীত হয়।)
মিনার
মিনারের উচ্চতা ৮৯ মিটার (২৯২ ফুট)

ওয়েবসাইট: www.gph.gov.sa

ভেতরের ও বাইরের নামাজের স্থান মিলে মসজিদের বর্তমান কাঠামো প্রায় ৩,৫৬,৮০০ বর্গমিটার (৮৮.২ একর) জুড়ে অবস্থিত। মসজিদ সার্বক্ষণিক খোলা থাকে। হজ্জের সময় এখানে উপস্থিত হওয়া মানুষের জমায়েত পৃথিবীর বৃহত্তম মানব সমাবেশের অন্যতম।

ইতিহাস

ইসলামপূর্ব যুগ

কুরআনে বর্ণিত রয়েছে যে ইবরাহিম (আ) ও ইসমাইল (আ) দুজন একত্রে কাবা নির্মাণ করেন। ইবরাহিম (আ) কাবার পূর্ব কোণে হাজরে আসওয়াদ পাথর স্থাপন করেছিলেন যা হাদিস অনুযায়ী বেহেশত থেকে আগত। এই পাথর একসময় দুধের মত সাদা ছিল কিন্তু মানুষের গুনাহর কারণে এটি কালো হয়ে পড়ে। ইবরাহিম (আ) এর নির্মিত কাবার মধ্যে এই পাথরটিই একমাত্র আদি বস্তু হিসেবে টিকে রয়েছে।

কাবা নির্মাণ সম্পন্ন হওয়ার পর ইবরাহিম (আ) কে হজ্জের জন্য আহ্বান করতে আদেশ দেয়া হয়। কুরআনের সূরা হজ্জে উল্লেখ আছে

আর মানুষের কাছে হজ্জ ঘোষণা করে দাও। ওরা তোমার কাছে আসবে পায়ে হেটে ও ধাবমান উটের পিঠে চড়ে, আসবে দুরদূরান্তের পথ অতিক্রম করে। (সূরা হজ্জ, আয়াত ২৭)

কাবা ২১৩০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে নির্মিত হয় বলে অনুমান করা হয়ে থাকে। ইসলাম অনুযায়ী কাবা পৃথিবীর প্রথম ইবাদতের স্থান।

প্রাথমিকভাবে আল্লাহর ইবাদতের উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হলেও কালক্রমে কাবা পৌত্তলিকতার চর্চা শুরু হয়। মক্কা বিজয়ের আগে এখানে ৩৬০টি দেবদেবীর মূর্তি ছিল।

প্রথম ইসলামি যুগ

মুহাম্মদ (সা) এর মক্কা বিজয়ের পর কাবার মূর্তিগুলো ভেঙে ফেলা হয়। ফলে কাবায় পৌত্তলিকতার চর্চা বন্ধ হয়ে যায়। এরপর মসজিদুল হারামের নির্মাণ বিভিন্ন সময়ে সম্পাদিত হয়।

৬৯২ খ্রিষ্টাব্দে মসজিদে প্রথম বড় আকারের সংস্কার সাধিত হয়। এর পূর্বে মসজিদ ছিল কাবাকে কেন্দ্র করে একটি খোলা স্থান। সংস্কারে ছাদসহ দেয়াল দিয়ে এলাকাটি ঘিরে দেয়া হয়। ৮ম শতাব্দীর শেষ নাগাদ মসজিদের পুরনো কাঠের স্তম্ভগুলোর বদলে মার্বেলের স্তম্ভ স্থাপন করা হয় এবং নামাজের স্থান বৃদ্ধিসহ মিনার যুক্ত করা হয়। ইসলামের প্রচার বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে হাজিদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় মসজিদে আরো সংস্কার করা হয়।

উসমানীয় যুগ

উসমানীয় সাম্রাজ্যের যুগে ১৮৫০ খ্রিষ্টাব্দে মক্কা।

১৫৭০ খ্রিষ্টাব্দে উসমানীয় সুলতান দ্বিতীয় সেলিম প্রধান স্থপতি মিমার সিনানকে মসজিদ পুনর্নির্মাণের আদেশ দেন। এই পুনর্নির্মাণের সময় সমতল ছাদগুলোর বদলে ক্যালিগ্রাফি সম্বলিত গম্বুজ ও নতুন স্তম্ভ স্থাপন করা হয়। এগুলো বর্তমান মসজিদের সবচেয়ে পুরনো প্রত্ননিদর্শ‌ন।

১৯১০ খ্রিষ্টাব্দে মক্কা

১৬২১ ও ১৬২৯ খ্রিষ্টাব্দে বৃষ্টি ও বন্যার কারণে কাবা ও মসজিদ আল হারামের দেয়াল ক্ষতিগ্রস্ত হয়।[3] ১৬২৯ খ্রিষ্টাব্দে সুলতান চতুর্থ মুরাদের শাসনামলে কাবা পুনর্নির্মিত হয় এবং মসজিদ আল হারাম সংস্কার করা হয়। মসজিদ সংস্কারের সময় পাথরের নতুন খিলান নির্মিত হয় এবং তিনটি নতুন মিনার যুক্ত করা হয়। মেঝেতে মার্বেলের আচ্ছাদন নতুন করে স্থাপিত হয়। এরপর প্রায় তিনশত বছর মসজিদের রূপ অপরিবর্তিত ছিল।

