জয়নগর মজিলপুর

জয়নগর মজিলপুর হল ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার অন্তর্গত একটি শহর ও পৌরসভা এলাকা। এই শহরটি কলকাতার দক্ষিণ শহরতলিতে অবস্থিত। এটি বৃহত্তর কলকাতার অন্তর্ভুক্ত এবং কলকাতা মেট্রোপলিটান ডেভেলপমেন্ট অথরিটির অধীনস্ত এলাকা।[1]

জয়নগর মজিলপুর
কলকাতা মহানগর অঞ্চল
জয়নগর মজিলপুর পৌরসভা
জয়নগর মজিলপুর
জয়নগর মজিলপুর
ভারতের পশ্চিমবঙ্গে অবস্থান
স্থানাঙ্ক: ২২.১৭৭২° উত্তর ৮৮.৪২৫৮° পূর্ব / 22.1772; 88.4258
দেশ ভারত
রাজ্যপশ্চিমবঙ্গ
বিভাগপ্রেসিডেন্সি
জেলাদক্ষিণ ২৪ পরগণা
অঞ্চলবৃহত্তর কলকাতা
স্থাপিত১ এপ্রিল ১৮৬৯ (1 April 1869)
সরকার
  ধরনপৌরসভা
  শাসকজয়নগর মজিলপুর পৌরসভা
আয়তন
  মোট৫.৮৫ কিমি (২.২৬ বর্গমাইল)
উচ্চতা মিটার (২৬ ফুট)
জনসংখ্যা (২০১১)
  মোট২৫,৯২২
  জনঘনত্ব৪৪০০/কিমি (১১০০০/বর্গমাইল)
ভাষা
  সরকারিবাংলা, ইংরেজি
সময় অঞ্চলআইএসটি (ইউটিসি+৫:৩০)
পিন৭৪৩৩৩৭
টেলিফোন কোড+৯১ ৩২১৮ ২২০/২২১/২২২
যানবাহন নিবন্ধনডব্লিউবি-০১ থেকে ডব্লিউবি-১০, ডব্লিউবি-১৯ থেকে ডব্লিউবি-২২, ডব্লিউবি-৯৫ থেকে ডব্লিউবি-৯৯
লোকসভা নির্বাচনক্ষেত্রজয়নগর (তফঃ)
বিধানসভা নির্বাচনক্ষেত্রজয়নগর (তফঃ)
ওয়েবসাইটwww.joynagarmozilpurmunicipality.com

ইতিহাস

শিয়ালদহ–নামখানা রেললাইনের পশ্চিমে জয়নগর শহর ও পূর্বে মজিলপুর শহর। কায়স্থ প্রধান জয়নগর হল প্রাচীন শহর, অপরদিকে ব্রাহ্মণ প্রধান মজিলপুর হল অপেক্ষাকৃত নবীন শহর। আদিগঙ্গার প্রাচীন প্রবাহপথে অবস্থিত সুন্দরবনের অন্তঃপাতী এই স্থান একসময় ঘন জঙ্গলাকীর্ণ ছিল। একসময় এখানকার আদিগঙ্গার উপর দিয়ে পর্তুগিজ বণিকদের জাহাজ যাতায়াত করত এবং আন্দুল গ্রামের কাছে বর্তমান সাঁকরাইল খাল দিয়ে পাশে হুগলি জেলার সপ্তগ্রামে পৌঁছাত। ষোড়শ-সপ্তদশ শতাব্দীর মঙ্গলকাব্যগুলিতে জয়নগর শহরের উল্লেখ থাকলেও মজিলপুর শহরের নেই।

