হুগলী নদী
হুগলি নদী বা ভাগীরথী-হুগলী পশ্চিমবঙ্গে নদীর একটি শাখানদী।[1] পশ্চিমবঙ্গের উপর দিয়ে প্রবাহিত এই নদীটির দৈর্ঘ্য প্রায় ২৬০ কিলোমিটার। মুর্শিদাবাদ জেলার ফারাক্কা বাঁধ থেকে একটি খালের আকারে নদীটি উৎসারিত হয়েছে। হুগলি জেলার হুগলি-চুঁচুড়া শহরটি (পূর্বনাম হুগলি) এই নদীর তীরে অবস্থিত। হুগলি নামটির উৎস অজ্ঞাত, তাই জানা যায় না যে নদী না শহর কোনটির নামকরণ আগে হয়েছিল।[2]
হুগলি নদী | |
ভাগীরথী-হুগলি | |
River | |
![]() হাওড়া জেলার বালী থেকে হুগলি নদী হাওড়া জেলার বালী থেকে হুগলি নদী | |
দেশ | ![]() |
---|---|
Parts | পশ্চিমবঙ্গ |
অঞ্চলসমূহ | প্রেসিডেন্সি বিভাগ, বর্ধমান বিভাগ, বৃহত্তর কলকাতা |
জেলা | মুর্শিদাবাদ, নদিয়া, বর্ধমান, হুগলি, হাওড়া, কলকাতা, উত্তর ২৪ পরগনা, পূর্ব মেদিনীপুর, দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা |
নগরসমূহ | কলকাতা, হাওড়া, চুঁচুড়া,চন্দননগর |
উৎস | |
- অবস্থান | ফারাক্কা বাঁধ, মুর্শিদাবাদ জেলা, পশ্চিমবঙ্গ |
দৈর্ঘ্য | ২৬০ কিলোমিটার (১৬২ মাইল) |

নামকরণ

ভগীরথী নামটি পৌরাণিক। কিংবদন্তী অনুযায়ী, রাজা ভগীরথ মর্ত্যলোকে গঙ্গা নদীর পথপ্রদর্শক ছিলেন বলে গঙ্গার অপর নাম ভাগীরথী। হুগলি নামটি অপেক্ষাকৃত অর্বাচীন। ইংরেজ আমলেই সর্বপ্রথম ভাগীরথীর দক্ষিণভাগের প্রবাহকে হুগলি নামে অভিহিত হয়।
ভাগীরথী-হুগলি গঙ্গার মূল প্রবাহপথ নয়। গঙ্গা নদীর মূল প্রবাহটি পদ্মা নামে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবাহিত। লোকবিশ্বাসে ভাগীরথী-হুগলিও গঙ্গার মূল ধারা এবং সেই অর্থে পবিত্র ও পূজ্য। পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতা এই নদীর তীরেই অবস্থিত।
ইতিহাস ও সাহিত্যে ভাগীরথী
বাংলার প্রাচীন সংস্কৃত গ্রন্থে ও লেখমালায় সর্বত্রই ভাগীরথীকে গঙ্গা বলা হয়েছে। ধোয়ীর পবনদূত গ্রন্থে ত্রিবেণী-সঙ্গমের ভাগীরথীকেই বলা হয়েছে গঙ্গা। লক্ষণসেনের গোবিন্দপুর পট্টোলীতে বেতড়ে পূর্ববাহিনী নদীটি জাহ্নবী নামে অভিহিত। বল্লালসেনের নৈহাটি লিপিতে ভাগীরথীকে ‘সুরসরিৎ’ অর্থাৎ স্বর্গীয় নদী আখ্যা দেওয়া হয়েছে।
মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যেও ভাগীরথীর উদার প্রশস্তি করা হয়েছে। পদ্মাপুরাণ, কবিকঙ্কণ চণ্ডী এমনকি মুসলমান কবিদের রচনাতেও গঙ্গার স্তুতি দেখা যায়। ১৪৯৪ সালে রচিত বিপ্রদাস পিপলাই-এর মনসামঙ্গল কাব্যে অজয় নদ থেকে গঙ্গাসাগর পর্যন্ত ভাগীরথী-হুগলির প্রবাহপথের এক মনোজ্ঞ বর্ণনা পাওয়া যায়, যার সঙ্গে ১৬৬০ সালে দেওয়া ফান ডেন ব্রোকের তথ্যের বেশ মিল লক্ষিত হয়।
প্রবাহপথ

