চার্বাক দর্শন

চার্বাক দর্শন (সংস্কৃত: चार्वाक) বা লোকায়ত দর্শন ভারতীয় দর্শনের প্রধান শাখাগুলোর অন্যতম। এটি আধ্যাত্মবাদবিরোধী নিরীশ্বরবাদী ও বস্তুবাদী দর্শন। এই দর্শন কোনো প্রকার প্রত্যাদেশে বিশ্বাসী নয়, ‘প্রমাণ’ই এ-দর্শন অনুসারে যথার্থ জ্ঞানের উৎস। পারলৌকিক নয়, ইহজাগতিক সুখ ভোগই মানুষের একমাত্র কাম্য বলে চার্বাকরা মনে করত। চার্বাক দর্শনের প্রভাব বুদ্ধের সময় ও প্রাক-বুদ্ধ যুগে উপস্থিত ছিল বলে অনেকে মনে করে থাকেন।

তথ্যসংগ্রহ

চার্বাক গোষ্ঠীর নিজস্ব রচনা হিসেবে জয়রাশি ভট্টের আনুমানিক অষ্টম শতাব্দীতে রচিত তত্ত্বোপপ্লবসিংহ নামক একটি মাত্র গ্রন্থের উল্লেখ পাওয়া যায়। সেই কারণে চার্বাক দর্শন সম্বন্ধে অধিকাংশ তত্ত্বের উৎস হিসেবে ভারতীয় দর্শনের বিভিন্ন গ্রন্থের চার্বাকী মতবাদের বিরুদ্ধ সমালোচনাগুলোরই উল্লেখ করা হয়ে থাকে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ন্যায় দার্শনিক জয় ভট্টের নবম শতাব্দীতে রচিত ন্যায়মঞ্জরী, বৌদ্ধ পন্ডিত শান্তরক্ষিতের ও অষ্টম শতাব্দীতে রচিত তত্ত্বসংগ্রহ ভারতীয় দর্শনের যে সকল সঙ্কলন গ্রন্থ চার্বাক দর্শনকে অন্তর্ভুক্ত করে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য অষ্টম শতাব্দীতে রচিত জৈন দার্শনিক হরিভদ্র সূরীর ষড়দর্শনসমুচ্চয়, চতুর্দশ শতাব্দীতে রচিত মাধবাচার্যের "সর্বদর্শনসমগ্র" ও শঙ্করাচার্যের রচনা বলে পরিচিত সর্বদর্শনসিদ্ধান্তসংগ্রহ[1]

প্রবক্তা

প্রবোধচন্দ্রোদয়, সর্বদর্শনসংগ্রহ ইত্যাদি গ্রন্থে চার্বাক দর্শনের আদি প্রচারক হিসেবে বৃহস্পতির নাম করা হয়েছে। এই গ্রন্থগুলিতে বৃহস্পতির শিষ্য হিসেবে চার্বাক নামক এক শক্তিশালী প্রচারকের উল্লেখ পাওয়া যায়, যার ঐতিহাসিক অস্তিত্ব সম্বন্ধে কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না।[2] তত্ত্বোপপ্লবসিংহষড়দর্শনসমুচ্চয় গ্রন্থে চার্বাক দর্শনের সূত্র রচয়িতা হিসেবে বৃহস্পতির নাম উল্লেখ করা হয়েছে। [3]

চার্বাক আচার্য বৃহস্পতির ঐতিহাসিক অস্তিত্ব কালক্রমে পৌরাণিক দেবগুরু বৃহস্পতির সঙ্গে একাত্মতা লাভ করেছে। [2] মৈত্রায়ণীয় উপনিষদের বর্ণনানুসারে দেবগুরু বৃহস্পতি বিষয়সুখে প্ররোচনাত্মক বিভ্রান্তিকর শাস্ত্র প্রণয়নের উদ্দেশ্যে অসুরদের ভুল পথে চালিত করার কাজে বতী হন। [1]