জয়নগর নামটি এসেছে স্থানীয় দেবী জয়চণ্ডীর নাম থেকে। জনশ্রুতি আছে, এখানকার প্রথম বসতি স্থাপয়িতা কলকাতার বাগবাজারের মতিলালবংশের পূর্বপুরুষ গুণানন্দ মতিলাল সপ্তদশ শতকে বাণিজ্যের কারণে নদীপথে যেতে যেতে গঙ্গার কিছু দূরে এক বাদাম গাছের কাছে নোঙর করেন; রাতে গঙ্গার কিছু দূরে জনশূন্য স্থানে আশ্চর্য আলো দেখতে পান এবং দেবী জয়চণ্ডী তাকে স্বপ্নাদেশ দিয়ে মাটি খুঁড়ে প্রতিষ্ঠা করতে বলেন। পরদিন গুণানন্দ মাটি খুঁড়ে একটি প্রস্তরখণ্ড পেয়ে তা মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করেন। আজও দেবী এখানে পূজিতা এবং প্রতি জৈষ্ঠ্যপূর্ণিমায় দেবীর প্রতিষ্ঠা উপলক্ষে মেলা বসে। মতিলালবংশের পর এখানে কায়স্থ সেন এবং বড়িশার মিত্রবংশ বসতি করেন। মিত্রপরিবারের প্রতিষ্ঠিত রাধাবল্লভ মন্দির ও দোলমঞ্চ বর্তমান। এছাড়া, মিত্র-গঙ্গা দীঘির পাশে পোড়ামাটির ভাস্কর্যের দ্বাদশ শিব মন্দির বর্তমান; এগুলির প্রতিষ্ঠাকাল ১৭৫৫ খ্রিঃ থেকে ১৭৯৯ খ্রিঃ। এরপাশেই দেবতা 'দক্ষিণের ক্ষেত্রপাল' বর্তমান; মূর্তি নেই, শুধু আছে পাথরের প্রাচীন মন্দিরের দরজার বা স্তম্ভের ভগ্নাংশ। মিত্র-গঙ্গা দীঘি খোঁড়ার সময়ই কতকগুলি ভাঙা প্রস্তরমূর্তি পাওয়া যায়, এগুলি কোন প্রাচীন মন্দিরের পাথরের ভগ্নাবশেষ বলে মনে করা হয়। জয়নগর শহরের রক্তাখাঁ পাড়ায় লোকদেবতা বৃষভবাহন পঞ্চাননবনবিবির থান রয়েছে। রক্তাখাঁ পীর বড়খাঁ গাজীর নামান্তর বলে মনে করা হয়।

