হাসান হাফিজুর রহমান
হাসান হাফিজুর রহমান (জুন ১৪, ১৯৩২ – এপ্রিল ১, ১৯৮৩) বাংলাদেশের একজন প্রথিতযশা কবি, সাংবাদিক ও সমালোচক ছিলেন। তার পূর্বপুরুষ জামালপুর জেলার অন্তর্গত কুলকান্দি গ্রামে বাস করতেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের দলিল সম্পাদনার জন্য বিখ্যাত।
হাসান হাফিজুর রহমান | |
---|---|
জন্ম | জামালপুর, বাংলাদেশ) | ১৪ আগস্ট ১৯৩২
মৃত্যু | ১৯৮৩ সালের ১ জুলাই, রাশিয়া, মস্কো |
পেশা | কবি, সাংবাদিক, সমালোচক |
জাতীয়তা | বাংলাদেশী |
নাগরিকত্ব | বাংলাদেশ |
উল্লেখযোগ্য পুরস্কার | বাংলা একাডেমি, একুশে পদক পুরস্কার |
জন্ম ও ব্যক্তিজীবন
হাসান হাফিজুর রহমান ১৯৩২ সালে ১৪ জুন জামালপুর জেলায় তার নানা বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন[1] পৈত্রিক বাড়ি ছিল জামালপুর জেলার ইসলামপুর থানার কুলকান্দি গ্রামে। তার বাবার নাম আবদুর রহমান এবং মার নাম হাফিজা খাতুন। ১৯৫৮ সালের ১৭ এপ্রিল হাসান হাফিজুর রহমান সাঈদা হাসানের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। হাসান হাফিজুর রহমান ও সাঈদা হাসানের প্রথম সন্তানের নাম হাসান সাঈদ দিশা। দ্বিতীয় সন্তানের নাম এশা হাসান মুন্নী ।
শিক্ষাজীবন
১৯৩৮ সালে ঢাকার নবকুমার স্কুলে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে সরাসরি তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৯৩৯ সালে তার বাবা বরিশালে বদলি হয়ে গেলে তিন বছর জামালপুরের সিংজানী হাইস্কুলে পড়াশুনা করেন তিনি। ১৯৪২ সালে তার বাবা ঢাকায় বদলি হয়ে এলে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন এবং মাধ্যমিক পরীক্ষা পর্যন্ত এই স্কুলেই পড়াশোনা করেন। ১৯৪৬ সালে হাসান হাফিজুর রহমান ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে দ্বিতীয় বিভাগে মাধ্যমিক পাস করেন। এবং এ বছরই ঢাকা কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণিতে মানবিক শাখায় ভর্তি হন। ১৯৪৮ সালে হাসান হাফিজুর রহমান ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। এবং এ বছরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে বি.এ. অনার্স শ্রেণিতে ভর্তি হন। কিন্তু অনার্স ফাইনাল পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ না করে ১৯৫১ সালে তিনি পাস কোর্স-এ বি.এ. পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হন। ১৯১৪ সালে মাধ্যমিক পাস করার পর মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। কিন্তু ডাক্তারি পড়া অসমাপ্ত রেখেই তিনি শিক্ষা বিভাগে চাকুরি নেন। পরবর্তীতে ১৯৫১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস কোর্স-এ বি.এ. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এবং এ বছরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে প্রথম পর্ব এম.এ. শ্রেণিতে ভর্তি হন।[2] চাকরি জীবনের পুরো সময় তিনি ঢাকা শহরেই অতিবাহিত করেন। তবে ১৯৩৯-১৯৪২ সাল পর্যন্ত তিনি বরিশালে কর্মরত ছিলেন। চাকুরি ছাড়াও তার আয়ের উৎস ছিল গ্রামের ভূ-সম্পত্তি। হাসান হাফিজুর রহমান ছিলেন পিতার দ্বিতীয় স্ত্রীর প্রথম সন্তান। প্রথম স্ত্রী নিঃসন্তান অবস্থায় মারা যাওয়ার পর আবদুর রহমান দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন এবং তার প্রথম সন্তান হাসান হাফিজুর রহমান জন্মগ্রহণ করেন। তারা ছিলেন সাত ভাই ও তিন বোন। ভাই-বোনদের মধ্যে তিনজনের মৃত্যু হয় অপরিণত বয়সে। স্কুলে ভর্তি হবার পূর্বে মাকে তিনি মুখে মুখে একটি ছড়া শুনাতেন-'খেয়ে মোদের অন্নজল/হবে মোদের হাতির বল'।
কর্মজীবন
হাসান হাফিজুর রহমানের পেশাজীবন খুব বৈচিত্রময় ছিল। সাপ্তাহিক বেগম পত্রিকায় ১৯৫২ সালে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন। এরপর তিনি একাধারে সওগাত (১৯৫৩), ইত্তেহাদ (১৯৫৫-৫৪) ও দৈনিক পাকিস্তান (১৯৬৫) এ সহকারী সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং স্বাধীনতার পর দৈনিক বাংলায় সম্পাদক মণ্ডলীর সভাপতি নিযুক্ত হন। সাংবাদিকতার পাশাপাশি তিনি ১৯৫৭-১৯৬৪ সাল পর্যন্ত জগন্নাথ কলেজে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক ছিলেন। এছাড়াও তিনি ১৯৭৩ সালে মস্কোস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসে প্রেস কাউন্সিলর পদে দায়িত্ব পালন করেন।
