জমজম কূপ

জমজম কুয়া (আরবি: زمزم) হল মক্কায় মসজিদুল হারামের অভ্যন্তরে অবস্থিত একটি কুয়া। এটি কাবা থেকে ২০ মি (৬৬ ফুট) পূর্বে অবস্থিত। ইসলামি বর্ণনা অনুযায়ী, নবী ইবরাহিম (আ) তার স্ত্রী হাজেরা (আ) ও শিশুপুত্র ইসমাইল (আ) কে মরুভূমিতে রেখে আসার পর জিবরাঈল (আ) এর পায়ের আঘাতে এর সৃষ্টি হয়।[1] মসজিদুল হারামে আগত লোকেরা এখান থেকে পানি পান করে।

জমজম কুয়া
স্থানীয় নাম
আরবি: زمزم
জমজম কূপের প্রবেশদ্বার
অবস্থানমসজিদুল হারাম, মক্কা
স্থানাঙ্ক২১°২৫′১৯.২″ উত্তর ৩৯°৪৯′৩৩.৬″ পূর্ব
অঞ্চলপ্রায় ৩০ মি (৯৮ ফু) গভীর ও ১.০৮ থেকে ২.৬৬ মি (৩ ফু ৭ ইঞ্চি থেকে ৮ ফু ৯ ইঞ্চি) ব্যাস
প্রতিষ্ঠাকাল২০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের কাছাকাছি সময়
পরিচালকবর্গসৌদি আরব সরকার
দাপ্তরিক নাম: জমজম
সৌদি আরবে জমজম কুয়ার অবস্থান

উৎপত্তি

ইসলামের ইতিহাসে জমজম কুপের উৎপত্তি নিয়ে বর্ণনা রয়েছে। নবী ইবরাহিম (আ) তার দ্বিতীয় স্ত্রী হাজেরা (আ) ও শিশুপুত্র ইসমাইল (আ) কে আল্লাহর আদেশে মক্কার বিরান মরুভূমিতে রেখে আসেন। তার রেখে যাওয়া খাদ্য পানীয় শেষ হয়ে গেলে হাজেরা (আ) পানির সন্ধানে পার্শ্ববর্তী সাফা ও মারওয়া পাহাড়দ্বয়ের মাঝে সাতবার ছোটাছুটি করেছিলেন। এসময় জিবরাঈল (আ) এর পায়ের আঘাতে মাটি ফেটে পানির ধারা বেরিয়ে আসে। ফিরে এসে এই দৃশ্য দেখে হাজেরা (আ) পাথর দিয়ে পানির ধারা আবদ্ধ করলে তা কুপের রূপ নেয়। এসময় হাজেরা (আ) উদগত পানির ধারাকে জমজম তথা থামো বলায় এর নাম জমজম হয়েছে। পরবর্তীতে নবী ইবরাহিম (আ) এর পাশে কাবা পুনঃনির্মাণ করেন।[1] পূর্বে আদম (আ) এর সময় এটি নির্মিত হলেও পরবর্তীকালে বিনষ্ট হয়ে গিয়েছিল। মুসলিমরা নামাজ পড়ার সময় কাবার দিকে মুখ করে দাঁড়ায়। জমজম কুয়া কাবা থেকে প্রায় ২০ মি (৬৬ ফুট) দূরে।

সংস্কার

জমজম কুয়া বেশ কয়েকবার সংস্কার করা হয়। প্রথম থেকে এটি বালি ও পাথর দিয়ে ঘেরা অবস্থায় ছিল। পরবর্তীতে খলিফা আল মনসুরের সময় ৭৭১ (১৫৪/১৫৫ AH)[2] সালে এর উপর গম্বুজ এবং মার্বেল টাইলস বসানো হয়। পরবর্তীতে খলিফা আল মাহদি এটি আরো সংস্কার করেন। সর্বশেষ ২০১৭-২০১৮ সালে সৌদি বাদশাহ সংস্কার করেন ।[3] বর্তমানে কুয়া কাবা চত্বরে দেখা যায় না। এটি ভূগর্ভস্থ অবস্থায় রাখা হয়েছে এবং এখানে থেকে পাম্পের সাহায্যে পানি উত্তোলন করা হয়। মসজিদুল হারামের বিভিন্ন স্থানে তা সরবরাহ করা হয়।