অষ্টাদশ শতকের রেনেলের গাঙ্গেয় বদ্বীপের মানচিত্রে দেখা যায়, বর্তমান মজিলপুর শহরের পশ্চিমাংশের বিস্তৃত ধানক্ষেত 'গঙ্গার বাদা'র উপর দিয়েই আদিগঙ্গার প্রবাহ বইত। আদিগঙ্গার মজাগর্ভে নতুন বসতির উৎপত্তি হয়েছিল বলেই এই শহরের নাম 'মজিলপুর' হয়েছে। সপ্তদশ শতকের গোড়ার দিকে ভাগ্যবিপর্যয়ের ফলে যশোরের রাজা প্রতাপাদিত্যের আমলা-অমাত্য, ব্রাহ্মণ-কায়স্থ, পণ্ডিত-পুরোহিতরা সুন্দরবনের এই জঙ্গলাকীর্ণ জনবিরল স্থানে বসবাস শুরু করেন। এখানকার দত্ত-ভট্টাচার্য ও পোণ্ডাবংশীয়রা আদি বাসিন্দা; ক্রমে চক্রবর্তী, দে, কান্বায়ণ ও অন্যান্য ব্রাহ্মণ-কায়স্থরা বসতি শুরু করেন। ছাত্র ও দেবালয়বহুল প্রাচীন মজিলপুর শহরে শিক্ষার জন্য অনেক চতুষ্পাঠী ছিল এবং সেগুলি জমিদার ও ধনী ব্যক্তিদের বৃত্তি বা নিষ্কর ভূমিস্বত্ব থেকে পরিচালিত হত। মজিলপুর শহরের ধন্বন্তরী কালীবাড়ি একটি প্রাচীন শক্তিপীঠ। ষোড়শ-সপ্তদশ শতকে আদিগঙ্গার তীরবর্তী স্থানগুলি শক্তিসাধনার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল; সপ্তদশ শতকে এক সিদ্ধতান্ত্রিক ভৈরবানন্দ আদিগঙ্গার তীরে ধন্বন্তরী কালী বিগ্রহ খুঁজে পান ও কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। মন্দিরের গর্ভগৃহে কাঠের তৈরী কারুকার্যময় রথসিংহাসনে পদ্মের ওপর শায়িত শিব বিগ্রহের বুকের ওপর দন্ডায়মানা সালঙ্কারা ত্রিনয়নী কালো কষ্টিপাথরে নির্মিত দক্ষিণাকালী বিগ্রহ অবস্থিত। মজিলপুর শহরের উল্লেখযোগ্য লোকদেবতা হলেন পণ্ডিতপাড়া ও কয়েলপাড়ার পঞ্চানন ঠাকুর। কয়েলপাড়ার পঞ্চানন গভীর পাঁশুটে রঙের ভয়ঙ্কর মূর্তি, পাশে গর্দভবাহনা শীতলা দেবীরবাবাঠাকুরের (দক্ষিণরায়) মূর্তি আছে। পণ্ডিতপাড়ার পঞ্চাননশীতলা সাধারণ ইটের ঘরে পাশাপাশি বিরাজিত; এদের সামনে বাবাঠাকুর, জরাসুর ও বসন্ত রায়ের ছোট ছোট মূর্তি বর্তমান। আগে মন্দিরটি চালাঘরের ছিল এবং মূর্তির বদলে ঘটে পূজা করা হত। উল্লেখ্য, রাঢ়-বঙ্গের লোকদেবতা ধর্মঠাকুর ক্রমে ভাগীরথী প্রবাহের নিম্নধারায় জনসংস্কৃতিতে মজিলপুর শহরের পঞ্চানন রূপের ভিতর দিয়ে পরিপূর্ণ শিবমূর্তিতে রূপান্তরিত হয়েছেন।[2]

ভূগোল

জয়নগর মজিলপুর শহরটি ২২°১০′৩৮″ উত্তর ৮৮°২৫′৩৩″ পূর্ব দ্রাঘিমাংশে অবস্থিত। সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে এই শহরের গড় উচ্চতা হল ৮ মিটার (২৬ ফু)সিন্ধু-গাঙ্গেয় সমভূমির বেশিরভাগ এলাকার মতো, জয়নগর মজিলপুরের মাটি ও জল মূলত পলিজ (alluvial) প্রকৃতির। শহরের মাটির তলায় কাদা, পলি, বিভিন্ন ক্রমের বালি ও নুড়ি নিয়ে গঠিত কোয়্যাটারনারি যুগের পললস্তর দেখা যায়। পললস্তরগুলি দুটির কাদার স্তরের মধ্যে বদ্ধ রয়েছে। নিচের কাদার স্তরটির গভীরতা ২৫০ মিটার (৮২০ ফুট) থেকে ৬৫০ মিটার (২,১৩৩ ফুট) এবং উপরের কাদার স্তরটির গভীরতা ১০ মিটার (৩৩ ফুট) থেকে ৪০ মিটার (১৩১ ফুট)। ব্যুরো অফ ইন্ডিয়ান স্ট্যান্ডার্ডসের হিসেব অনুযায়ী, জয়নগর মজিলপুর শহর তৃতীয় ভূ-কম্পী ক্ষেত্রের অন্তর্গত, যার মাত্রা ১ (I) থেকে ৫ (V) (ভূমিকম্পের বৃদ্ধিপ্রবণতা অনুসারে)। আবার রাষ্ট্রসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির রিপোর্ট অনুযায়ী বায়ুপ্রবাহ ও ঘূর্ণিঝড় ক্ষেত্র হিসেবে জয়নগর মজিলপুর “অতি উচ্চ ক্ষয়ক্ষতি-প্রবণ” এলাকা।[3]

