ঈদুল আযহা
ঈদ উল আযহা বা ঈদ উল আজহা বা ঈদ উল আধহা (আরবি: عيد الأضحى, প্রতিবর্ণী. ʿīd al-ʾaḍḥā, অনুবাদ 'ত্যাগের উৎসব', [ʕiːd ælˈʔɑdˤħæː]) ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় দুটো ধর্মীয় উৎসবের দ্বিতীয়টি।[1] চলতি কথনে এই উৎসবটি কুরবানির ঈদ নামেও পরিচিত। এই উৎসবকে ঈদুজ্জোহাও বলা হয়। ঈদুল আযহা মূলত আরবি বাক্যাংশ। এর অর্থ হলো ‘ত্যাগের উৎসব’।[2] এই উৎসবের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হল ত্যাগ করা। এ দিনটিতে মুসলমানেরা ফযরের নামাযের পর ঈদগাহে গিয়ে দুই রাক্বাত ঈদুল আযহার নামাজ আদায় করে ও অব্যবহিত পরে স্ব-স্ব আর্থিক সামর্থ্য অনুযায়ী গরু, ছাগল, ভেড়া, মহিষ ও উট আল্লাহর নামে কোরবানি করে।
ঈদুল আযহা | |
---|---|
![]() ঈদুল আযহার জন্য আশীর্বাদ | |
আনুষ্ঠানিক নাম | عيد الأضحى |
পালনকারী | মুসলিম |
ধরন | ইসলামি |
তাৎপর্য |
|
পালন | ঈদের নামাজ, কুরবানি, দান, সামাজিক সমাবেশ, ভোজ, উপহার বিনিময় |
শুরু | ১০ জ্বিলহজ্জ |
সমাপ্তি | ১২ বা ১৩ জ্বিলহজ্জ |
তারিখ | জ্বিলহজ্জ ১০ |
সম্পর্কিত | হজ্জ; ঈদুল ফিতর |
![]() |
ইসলামী সংস্কৃতি |
---|
ধারাবাহিকের অংশ |
স্থাপত্য |
|
শিল্প |
|
পোশাক |
|
ছুটির দিন |
সাহিত্য |
সঙ্গীত |
থিয়েটার |
|
|
ইসলামি চান্দ্র পঞ্জিকায়, ঈদুল আযহা জ্বিলহজ্জের ১০ তারিখে পড়ে। আন্তর্জাতিক (গ্রেগরীয়) পঞ্জিকায় তারিখ প্রতি বছর ভিন্ন হয়, সাধারণত এক বছর থেকে আরেক বছর ১০ বা ১১ দিন করে কমতে থাকে। ঈদের তারিখ স্থানীয়ভাবে জ্বিলহজ্জ মাসের চাঁদ দেখার ওপর নির্ভর করে।
অন্য নাম
আরবি ছাড়া অন্য ভাষায়, এই নামটি প্রায়ই স্থানীয় ভাষায় বলা হয়ে থাকে, যেমন বাংলায় কোরবানি ঈদ, জার্মান ভাষায় Opferfest, ওলন্দাজ ভাষায় Offerfeest, রোমানীয় ভাষায় Sărbătoarea Sacrificiului, ও হাঙ্গেরীয় ভাষায় Áldozati ünnep। স্পেনীয় ভাষায় এটি Fiesta del Cordero বা Fiesta del Borrego (দুটিরই অর্থ "মেষশাবকের উৎসব") নামে পরিচিত। এছাড়া মিশর, সৌদি আরব ও মধ্যপ্রাচ্যে এটি عید البقرة ʿĪd al-Baqarah নামে, ইরানে عید قربان ঈদে কোরবান নামে, তুরস্কে Kurban Bayramı ("ত্যাগের দিন") নামে, ত্রিনিদাদে Bakara Eid নামে, মাগরেবে عید الكبير ʿĪd el-Kebīr নামে, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং ফিলিপাইন Iduladha, Hari Raya Aiduladha, Hari Raya Haji বা কুরবান নামে, ভারত ও পাকিস্তানে بکرا عید বক্রা ঈদ বা بڑی عید বরি ঈদ নামে পরিচিত।
ব্যুৎপত্তি
আরবি عيد ঈদ শব্দটির অর্থ "উৎসব," "উদযাপন," "ভোজের দিন," বা "ছুটির দিন"। ًأضحى আদহা শব্দটির অর্থ "বলিদান", '"ত্যাগ"।
ইতিহাস