সৌদি যুগ

সৌদি শাসন শুরু হওয়ার পর ১৯৫৫ থেকে ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে বড় আকারের সংস্কার সাধিত হয়। এসময় আরো চারটি মিনার যুক্ত করা হয়, ছাদ সংস্কার করা হয় এবং মেঝে পাথর ও মার্বেল দিয়ে আচ্ছাদিত করা হয়। সাফা ও মারওয়াকে এসময় মসজিদের দালানের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সংস্কারের সময় উসমানীয় যুগের অনেক অংশ বাদ দেয়া হয়েছিল।

বাদশাহ ফাহাদ বিন আবদুল আজিজের শাসনামলে দ্বিতীয়বার সংস্কার করা হয়। এসময় নামাজের নতুন স্থান এবং বাইরে নামাজ পড়ার স্থান যুক্ত করা হয়। এই নতুন অংশে কিং ফাহাদ গেট দিয়ে প্রবেশ করা যায়। ১৯৮২ থেকে ১৯৮৮ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে এই সংস্কার কাজ সম্পন্ন হয়।

১৯৮৮ থেকে ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে তৃতীয় সৌদি সম্প্রসারণ সম্পন্ন হয়। এসময় আরো মিনার যুক্ত করা হয়। সেসাথে আরাফাত, মিনা, মুজদালিফাতেও বিভিন্ন স্থাপনা নির্মিত হয়। তৃতীয় সম্প্রসারণে ১৮টি নতুন ফটক যুক্ত করা হয়, প্রায় ৫০০টি মার্বেল স্তম্ভ যুক্ত করা হয়, তাপ নিয়ন্ত্রিত মেঝে, এয়ার কন্ডিশন, চলন্ত সিড়ি ও পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা যুক্ত হয়।

বর্তমান সম্প্রসারণকার্য‌

২০০৭ খ্রিষ্টাব্দে মসজিদ আল হারামের চতুর্থ সম্প্রসারণ কার্য‌ শুরু হয় যা ২০২০ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ শেষ হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তৎকালীন বাদশাহ আবদুল্লাহ বিন আবদুল আজিজ মসজিদের ধারণ ক্ষমতা ২০ লক্ষে উন্নীত করার পরিকল্পনা করেন। ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দে বাদশাহ মারা যাওয়ার পর তার উত্তরসূরি সালমান বিন আবদুল আজিজ এই সম্প্রসারণ চালু রেখেছেন।[4] ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দের ১১ সেপ্টেম্বর সম্প্রসারণের সময় ব্যবহৃত একটি ক্রেন ঝড়ে ভেঙে পড়ায় ১১১ জন মারা যান।[5][6][7][8][9][10]

সম্প্রসারণ কাজের সময় মাতাফে তাওয়াফের জন্য ব্যবহৃত অস্থায়ী স্থাপনা।

ধর্মীয় গুরুত্ব

মসজিদুল হারাম ইসলামের প্রধানতম মসজিদ। এখানে অবস্থিত কাবার দিকে ফিরে মুসলিমদের নামাজ পড়তে হয়। হজ্জ ও উমরার সময়ও মসজিদুল হারামে উপস্থিত হতে হয়।

কিবলা

কাবা মুসলিমদের কিবলা। যেকোনো নামাজ পড়ার সময় এর দিকে ফিরতে হয়। মুহাম্মদ (সা) নবুয়ত লাভের পর প্রথমে মসজিদুল আকসার দিকে ফিরে নামাজ পড়তে হত। হিজরতের পর কুরআনের নির্দেশ অনুযায়ী কাবাকে কিবলা হিসেবে ব্যবহার শুরু হয়। মসজিদে কিবলাতাইনে এ বিষয়ক কুরআনের আয়াত নাযিল হয়েছিল।

হজ্জ ও উমরা

হজ্জউমরা পালনের সময় মুসলিমরা মসজিদুল হারামে আসেন। তবে হজ্জের সময় মসজিদুল হারাম ছাড়াও আরাফাত, মিনা ও মুজদালিফাতে যেতে হয়।

হজ্জের সময় মসজিদুল হারামের প্যানারোমা দৃশ্য, ২০০৭ খ্রিষ্টাব্দ।

গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা

কাবা

কাবা ঘনকাকৃতির একটি স্থাপনা যা ইসলামের অন্যতম পবিত্র স্থান।[11] কাবার দিকে ফিরে নামাজ পড়া হয়। হজ্জ ও উমরার সময় কাবাকে ঘিরে তাওয়াফ করা হয়।[11][12][13]

