মধুপুর সত্র

মধুপুর সত্র অসমীয়া জাতির বিশেষত বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বী মানুষদের অন্যতম তীর্থভূমি। বর্তমান পশ্চিমবঙ্গর কোচবিহার জেলার মধুপুর-এ অবস্থিত এই স্থানে মহাপুরুষ শঙ্করদেবমাধবদেব দেহ ত্যাগ করেছিলেন।[1][2]। এছাড়া এখানে অন্য অনেক ভক্তের সমাধি আছে। জীবনের অন্তিম সময়ে শঙ্করদেব এখানে থেকে ধর্মচর্চা করার সাথে বহু সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক কৃত্তিও রচনা করেছিলেন। এই মধুপুর সত্রকে দশমুকুতর থানও বলা হয়। দশমুকুত (মুকুত = মুক্ত) মানে হল শঙ্করদেবের দশজন শিষ্যের এখানে থাকা ভিটে।

মধুপুর সত্র
ধর্ম
অন্তর্ভুক্তিহিন্দুধর্ম
জেলাকোচবিহার (পশ্চিমবঙ্গ)
অবস্থান
দেশ India
স্থাপত্য
সৃষ্টিকারীনরনারায়ণ

নামকরণের ইতিহাস

মধুপুরের আগের নাম ছিল চন্দনচৌরা | মহাপুরুষ শ্রীমন্ত শঙ্করদেব প্রায় ৯৭ বছর বয়সে প্রধান শিষ্য মাধবদেব, নারায়ণ ঠাকুর, রামরামগুরু, রামরায় সহ প্রায় শতাধিক ভক্ত নিয়ে দ্বিতীয়বার পুরীর উদ্দেশ্যে তীর্থযাত্রা করেন । আনুমানিক ১৫৫০ খ্রিষ্টাব্দে গুরু শঙ্করদেব পুরীতীর্থের জগন্নাথ ক্ষেত্র থেকে ফেরার পথে বর্তমান কোচবিহার শহরের পশ্চিম দিকে প্রায় ৭ কিঃ মিঃ অভ্যন্তরে একটি বড় গাছের তলায় ভক্তদের ভাগবত থেকে বৃন্দাবন-এর শ্রীকৃষ্ণর লীলার কথা ব্যাখ্যা করছিলেন। এই সময়ে একজন গুরু গাছে ঝুলতে থাকা মৌচাক থেকে সঞ্চিত মধু আহরণ করে তাদের খাইয়ে তপ্ত করেন। এই ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখতে মহাপুরুষ শঙ্করদেব এই স্থানের নাম "মধুপুর থান" রাখেন। শঙ্করদেব ১৪৯০ শকের (১৫৬৮ খ্রীষ্টাব্দ) ভাদ্র মাসের ২১ তারিখে শুক্লা দ্বিতীয়া তিথি, বৃহস্পতিবারে দিনের দেড় প্রহরের সময় মধুপুরে নশ্বরদেহ ত্যাগ করে বৈকুণ্ঠগামী হন। পরে তার ভক্ত কোচবিহারের মহারাজ নরনারায়ণ শঙ্করদেবকে ঈশ্বর জ্ঞান করে সত্রের নামে দুশ বিঘা জমি ব্রহ্মোত্তর হিসাবে প্রদান করেন।

নির্মাণ

১৬ শতকের কোচরাজ্যের রাজা নরনারায়ণের রাজত্বকালে এই সত্র নির্মাণ করা হয়েছিল। বর্তমানে, ভারতের স্বাধীনতার পর তদানীন্তন অসমের মুখ্যমন্ত্রী স্বর্গীয় মহেন্দ্র মোহন চৌধুরীর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ১৯৬৮ সালের জানুয়ারী মাসে শঙ্করদেবের সমাধি মন্দিরের নির্মাণকার্য্য সম্পন্ন হয়।

সত্রাধিকারগণ

শঙ্করদেবের প্রধান শিষ্য ছিলেন মাধবদেব। শ্রীমন্ত শঙ্করদেবের মৃত্যুর পর মাধবদেব গুরুভার পেয়ে ১৫৬৮ সালে ধর্মাচার্য্য হিসাবে পাটবাউসী,গণককুছি,বরপেটা ও সুন্দরীদিয়া সত্র থেকে ধর্ম প্রচার করেন। মহারাজ নরনারায়ণের মৃত্যুর পর পুত্র লক্ষ্মীনারায়ণ রাজ্যের রাজা হন; তার রাজত্বকালে ১৫৯৬ খ্রীষ্টাব্দে ভাদ্র মাসের কৃষ্ণা পঞ্চমী তিথিতে ভেলা সত্রে মহাপুরুষ মাধবদেব বৈকুণ্ঠগামী হন। এরপর ক্রমে অচ্যুৎ গুরু, শ্রীরাম আতা, বিষ্ণু আতা আদি সত্রের অধিকার হন। বিষ্ণু আতার মৃত্যুর পর কিছুদিন সত্র চালানোর ভার ‘সমূহ’র ওপরে পড়ে। সমূহ হল এই অঞ্চলের সত্রশাল,মাধবপুর, বৈকুণ্ঠপুর ইত্যাদি গ্রামসমূহের ভক্তবৃন্দ। পরে বুঢ়ীর-পো গোবিন্দ আতৈ ভেলা সত্রের অধিকার হন। এই সময় ভেলা সত্র তোর্সা নদীর করাল গ্রাসে পড়ে। তখন কোচবিহারের রাজা ছিলেন বীর নারায়ণ। ভেলা সত্রের দুর্গতির কথা রাজাকে জানানো হলে রাজা পিতা লক্ষ্মীনারায়ণের কথা স্মরণ করে সেই মাটি সহ সত্রের সমস্ত বস্ত্ত নৌকায় নিয়ে এসে গুরুগৃহ, কীর্ত্তনঘর, হাটী নির্মাণ করে মধুপুরে পুনঃ সত্র স্থাপন করেন এবং তখন থেকে দুটি সত্রের একত্রে নাম হয় ভেলা মধুপুর সত্র। বুঢ়ীর-পো গোবিন্দ আতৈ শ্রীশ্রীভেলা মধুপুর সত্রের প্রথম অধিকার হয়ে ছয়-কুড়ি ভক্ত সমন্বয়ে সত্রে অক্ষয় প্রদীপ প্রজ্জ্বলিত করে নাম-কীর্ত্তন করতে থাকেন।