ইসলামের বিভিন্ন বর্ণনা অনুযায়ী, মহান আল্লাহ তা’আলা ইসলামের রাসুল হযরত ইব্রাহীম (আ.)কে স্বপ্নযোগে তার সবচেয়ে প্রিয় বস্তুটি কুরবানি করার নির্দেশ দেন:
“ | তুমি তোমার প্রিয় বস্তু আল্লাহর নামে কোরবানি কর। | ” |
ইব্রাহীম স্বপ্নে এবম্বিধ আদেশ পেয়ে ১০টি উট কোরবানি করলেন। পুনরায় তিনি আবারো একই স্বপ্ন দেখলেন। অতঃপর ইব্রাহীম এবার ১০০টি উট কোরবানি করেন। এরপরেও তিনি একই স্বপ্ন দেখে ভাবলেন, আমার কাছে তো এ মুহূর্তে প্রিয় পুত্র ইসমাইল (আ.) ছাড়া আর কোনো প্রিয় বস্তু নেই। তখন তিনি পুত্রকে কোরবানির উদ্দেশ্যে প্রস্তুতিসহ আরাফাতের ময়দানের উদ্দেশে যাত্রা করেন। এ সময় শয়তান আল্লাহর আদেশ পালন করা থেকে বিরত করার জন্য ইব্রাহীম ও তার পরিবারকে প্রলুব্ধ করেছিল, এবং ইব্রাহীম শয়তানকে পাথর ছুঁড়ে মেরেছিলেন। শয়তানকে তার প্রত্যাখ্যানের কথা স্মরণে হজ্জের সময় শয়তানের অবস্থানের চিহ্ন স্বরূপ নির্মিত ৩টি স্তম্ভে প্রতীকী পাথর নিক্ষেপ করা হয়।[3]
যখন ইব্রাহীম (আ.) আরাফাত পর্বতের উপর তার পুত্রকে কোরবানি দেয়ার জন্য গলদেশে ছুরি চালানোর চেষ্টা করেন, তখন তিনি বিস্মিত হয়ে দেখেন যে তার পুত্রের পরিবর্তে একটি প্রাণী কোরবানি হয়েছে এবং তার পুত্রের কোনো ক্ষতি হয়নি। ইব্রাহীম (আ.) আল্লাহর আদেশ পালন করার দ্বারা কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এটি ছিল ছয় সংখ্যক পরীক্ষা। এতে সন্তুষ্ট হয়ে আল্লাহ ইব্রাহীম (আ.) কে তার খলিল (বন্ধু) হিসাবে গ্রহণ করেন।
কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন,
১০০। অবশেষে আমি তাহাকে প্রশাশু বালকের (এসমায়িলনামক পুত্রের) সুসংবাদ দান করিলাম।
১০১। পরে যখন সে তাহার সঙ্গে দৌড়িবার বয়ঃপ্রাপ্ত হইল, তখন সে বলিল, “হে আমার নন্দন, নিশ্চয় আমি স্বপ্নে দেখিয়াছি যে, সত্যই আমি তোমাকে বলিদান করিতেছি ; অতএব তুমি কি দেখিতেছ, দেখ। সে বুলিল “হে আমার পিতা, যে বিষয়ে আদিষ্ট হইয়াছ, তাহা কর ; ঈশ্বরেচ্ছায় তুমি আমাকে অবশ্য সহিষ্ণুদিগের অন্তর্গত পাইবে”।
১০২। পরে যখন তাহারা দুই জনে (ঈশ্বরাজ্ঞার) অনুগত হইল, এবং সে তাহাকে (ছেদন করিতে) ললাটের অভিমুখে ফেলিল।
১০৩। এবং আমি তাহাকে ডাকিলাম যে, 'হে এব্রাহিম, ।
১০৪। সত্যই তুমি স্বপ্নকে সপ্রমাণ করিয়াচ; নিশ্চয় আমি এইরূপে হিতকারী লোকদিগকে বিনিময় দান করিয়া থাকি’ ।
১০৫। নিশ্চয় ইহা সেই স্পষ্ট পরীক্ষা।
১০৬। আমি তাহাকে বৃহৎবলি (শৃঙ্গযুক্ত পুং মেষ) বিনিময় দান করিলাম।
১০৭। এবং তাহার সম্বন্ধে (সৎপ্রশংসা) ভবিষ্যদ্বংশীয়দিগের প্রতি রাখিলাম।
১০৮। এব্রাহিমের প্রতি সেলাম । হৌক।
১০৯। এই রূপে আমি হিতকারীদিগকে বিনিময় দান করি।
১১০। নিশ্চয়ই সে আমার বিশ্বাসী দাসদিগের অন্তর্গত ছিল।
১১১। আমি তাহাকে সাধুদিগের অন্তর্গত এক প্রেরিত পুরুষ এসহাক (পুত্রের) সম্বন্ধে সুসংবাদ দান করিয়াছিলাম।
