সাম্যবাদ

সাম্যবাদ বা কমিউনিজম communism (লাতিন ভাষা communis থেকে, যার অর্থ:"সাধারণ, চিরন্তন")[1][2] হল শ্রেণীহীন, শোষণহীন, ব্যক্তি মালিকানাহীন এমন একটি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ভাবাদর্শ যেখানে ব্যক্তিগত মালিকানার স্থলে উৎপাদনের সকল মাধ্যম এবং প্রাকৃতিক সম্পদ (ভূমি, খনি, কারখানা) রাষ্ট্রের মালিকানাধীন এবং নিয়ন্ত্রণাধীন থাকে। সাম্যবাদ হল সমাজতন্ত্রের একটি উন্নত এবং অগ্রসর রূপ, তবে এদের মধ্যেকার পার্থক্য নিয়ে বহুকাল ধরে বিতর্ক চলে আসছে।[3]

উভয়েরই মূল লক্ষ্য হল ব্যক্তিমালিকানা এবং শ্রমিক শ্রেণীর উপর শোষণের হাতিয়ার পুঁজিবাদী অর্থ ব্যবস্থার অবসান ঘটানো।[4] কার্ল মার্কস যে মতাদর্শ উপস্থাপন করেছিলেন সেই মতে সাম্যবাদ হল সমাজের সেই চূড়ান্ত শিখর, যেখানে পৌঁছাতে হলে বিপ্লবের মাধ্যমে সমাজে আর্থনৈতিক সাম্য স্থাপন করতে হবে এবং সেই ক্রান্তিকালে উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি পেলে, সমাজে সামগ্রী ও সেবার অতিপ্রাচুর্য সৃষ্টি হবে। কোনো দেশে সাম্যবাদ থাকলে সেখানে ধনী গরীবের ব্যবধান থাকবে না। নাগরিকদের মৌলিক অধিকারগুলো নিশ্চিত করার দ্বায়িত্ব সরকার নেবে।

সাম্যবাদ হল স্বাধীন, সামাজিকভাবে সচেতন শ্রমজীবী মানুষের উঁচু মাত্রায় সুসংগঠিত সমাজ, তাতে কায়েম হবে সকলের স্বশাসন। সেই সমাজে সমাজের কল্যাণের জন্য শ্রম হয়ে উঠবে প্রত্যেকের মুখ্য অপরিহার্য প্রয়োজন এবং এই প্রয়োজন উপলব্ধি করবে প্রত্যেকেই। প্রত্যেকের সামর্থ নিয়োজিত হবে সর্বসাধারণের সর্বাধিক কল্যাণের জন্য'।সাম্যবাদ ব্যক্তিকে ব্যাপক সামাজিক স্বাধীনতা দেয়। এতে রয়েছে কমিউন সংস্থাগুলিতে নির্বাচিত হওয়ার ও নির্বাচন করার এবং সমাজের প্রশাসনে অংশগ্রহণের অধিকার; শিক্ষা, বিশ্রাম, বিনোদন ও ছুটির অধিকার; বৈষয়িক ও সাংস্কৃতিক উৎপাদনের সকল ক্ষেত্রে সৃজনশীল কাজের সুযোগ সুবিধা। সাম্যবাদ ব্যক্তিকে সাংস্কৃতিক সকল ফলভোগের সুযোগসহ বিজ্ঞান ও শিল্পকলায় সক্রিয় অবদান যোজনে সাহায্য করে।[5]

সাম্যবাদ হচ্ছে সর্বহারা শ্রেণির একটা পূর্ণাঙ্গ মতাদর্শের ব্যবস্থা এবং একই সময়ে একটা নতুন সমাজ ব্যবস্থাও। অন্য যে কোনো মতাদর্শের ব্যবস্থা ও সমাজ ব্যবস্থা থেকে এটা ভিন্ন, মানব ইতিহাসে এটাই হচ্ছে সবচেয়ে বেশি সম্পূর্ণ, প্রগতিশীল, বিপ্লবী ও যুক্তিসংগত।[6]

