ওলাইচণ্ডী

ওলাইচণ্ডী হলেন একজন হিন্দু লৌকিক দেবী। ইনি ওলাদেবী, ওলাবিবি বা বিবিমা নামেও পরিচিত। ইনি কলেরার দেবী এবং অসুর ময়ের পত্নী। বঙ্গ (অধুনা বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য) অঞ্চলের অধিবাসীরা ওলাইচণ্ডীর পূজা করে। উক্ত অঞ্চলের হিন্দু ও মুসলমান উভয় ধর্মাবলম্বীর কাছেই এই দেবী সম্মানীয়া। সাধারণত বাংলায় তাঁর ছয় বোন বনদেবী/বনবিবি (কলেরার দেবী), আজগাইবিবি, ঝোলাইবিবিআসানবিবির সঙ্গে তাঁর পূজা হয়। কোনো কোনো আধুনিক গবেষকের মতে ‘সাতবিবি’ নামে পরিচিত এই সাত দেবী আসলে হিন্দু সপ্তমাতৃকার (ব্রাহ্মী, মাহেশ্বরী, বৈষ্ণবী, বারাহী, ইন্দ্রাণী ও অন্যান্য) রূপান্তর। তবে সপ্তমাতৃকা ও সাতবিবির মধ্যে প্রায় কোনো সাদৃশ্য নেই বললেই চলে। ভারতে সাত দেবীর পূজা যে সুপ্রাচীন কাল থেকে চলে আসছে, তার প্রমাণ অধুনা পাকিস্তানের সিন্ধুপ্রদেশের অন্তর্গত সিন্ধু সভ্যতার মহেঞ্জোদাড়ো শহরের টেরাকোটা সিলমোহরে দেখা যায়। এই সিলমোহরে সাতজন নারীকে একসঙ্গে দণ্ডায়মান অবস্থায় দেখা যায়।

ওলাইচণ্ডী বাংলার লোকসংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। বিভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতির মধ্যে তাঁর পূজা প্রচলিত।[1][2][3]

দেবী

লোক বিশ্বাস অনুসারে, ওলাইচণ্ডী ময়াসুরের পত্নী। ময়াসুর হিন্দু পুরাণের অসুর, দানব, রাক্ষসদৈত্যদের রাজা ও স্থপতি।[1] ভক্তেরা তাঁকে কলেরার হাত থেকে ত্রাণকর্ত্রী দেবী মনে করেন। রোগ ও মহামারীতে আক্রান্ত অঞ্চলে তাঁর পূজা হয়।[1] বাংলায় কলেরাকে বলা হয় ‘ওলাওঠা’। সেই থেকেই এই দেবীর নাম ‘ওলাইচণ্ডী’।

হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা ওলাইচণ্ডীকে লক্ষ্মী ও সরস্বতীর মিলিত মূর্তি মনে করে। তাঁর গায়ের রং গাঢ় হলুদ।তাঁর মাথায় থাকে মস্তকাবরণী, গলায় গলবস্ত্র ও গয়না। তিনি নীল শাড়ি ও গয়না পরে থাকেন। হাতে বিশেষ কোনো মুদ্রা দেখা যায়না | দুটি হাত প্রসারিত অবস্থায় থাকে, দেবী কখনো দন্ডায়মান আবার কখনো মূর্তিতে তাঁর কোলে একটি শিশুকে দেদেবীর সালংকারা ও এলোকেশী রূপ দুইই দেখা যায়।[1] মুসলমানরা তাঁকে ‘ওলাবিবি’ বা ‘বিবিমা’ বলে। এই নামটি এসেছে বিবির গান আখ্যান থেকে। এই আখ্যান অনুসারে, তিনি এক কুমারী মুসলমান রাজকন্যার সন্তান। তিনি অলৌকিক উপায়ে অদৃশ্য হয়ে যান এবং পরে দেবী রূপে আবির্ভূত হন। তাঁর আবির্ভাবের কারণ ছিল তাঁর দাদামশাইয়ের (‘বাদশা’) ও রাজ্যের মন্ত্রীদের সন্তানদের আরোগ্য দান।[3]