১১২। এবং তাহার প্রতি ও এসহাকের প্রতি আশীৰ্ব্বাদ করিয়াছিলাম, এবং তাহাদের সস্তানগণের মধ্যে কতক হিতকারী ও কতক আপন জীবনসম্বন্ধে স্পষ্ট অত্যাচারী হয়।
এই ঘটনাকে স্মরণ করে সারা বিশ্বের মুসলিমরা আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য প্রতি বছর এই দিবসটি উদযাপন করে। হিজরি বর্ষপঞ্জি হিসাবে জিলহজ্জ্ব মাসের ১০ তারিখ থেকে শুরু করে ১২ তারিখ পর্যন্ত ৩ দিন ধরে ঈদুল আজহার কুরবানি চলে। হিজরি চান্দ্র বছরের গণনা অনুযায়ী ঈদুল ফিতর এবং ঈদুল আজহার মাঝে ২ মাস ১০ দিন ব্যবধান থাকে। দিনের হিসেবে যা সর্বোচ্চ ৭০ দিন হতে পারে।[5]

ঈদের নামাজ
মুসলিমগণ ঈদুল আযহার নামাজ মসজিদে বা খোলা মাঠে আদায় করে থাকেন। ঈদের নামাজ জ্বিলহজ্জের ১০ তারিখে, সূর্য উদয়ের পর থেকে যোহর নামাজের সময় হবার আগ পর্যন্ত মধ্যবর্তী সময়ে যে কোনো সময় আদায় করা হয়ে থাকে। কোনো কারণবশত (উদাহরণ: প্রাকৃতিক দুর্যোগ) নামাজ আদায় করা না গেলে ঈদুল আজহার নামাজ ১২ই যিলহজ্ব পর্যন্ত ঐ সময়ের মধ্যে আদায় করা যাবে। ঈদের নামাজের আগে মুসল্লিরা জোরে জোরে "তাকবীর" উচ্চারণ করে।
الله أكبر الله أكبر |
আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, |
ঈদের নামাজ দুই রাক্বাত। এটি ওয়াজিব নামাজ। তা জামায়াতের সঙ্গে ছয় অতিরিক্ত তাক্ববিরের সঙ্গে পড়তে হয়। ঈদের নামাজ শেষে ইমামের জন্য খুৎবা পড়া সুন্নত ও মুছুুল্লিদের জন্য খুৎবা শোনা ওয়াজিব।
পশু কুরবানী


ইসলাম মতে ঈদুল আযহার দিনে যার যাকাত দেয়ার সামর্থ্য আছে অর্থাৎ যার কাছে ঈদের দিন প্রত্যূষে সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রৌপ্য বা সমপরিমাণ সম্পদ (যেমন জমানো টাকাা) আছে তার ওপর ঈদুল আযহা উপলক্ষে পশু কুরবানি করা ওয়াজীব। ঈদুল আযহার দিন থেকে শুরু করে পরবর্তী দুইদিন পশু কুরবানির জন্য নির্ধারিত। মুসাফির বা ভ্রমণকারির ওপর কুরবানি করা ওয়াজিব নয়| ঈদুল আযহার নামাজ শেষে কুরবানী করতে হবে। ঈদুল আযহার নামাজের আগে কুরবানি করা সঠিক নয়।
বাংলাদেশের মুসলিমরা সাধারণত গরু ও ছাগল কুরবানি দিয়ে থাকেন। এছাড়া কেউ কেউ ভেড়া, মহিষ, উট, দুম্বাও কোরবানি দিয়ে থাকেন। ২০১৯ সালে বাংলাদেশে কোরবানির পশুর চাহিদা ছিল ১ কোটি ১০ লক্ষ আর বাংলাদেশে কোরবানির উপযোগী পশুর সংখ্যা ছিল ১ কোটি ১৮ লক্ষ।[6] ২০১৮ সালে বাংলাদেশে কোরবানিকৃত পশুর সংখ্যা ছিল ১ কোটি ৫ লাখ।[7] এক ব্যক্তি একটি গরু, মহিষ, উট, ছাগল, ভেড়া বা দুম্বা কুরবানি করতে পারেন। তবে গরু, মহিষ ও উটের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৭ ভাগে কুরবানি করা যায় অর্থাৎ ২, ৩, ৫ বা ৭ ব্যক্তি একটি গরু কুরবানিতে শরিক হতে পারেন। কুরবানির ছাগলের বয়স কমপক্ষে ১ বছর হতে হবে। গরু ও মহিষের বয়স কমপক্ষে ২ বছর হতে হবে। নিজ হাতে কুরবানি করা ভাল। কুরবানি প্রাণীর দক্ষিণ দিকে রেখে কিবলামুখী করে, ধারালো অস্ত্র দিয়ে 'বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার' বলে জবাই করতে হয়।
