জহুরুল হক
সার্জেন্ট জহুরুল হক (জন্ম: ৯ ফেব্রুয়ারি, ১৯৩৫ - মৃত্যু: ১৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৯) নোয়াখালী জেলার সোনাপুর গ্রামে জন্মগ্রহণকারী এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামী ও শহীদ ব্যক্তিত্ব। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি ২০১৮ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার (মরণোত্তর) পান।
জহুরুল হক | |
---|---|
![]() | |
জন্ম | |
মৃত্যু | ফেব্রুয়ারি ১৫, ১৯৬৯ ৩৪) | (বয়স
জাতীয়তা | বাংলাদেশী |
নাগরিকত্ব | ![]() |
পরিচিতির কারণ | আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামী ও শহীদ ব্যক্তিত্ব |
পুরস্কার | স্বাধীনতা পুরস্কার (২০১৮) |
শৈশবকাল ও কর্মজীবন
জহুরুল হক ১৯৩৫ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি নোয়াখালী জেলার সোনাপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৫৩ সালে নোয়াখালী জিলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। ১৯৫৬ সালে জগন্নাথ কলেজের (বর্তমান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) ব্যবসায় শিক্ষা শাখা থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন এবং ঐ বছরই পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে যোগদান করেন। কালক্রমে তিনি 'সার্জেন্ট' পদে উন্নীত হন। ১৯৬৭ সালের ডিসেম্বর মাসে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কর্মরত অবস্থায় গ্রেফতার হন সার্জেন্ট জহুরুল হক।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত হওয়ার পর জহুরুল হককে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আটকে রাখা হয়। ১৯৬৮ সালের ৬ জানুয়ারি ২ জন সি. এস. পি অফিসারসহ ২৮জনকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের গ্রেফতার সম্পর্কে সরকারী প্রেসনোটে উল্লেখ করা হয় যে,
“ | গত মাসে (অর্থাৎ ডিসেম্বর, ১৯৬৭) পূর্ব-পাকিস্তানে উদ্ঘাটিত জাতীয় স্বার্থবিরোধী এক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকার অভিযোগে এঁদের গ্রেফতার করা হয়েছে। | ” |
তৎকালীন পাকিস্তান সরকার এই ষড়যন্ত্রকে "আগরতলা ষড়যন্ত্র" নামে অভিহিত করে। এই একই অভিযোগে ১৯৬৮ সালের ১৭ জানুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমানকেও গ্রেফতার করা হয়। ৩৫ জনকে আসামী করে সরকার পক্ষ মামলা দায়ের করে।
রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্যদের বিচার
তৎকালীন পাকিস্তান সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাটির সরকারি নাম রেখেছিল 'রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্যদের বিচার'। এই মামলায় ৩৫ জনকে আসামী করা হয়। তন্মধ্যে - ১ নম্বর আসামী হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানকে রাখা হয়। জহুরুল হককে ১৭ নম্বর আসামী হিসেবে উল্লেখ করা হয়।[1]
বিচার প্রক্রিয়া
প্রথমে আসামীদেরকে 'দেশরক্ষা আইন' থেকে মুক্তি দেয়া হয়। পরবর্তীতে 'আর্মি, নেভি অ্যান্ড এয়ারফোর্স অ্যাক্টে' সার্জেন্ট জহুরুল হক-সহ অন্যান্য আসামীকে পুণরায় গ্রেফতার করে সেন্ট্রাল জেল থেকে কুর্মিটোলা সেনানিবাসে স্থানান্তর করা হয়। ১৯ জুন, ১৯৬৮ সালে মামলাটির শুনানি কার্যক্রম শুরু হয়।[1]
অভিযোগনামা
রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্যদের বিচার শিরোনামের মামলার অভিযোগনামায় উল্লেখ করা হয়েছিল যে,
“ | অভিযুক্তরা ভারতীয় অর্থ ও অস্ত্রের সাহায্যে সশস্ত্র সংঘর্ষ ঘটিয়ে কেন্দ্র থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করতে চেয়েছিল। | ” |
মামলার স্থান হিসেবে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের অভ্যন্তরে অবস্থিত 'সিগন্যাল অফিসার মেসে' নির্ধারণ করা হয়। মামলার শেষ তারিখ ছিল ৬ই ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৯ সালে।[1]
ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান
প্রবল গণ-আন্দোলন তথা উত্তাল ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের মুখে আইয়ুব খানের সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করতে একান্ত বাধ্য হয়। ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে দেশের মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার ও শেখ মুজিবুর রহমান-সহ অন্যান্যদের মুক্তির দাবী করেছিল। সরকার প্রধান হিসেবে আইয়ুব খান সমগ্র পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে গোলটেবিল বৈঠক আয়োজন করতে বাধ্য হয়েছিলেন। ঠিক এ সময়টিতেই সার্জেন্ট জহুরুল হকের জীবনে মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে কুর্মিটোলা ক্যান্টনমেন্টে।[1]
শাহাদাৎবরণ
সার্জেন্ট জহুরুল হক বন্দীনিবাসে থাকাকালীন সময়ে তাকে প্রহরার দায়িত্বে নিয়োজিত পাকিস্তানী সৈনিকের হাতে থাকা রাইফেলের গুলিতে বিদ্ধ হন। ১৯৬৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় ক্যান্টমেন্টে সৈনিকদের খাবারের উচ্ছিষ্ট সংগ্রহের জন্য বাঙালি শিশুরা ভিড় করে। এতে অবাঙালি সৈনিকেরা কয়েকজন অভুক্ত শিশুকে ধরে এনে বন্দী শিবিরের সামনে অমানবিকভাবে প্রহার শুরু করে। কয়েকজন বন্দী এ ঘটনায় প্রতিবাদ জানালে হাবিলদার 'মনজুর শাহ' বন্দীদের নিজ নিজ কামরায় ফিরে যেতে আদেশ করেন। জহুরুল হক সে আদেশ উপেক্ষা করে মনজুর শাহের সঙ্গে তর্ক-বিতর্কে লিপ্ত হয়ে পড়েন। এতে মনজুর শাহ প্রচণ্ডভাবে রাগান্বিত হয়ে রাইফেলের বেয়োনেট লাগিয়ে তার দিকে ধেয়ে আসেন। কিন্তু জহুরুল হক পাশ কাটিয়ে আক্রমণকারীর হাত থেকে রাইফেল ছিনিয়ে নেন এবং বিজয়ী বীরের মতো কামরার দরজায় গিয়ে তাকে রাইফেল ফেরত দেন। পরদিন ১৫ ফেব্রুয়ারি ভোরবেলা জহুরুল হক ঘর থেকে বের হলে মনজুর শাহ তাকে লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়ে। ঐ গুলিটি তার পেটে বিদ্ধ হয়। সঙ্গে সঙ্গে তাকে কম্বাইন্ড মিলিটারী হাসপাতাল বা সিএমএইচে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ঐদিন রাত ৯টা ৫৫ মিনিটে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।[1]
স্বীকৃতি
বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের আবাসিক হলরূপে তৎকালীন ইকবাল হলের নাম পরিবর্তন করে। দেশের মুক্তির লক্ষ্যে তার অসামান্য অবদানের কথা বিবেচনায় এনে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ হলটির নূতন নামকরণ করেন 'সার্জেন্ট জহুরুল হক হল'।
এছাড়া তার স্মৃতি রক্ষার্থে চট্টগ্রামে অবস্থিত বাংলাদেশ বিমান বাহিনী ঘাঁটির নামকরণ করা হয় বাংলাদেশ বিমান বাহিনী ঘাঁটি জহুরুল হক।
মূল্যায়ণ ও পর্যালোচনা
সার্জেন্ট জহুরুল হক স্বাধীনচেতা দেশপ্রেমিক সৈনিক ছিলেন। তার সহকর্মীদের ভাষায় -
“ | তাঁকে কখনো কাঁদতে দেখা যায়নি। কোনো কারণে কারো কাছে মাথা নত করেননি। | ” |
এজন্যে সহকর্মী বন্ধুরা তাকে 'মার্শাল' বলে ডাকতেন। তার হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে আইয়ুব বিরোধী গণ-আন্দোলন আরো গতি লাভ করে। ব্যাপক গণ-বিক্ষোভের মুখে ২৫ মার্চ, ১৯৬৯ তারিখে আইয়ুব খান সরকারের পতন ঘটে।
তার শহীদ স্মৃতি পূর্ব বাংলায় বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে শাণিত করে তোলার ক্ষেত্রে বলিষ্ঠ ও অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। এ গণ-আন্দোলনের পথ ধরেই পরবর্তীকালে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা লাভ করে ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালে। জহুরুল হক 'বাঙালি জাতির সূর্য সন্তান' হিসেবে আখ্যায়িত হয়ে থাকবেন চিরকাল।[1] সাঁতার কাটা, খেলাধূলা, ছবি তোলা, ছবি আঁকা, কাঠের কাজ ইত্যাদি কর্মকাণ্ডে দক্ষতা ছিল তার। সার্জেন্ট জহুরুল হকের অঙ্কিত চিত্রকর্ম ঢাকা জাদুঘরে সযত্নে সংরক্ষিত আছে।
তথ্যসূত্র
- বাংলা একাডেমী চরিতাভিধান, সম্পাদক: সেলিনা হোসেন ও নূরুল ইসলাম, ২য় সংস্করণ, ২০০৩, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, পৃ. ১৭২