চণ্ডী
চণ্ডী (সংস্কৃত: चण्डी) বা চণ্ডিকা দেবীমাহাত্ম্যম্ গ্রন্থের সর্বোচ্চ দেবী। তিনি দুর্গা সপ্তশতী নামেও পরিচিত। মহাকালী, মহালক্ষ্মী ও মহাসরস্বতী দেবীর সমন্বয়ে চণ্ডীকে উক্ত গ্রন্থে সর্বোচ্চ সত্ত্বা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। গ্রন্থের অন্তভাগে মূর্তিরহস্য অংশে তাকে অষ্টাদশভূজা মহালক্ষ্মী নামে অভিহিত করা হয়েছে।
- এই নিবন্ধটি দেবী চণ্ডী সম্পর্কিত। শ্রীশ্রীচণ্ডী নামে পরিচিত শাক্ত ধর্মগ্রন্থটি সম্পর্কে জানতে হলে দেখুন দেবীমাহাত্ম্যম্।
চণ্ডী | |
---|---|
চতুর্ভূজা চণ্ডী | |
দেবনাগরী | चण्डी |
সংস্কৃত লিপ্যন্তর | Caṇḍī |
অন্তর্ভুক্তি | মহাশক্তি |
মন্ত্র | ওঁ ঐং হ্রীং ক্লীং চামুণ্ডায়ৈ বিচ্চে |
বাহন | সিংহ |
ব্যুৎপত্তি
দেবীমাহাত্ম্যম্ গ্রন্থে "চণ্ডী" বা "চণ্ডিকা" দেবীকে সর্বোচ্চ দেবীর মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। কোবার্নের মতে, চণ্ডিকা হলেন ভয়ংকরী ও ক্রোধন্মত্তা দেবী। উল্লেখ্য, প্রাচীণ সংস্কৃতে "চণ্ডিকা" শব্দটি কোথাও পাওয়া যায় না। বৈদিক সাহিত্যেও এই শব্দটির কোনো উল্লেখ নেই। রামায়ণ ও মহাভারতেও শব্দটি উল্লিখিত না হলেও, একটি স্তোত্রে "চণ্ড" ও "চণ্ডী" কথাদুটি বিশেষণ হিসেবে পাওয়া যায়।[1]
প্রাচীন সংস্কৃত রচনায় চণ্ডী কথাটির অনুপস্থিতির কারণ হল এই দেবী হিন্দুধর্মের অব্রাহ্মণ্য শাখার দেবতা। ইনি প্রকৃতপক্ষে বঙ্গদেশের অনার্য আদিবাসী সমাজের দেবী।
দেবীমাহাত্ম্যম্ গ্রন্থে চণ্ডী বা চণ্ডিকা শব্দদুটি মোট ২৯ বার ব্যবহৃত হয়েছে। অনেক গবেষক মনে করেন এই দেবীর উৎস প্রাচীন বঙ্গদেশের শাক্ত সম্প্রদায়ের তন্ত্র সাধনায়। "চণ্ডী" শব্দটি দেবীর সর্বাপেক্ষা পরিচিত অভিধা। দেবীমাহাত্ম্যম্ গ্রন্থে চণ্ডী, চণ্ডিকা, অম্বিকা ও দুর্গা শব্দগুলি সমার্থক শব্দ হিসেবে ব্যবহৃত।[2]
পৌরাণিক উপাখ্যান
দেবীমাহাত্ম্যম্ গ্রন্থের দ্বিতীয় অধ্যায়ে দেবীর উৎস ব্যাখ্যা করা হয়েছে: "অসুরগণের সঙ্গে দীর্ঘ যুদ্ধের পর দেবতারা পরাজিত হলে সকল দেবগণের দেহসঞ্জাত তেজঃপুঞ্জ হতে মহাদেবীর উৎপত্তি। দেবগণের শক্তি সম্মিলিত হয়ে এক মহাজ্যোতির সৃষ্টি করলে দশদিক আলোকে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। সেই অভূতপূর্ব ত্রিলোক-উদ্ভাসনকারী আলোক এক হয়ে নারীমূর্তি ধারণ করে।"
"এই দেবী ছিলেন মহাশক্তি। তিনি ত্রিনয়না, তাঁর কপালে অর্ধচন্দ্র শোভিত। দেবীর বহু হাতে বহু প্রকার অস্ত্র, গাত্রে বহুমূল্য অলংকার ও মালা। সকলই দেবগণ দেবীকে উপহার দিয়েছিলেন। তাঁর সোনার অঙ্গ সহস্র সূর্যের ন্যায় উজ্জ্বল। এইরূপে সিংহবাহিনী দেবী চণ্ডী হয়ে উঠলেন বিশ্বশক্তির মূর্তিস্বরূপ।"[3]
