স্কন্দোপনিষদ্‌

স্কন্দোপনিষদ্‌ (সংস্কৃত: स्कंदोपनिषद्) বা স্কন্দ উপনিষদ্‌ হিন্দুধর্মের ১০৮টি উপনিষদের অন্যতম। এই গ্রন্থটি সংস্কৃত ভাষায় রচিত। কৃষ্ণ যজুর্বেদের সঙ্গে যুক্ত[2] এই উপনিষদ্‌টি হল ৩২টি সামান্য (সাধারণ) উপনিষদের অন্যতম।[3]

স্কন্দোপনিষদ্‌
হিন্দু দেবতা স্কন্দ, যিনি মুরুগান ও কার্তিক নামেও পরিচিত। কার্তিক বলছেন, সকল দেবদেবী ও আত্মা এক।[1]
দেবনাগরীस्कंद
IASTSkānda
নামের অর্থহিন্দু দেবতা কার্তিক (স্কন্দ)
উপনিষদের ধরনসামান্য
যে বেদের সঙ্গে সংযুক্তকৃষ্ণ যজুর্বেদ
শ্লোকসংখ্যা১৫
মূল দর্শনবেদান্ত

স্কন্দোপনিষদ্‌ যুদ্ধের দেবতা তথা শিবের পুত্র কার্তিকের (স্কন্দ) দ্বারা কথিত হয়েছে। এই উপনিষদে স্কন্দকে ‘ব্রহ্ম’ নামে পরিচিত পরম সত্য বলে উল্লেখ করা হয়েছে।[4] সেই সঙ্গে এই গ্রন্থে তাঁকে চৈতন্য, আত্মা ও শিব বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।[5][6]

এই গ্রন্থ অনুসারে, বৈষ্ণবধর্মের বিষ্ণুশৈবধর্মের শিবের মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। তাঁরা এক। সেই রকম সকল দেবতাও এক।[5] এই উপনিষদের মতে, নিজের অন্তরস্থ আত্মাকে স্কন্দ, শিব, বিষ্ণু ও ব্রহ্মের থেকে অভিন্ন রূপে দর্শন করাই হল শ্রেষ্ঠ পূজা।[5][6]

ইতিহাস

স্কন্দোপনিষদ্‌ গ্রন্থের রচয়িতার নাম ও রচনাকাল অজ্ঞাত। অক্ষ্যুপনিষদ্‌ শিরোনামেও এই গ্রন্থের পুথি আবিষ্কৃত হয়েছে।[7][8] রাম কর্তৃক হনুমানের নিকট বর্ণিত ১০৮টি উপনিষদের তালিকা সম্বলিত তেলুগু সংকলন মুক্তিকায় এই উপনিষদ্‌টির ক্রমসংখ্যা ৫১।[9]

বিষয়বস্তু

স্কন্দোপনিষদ্‌ হিন্দু যুদ্ধদেবতা তথা শিবের পুত্র কার্তিকের উক্তির আকারে লিখিত। এই উপনিষদ্‌টি ১৫টি শ্লোকে বিন্যস্ত।[10] স্কন্দ তাঁর পিতা শিবকে ‘মহাদেব’ নামে সম্বোধন করছেন এবং বলছেন যে, শিবের আশীর্বাদে তিনি শ্রেষ্ঠতর সত্ত্বা অর্জন করেছেন। স্কন্দ নিজেকে ‘বিজ্ঞান’ (জ্ঞান) ও স্বয়ং শিব বলে ঘোষণা করছেন। অন্তরেন্দ্রিয়গুলি সত্যকে আবৃত করে রাখে এবং এই সকল ইন্দ্রিয়ের বিলোপের পর বিষ্ণুসম্বিৎ’ (চৈতন্য বা জ্ঞান) থেকে ব্যুত্থিত হন। স্কন্দ নিজেকে ‘অজাত’ ও সম্বিতের অংশ হিসেবে ঘোষণা করছেন। আত্মা ছাড়া সকল জড় বস্তুই ধ্বংসকারক। চৈতন্য ও জড়তার মধ্যে পার্থক্য নিরুপণ করতে পারেন ‘অচ্যুত’ (বিষ্ণুর একটি নাম)। তিনিই ‘জ্ঞান’, শিব, বিষ্ণু, পরমেশ্বর, জ্যোতির জ্যোতি ও পরব্রহ্ম। স্কন্দ ঘোষণা করছেন যে, তিনিই ব্রহ্ম।[11][12] He says that he is indestructible.[13]