জলবায়ু

জয়নগর মজিলপুরের জলবায়ু "ক্রান্তীয় সাভানা" প্রকৃতির ("কোপেন জলবায়ু শ্রেণিবিভাগ" অনুসারে Aw)। বার্ষিক সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ২৬.৮° সেন্টিগ্রেড এবং মাসিক সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১৯°-৩০° সেন্টিগ্রেডের মধ্যে থাকে। এখানে গ্রীষ্মকাল উষ্ণ ও আর্দ্র। এই সময় সর্বনিম্ন গড় তাপমাত্রা ৩০° সেন্টিগ্রেডের কাছাকাছি থাকলেও মে-জুন মাসে সর্বোচ্চ গড় তাপমাত্রা প্রায়শই ৪০° সেন্টিগ্রেড ছাড়িয়ে যায়। শীতকাল সাধারণত মাত্র আড়াই মাস স্থায়ী হয়। ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে সর্বনিম্ন গড় তাপমাত্রা ৯°-১১° সেন্টিগ্রেডের কাছাকাছি থাকে। শহরের সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রার রেকর্ড যথাক্রমে ৪৩.৯° সেন্টিগ্রেড ও ৩.২° সেন্টিগ্রেড। সাধারণভাবে মে মাস শহরের উষ্ণতম মাস। এই সময় শহরের সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন গড় তাপমাত্রা থাকে যথাক্রমে ৩৭° সেন্টিগ্রেড ও ২৭° সেন্টিগ্রেড। অন্যদিকে জানুয়ারি শীতলতম মাস। জানুয়ারির সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন গড় তাপমাত্রা যথাক্রমে ২৩° সেন্টিগ্রেড ও ১২° সেন্টিগ্রেড। গ্রীষ্মের শুরুতে প্রায়শই শিলাবৃষ্টি, ঝড় ও বজ্রবিদ্যুৎ সহ বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে। এই ধরনের ঝড়বৃষ্টি প্রকৃতিগতভাবে পরিচলন। এর স্থানীয় নাম কালবৈশাখী।

দক্ষিণ-পূর্ব মৌসুমি বায়ুর বঙ্গোপসাগরীয় শাখাটি শহরে বৃষ্টিপাত ঘটানোর জন্য দায়ী। বর্ষাকাল সাধারণত স্থায়ী হয় জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত। শহরের বার্ষিক ১৫৮২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতের অধিকাংশই এই সময়ে ঘটে থাকে। অগস্ট মাসে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ সর্বোচ্চ থাকে। এই সময় গড়ে ৩০৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়। জয়নগর মজিলপুর বার্ষিক ২,৫২৮ ঘণ্টার সূর্যালোক পেয়ে থাকে। অধিকাংশ সূর্যালোক প্রাপ্তির সময় মার্চ মাস।[4]

জয়নগর মজিলপুর
জলবায়ু লেখচিত্র
জাফেমামেজুজুসেডি
 
 
১৭
 
২৭
১৪
 
 
২৩
 
৩০
১৭
 
 
৩৩
 
৩৪
২২
 
 
৪৮
 
৩৬
২৫
 
 
১০২
 
৩৬
২৬
 
 
২৬০
 
৩৪
২৭
 
 
৩৩২
 
৩২
২৬
 
 
৩২৯
 
৩২
২৬
 
 
২৯৬
 
৩২
২৬
 
 
১৫১
 
৩২
২৪
 
 
১৭
 
৩০
১৯
 
 
৭.৪
 
২৭
১৪
সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সর্বোচ্চ এবং সর্বোনিম্ন গড়
মিলিমিটারে বৃষ্টিপাতের মোট পরিমাণ

জনপরিসংখ্যান

ভারতের ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুসারে জয়নগর মজিলপুর শহরের জনসংখ্যা হল ২৫,৯২২ জন। এর মধ্যে পুরুষ ১৩,২৩৪ (৫১%) জন, এবং মহিলা ১২,৬৮৮ (৪৯%) জন। এখানে সাক্ষর ২০,৮৯৮ জন। ৬ বছর বয়সের নিচে জনসংখ্যা হল ২,২৭৭ জন (মোট জনসংখ্যার ৮৮.৩৮% এর বয়স ৬ বছরের উপরে)।[5]

