চুড়িহাট্টা মসজিদ
প্রাচীন চুড়িহাট্টা মসজিদ বা চুড়িহাট্টা মসজিদ বাংলাদেশের একটি পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন, যা ঢাকা মহানগরের পুরনো ঢাকার উমেশ চন্দ্র দত্ত লেন ও হায়দার বকশ লেনের তেমাথায় অবস্থিত। স্থানীয়ভাবে মসজিদটি চুড়িহাট্টা শাহী মসজিদ নামে পরিচিত ছিল। মসজিদটির প্রকৃত অবস্থান ছিল চকবাজারের সামান্য পশ্চিম দিকে ২৬-২৭ শেখ হায়দার বকশ লেন। ঐতিহাসিক তথ্যমতে মসজিদটি ৩৭০ বছর পুরনো (২০১8 খ্রিস্টাব্দ)। তবে প্রাচীন মসজিদ স্থাপত্যটি বর্তমানে বিলুপ্ত; সে জায়গায় গড়ে তোলা হয়েছে আধুনিক স্থাপত্য।[1]
চুড়িহাট্টা মসজিদ | |
---|---|
![]() চুড়িহাট্টা মসজিদ | |
অবস্থান | পুরনো ঢাকা |
প্রতিষ্ঠিত | ১৬৪৯ |
স্থাপত্য তথ্য | |
দৈর্ঘ্য | ৩০ ফুট |
প্রস্থ | ১৩ ফুট |
একটি সিরিজের অংশ
|
স্থাপত্য |
তালিকা
|
স্থাপত্য স্টাইল |
তালিকা
|
মসজিদের তালিকা |
অন্যান্য |
তালিকা
|
বিবরণ
চুড়িহাট্টা মসজিদটির দৈর্ঘ্য ৩০ ফুট এবং প্রস্থ ১৩ ফুট।[1] মসজিদটির কোন গম্বুজ ছিল না, এবং সমতল ছাদ ছিল। এই হিসাবে মসজিদটি সাধারণ বাঙালি স্থাপত্যের খড়ের ছাদওয়ালা দো চালা ঘরের মতন ছিল। ড. দানী'র মতে মসজিদটি আয়তাকৃতির এবং এর চার কোণে চারটা টাওয়ারসদৃশ মিনার ছিল। পূর্বদিকে ৩টি দরজাপথ রয়েছে, যার প্রতিটি দুটো পরিপূর্ণ আর্চ বা কীলকে গিয়ে খুলতো। সামনের দিকটা বিভিন্ন আয়তাকৃতি আর কার্ণিশ দ্বারা অলঙ্কৃত ছিল। সামনের দেয়াল প্যানেল দ্বারা অলঙ্কৃত ছিল। এছাড়া উত্তর ও দক্ষিণ দেয়ালে আলো-বাতাস চলাচলের সুবিধার জন্য ১টি করে দরজা ছিল।[2] অভ্যন্তরভাগ ঢাকা ছিল সংস্পর্শী দুটো ভোল্টেড ছাদ দ্বারা, সংযোগস্থলটা আর মধ্যখানটা ছিল বাঁকানো। তবে এ জাতীয় ভোল্টেড ছাদকে ড. দানী উত্তর ভারতীয় পিরামিডাকৃতির স্থাপত্যের সাথে তুলনাপূর্বক বাংলাদেশের স্থানীয় স্থাপত্য থেকে পৃথক বলেছেন।[3]

মসজিদটিতে একটি শিলালিপি পাওয়া যায়; আরবি ও ফার্সি ভাষায় লেখা ঐ শিলালিপিতে মুসলমানদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরআনের সূরা তওবার ১৭ ও ১৮ নম্বর আয়াতের সারমর্ম উপস্থাপিত হয়েছে। সেখানে লেখা বক্তব্যের বাংলা অনুবাদ হলো:
“ | আল্লাহ তা'আলা বলেন, একমাত্র তাঁরাই আল্লাহর মসজিদসমূহের রক্ষণাবেক্ষণ করবেন, যাঁরা আল্লাহ ও পরকালের উপর বিশ্বাস রাখে। নামাজ প্রতিষ্ঠা করেন, যাকাত দেয় এবং আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে ভয় করে না। | ” |
শিলালিপিতে মসজিদটির নির্মাতা হিসেবে মোহাম্মদী বেগ কিংবা মোহাম্মদ বেগ নামের এক ব্যক্তির কথা বলা হয়েছে।[2] তখন ছিল শাহ সুজার রাজত্বকাল। শিলালিপিটি বর্তমানে নবনির্মিত মসজিদের গাত্রে সংস্থাপিত আছে।