সাহিত্য
১৯৪৬ সালে তিনি যখন স্কুলছাত্র তখন তার ছোট গল্প “অশ্রুভেজা পথ চলাতে” প্রকাশিত হয় সওগাত পত্রিকায়। এর দুবছর পর সোনার বাংলায় তার প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে তিনি সক্রিয় অবদান রাখেন। একুশের চেতনার উপর ভিত্তি করে তার কবিতা অমর একুশে প্রকাশিত হয় ১৯৫২ সালেই। এটিসহ আরও কিছু লেখা একত্র করে ১৯৫৩ সালে তিনি তার প্রথম বই একুশে ফেব্রুয়ারী প্রকাশ করেন।
রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড
হাসান হাফিজুর রহমান বিভিন্ন সামাজিক-রাজনৈতিক কাজে জড়িত ছিলেন। ১৯৫৪ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সাহিত্য সম্পাদক নির্বাচিত হন। সেবছর তিনি নাট্য চক্রের সভাপতি হন এবং দুটি গুরুত্বপূর্ন প্রবন্ধ রচনা করেন। সেগুলো হলো, কবিতার বিষয়বস্তু ও আধুনিক কবিতার লক্ষণ। ষাটের দশকে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক বাংলার অক্ষর বদলিয়ে আরবি অক্ষরে রূপান্তরের ষড়যন্ত্র ও রেডিও টিভিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্যকর্ম প্রচারের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেবার দাবিতে জোরালো আন্দোলনে অংশ নেন। হাসান হাফিজুর রহমান সাম্যবাদী ভাবধারায় বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি বাঙালি কৃষ্টি ও সংস্কৃতিতে অবিচল আস্থাশীল ছিলেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে তিনি সরাসরি অংশ নেন।
সাহিত্যকর্ম
হাসান হাফিজুর রহমান বেশি পরিচিত তার বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ১৬ খণ্ডের দলিলপত্রের (১৯৮২-৮৩) সম্পাদনার জন্য। অন্যান্য উল্লেখযোগ্য রচনার মধ্যে
- বিমুখ প্রান্তর (১৯৬৩),
- আর্ত শব্দাবলী (১৯৬৮),
- আধুনিক কবি ও কবিতা (১৯৬৫),
- মূল্যবোধের জন্যে (১৯৭০),
- অন্তিম শরের মতো (১৯৬৮)
- যখন উদ্যত সঙ্গীন (১৯৭২)
- শোকার্ত তরবারী (১৯৮১)
- প্রতিবিম্ব (১৯৭৬),
- আরো দুটি মৃত্যু (১৯৭০) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
বাংলা ভাষায় হোমারের ওডিসি অনুবাদও করেছেন তিনি।
পুরস্কার ও পদক
- পাকিস্তান লেখক সংঘ পুরস্কার (১৯৬৭)
- আদমজী পুরস্কার (১৯৬৭)
- বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৭১)
- সুফি মোতাহার হোসেন স্মারক পুরস্কার (১৯৭৬)
- অলক্ত সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮১)
- সওগাত সাহিত্য পুরস্কার ও নাসিরুদ্দিন স্বর্ণপদক (১৯৮২)
- মরোনোত্তর একুশে পদক (১৯৮৪)
এদেশের সাহিত্য ক্ষেত্রে অসাধারণ অবদানের জন্য ২০০২ সালে দেশের “সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার”[3][4][5] হিসাবে পরিচিত “স্বাধীনতা পুরস্কার” প্রদান করা হয় তাকে।[6]
আরও দেখুন
তথ্যসূত্র
- দৈনিক সকালের খবর
- গুণীজন
- সানজিদা খান (জানুয়ারি ২০০৩)। "জাতীয় পুরস্কার: স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার"। সিরাজুল ইসলাম। [[বাংলাপিডিয়া]]। ঢাকা: এশিয়াটিক সোসাইটি বাংলাদেশ। আইএসবিএন 984-32-0576-6। সংগ্রহের তারিখ ০৯ অক্টোবর ২০১৭।
স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার।
এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন:|সংগ্রহের-তারিখ=
(সাহায্য); ইউআরএল–উইকিসংযোগ দ্বন্দ্ব (সাহায্য) - "স্বাধীনতা পদকের অর্থমূল্য বাড়ছে"। কালেরকন্ঠ অনলাইন। ২ মার্চ ২০১৬। সংগ্রহের তারিখ ২৫ অক্টোবর ২০১৭।
- "এবার স্বাধীনতা পদক পেলেন ১৬ ব্যক্তি ও সংস্থা"। এনটিভি অনলাইন। ২৪ মার্চ ২০১৬। ১ ডিসেম্বর ২০১৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৫ অক্টোবর ২০১৭।
- "স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠানের তালিকা"। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার। ১ ডিসেম্বর ২০১৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ০৯ অক্টোবর ২০১৭। এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন:
|সংগ্রহের-তারিখ=
(সাহায্য)