সাধারণত আমাদের দেশে কুরবানির মাংস তিন ভাগে ভাগ করে ১ ভাগ গরিব-দুঃস্থদের মধ্যে ১ ভাগ আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে এবং ১ ভাগ নিজেদের খাওয়ার জন্য রাখা হয়। তবে মাংস বিতরণের কোন সুস্পষ্ট হুকুম নেই কারন কুরবানির হুকুম পশু জবেহ্ হওয়ার দ্বারা পালন হয়ে যায়। কুরবানির পশুর চামড়া বিক্রির অর্থ দান করে দেয়ার নির্দেশ রয়েছে।[8][9]
উদযাপন
ঈদের দিন শুরু হয় ঈদের নামাজের জন্য গোছল করে এবং নতুন কাপড় পরিধান করে। সকল মুসলিম ছেলেদের জন্য এই ঈদের দুই রাকাত নামাজ আদায় করা ওয়াজিব এবং মহিলাদের জন্য এই নামাজ সুন্নৎ।
বাঙ্গালী মুসলমানরা নামাজের পরে পুরো পরিবার একত্রে সকাল বেলা মিষ্টিজাতীয় খাদ্য দিয়ে নাস্তা করে। সকালের এই নাস্তাতে থাকে নানান ধরনের মিষ্টান্ন। নাস্তা খাবার শেষে মুসলমান পুরুষেরা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষে কোরবানির প্রস্তুতি নিতে থাকে। কোরবানী শেষে কোরবানীর প্রথানুযায়ী কোরবানীর মাংশ গরীব, আত্নীয় প্রতিবেশীদের মধ্যে ভাগ করে দেয়। এ দিনে প্রত্যেক মুসলমান অন্যদের বাড়িতে বেড়াতে যায় আনন্দ নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেয়। বাঙ্গালী মুসলিম সমাজে এ উৎসবটি কেবল মুসলমানদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনা, অন্যান্য ধর্মাম্বলীরাও অংশগ্রহণ করে উদযাপনে।
টীকা
-
আল্লাহ মহান, আল্লাহ মহান,
আল্লাহ ছাড়া সত্য কোন উপাস্য নেই,
আল্লাহ মহান, আল্লাহ মহান,
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য।
তথ্যসূত্র
- "ঈদুল আযহার তাৎপর্য"। The Daily Sangram। সংগ্রহের তারিখ ২০১৭-০৯-১৩।
- ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ৯ জুন ২০১২ তারিখে বাংলাপিডিয়া
- "হজ্বের নিয়ম-কানুন"। দৈনিক সংগ্রাম। ১৫ আগস্ট ২০১৭। ২১ আগস্ট ২০১৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২১ আগস্ট ২০১৮।
- কোরআন ৩৭:১০০-১১২ অনুবাদ ভাই গিরিশ চন্দ্র সেন
- http://www.dailysangram.com/post/42611-ঈদুল-আযহার-তাৎপর্য
- "চোরাই পথে গরু আসা বন্ধ হউক"। ইত্তেফাক। ১ আগস্ট ২০১৯। সংগ্রহের তারিখ ১১ আগস্ট ২০১৯।
- "ভারতের কঠোর পদক্ষেপ যেভাবে বাংলাদেশের গরু খামারিদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে গেল"। বিবিসি বাংলা। ৯ আগস্ট ২০১৯। সংগ্রহের তারিখ ১১ আগস্ট ২০১৯।
- কুরবানীর বিধিবিধান
- কুরবানীর বিধিমালা