হাজরে আসওয়াদ

হাজরে আসওয়াদ চুম্বনের জন্য ভিড়।

হাজরে আসওয়াদ কাবার পূর্ব কোণে অবস্থিত কালো রঙের পাথর।[14] তাওয়াফের শুরুতে এই পাথর চুমু দিতে হয়। তবে ভিড় বা অন্য কোনো কারণে সামনে যাওয়া সম্ভব না হলে হাতের ইশারা করে তাওয়াফ শুরু করা নিয়ম

মাকামে ইবরাহিম

মাকামে ইবরাহিম মাতাফে একটি কাচের আবরণে অবস্থিত পাথর। ইবরাহিম (আ) কাবা নির্মাণের সময় এর উপর দাঁড়িয়েছিলেন। এতে তার পায়ের ছাপ রয়েছে।

সাফা ও মারওয়া

মসজিদুল হারামে সাফা পাহাড়।

সাফা ও মারওয়া কাবার পাশে দুটি পাহাড়। বর্তমানে মসজিদ সম্প্রসারণের মাধ্যমে এগুলোকে মসজিদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ইবরাহিম (আ) এর স্ত্রী হাজেরা (আ) তার শিশুপুত্র ইসমাইল (আ) এর জন্য পানির সন্ধানে এই দুই পাহাড়ে সাতবার ছোটাছুটি করেছিলেন। তার অনুকরণে এই দুই পাহাড়ে হজ্জ ও উমরার সময় সায়ি করা হয়।

জমজম কুয়া

জমজমের পানি সরবরাহের কল
মূল কমপ্লেক্সের পশ্চিম অংশে একটি হালাকা

জমজম কুয়া মসজিদুল হারামের মধ্যে অবস্থিত।[15] পূর্বে মাতাফের উপর জমজমের অংশ ছিল। পরে তা ভূগর্ভস্থ করে ফেলা হয় এবং পাম্পের সাহায্যে পানি উত্তোলনের ব্যবস্থা করা হয়। সহীহ হাদীসে আছে জিবরাঈল (আ) এর পায়ের আঘাতে জমজম সৃষ্টি হয়েছিল।[16]

আরও দেখুন

তথ্যসূত্র

  1. "Location of Masjid al-Haram"। Google Maps। সংগ্রহের তারিখ ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৩
  2. "The 40 Steps Towards the Grave of the Prophet Muhammad صلى الله عليه و آله و صحبه وسلم . The Virtues of Madinah. #1 | Muwatta.com - The People of Madina"। muwatta.com। সংগ্রহের তারিখ ৭ আগস্ট ২০১৪
  3. James Wynbrandt (২০১০)। A Brief History of Saudi Arabia। Infobase Publishing। পৃষ্ঠা 101। আইএসবিএন 978-0-8160-7876-9। সংগ্রহের তারিখ ১২ জুন ২০১৩
  4. Ambitious new architecture plan for Al-Masjid Al-Haram
  5. "Makkah crane crash report submitted"Al Arabiya। ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৫। সংগ্রহের তারিখ ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৫
  6. "Daftar Nama Jemaah Rawat/Wafat Musibah Jatuhnya Crane Di Masjidil Haram 11 September 2015" [Names of Pilgrims Hospitalized/Dead in Calamity of Haram Crane Collapse September 11, 2015] (Indonesian ভাষায়)। Direktorat Jenderal Penyelenggaraan Haji dan Umrah - Kementerian Agama Republik Indonesia। ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৫। সেপ্টেম্বর ১৯, ২০১৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৫
  7. "King Salman to make findings of Makkah crane collapse probe public"। সংগ্রহের তারিখ ২০১৫-০৯-১৪
  8. "Number of casualties of Turkish Haji candidates at the Kaaba accident reach 8…"Presidency of Religious Affairs। ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৫। ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৫
  9. "Six Nigerians among victims of Saudi crane accident: official"Yahoo! NewsAFP। ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৫। সংগ্রহের তারিখ ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৫
  10. Halkon, Ruth; Webb, Sam (১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৫)। "Two Brits dead and three injured in Mecca Grand Mosque crane tragedy that killed 107 people l"Mirror Online। সংগ্রহের তারিখ ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৫
  11. Wensinck, A. J; Ka`ba. Encyclopaedia of Islam IV p. 317
  12. "In pictures: Hajj pilgrimage"BBC News। ৭ ডিসেম্বর ২০০৮। সংগ্রহের তারিখ ৮ ডিসেম্বর ২০০৮
  13. "As Hajj begins, more changes and challenges in store"। altmuslim। ১১ জানুয়ারি ২০১২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২২ ডিসেম্বর ২০১৬
  14. Shaykh Safi-Ar-Rahman Al-Mubarkpuri (২০০২)। Ar-Raheeq Al-Makhtum (The Sealed Nectar): Biography of the Prophet। Dar-As-Salam Publications। আইএসবিএন 1-59144-071-8।
  15. "Zamzam Studies and Research Centre"Saudi Geological Survey। ৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৫ জুন ২০০৫
  16. সহীহ বুখারী । হাদীস নং : ৩৩৬৫ । আল হাদিস অ্যাপ ।

বহিঃসংযোগ

This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.