গঙ্গার ২৫৩৯ কিলোমিটার দীর্ঘ পথের ৫২৪ কিলোমিটার পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্গত। রাজমহল পাহাড়ের উত্তর-পশ্চিমে তেলিগড় ও সকরিগলির সংকীর্ণ গিরিপথটি ঘেঁষে মুর্শিদাবাদ জেলার জঙ্গীপুর মহকুমায় গঙ্গা পশ্চিমবঙ্গের সমভূমিতে প্রবেশ করেছে। এরপর ধুলিয়ান শহরের নিকটে এটি ভাগীরথী ও পদ্মা নামে দ্বিধাবিভক্ত হয়েছে। ভাগীরথীর প্রবাহ মুর্শিদাবাদ জেলাকে দুটি ভৌগোলিক অংশে বিভক্ত করেছে – বাগড়ি (পূর্বভাগে) ও রাঢ় (পশ্চিমভাগে)। এরপর নবদ্বীপ পর্যন্ত গঙ্গার নাম ভাগীরথী ও নবদ্বীপ থেকে গঙ্গাসাগর অবধি এই নদী হুগলি নামে প্রবাহিত। নবদ্বীপের আরও দক্ষিণে হুগলি জেলা এবং উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলা। এই নদী হালিশহর, চুঁচুড়া, শ্রীরামপুর, কামারহাটী শহরগুলির পাশদিয়ে প্রবাহিত হয়। তারপর কলকাতা (কলকাতা) এবং হাওড়া এর দ্বৈত শহর প্রবেশ করার আগে, এটি দক্ষিণ-পশ্চিমে নদীটি নূরপুরে গঙ্গার একটি পুরানো প্রবাহে প্রবেশ করে এবং নদীটি সাগরদ্বীপের দক্ষিণ পান্তে গঙ্গাসাগরের মোহনায় প্রায় ২০ মাইল (৩২ কিলোমিটার) চওড়া হয়ে বঙ্গোপসাগরে মিলিত হয়। [3]
এর দুটি প্রধান উপনদী হল দামোদর ও রূপনারায়ণ। কলকাতা শহর ও মহানগর হুগলির তীরেই অবস্থিত। হুগলি নদীর গড় গভীরতা ২০০ ফুট এবং সর্বচ্চো গভীরতা ৩৮১ ফুট।[4]
জলোচ্ছ্বাস
সমুদ্র থেকে জোয়ার হুগলি নদীতে দ্রুত চালিত হয় এবং একটি "বৃহত্ত জলোচ্ছ্বাস" বা বান হিসাবে পরিচিত জলের দেয়াল বা জলের তরঙ্গের একটি অসাধারণ উদাহরণ তৈরি করে। এটি জোয়ারে অগ্রভাগের-তরঙ্গের অন্তর্ভুক্ত, যেখানে নদীতে আকস্মিকভাবে গঠিত হয় হয় এবং প্রায় ৭ ফিট (২.১ মি) উচ্চতা অতিক্রম করে। এটি কলকাতা শহরের কাছে অনেক বেশি উচ্চতায় অনুভূত হয়, এবং প্রায়ই ছোট নৌকা ও জাহাজ ধ্বংস করে। শুষ্ক মৌসুমে বৃষ্টিপাতের কম জলের সর্বনিম্ন পয়েন্ট থেকে উচ্চমাত্রার বৃষ্টিপাতের সময়ের উচ্চতম জলের পার্থক্যটি জানা যায় যে ২০ ফিট ১০ সেন্ট (৬.৩৫ মিটার)। মার্চ, এপ্রিল বা মে মাসে জোয়ারের সবচেয়ে বড় উচ্চতা বৃদ্ধি ঘটে -প্রায় ১৬ ফুট (৪.৯ মিটার)। এছাড়া সাধারনত বর্ষার সময় ১০ ফুট (৩.০ মিটার) এবং অন্য সময়ে জোয়ারের ফলে ৩ ফুট (১.০৭ মিটার) উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস ঘটে হুগলি নদীতে।
অর্থনীতি
ভাগীরথী-হুগলি নদী ব্যবস্থা পশ্চিমবঙ্গের মানুষের জন্য একটি অপরিহার্য লাইফলাইন হিসাবে কাজ করে। এই নদীর জলপথ দিয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলায় যাত্রা করেছিল এবং তাদের বাণিজ্য ব্যবস্থা এবং কলকাতা শহরকে ব্রিটিশ ভারত রাজধানী হিসাবে প্রতিষ্ঠা করেছিল। ফ্রান্স, ডাচ, পর্তুগিজ প্রভৃতি অন্যান্য দেশের লোকেরা এই নদীর তীরে তাদের বাণিজ্য বসতি স্থাপন করেছিল।