গোবিন্দ আতৈর পরে ক্রমে নিরঞ্জণ আতৈ, গোপীনাথ আতৈ আদি সত্রের দায়িত্ব নেন। পরবর্ত্তীকালে যেসকল সত্রীয়া আতৈ বুঢ়া ভক্ত মধুপুর সত্র পরিচালনা করেন তারা হলেন যথাক্রমে – কৃষ্ণ বাপু সত্রীয়া, রামনাথ বাপু সত্রীয়া, গোপীনাথ বাপু সত্রীয়া, গঙ্গারাম ভরালী, পচারাম ভরালী আতৈ, কিনারাম আতৈ, নিরন আতৈ, তোলন আতৈ, লক্ষ্মীকান্ত আতৈ বুঢ়াভক্ত, ফটিক চন্দ্র দেব গোস্বামী। ইং ১৮ এপ্রিল ২০১২ সালে পূর্বের সত্রাধিকার ফটিক চন্দ্র দেব গোস্বামীর মৃত্যুর পর আগের ডেকা সত্রাধিকার লক্ষ্মীকান্ত মহন্তকে সত্রাধিকার হিসেবে অভিষেক করা হয়।

দর্শনীয় বস্তুসমূহ

মধুপুর সত্রে প্রধান গুরুর সমাধি মন্দির, কীর্ত্তনঘর ও মণিকূট আছে। গুরু মন্দিরের কাছাকাছি পাঁচটা আতাগৃহ বা ভক্তের ঘর আছে। সত্রাধিকার ছাড়াও সত্রে উদাসীন ও কেবলীয়া ভক্ত অনেকজন আছে। সত্রে যাত্রীরা এলে তাদের থাকার জন্য সর্বপ্রকার সুবিধাযুক্ত প্রায় তিনিশজন মানুষের উপযোগী একটা যাত্রীগৃহ আছে। সত্রের সঙ্গে অসম সরকার-এর একটি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র আছে। মূল সমাধি মন্দিরে গুরুর ব্যবহৃত কিছু সেবার বস্ত্ত সংরক্ষিত আছে। সেইগুলি হল – গুরুর বসার খাট, তার খড়ম, রাজার দেওয়া লাঠি, গুরুর হাতের জপমালা, গুরুর নিজের হাতে লেখা সাঁচিপাতার গুণমালা পুঁথি, তার বৃন্দাবনী বস্ত্র-এর অংশবিশেষ, গুরুর গুয়া-পান গ্রহণ করা টেমি-কাটারি সহ পান রাখার পাত্র, গুণমালা পুঁথি লেখার দোয়াত-কলম ইত্যাদি। এছাড়াও মাধবদেবের স্বহস্তে লেখা পুঁজিটি, তার জলপান করার লোটা ও দুজন গুরুর শরীরের অংশ অস্থি ইত্যাদি সেবার বস্তু হিসাবে পরম্পরাগতভাবে রক্ষা করে আসা হচ্ছে।

বিভিন্ন উত্‍সব / অনুষ্ঠাসমূহ

সত্রে চৈধ্য প্রসঙ্গ সম্পূর্ণভাবে চলতে থাকে। সকালবেলা পুবাগীত প্রসঙ্গ হয়, দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত ভাগবত পাঠ, ভাটিবেলা প্রসঙ্গ ও আইদের নাম ও সন্ধ্যায় নাম-কীর্ত্তন করা হয়। এখানে বার্ষিক উৎসব হিসাবে আশ্বিন মাসে শঙ্করদেবের জন্মোৎসব, ও কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাসে রাসোৎসব পালন করা হয়। ফাল্গুনে ফাগুয়া বা দোলোৎসব, ভাদ্র মাসে গুরু দুজনের কীর্ত্তন মহোৎসব ও বৈশাখে বহাগ বিহু ইত্যাদি পালন করা হয়[1]। মাঘ মাসে প্রথম সত্রাধিকার গোবিন্দ আতার মৃত্যুতিথি মহাসমারোহে পালন করা হয়।

সহায়ক গ্রন্থপঞ্জী

  • শ্রীশ্রীশঙ্করদেব ও শ্রীশ্রীমাধবদেব – লেখক: লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়া
  • শ্রীমন্ত শঙ্করদেব ও তেওঁর যুগর বৈষ্ণবাতার্যসকল – ড° শিবনাথ বর্মন
  • মহাপুরুষ শ্রীমন্ত শঙ্করদেবর চমু পরিচয় ও বৈকুণ্ঠ প্রয়াণর স্থান শ্রীশ্রীমধুপুর (ধাম) সত্রর ইতিবিত্ত – পীতাম্বর রায় ভক্ত (কোচবিহার)।

তথ্যসূত্র

  1. "Madhupur Satra in India"। India9.com। ২০০৫-১০-০৪। সংগ্রহের তারিখ ২০১৩-০৩-১৬
  2. "Road & Electricity"। Cic.nic.in। ২০১৬-০৩-০৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৩-০৩-১৬
This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.