অন্য একটি কাহিনি অনুযায়ী, কালি রক্তবীজ দৈত্যবধে দেবী পার্বতীকে সহায়তা করেন। রক্তবীজের রক্ত মাটিতে পড়লে সহস্র সহস্র রক্তবীজ অসুরের সৃষ্টি হত। কৃৃৃৃষ্ণবর্ণা দেবী রক্তবীজের রক্ত পান করেন। এই সময় ভূপতিত রক্ত থেকে সৃষ্ট অসুরদের ধ্বংস করেন কালিকা এবং শেষে তিনিই রক্তবীজকে বধ করেন।[4] স্কন্দ পুরাণেও এই কাহিনিটি রয়েছে। এই পুরাণে আরও বলা হয়েছে যে দেবী পার্বতী দেহসম্ভুুুতা এক দেবী চন্ড ও মুন্ড নামক অসুরদ্বয়কে বধ করেন।[5] এবং এর থেকে তার নাম হয় চামুন্ডা।
এই চামুুন্ডা বা কালিকা দেবীর চন্ডীরই অপর রূপ।
মূর্তিতত্ত্ব
_Nat.jpg)
দেবীমাহাত্ম্যম্ গ্রন্থের মধ্যম চরিতে বর্ণিত ধ্যানমন্ত্র অনুযায়ী দেবী চণ্ডী অষ্টাদশভূজা, অক্ষমালা, পরশু, গদা, তীর, ধনুক, বজ্র, পদ্ম, কমণ্ডলু, মুদ্গর, শূল, খড়্গ, ঢাল, শঙ্খ, ঘণ্টা, মধুপাত্র, ত্রিশূল, অঙ্কুশ ও চক্রধার। তিনি রক্তবর্ণা ও পদ্মাসনা।[6]
কোনো কোনো মন্দিরে দেবী চণ্ডী মহাকালী, মহালক্ষ্মী ও মহাসরস্বতী দেবীর রূপে পৃথক পৃথকভাবে পূজিতা হন। আবার কোথাও কোথাও দেবীর চতুর্ভূজা মূর্তিও পূজা করা হয়।
মন্দির
দেবী চণ্ডীর কয়েকটি বিখ্যাত মন্দিরের তালিকা নিচে দেওয়া হল:
- গণ্ডকী চণ্ডী, গণ্ডকী (পোখরার নিকটস্থ), নেপাল। (শক্তিপীঠ)
- মঙ্গল চণ্ডিকা, উজ্জয়িনী, পশ্চিমবঙ্গ। (শক্তিপীঠ)
- সপ্তশার্ঙ্গী মন্দির, বানি, মহারাষ্ট্র। (অষ্টাদশভূজা মহালক্ষ্মী)
- মহালক্ষ্মী মন্দির, মুম্বই, মহারাষ্ট্র। (তিনটি পৃথক মূর্তি)
- হেমাদপন্থি চণ্ডিকা দেবী মন্দির, কাটোল, মহারাষ্ট্র।
- বৈষ্ণো দেবী মন্দির, খাটরা, জম্মু ও কাশ্মীর। (তিনটি পিণ্ড বা প্রস্তর)।
- কটক চণ্ডী মন্দির, কটক, ওড়িশা। (চতুর্ভূজা)
- অষ্টাদশভূজা মহালক্ষ্মী মন্দির, স্কন্দাশ্রমম, সালেম, তামিলনাড়ু।
- মঙ্গলচণ্ডী মন্দির, গুয়াহাটি, অসম।
- মঙ্গলচণ্ডী মন্দির, চণ্ডীতলা, কলকাতা।
- চণ্ডী দেবী মন্দির, নীল পর্বত, হরিদ্বার।[7]
- চণ্ডী মন্দির, চণ্ডীগড়. (এই দেবীর নামানুসারেই শহরের নামকরণ)।
বাংলার লোকবিশ্বাস