আবির্ভাব

ছান্দোগ্য উপনিষদে অসুর শব্দটি এক শ্রেণীর অবিশ্বাসী অর্থে ব্যবহৃত যাদের কাছে জাগতিক সুখভোগ জীবনের চরম লক্ষ্য। অসুর সংজ্ঞা যদি চার্বাক মতে বিশ্বাসী কোন গোষ্ঠীকে বোঝাতে ব্যবহৃত হয়, তাহলে মৈত্রায়ণীয় ও ছান্দোগ্য উপনিষদের রচনাকালেই চার্বাক মতবাদের গোড়াপত্তন হয়েছিল বলে অনুমান করা যায়।[1] ঐতরেয় উপনিষদের কিছু অনুচ্ছেদে দেহাত্মবাদ[4] ও বৃহদারণ্যক উপনিষদে মরণোত্তর চৈতন্যের অস্তিত্বের অস্বীকৃতির[5] স্বপক্ষে কিছু শ্লোকের উল্লেখ পাওয়া যায়। কঠ উপনিষদের পরলোকগামী আত্মার অস্তিত্বে অবিশ্বাসী সম্প্রদায়ের উল্লেখ পাওয়া যায়।[6]

বিভিন্ন স্থানে বিক্ষিপ্তভাবে উদ্ধৃত চার্বাকী মতের বিবরণ এই চিন্তাধারার সঠিক কাল সম্বন্ধে সামান্যই তথ্যপ্রদান করতে পারে, তবে উপনিষদীয় যুগের বৃহৎ পরিসরে এই কালকে অন্তর্ভুক্ত করা যায়। ছান্দোগ্য উপনিষদ ও বৃহদারণ্যক উপনিষদের রচনাকাল খৃষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে বুদ্ধদেবের আবির্ভাবের পূর্ববর্তী বলে অনুমান করা হলে চার্বাক মতের জন্ম এই কালেই হয়েছে বলে ধরে নেওয়া যায়।[1]

চার্বাক সিদ্ধান্ত

প্রত্যক্ষ প্রমাণ

চার্বাক দর্শন সম্বন্ধে বিভিন্ন দর্শন সঙ্কলনগুলিতে প্রত্যক্ষপ্রমাণবাদী হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। [7][8] ষড়দর্শনসমুচ্চয় গ্রন্থে বলা হয়েছে চার্বাকের জগতের আয়তন ইন্দ্রিয়গোচরতার মধ্যে সীমাবদ্ধ।[9] ইন্দ্রিয়ের দ্বারা প্রত্যক্ষ বস্তুজ জ্ঞানই চার্বাকগোষ্ঠী প্রমাণ হিসেবে বিবেচনা করেন বলে অধিকাংশ দর্শন গ্রন্থগুলি উল্লেখ করলেও জয়ন্ত ভট্টের “ন্যায়মঞ্জরী” গ্রন্থে অপর এক মতবাদকে চার্বাকের মতবাদ বলে উল্লেখ করেছেন। এই মতবাদ অনুসারে, প্রমাণ এবং প্রমেয়ের সংখ্যা ও লক্ষণের অনৈক্যই হল তত্ত্ব।[10] “তত্ত্বোপপ্লবসিংহ” গ্রন্থে এই মতবাদের সমর্থন পাওয়া যায়। [11] এই তত্ত্বের মতে জাগতিক বস্তুনিচয়ের সত্যাসত্য নির্ণয়ের মান বাস্তবিকপক্ষে কখনোই ত্রুটিমুক্ত না হওয়ার দরুন প্রমাণ ও প্রমেয় সম্বন্ধে ধারণাও ত্রুটিমুক্ত হয় না। [12]

অনুমান প্রমাণ

ন্যায় দর্শন দ্বারা স্বীকৃত অনুমানের দ্বারা প্রমাণকে চার্বাক মতে অনুমোদন করা হয়নি। অনুমানলব্ধ জ্ঞানের হেতু বা সাধনের সঙ্গে অনুমান বা সাধ্যের সম্পর্ক বা ব্যাপ্তিকে চার্বাকবাদী দার্শনিকেরা ভ্রান্ত হিসেবে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন। তাদের মতে অভ্রান্ত ব্যাপ্তিজ্ঞানের উৎপত্তি প্রত্যক্ষের সাহায্যে সম্ভব নয়। “তত্ত্বোপপ্লবসিংহ” গ্রন্থে এর প্রধান অন্তরায় হিসেবে দেশ, কাল ও স্বভাবের ব্যবধানকে এর কারণ হিসেবে ধরা হয়েছে। [13] এই পরিবর্তনশীল জগতে দেশ, কাল ও পরিবেশের বিভিন্নতা অনুযায়ী বস্তুজগত ও তার ধর্ম প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হয়, তাই অনুমান দ্বারা ব্যাপ্তিজ্ঞানকে চিরকালীন ধরে নেওয়া যায় না।[14] চার্বাক মতে অনুমান সম্ভাবনার আভাষ মাত্র।