নদীটি সেচ ও মানব ও শিল্প খাতের জন্য পশ্চিমবঙ্গের সমভূমিতে জলপ্রবাহ সরবরাহ করে থাকে। নদীটি ছোট নৌযান, জাহাজ এবং একটি বড় নৌ পরিবহন ব্যবস্থার সঙ্গে একটি প্রধান জলপথ। দীর্ঘদিন ধরে, কলকাতা বন্দর ছিল ভারতের বৃহত্তম বন্দর। যদিও অতীতে তার তাত্পর্য নিম্নমুখী ছিল, সম্প্রতি এটি ভারতীয় বন্দরের তালিকায় তৃতীয় অবস্থানে পৌঁছেছে। হলদিয়া বন্দর, হলদিয়া আধুনিক কন্টেইনার পোর্ট, নিম্ন হুগলি ও হালদি নদী পার্শ্বে, এখন বেশিরভাগ অঞ্চলের সামুদ্রিক বাণিজ্য সংগঠিত হয় থাকে। বর্তমানে কলকাতা বন্দরে জাহাজের চাপ কমাতে হুগলি নদীর মোহনায় সাগরদ্বীপের দক্ষিণ প্রান্তে গভীর সমুদ্রে একটি নতুন বন্দর নির্মাণ করা হবে।
দূষিত হওয়া সত্ত্বেও, নদী থেকে মাছ আহরণ স্থানীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।
হুগলি নদীর উপত্যকা ছিল বাংলার রাজ্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিল্প এলাকা। পাট শিল্পের অবনমন ঘটেছে, যা এই অঞ্চলের প্রধান শিল্প, কিন্তু এটি এখনো ভারতের বৃহত্তম শিল্প এলাকাগুলির একটি। এই নদীর দুই তীরে রয়েছে বৃহত্তর কলকাতার বিভিন্ন ছোটো ছোটো শহর, এই নদীর তীরে দ্বিতীয় বৃহত্তম ভারতীয় মহানগর এবং ভারতেরসাবেক রাজধানী কলকাতা অবস্থিত।

কলকাতা-হাওড়া শহর সংযোগ কারি হাওড়া সেতু, বিদ্যাসাগর সেতু, বিবেকানন্দ সেতু, নিবেদিতা সেতু (দ্বিতীয় বিবেকানন্দ সেতু), জুবিলী ব্রিজ (চুঁচুড়িয়া) এবং ঈশ্বরগুপ্ত সেতুসহ হুগলী নদীতে বেশ কয়েকটি সেতু রয়েছে।
২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ন্যাশনাল গঙ্গা রিভার বেসিন প্রোজেক্ট স্কিমের অধীনে বিশ্বব্যাংকের তহবিল সহায়তায় কলকাতায় হুগলি নদী সংস্কারের কাজ শুরু করেছে। [5]
সেতু
নিম্নোক্ত সেতুগুলো বর্তমানে হুগলী বা ভাগীরথী নদী অতিক্রম করে (দক্ষিণ থেকে উত্তর বা মুখ থেকে উৎস, ক্রমানুসারে লিখিত):
- বিদ্যাসাগর সেতু (দ্বিতীয় হুগলি ব্রিজ) - হাওড়া এবং কলকাতা সংযোগ করে
- রবীন্দ্র সেতু (হাওড়া ব্রিজ) - হাওড়া এবং কলকাতা সংযোগ করে
- নিবেদিতা সেতু (দ্বিতীয় বিবেকানন্দ সেতু) - বালি এবং কামারহাটি সংযোগ করে; বিবেকানন্দ সেতুর সঙ্গে সমান্তরাল
- বিবেকানন্দ সেতু (বালি ব্রিজ, সড়ক ও রেল সেতু) - বালি এবং কামারহাটি সংযোগ করে; নিবেদিতা সেতুর সঙ্গে সমান্তরাল
- সম্প্রীতি সেতু (নতুন জুবিলী ব্রিজ; রেল শুধুমাত্র) - ব্যান্ডেল এবং নৈহাটী সংযোগ করে; পুরোনো জুবিলী ব্রিজের প্রতিস্থাপন
- ঈশ্বর গুপ্ত সেতু (কল্যাণী ব্রিজ) - বাঁশবেড়িয়া এবং কল্যাণী সংযোগ করে
- গৌরাঙ্গ সেতু - নবদ্বীপ এবং কৃষ্ণনগর সংযোগ করে
- রমেন্দ্র সুন্দর ত্রিবেদী সেতু - খাগড়াঘাট এবং বহরমপুর সংযোগ করে