স্কন্দ বলছেন যে, ‘জীব’ই (কোনও জীবিত সত্ত্বা) শিব। ভুসি ছাড়ানোর আগে যা ধান, ভুসি ছাড়ানোর পরই সেই শস্যদানাটি হয়ে যায় চাল। সেই রকম যখন [[কর্ম (হিন্দু দর্শন)|কর্মের বন্ধনে আবদ্ধ, তখন যে ‘জীব’ এবং যখন কর্মের বন্ধন থেকে মুক্ত তখনই সে শিব। এরপর স্কন্দ সেই শিবকে প্রণাম করছেন, যিনি বিষ্ণুর একটি রূপভেদ এবং যে বিষ্ণু শিবেরই একটি রূপভেদ। এরপর বলা হয়েছে যে, বিষ্ণু শিবের হৃদয়ে এবং শিব বিষ্ণুর হৃদয়ে বাস করেন। শিব ও বিষ্ণু এক ও অদ্বিতীয়।[11][12]

এরপর স্কন্দোপনিষদ্‌ গ্রন্থে দেহকে মন্দিরের সঙ্গে এবং ‘জীব’কে (জীবনী শক্তি) শিবের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। মন্দিরের বাসি ফুল যেমন বাইরে ফেলে দেওয়া হয়, তেমনই ‘অজ্ঞান’ (অজ্ঞানতা, জ্ঞানের অভাবজনিত অবস্থা) শরীর থেকে বর্জন করা উচিত। ব্যক্তি আত্মার সঙ্গে ঈশ্বরের একত্ব চিন্তা করার মাধ্যমে যে পূজা করা হয়, তা-ই ‘জ্ঞান’। মনকে বস্তুর থেকে প্রত্যাহার করার জন্য ধ্যান অভ্যাস করা উচিত। স্নান করলে মনের কলুষতা দূরীভূত হয়। পরিচ্ছন্নতা হল ইন্দ্রিয়ের উপর নিয়ন্ত্রণ। ব্যক্তির উচিত ব্রহ্মরস পান করা। ব্যক্তির উচিত ভিক্ষাবৃত্তি করে নির্জনে বাস করা এবং আত্মা ও ব্রহ্মের অভিন্নতা উপলব্ধি করা। এইভাবেই ব্যক্তি মোক্ষ লাভ করতে পারে।[11][12]

এরপর প্রথম পুরুষে একটি প্রার্থনা প্রদত্ত হয়েছে। সমৃদ্ধি ও দীর্ঘায়ু কামনায় সর্বোচ্চ জ্যোতিকে প্রণাম করা হয়েছে। বিষ্ণুকে নৃসিংহ ও শিবকে মহাদেব রূপে সম্বোধন করা হয়েছে। এই স্তোত্রে বলা হয়েছে যে, তাঁদের আশীর্বাদে মানুষ ব্রহ্মকে অনুধাবন করতে পারেন। ব্রহ্ম অবাঙ্মনসোগোচর, নির্গুণ, অনন্ত ও অবিনশ্বর হলেও ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব প্রমুখ দেবতার রূপ ধারণ করেন।[14][12]

বাঁ দিকে: শিব ও বিষ্ণুর মিলিত রূপ হরিহর
ডান দিকে: হরিহর খোদাইচিত্র, ৩য় গুহা, বাদামী গুহা মন্দির, খ্রিস্টীয় ৬ষ্ঠ শতাব্দী

স্কন্দোপনিষদ্‌ সমাপ্ত হয়েছে নিম্নোক্ত স্তোত্রটির মাধ্যমে:[15]