আপ্তবাক্য প্রমাণ

আপ্তবাক্য অনুমানের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় এর দ্বারা প্রমাণ চার্বাকগণের মতে ভ্রান্ত বলে বিবেচিত। আপ্তবাক্যের সত্যতার ভিত্তি নির্ভরযোগ্য ব্যক্তির উক্তি যা ব্যক্তির ব্যাপ্তিজ্ঞানে বিশ্বাসের ওপর অধিকাংশ সময়ে নির্ভরশীল হওয়ায় তা চার্বাক মতে গ্রাহ্য নয়।

দেহাত্মবাদ

প্রত্যক্ষবাদী চার্বাকেরা বস্তুজগতের মূলগত উপাদানের সংখ্যা চারে সীমিত রাখেন। এগুলি হল ক্ষিতি, অপ্, তেজ ও মরুৎ। ব্যোম বা আকাশকে প্রত্যক্ষ করা যায় না বলে একে জগতের মূল উপাদানের মধ্যে তারা ধরেন না।

তথ্যসূত্র

  1. চার্বাক দর্শন - লতিকা চট্টোপাধ্যায়, প্রথম প্রকাশ জুলাই, ১৯৮২, নিউ এজ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, ১২, বঙ্কিম চ্যাটার্জী স্ট্রীট, কলিকাতা - ৭৩
  2. প্রবোধচন্দ্রোদয়ম - কৃষ্ণ মিশ্র , বেনারস, ১৯৫৫
  3. তত্ত্বোপপ্লবসিংহ - জয়রাশি ভট্ট , গায়কোয়াড় ওরিয়েন্টাল সিরিজ
  4. চার্বাক দর্শন - দক্ষিণারঞ্জন শাস্ত্রী
  5. বিজ্ঞানঘন এব এতেভ্যো ভূতেভ্যঃ সমুত্থায় তান্যেবানুবিনশ্যতি, ন প্রেত্য সংজ্ঞাস্তীত্যরে ব্রবীমি- বৃহদারণ্যকোপনিষদ, ২|৪|১২
  6. য়েয়ং প্রেতে বিচিকিৎসা মনুষ্যে অস্তীত্যেকে নায়মস্তীতি চৈকে- কঠোপনিষদ, ১|১|২০
  7. লোকায়তমেব শাস্ত্রং যত্র প্রত্যক্ষমেব প্রমাণম- প্রবোধচন্দ্রোদয়ম - কৃষ্ণ মিশ্র , বেনারস, ১৯৫৫, পৃষ্ঠা ৬৪
  8. প্রত্যক্ষমেবৈকং প্রমাণামিতি চার্বাকাঃ- ন্যায়মঞ্জরী, জয়ন্ত ভট্ট
  9. এতাবানেব লোকোহয়ং যাবানিন্দ্রিয়গোচরঃ- ষড়দর্শনসমুচ্চয়
  10. চার্বাকধূর্তস্তু প্রমাণসংখ্যানিয়মাশক্যকরণীয়ত্বসিদ্ধেয় চ প্রমিতি ভেদান প্রত্যক্ষাদিপ্রমাণানুপজন্যানীদৃশানুপাদর্শয়েৎ- ন্যায়মঞ্জরী, জয়ন্ত ভট্ট
  11. পৃথিব্যাদীনি তত্ত্বানি লোকে প্রসিদ্ধানি, তান্যপি বিচার্যমানানি ন ব্যবতিষ্ঠন্তে, কিং পুনরন্যানি- তত্ত্বোপপ্লবসিংহ, জয়রাশি ভট্ট
  12. তদুচ্যতে সল্লক্ষণনিবন্ধং মানব্যবস্থানং, মাননিবন্ধনা চ মেয়স্থিতিঃ, তদভাবে ন তথা সদব্যভারবিশয়ত্বং কথং- তত্ত্বোপপ্লবসিংহ, জয়রাশি ভট্ট
  13. দেশকালস্বভাববিপ্রকষার্চ্চ ন ব্যক্তীনাং সম্বন্ধাবধারণায় অলং প্রত্যক্ষম- তত্ত্বোপপ্লবসিংহ, জয়রাশি ভট্ট
  14. দেশকালদশাভেদবিচিত্রাত্মসু বস্তুযু অবিনাভাবনিয়মো ন শক্যা বস্তুমাহ চ- ন্যায়মঞ্জরী, জয়ন্ত ভট্ট
This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.