পুনর্নির্মাণ

বাদশাহ আবদুল আজিজ ইবনে সৌদ জমজমের পূর্ব ও দক্ষিণে পানি পান করানোর জন্য দুটি স্থান নির্মাণ করেন। দক্ষিণ দিকে ৬টি এবং পূর্বদিকে ৩টি ট্যাপ লাগানো হয়। বর্তমানে কাবা ঘরের ২০ মিটার দূরে অবস্থিত এই কূপটি থেকে পাম্পের সাহায্যে প্রতিদিন ২০ লক্ষাধিক ব্যারেল পানি উত্তলিত হয়। এই কূপের পানি বণ্টনের জন্য ১৪০৩ হিজরিতে সৌদি বাদশাহের এক রাজকীয় ফরমান অনুযায়ী হজ মন্ত্রণালয়ের সরাসরি তত্ত্বাবধানে ইউনিফাইড ‘জামাজেমা দফতর’ গঠিত হয়। এই দফতরে একজন প্রেসিডেন্ট ও একজন ভাইস প্রেসিডেন্টসহ মোট ১১ জন সদস্য ও ৫ শতাধিক শ্রমিক ও কর্মচারী নিয়োজিত আছেন। বাদশাহ আব্দুল্লাহ জমজম পানি কমপ্লেক্সটি ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরে ৭০০ মিলিয়ন রিয়াল ব্যয়ে মক্কাতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, যা প্রতিদিন ২০০,০০০ বোতল পানি সরবরাহ করতে পারে।[4]

জমজম পানির খনিজ উপাদান

জমজম কূপের পানির কোনও রং বা গন্ধ নেই, তবে এর বিশেষ একটি স্বাদ রয়েছে। বাদশাহ সৌদ বিশ্ববিদ্যালয় জমজম কূপের পানি পরীক্ষা করেছে এবং তারা এর পুষ্টি গুণ ও উপাদান সমূহ নির্ণয় করেছে। জমজম পানির উপাদানসমূহ:

খনিজের ঘনীভবন
বাদশাহ সৌদ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রদত্ত[5]
খনিজ ঘনীভবন
mg/L oz/cu in
সোডিয়াম ১৩৩ ৭.৭×১০−৫
ক্যালসিয়াম ৯৬ ৫.৫×১০−৫
ম্যাগনেসিয়াম ৩৮.৮৮ ২.২৪৭×১০−৫
পটাশিয়াম ৪৩.৩ ২.৫০×১০−৫
বাইকার্বোনেট ১৯৫.৪ ০.০০০১১২৯
ক্লোরাইড ১৬৩.৩ ৯.৪৪×১০−৫
ফ্লোরাইড ০.৭২ ৪.২×১০−৭
নাইট্রেট ১২৪.৮ ৭.২১×১০−৫
সালফেট ১২৪.০ ৭.১৭×১০−৫
মোট দ্রবীভূত কঠিন বস্তুর ৮৩৫ ০.০০০৪৮৩

স্বাস্থ্যগত দিক

সৌদি সরকার জমজমের পানি সংরক্ষণ এবং বিতরণের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখে। প্রতি ঘন্টায় এ পানির অবস্থা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়। সৌদি ভূতাত্ত্বিক জরিপের সভাপতি জুহাইর নাওয়াব জানান যে জমজম কূপ এবং এটির পানির নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা রয়েছে। নিয়মিতভাবে জমজম কূপের পানির গুনগতমান পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে। সৌদি ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থার বিশেষজ্ঞরা প্রতিদিন জমজমের অবস্থা নিরীক্ষণ করে। প্রতিদিন পরীক্ষা এবং গবেষণার জন্য পানির তিনটি নমুনা সংগ্রহ করা হয়, যাতে নিশ্চিত হওয়া যায় যে কোনোরূপ বিদূষণ ঘটে নি। গভীর পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে পানি সরবরাহ করা হয় এবং ক্ষতিকারক ব্যাক্টেরিয়া হত্যার জন্য অতিবেগুনী রশ্মি প্রয়োগ করা হয়। জমজমের পানি সুরক্ষার জন্য স্টেইনলেস স্টীলের পাইপের মাধ্যমে শীতলীকরণ কেন্দ্রে যায়, অতঃপর গ্র্যান্ড মসজিদে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, স্বাভাবিক পানিতে আর্সেনিকের গ্রহণযোগ্য মাত্রা প্রতি লিটারে ১০ মাইক্রোগ্রাম। যদি পানিতে এই মাত্রা বৃদ্ধি পায়, তাহলে সেই পানি কিডনী ও লিভারের জন্য ক্ষতিকারক এবং ক্যানসারের কারণ হতে পারে। জমজমের পানিতে আর্সেনিকের মাত্রা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদিত মাত্রার চেয়ে অনেক কম । মক্কায় নতুন প্রতিষ্ঠিত বাদশাহ আব্দুল্লাহ জমজম পানি বিতরণ কেন্দ্রটি উন্নত সুবিধায় সজ্জিত এবং সেখানে আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী বোতলজাত করা হয়। জীবাণুমুক্ত করার পর বোতলজাত করতে আধুনিক পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয় । বাদশাহর তত্ত্বাবধানে গভীর পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে পানি সরবরাহ করা হয় এবং ক্ষতিকারক ব্যাক্টেরিয়া হত্যার জন্য অতিবেগুনী রশ্মি প্রয়োগ করা হয়। সৌদি আরবের জিওলজিক্যাল সার্ভে-র একটি “জমজম স্টাডিজ অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার” আছে যারা এই কূপের পানির মান, গভীরতা, অম্লতার মাত্রা এবং তাপমাত্রার দিকে নিয়মিত নজর রাখে। প্রতিদিন ট্যাঙ্কারে করে অন্তত ১২০ টন জমজমের পানি মদিনার মসজিদে নববীতে নিয়ে যাওয়া হয়। পরিবহনের সময় সেই পানি যাতে কোনওভাবে দূষিত না-হয়, সেদিকেও বিশেষ দৃষ্টি দেওয়া হয়ে থাকে। ফরাসি পরীক্ষাগারে জমজমের পানির উপর পরিচালিত পরীক্ষায় দেখা গেছে যে, "মূল উৎস থেকে নেওয়া নমুনাসমূহে পরিচালিত বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে যে, জমজম পানি পান করার জন্য ভাল। রাষ্ট্রীয়ভাবে জমজম পানি রপ্তানী করা হয় না। সৌদি সরকার জমজমের পানির অবৈধ বিক্রয় নিষিদ্ধ করেছে।"[3][4]