পূজা পদ্ধতি

পুরোহিত বা মুসলমান ফকির এই দেবীর পূজা করেন |হিন্দুমতে পূজায় লৌকিক চন্ডীমন্ত্র বা আচার অনুষ্ঠান পালন করা হয়না | পূজায় বিশেষ কোনো মন্ত্র নেই | নারীরা এবং হাড়ি ডোম শ্রেণীর মানুষও এই পুজোর পৌরোহিত্য করতে পারেন | বিশেষত শনি ও মঙ্গলবারে দেবীকে নিরামিষ ভোগ দেওয়া হয় | নদীয়া জেলার ডোম জাতিরা দেবীর পুজায় পশুবলি দিয়ে থাকে ।ওলাইচণ্ডীর নৈবেদ্য স্থান অনুযায়ী নানারকম হয়ে থাকে তবে এতে সন্দেশ, পান সুপারি, বাতাসা, আতজাপচাল, পাটালি এগুলো দেওয়া হয় |

লোকায়ত বিধান

দেবীর বিশেষপল্লীগত পূজা লক্ষ্য করা যায় | বর্তমানে কলেরা প্রসঙ্গ না থেকে প্রথাগত ও পারম্পরিক ভাবে পল্লীতে শনিবার বা মঙ্গলবার একত্র হয়ে পূজার আয়োজন করা হয় |

  • মাঙ্গন করা - পল্লীর প্রধান গলায় বদির মালা অর্থাৎ খড়ের হার পরে দাঁতে তৃণধারণ করে বাড়ি বাড়ি গিয়ে পূজার জন্য অর্থ চাল ডাল ফলমূল ভিক্ষা করে |
  • ছলন / সলন - এই পূজায় দেবীর ক্ষুদ্রাকৃতি মূর্তি বানিয়ে পূজা স্থানে রেখে দেওয়া হয় |

মন্দির

  • কলকাতার বেলগাছিয়া অঞ্চলে টালিগঞ্জের বাবুরাম ঘোষ স্ট্রিট
  • হাওড়ার কাসুন্দিয়া অঞ্চলে
  • বীরভূম বোলপুর নীলকুঠির পাশে
  • মেদিনীপুরের গড়বেতার রাজকোটের দুর্গে
  • চব্বিশ পরগনার জয়নগরে বিবিমা নামে খ্যাত
  • কলকাতার সুরেন্দ্র ব্যানার্জী স্ট্রিটে শীতলা মন্দিরে
  • বাঞ্চারাম অক্রূর লেনের বাঁকারায় অর্থাৎ ধর্ম ঠাকুরের মন্দিরে |

সামাজিক প্রভাব

ওলাইচণ্ডী বাংলার লোকসংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। কোনো কোনো বিশেষজ্ঞের মতে, তিনি হিন্দু দিব্য জননী ধারণার সঙ্গে একেশ্বরবাদী ইসলামিক আল্লাহ্‌-ধারণার মিশ্রণ।[2] সম্ভবত ১৯শ শতাব্দীতে ভারতীয় উপমহাদেশে কলেরার দেবী রূপে ওলাইচণ্ডীর পূজা শুরু হয়।[4] ওলাইচণ্ডীর গুরুত্ব সাম্প্রদায়িক ও বর্ণব্যবস্থার সীমারেখাকে ছাড়িয়ে গিয়েছে।[1] যদিও আধুনিক যুগে কলেরার চিকিৎসা ব্যবস্থা উন্নত হয়ে পড়ায় ওলাইচণ্ডীর পূজাও সীমিত হয়ে এসেছে।[1]

আরও দেখুন

তথ্যসূত্র

  1. Oladevi - Banglapedia
  2. Islam in Bangladesh
  3. Ralph W. Nicholas. Fruits of Worship: Practical Religion in Bengal. Page 205. Orient Longman, 2003. আইএসবিএন ৮১-৮০২৮-০০৬-৩
  4. The Cool Goddess
This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.