ভারতের ২০০১ সালের আদমশুমারি অনুসারে জয়নগর মজিলপুর শহরের জনসংখ্যা ছিল ২৩,৩১৯ জন। এর মধ্যে পুরুষ ছিল ৫২% এবং নারী ছিল ৪৮%। এখানে সাক্ষরতার হার ছিল ৭৬%। পুরুষদের মধ্যে সাক্ষরতার হার ছিল ৮২% এবং নারীদের মধ্যে সাক্ষরতার হার ছিল ৭১%। সারা ভারতের সাক্ষরতার হার ৫৯.৫%, তার চাইতে জয়নগর মজিলপুর শহরের সাক্ষরতার হার ছিল বেশি। এই শহরের জনসংখ্যার ১০% ছিল ৬ বছর বা তার কম বয়সী।[6]

প্রশাসন

জয়নগর মজিলপুর শহরের একটি স্থানীয় স্বায়ত্ত্বশাসন সংস্থা হল জয়নগর মজিলপুর পৌরসভা। জয়নগর মজিলপুর শহরের ৫.৮৫ বর্গকিলোমিটার (২.২৬ মা) অঞ্চলের পৌর পরিষেবা দেওয়া ও নগরাঞ্চলের উন্নয়ন এই পৌরসভার প্রাথমিক দায়িত্ব। এটি একটি বিধিবদ্ধ সরকারি সংস্থা। ১৮৬৯ সালের ১ লা এপ্রিল জয়নগর, মজিলপুর ও আরও ৪-৫টি ছোটো ছোটো অঞ্চল (চাঁপাতলা, হাসানপুর, গহেরপুর, ইত্যাদি) নিয়ে এই পৌরসভাটি গঠিত হয়েছিল। এটি সারা দেশের প্রাচীনতম পৌরসভাগুলির মধ্যে অন্যতম। জয়নগর মজিলপুর পৌরসভার সদস্যরা শহরের জনসাধারণ কর্তৃক প্রত্যক্ষভাবে পাঁচ বছরের মেয়াদে নির্বাচিত হন। এই পৌরসভাটি জনসংখ্যার ভিত্তিতে ১৪ টি প্রশাসনিক ওয়ার্ডে বিভক্ত। এক এক জন পৌরপ্রতিনিধি এক-একটি ওয়ার্ড থেকে নির্বাচিত হন। নির্বাচিত পৌরপ্রতিনিধিরা নিজেদের মধ্যে থেকে একজন পৌরপ্রতিনিধিকে পৌরপ্রধান হিসেবে নির্বাচিত করেন। সরকারি আধিকারিকরা তাদের কাজে সহায়তা করেন। ১৮৬৯ সালে বেঙ্গল মিউনিসিপাল অ্যাক্ট কার্যকর হওয়ার সাথে সাথে জয়নগর মজিলপুর পৌরসভা গঠিত ও অনুমোদিত হয়। তার আগে ১৮৬৪ সালে যে জয়নগর টাউন কমিটি গড়ে উঠেছিল, তার সভাপতি ছিলেন বাংলার নবজাগরণের অন্যতম পথিকৃৎ পণ্ডিত শিবনাথ শাস্ত্রীর (১৮৪৭-১৯১৯) পিতা ও তৎকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাপ্তাহিক পত্রিকা 'সোমপ্রকাশ'এর সম্পাদক পণ্ডিত দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণের (১৮১৯-১৮৮৬) ভগ্নীপতি পণ্ডিত হরানন্দ বিদ্যাসাগর (১৮২৭-১৯১২)। ১৮৬৯ সালে সদ্যগঠিত পৌরসভার পৌরপ্রধানের পদও তিনি অলঙ্কৃত করেন।[7]

আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য জয়নগর থানা দায়ীত্বপ্রাপ্ত। জয়নগর মজিলপুর পৌরসভা এবং জয়নগর ১জয়নগর ২ সমষ্টি উন্নয়ন ব্লকদুটি এই থানার আওতাধীন। জয়নগর থানার আওতাভুক্ত মোট এলাকা হল ৪৩৮.০৬ বর্গকিলোমিটার (১৬৯.১৪ মা)[8]

পরিবহণ

রেলপথ

জয়নগর মজিলপুর শহরে পরিবহন ব্যবস্থার প্রাথমিক মাধ্যম হল রেলপথ। জয়নগর মজিলপুর শহর ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলি কলকাতা শহরতলি রেলওয়ের জয়নগর মজিলপুর রেলওয়ে স্টেশন দ্বারা পরিবেশিত হয়। এই রেলওয়ে স্টেশনটি শিয়ালদহ রেলওয়ে স্টেশন থেকে ৪৯ কিলোমিটার (৩০ মা) দক্ষিণে শিয়ালদহ–নামখানা লাইনে অবস্থিত। এটি ভারতীয় রেলওয়ের অধীনস্থ পূর্ব রেলওয়ের আওতাধীন। জয়নগর মজিলপুর রেলওয়ে স্টেশনটি শিয়ালদহ রেলওয়ে বিভাগের ব্যস্ততম রেলওয়ে স্টেশনগুলির মধ্যে অন্যতম।

রাস্তাপথ

জয়নগর মজিলপুর শহরটি ১ নং রাজ্য সড়ক দ্বারা কলকাতাবাংলার অন্যান্য শহরগুলির সঙ্গে সংযুক্ত। জয়নগর মজিলপুর শহরে বাস পরিষেবা সরকারি ও বেসরকারী উদ্যোগে পরিচালিত হয়ে থাকে। এখানকার সরকারি বাস পরিবহন সংস্থাগুলি হল পশ্চিমবঙ্গ ভূতল পরিবহন নিগম, কলকাতা রাষ্ট্রীয় পরিবহণ সংস্থা, ক্যালকাটা ট্রামওয়েজ কোম্পানি ইত্যাদি। জয়নগর মজিলপুরে পরিবহন ব্যবস্থার অপর এক বিশিষ্ট মাধ্যম হল ট্যাক্সি। কোনো কোনো নির্দিষ্ট রুটে অটোও চলাচল করে। স্বল্পদুরত্বের যাত্রীরা অনেক সময় রিক্সাও ব্যবহার করে থাকেন।

সংস্কৃতি

জয়নগর মজিলপুর শহর তার সাহিত্যিক, শৈল্পিক ও বৈপ্লবিক ঐতিহ্যগুলির জন্য সুবিদিত। শিল্প ও সাহিত্যের প্রতি এলাকাবাসীদের বিশেষ আগ্রহ পরিলক্ষিত হয়ে থাকে; নতুন প্রতিভাকে গ্রহণ করার ঐতিহ্য জয়নগর মজিলপুর শহরকে তাই পরিণত করেছে প্রচণ্ড সৃজনীশক্তিধর এক শহরে।

জয়নগর মজিলপুরের অন্যতম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হল শহরের ছোটো ছোটো অঞ্চলকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা পাড়া সংস্কৃতি। সাধারণত প্রত্যেক পাড়ায় একটি করে ক্লাবঘর সহ নিজস্ব সংঘ বা ক্লাব থাকে। অনেক সময় ক্লাবগুলির নিজস্ব খেলার মাঠও থাকে। পাড়ার বাসিন্দারা অভ্যাসগতভাবে এখানে এই সব ক্লাবঘরে আড্ডা দিতে আসেন; মাঝেমধ্যে এই সব আড্ডা হয়ে ওঠে মুক্তছন্দের বৌদ্ধিক আলাপআলোচনা। এই শহরে রাজনৈতিক দেওয়াললিখনেরও এক ঐতিহ্য লক্ষিত হয়; এই সব দেওয়াললিখনে কেচ্ছাকেলেংকারির বর্ণনা থেকে শ্লেষাত্মক রঙ্গব্যঙ্গ, লিমেরিক, কার্টুন, ইস্তাহার – সবই বিধৃত হয়।[9]