- জঙ্গিপুর ভাগীরথী সেতু - রঘুনাথগঞ্জ এবং জঙ্গিপুর সংযোগ করে
নিম্নোক্ত সেতুগুলো বিকাশের বিভিন্ন পর্যায়ে আছে:
সাহিত্য
রুডইয়ার্ড কিপলিং একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন, অন দ্যা ব্যঙ্ক ওফ হুগলি (বাংলা অনুবাদ:হুগলি তীরে) [7] (১৮৮৮), এবং একটি ছোট গল্প অ্যান আনকুয়ালিফাইড পাইলট (বাংলা অনুবাদ:একটি অযোগ্য পাইলট) [8] (১৮৯৫)।
সাংস্কৃতিক ঘটনা

সিল্ক নদী প্রকল্প হুগলি নদী এবং টেমস নদী বরাবর ১০ টি অবস্থানের প্রতিটি শৈল্পিক বিষয় বিনিময় মাধ্যমে কলকাতা ও লন্ডন মহানগরের মধ্যে শৈল্পিক সম্পর্ক অন্বেষণ করার লক্ষ্যে কাজ করেছে। হুগলি নদীর তীরে ১০ টি স্থান হল মুর্শিদাবাদ, কৃষ্ণনগর, চন্দননগরে, ব্যারাকপুর, জোড়াসাঁকো, বৌউবাজার, হাওড়া, খিদিরপুর, বোটানিক্যাল গার্ডেন এবং বাটননর রয়েছে। দশটি স্ক্রলগুলি, পটুয়া ঐতিহ্যের মধ্যে আঁকা, ১০ টি স্থানকে চিত্রিত করে হুগলি নদী বরাবর বহন করা হবে। ৭ ডিসেম্বর ২০১৭ তারিখে মুর্শিদাবাদে যাত্রা শুরু হবে এবং ১৭ ডিসেম্বর ২০১৭ তারিখে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, কলকাতায় যাত্রা শেষ হবে। [9][10]
তথ্যসূত্র
- এই নিবন্ধটি একটি প্রকাশন থেকে অন্তর্ভুক্ত পাঠ্য যা বর্তমানে পাবলিক ডোমেইনে: চিসাম, হিউ, সম্পাদক (১৯১১)। ব্রিটিশ বিশ্বকোষ (১১তম সংস্করণ)। কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস।
- "Hugli River - river, India"।
- "District"। Voiceofbengal.com।
- "Hugli River"। Encyclopædia Britannica। সংগ্রহের তারিখ ৮ জুলাই ২০১৬।
- বাংলার নদনদী, দিলীপকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, ২০০৭।
- "World Bank to fund Hooghly riverfront revamp - Times of India"।
- Desk, Kolkata। "The WB Govt is going to start the construction of three bridges" (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০১৮-০৩-১৫।
- "Chapter IV - City of Dreadful Night - From Sea to Sea - Rudyard Kipling, Book, etext"। Telelib.com। ১ ফেব্রুয়ারি ২০০৩। সংগ্রহের তারিখ ২৫ আগস্ট ২০১৩।
- "An Unqualified Pilot - Land & Sea Tales - For Scouts and Guides - Rudyard Kipling, Book, etext"। Telelib.com। ১ মার্চ ২০০৩। সংগ্রহের তারিখ ২৫ আগস্ট ২০১৩।
- Chatterjee, Chandreyee (১০ নভেম্বর ২০১৬)। "Exploring the River Connect" (Kolkata)। ABP। The Telegraph। সংগ্রহের তারিখ ২১ জুলাই ২০১৭।
- Basu, Anasuya (২১ জুলাই ২০১৭)। "River Walk to Boost Ties" (Kolkata)। ABP। The Telegraph। সংগ্রহের তারিখ ২১ জুলাই ২০১৭।
বহিঃসংযোগ
- Hugli River at NASA Earth Observatory