বিষ্ণুর সর্বোচ্চ পদক্ষেপ
যা দেবগণ সর্বদা দর্শন করেন
চক্ষুর ন্যায়, তা স্বর্গে স্থিত।
বিষ্ণুর সর্বোচ্চ পদক্ষেপের উপর সঞ্চরণশীল
পুরোহিতগণ সদাজাগ্রত অবস্থায়
যজ্ঞাগ্নি প্রজ্বালিত করেন।

এই স্তোত্রটি ঋগ্বেদ থেকে গৃহীত। এটি আরুণেয়োপনিষদ্‌, নৃসিংহতাপনীয়োপনিষদ্‌, বাসুদেবোপনিষদ্‌মুক্তিকা উপনিষদেও পাওয়া যায়।[15]

টীকা

স্কন্দোপনিষদ্‌ গ্রন্থের দুটি সূত্র বহু ক্ষেত্রে উদ্ধৃত করা হয়। এদুটি হল: “জীবই শিব” এবং “দেহই মন্দির”। অরবিন্দ ঘোষ এই সূত্রদুটির ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন, ব্যক্তির নির্গুণ আত্মার উচিত শিব অর্থাৎ ব্রহ্মের সঙ্গে যুক্ত হওয়া।[16]

হিন্দুদের দুই বিবদমান সম্প্রদায় বৈষ্ণবধর্মশৈবধর্মের প্রধান দুই দেবতা যথাক্রমে বিষ্ণু ও শিবের সমন্বয় ও একত্বের উপর এই গ্রন্থে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।[12][17] মনে করা হয়, এটি দুই যুযুধান সম্প্রদায়কে একীভূত করার প্রচেষ্টা। এই প্রচেষ্টা বিষ্ণু ও শিবের মিলিত রূপ হরিহরের অনুরূপ।[18]

তথ্যসূত্র

  1. Ayyangar 1941, পৃ. 530-533।
  2. Farquhar, John Nicol (১৯২০), An outline of the religious literature of India, H. Milford, Oxford university press, পৃষ্ঠা 364, আইএসবিএন 81-208-2086-X
  3. Tinoco 1996, পৃ. 88।
  4. Roshen Dalal (অক্টোবর ২০১১)। Hinduism: An Alphabetical Guide। Penguin Books India। পৃষ্ঠা 432। আইএসবিএন 978-0-14-341421-6।
  5. Ayyangar 1941, পৃ. 530-534।
  6. Aiyar 1914, পৃ. 41-42।
  7. Hattangadi 2000
  8. Vedic Literature, Volume 1, গুগল বইয়ে A Descriptive Catalogue of the Sanskrit Manuscripts, পৃ. PA584,, Government of Tamil Nadu, Madras, India, pages 584-586
  9. Deussen 1997, পৃ. 556-557।
  10. Weber 2013, পৃ. 171।
  11. Dr. A. G. Krishna Warrier। "Skanda Upanishad"। The Theosophical Publishing House। সংগ্রহের তারিখ ১৬ জানুয়ারি ২০১৫
  12. K. Narayanasvami Aiyar (১৯১৪)। Thirty Minor Upanishads
  13. Parmeshwaranand 2000, পৃ. 665।
  14. Warrier 1967
  15. Deussen, Paul (১ জানুয়ারি ১৯৯৭)। Sixty Upanishads of the Veda। Motilal Banarsidass Publ.। পৃষ্ঠা 743। আইএসবিএন 978-81-208-1467-7।
  16. Sri G. Ananda (৩ ডিসেম্বর ২০১৩)। Shiva: A Rediscovery of the Holy Spirit। Art of Unity। পৃষ্ঠা 135। আইএসবিএন 978-1-4943-6868-5।
  17. Upanisads: The Selections from 108 Upanisads। Motilal Banarsidass Publ.। ১৯৭৫। পৃষ্ঠা 187। আইএসবিএন 978-81-208-1611-4।
  18. Haridāsa Bhaṭṭācāryya (১৯৬৯)। The Cultural Heritage of India: The religious. 1956। Ramakrishna Mission, Institute of Culture। পৃষ্ঠা 50।

গ্রন্থপঞ্জি

বহিঃসংযোগ

This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.