জমজম পানি বিতর্ক

২০১১ সালের মে মাসে বিবিসি লন্ডন এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, লন্ডনে বাজারজাতকৃত জমজম পানিতে প্রচুর পরিমাণে আর্সেনিক রয়েছে। এই পানি খাওয়া মানুষের পক্ষে খুবই ক্ষতিকর। দীর্ঘ দিন এই পানি কেউ পান করলে খুব দ্রুতই সে ক্যানসারে আক্রান্ত হতে পারে।[6] কিন্তু সৌদি আরব এটি তীব্রভাবে প্রত্যাখান করেছে। সৌদি আরবের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, "জমজমের পানি পরীক্ষিত এবং আসল জমজম পানিতে কোনো আর্সেনিক নেই। জমজম পানি পবিত্র শহর মক্কার জমজম কূপ থেকে সংগ্রহ করা হয় এবং এটি বাণিজ্যিক ব্যবহারের জন্য রপ্তানী করা হয় না। ফ্রান্সের স্ট্যান্ডার্ড পরীক্ষা অনুযায়ী জমজম পানি মানুষের জন্য উপযুক্ত।"[7] টাওয়ার হ্যামলেটসের পরিবেশ বিষয়ক নেতৃত্বকারী কাউন্সিলার আব্দাল উল্লাহ এক বিবৃতিতে বলেন, 'আসল জম-জম পানি যা মুসলমানদের জন্য অত্যন্ত পবিত্র, তা শুধুমাত্র সৌদি আরবের একটি নির্দিষ্ট স্থান থেকে উৎসরিত হয়। আর এটি আইনতঃ কোনোভাবেই ওই দেশ থেকে বাইরে বাণিজ্যিকভাবে রফতানী করা সম্ভব নয়।' তিনি আরও বলেন,'তাই দোকানে বিক্রি হওয়া এ-ধরনের পানির উৎসের কোন নিশ্চয়তা নেই।[8]

জমজমের পানি পানের আদব

ইসলামের বিধান অনুযায়ী পানি উপবিষ্ট অবস্থায় পান করতে হয়। কিন্তু জমজমের পানি দাঁড়িয়ে পানের বিধান রয়েছে। একজন মুসলিম জমজমের পানি পান করার সময় কিবলার দিকে মুখ করে দাঁড়াবেন এবং আল্লাহ’র নাম নিয়ে তিন ঢোকে জমজমের পানি পান করবেন।

عن ابن عباس، أن رسول الله صلى الله عليه وسلم شرب من زمزم وهو قائم ‏.‏

ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম দাঁড়িয়ে জমজম হতে পানি পান করেছেন। [9] হজ্জে গেলে মানুষ জমজমের পানি সাথে নিয়ে আসে।এটি মুসলমানদের জন্য প্রবিত্র মনে করা হয়

তথ্যসূত্র

বহিঃসংযোগ

  • Careem, S. H. A. "The Miracle of Zamzam"Sunday Observer। ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ জুন ৫, ২০০৫ Provides a brief history of the well and some information on the alleged health benefits of Zamzam water.
This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.