চণ্ডী পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম জনপ্রিয় লৌকিক দেবী। খ্রিষ্টীয় ত্রয়োদশ থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে দেবী চণ্ডীর মাহাত্ম্য প্রচারের জন্য একাধিক চণ্ডীমঙ্গল কাব্য রচিত হয়। এর ফলে লৌকিক চণ্ডী দেবী মূলধারার হিন্দুধর্মে স্থান করে নেন। মঙ্গলকাব্য ধারার চণ্ডী দেবী কালীর সমতুল্য।[8] তিনি শিবের স্ত্রী, গণেশ ও কার্তিকের জননী। দেবীর এই সত্ত্বাদুটি পার্বতী বা দুর্গার সমতুল্য।[9] চণ্ডীর ধারণাটি নানা বিবর্তনের মধ্য দিয়ে এসেছে। তাই চণ্ডীর পূজাও বিভিন্ন প্রকার।
চণ্ডী সৌভাগ্যের দেবী। সুখসমৃদ্ধি, সন্তান, বিজয় ইত্যাদি কামনায় তার মঙ্গলচণ্ডী, সঙ্কটমঙ্গলচণ্ডী, রণচণ্ডী ইত্যাদি মূর্তিগুলি পূজা করা হয়। ওলাইচণ্ডীর পূজা হয় মহামারী ও গবাদিপশুর রোগ নিবারণের উদ্দেশ্যে।[10]
পশ্চিমবঙ্গের বহু গ্রামের নামের সঙ্গে দেবী চণ্ডীর নাম যুক্ত। মঙ্গলচণ্ডীর পূজা সমগ্র রাজ্যে এমনকি অসমেও প্রচলিত।[11]
পাদটীকা
- Coburn, Thomas B., Devī Māhātmya. p 95
- Coburn, Thomas B., Devī Māhātmya.
- Mookerjee, Ajit, Kali, The Feminine Force, p 49
- Wilkins p.255-7
- Wilkins p.260
- Sankaranarayanan. S., Devi Mahatmyam, P 148.
- Chandi Devi ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ৫ মে ২০০৬ তারিখে Haridwar.
- McDaniel(2004) p.21
- McDaniel(2004) pp. 149-150
- McDaniel(2002) pp. 9-11
- Manna, Sibendu, Mother Goddess, Chaṇḍī, pp. 100-110
তথ্যসূত্র
- Coburn, Thomas B., "Devī Māhātmya, The Crystallization of the Goddess Tradition" , South Asia Books, 2002. (আইএসবিএন ৮১-২০৮-০৫৫৭-৭)
- Manna, Sibendu, Mother Goddess, Chaṇḍī, Punthi Pustak, Calcutta, India, 1993. (আইএসবিএন ৮১-৮৫০৯৪-৬০-৮)
- Mookerjee, Ajit, Kali, The Feminine Force, Destiny Books, Rochester, Vermont, 1988, (আইএসবিএন ০-৮৯২৮১-২১২-৫)
- Sankaranarayanan, S., Glory of the Divine Mother (Devī Māhātmyam), Nesma Books, India, 2001. (আইএসবিএন ৮১-৮৭৯৩৬-০০-২)
- McDaniel, June, Offering Flowers, Feeding Skulls: Popular Goddess Worship in West , Published 2004, Oxford University Press - US, 368 pages, আইএসবিএন ০-১৯-৫১৬৭৯০-২
- McDaniel, June, Making Virtuous Daughters and Wives: An Introduction to Women's Brata Rituals in Benegal Folk Religion, Published 2002, SUNY Press, 144 pages, আইএসবিএন ০-৭৯১৪-৫৫৬৫-৩
- Wilkins, William Joseph, Hindu Mythology, Vedic and Puranic, Published 2004, Kessinger Publishing, 428 pages, আইএসবিএন ০-৭৬৬১-৮৮৮১-৭ (First edition: Published 1882; Thacker, Spink & co.)