ইতিহাস
বিভিন্ন ঐতিহাসিক তথ্য-উৎস থেকে জানা যায়, মসজিদটি মুঘল আমলের স্থাপত্য নিদর্শন। সুবাদার শাহ সুজার সময়ে ১৬৪৯ খ্রিস্টাব্দে মসজিদটি নির্মিত হয়। জেমস ওয়াইযের ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দের বর্ণনানুযায়ী[3], মুঘল আমল থেকেই মুসলমান কারিগরেরা কাচের চুড়ি তৈরি করে পুরোন ঢাকার চকবাজারে বেচাকেনা করতেন, তাই এই পুরো এলাকাটি স্থানীয়ভাবে "চুড়িহাট্টা" নামে পরিচিত। জানা যায়, চুড়ির এইসব কারিগরেরা নামায পড়ার জন্যই গড়ে তোলেন মসজিদটি।[1]

মসজিদটির নির্মাণ বিষয়ে বিভিন্ন বক্তব্য পাওয়া যায়। "তাওয়ারিখে ঢাকা" গ্রন্থের প্রণেতা মুনশী রহমান আলী তায়েশ উল্লেখ করেন, আগে এই জায়গায় একটি মন্দির ছিল; সম্রাট শাহজাহানের আমলে কোনো এক হিন্দু কর্মকর্তা মন্দিরটি নির্মাণ করেন। পরে সুবাদার শাহ সুজা মন্দিরের দেবমূর্তি ফেলে দিয়ে মন্দিরটিকে মসজিদে রূপান্তর করেন। "ঢাকার ইতিহাস" গ্রন্থের প্রণেতা যতীন্দ্রমোহন রায়ের বিবরণ থেকে জানা যায়; ঢাকার নবাব তার কয়েকজন কর্মচারীকে একটি ধর্মমন্দির নির্মাণের জন্য অর্থ দান করেছিলেন। সেই অর্থ ব্যয় করে একটি বাসুদেব মন্দির নির্মাণ করা হয়। কিন্তু নবাব, তাঁর কর্মচারীদের এই আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে বাসুদেব মন্দিরকে মসজিদে পরিণত করেন। এই কথার সমর্থন পাওয়া যায়, যখন ইংরেজ আমলে ঢাকার তৎকালীন ম্যাজিস্ট্রেট জে টি র্যাং কিন্স মসজিদের মাটি খনন করে একটি বাসুদেব মূর্তি উদ্ধার করেছিলেন।[1] ইতিহাসবিদ ড. মুনতাসির মামুনের মতে সুবাদার শাহ সুজার নির্দেশে মোহাম্মদী বেগ নামের এক মুঘল কর্মকর্তা মসজিদটি নির্মাণ করেন।
বাংলাদেশের প্রত্নসম্পদ গ্রন্থে আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া উল্লেখ করেছেন, ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে মসজিদ প্রাঙ্গনে মাটির নিচে পাথরের একটি বাসুদেব মূর্তি পাওয়া গিয়েছিল।[2] ব্র্যাডলে বার্টের মতে, মাটি খুঁড়ে বাসুদেবের চিত্র অঙ্কিত পাথরখণ্ড পাওয়া গিয়েছিল।[3] "কিংবদন্তির ঢাকা" গ্রন্থে গ্রন্থকার নাজির হোসেন উল্লেখ করেছেন, শাহ সুজার সময়ে জনৈক হিন্দু কর্মকর্তাকে একটি মসজিদ নির্মাণ করতে বললে তিনি মন্দির নির্মাণ করেন। পরবর্তিতে শাহ সুজা তা জানতে পেরে মন্দির ভেঙে মসজিদ নির্মাণ করেন।[1] Glimpses of Old Dhaka গ্রন্থে এস. এম. তাইফুর লিখেছেন, মসজিদের শিলালিপিতে মন্দির ভেঙে মসজিদ নির্মাণের কথা উল্লেখ ছিল; যদিও বর্তমান শিলালিপিতে তেমন কিছুর উল্লেখ নেই।[4] মন্দিরটি পুরোপুরি ভেঙে সেটিকে মসজিদ বানানো হয়েছিল, নাকি মন্দির থেকে বিগ্রহ অপসারন পূর্বক স্থাপত্য নকশায় সামান্য পরিবর্তন করে সেটিকে মসজিদে রূপান্তর করা হয়েছিল, সে বিষয়ে ঐতিহাসিক তথ্যে মতপার্থক্য আছে। পুরাতত্ববিদ আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া'র মতে মন্দির ভেঙেই মসজিদ নির্মিত হয়েছিল।[2] তবে এভাবেই ঐতিহাসিকভেদে চুড়িহাট্টা মসজিদের ইতিহাসও ছিল বিভিন্ন। তাই মসজিদটির যথেষ্ট ঐতিহাসিক মর্যাদাও ছিল।