খ্যাতি

জয়নগরের মোয়া নামক মিষ্টান্নটি সুপ্রসিদ্ধ। কনকচূর ধানের খই, নলেন গুড় ও গাওয়া ঘিয়ের তৈরী এই অতি জনপ্রিয় মিষ্টান্নটির জন্যে জয়নগর শহরের ব্যপক পরিচিতি আছে। জয়নগরের মোয়া অনেক ধরনের উপাদান যুক্ত করে তৈরি করা হয়। এতে খেজুর গুড়, কনকচুর খই (ভাজা চাল/মুড়ি), এলাচি, পোস্ত-দানা, গাওয়া ঘি (গরুর দুধে তৈরি), ক্ষীর, পেস্তা, কাজুবাদাম, কিশমিশ মিশানো হয়। এই মিষ্টান্নটি শীতকালে (নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারিতে) তৈরি করা হয়। সেইসময় জয়নগর শহর ও তার আশেপাশের প্রায় ২৫০ টি মিষ্টির দোকানে জয়নগরের মোয়া তৈরি করা হয়। এই জয়নগরের মোয়া ভারতের ভৌগোলিক স্বীকৃতি বহন করে।

বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব

তথ্যসূত্র

  1. "কলকাতা মহানগর অঞ্চলের মুল মানচিত্র"। কলকাতা মেট্রোপলিটান ডেভেলপমেন্ট অথরিটি। ২৮ সেপ্টেম্বর ২০০৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৩ সেপ্টেম্বর ২০০৭
  2. জয়দেব দাস (২০১৫)। অজানা সুন্দরবন। কলকাতা। পৃষ্ঠা ৮৮।
  3. "ফলিং রেন্ জিনোমিক্স, আইএনসি - জয়নগর মজিলপুর"। ফলিং রেন্ জিনোমিক্স। সংগ্রহের তারিখ ২৭ আগস্ট ২০১৬
  4. "জলবায়ু: জয়নগর মজিলপুর"। জলবায়ু তথ্য। সংগ্রহের তারিখ ১৪ জানুয়ারি ২০১৪
  5. "২০১১ আদমশুমারি – প্রাথমিক জনগণনা বিমূর্ত তথ্য তালিকা"পশ্চিমবঙ্গ – জেলা-অনুযায়ী। রেজিস্ট্রার জেনারেল ও সেন্সাস কমিশনার, ভারত। সংগ্রহের তারিখ ২৭ এপ্রিল ২০১৬
  6. "২০০১ আদমশুমারি: ২০০১ সালের জনগণনা থেকে তথ্য (অস্থায়ী)"। ভারতের জনসংখ্যা কমিশন। ১৬ জুন ২০০৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১ নভেম্বর ২০০৮
  7. "জয়নগর মজিলপুর পৌরসভা"পৌর ও নগরোন্নয়ন দফতর। পশ্চিমবঙ্গ সরকার। ২১ এপ্রিল ২০১৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৮ মে ২০১৫
  8. "জয়নগর থানা"বারুইপুর পুলিশ জেলা। পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ। সংগ্রহের তারিখ ৯ মার্চ ২০১৭
  9. ঘোষ, বিনয়, "পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি", তৃতীয় খন্ড, প্রথম সংস্করণ, প্রকাশ ভবন, পৃষ্ঠা: ২৫১-২৫৪

বহিঃসংযোগ

  • উইকিভ্রমণ থেকে জয়নগর মজিলপুর ভ্রমণ নির্দেশিকা পড়ুন
  • "ডিজিটাইজ়্ জয়নগর মজিলপুর"। ১০ ২ এপ্রিল ০১৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৬ ২ এপ্রিল ০১৯ এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন: |সংগ্রহের-তারিখ=, |আর্কাইভের-তারিখ= (সাহায্য)

আরও পড়ুন

This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.