অবলুপ্তি

চুড়িহাট্টার ঐতিহাসিক মসজিদটি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত ছিল না। মসজিদটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব না জেনেই মসজিদ কমিটির লোকজন অপেক্ষাকৃত বৃহদাকৃতির বহুতল মসজিদ নির্মাণের লক্ষ্যে পুরোন মসজিদটি ভেঙে ফেলার উদ্যোগ নেন। জানা যায় ২০০৮ খ্রিস্টাব্দের প্রথম দিকেই মসজিদটি ভাঙার কাজ শুরু হয়, এবং জুলাই মাস নাগাদ পুরো মসজিদটি বিলুপ্ত হয়ে যায়। ভেঙে ফেলার পর সেখানে যে নতুন ভবন নির্মাণ করা হয়। শিলালিপিটি নবনির্মিত মসজিদের দোতলার মিহরাবে লাগানো হয়।[5] তবে বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এই ভেঙে ফেলা ভবনটিকে আদি ভবন বলে স্বীকার করে না। তাঁদের মতে মসজিদের আদি ভবনটি পাকিস্তান আমলে (১৯৪৭-১৯৭১) কোনো এক সময় ভেঙে ফেলা হয়েছিল।[5]
আধুনিক স্থাপত্য

পুরোনো, ধ্বংস করে দেয়া মসজিদটির জায়গায় নির্মিত হয়েছে নতুন মসজিদ ভবন। নতুন ভবনের দোতলার মিহরাবে আদি মসজিদের ফলকটি স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়া নিচতলার মিহরাব ও মেঝে গ্রানাইট পাথর দিয়ে ছেয়ে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া মসজিদে একটি উঁচু মিনারের কাজ হচ্ছে।[5]
তথ্যসূত্র
- আপেল মাহমুদ (৬ জুলাই ২০০৮)। "নগর ঐতিহ্য: ভেঙে ফেলা হয়েছে ৩৬৭ বছরের পুরোন চুড়িহাট্টা মসজিদ!"। দৈনিক প্রথম আলো। ঢাকা। পৃষ্ঠা ২৫। ৮ আগস্ট ২০১০ তারিখে মূল (ওয়েব) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৪ মে ২০১০।
- বাঙলাদেশের প্রত্নসম্পদ, আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া, পৃ.৫২৭ (ঢাকা জেলা: চুড়িহাট্টা মসজিদ); জানুয়ারি ২০১০ খ্রিস্টাব্দ; দিব্যপ্রকাশ, ঢাকা। পরিদর্শনের তারিখ: মার্চ ৩০, ২০১১ খ্রিস্টাব্দ।
- Muslim Monuments of Bangladesh - ch. Churihatta Masjid - pg. 268, by Dr. Syed Mahmudul Hasan; মে ১৪, ২০১০ সংস্করণ; (আইএসবিএন ৯৮৪-০৬-৯০২৩-০ ISBN বৈধ নয়), Islamic Foundation Bangladesh, Dhaka. (Language: English) - পরিদর্শনের তারিখ=মে ১৪, ২০১০।
- Glimpses of Old Dhaka, S. M. Taifoor, পৃষ্ঠা ১৬৪।
- "মসজিদের গায়ে ঢাকার ইতিহাস" (ওয়েব)। দৈনিক প্রথম আলো। ঢাকা। আগস্ট ২২, ২০১০। সংগ্রহের তারিখ জুন ২৬, ২০১২।