ইতিহাস

ব্যুৎপত্তি

লাতিন শব্দ Communis থেকে Communism শব্দটির উত্পত্তি। Communis মানে এজমালি অর্থাৎ সাম্য বা সর্বজনীন। কমিউনিস্ট অর্থ সর্বজনীন। কমিউনিস্ট সমাজ হল সর্বজনীন ভূমি, সর্বজনীন কলকারখানা, সার্বজনীন শ্রম, সমান অধিকার, কর্তব্যের অধিকার এবং শ্রেণীহীন সমাজ। এই মিলে হল সাম্যবাদ। সাম্যবাদ হল উত্পাদনের উপায়ের উপরে সামাজিক মালিকানা ভিত্তিক এক সামাজিক গঠনরূপ, যা উত্পাদনি শক্তিগুলোর বিকাশের পূর্ণ সুযোগ দেয়; তা হল মানবজাতির সামাজিক অর্থনৈতিক প্রগতির সর্বোচ্চ পর্যায় এবং পুঁজিবাদকে তা প্রতিস্থাপিত করে।

সাম্যবাদের দুই স্তর

  1. সমাজতন্ত্র, নিম্মতম স্তর- এ পর্বে উত্পাদনের উপায়ে সমাজতান্ত্রিক মালিকানা হল এর অর্থনৈতিক ভিত্তি। সমাজতন্ত্র উত্খাত ঘটায় ব্যক্তিগত মালিকানার ও মানুষ মানুষের শোষণের, বিলোপ ঘটায় শ্রেণীর, বিলোপ ঘটায় অর্থনৈতিক সংকটের ও বেকারত্বের, উন্মুক্ত করে উত্পাদনী শক্তির পরিকল্পিত বিকাশ ও উত্পাদন সম্পর্কের পূর্ণতর রূপদানের প্রান্তর। সমাজতন্ত্রের আমলে সামাজিক উত্পাদনের লক্ষ্য - জনগনের সচ্ছলতা বৃদ্ধি ও সমাজের প্রতিটি লোকের সার্বিক বিকাশ। সমাজতন্ত্রের মূলনীতি হল- প্রত্যেকের কাছ থেকে সামর্থ অনুযায়ী, প্রত্যেকে শ্রম অনুযায়ী।
  2. সম্পূর্ণ সাম্যবাদ, উচ্চতর স্তর। এ-পর্বে শ্রম অনুসারে বণ্টন ছেড়ে সমাজ এগিয়ে যাবে চাহিদা অনুযায়ী বণ্টনের দিকে। বাস্তবায়িত হবে কমুনিজমের মূলনীতি: প্রত্যেকের কাছ থেকে সামর্থ অনুযায়ী, প্রত্যেকে চাহিদা অনুযায়ী। শ্রেণী লোপ পেয়ে লোকেদের সম্পূর্ণ সামাজিক সমতায় সমাজ হয়ে উঠবে শ্রেণিহীন।

সাম্যবাদ ও সমাজতন্ত্রের মধ্যে তফাৎ

  1. সমাজতন্ত্রে শ্রেণী বিলোপের সূত্রপাত ও বৈরী শ্রেণীদের বিলোপ আর সাম্যবাদে সমস্ত শ্রেণীর উচ্ছেদ ও লোকসমাজতন্ত্রে কিছুটা কালযাবত্‍ বুর্জোয়া চেতনাগত অধিকারই শুধু নয়, রাষ্ট্রও টিকে থাকে। আবশ্যিকতার রাজ্য, আর সাম্যবাদে বুর্জোয়া চেতনাগত অধিকার ও রাষ্ট্র কিছুই থাকবে না। মুক্তির রাসমাজতন্ত্রে প্রলেতারিয়েতের একনায়কত্ব থাকে আর সাম্যবাদে কোনো শ্রেণীরই অস্তিত্ব থাকে না। শ্রেণীহীন সমাজ।
  2. সমাজতন্ত্রে বেতন ও মজুরির অনুপাত সমান থাকে এবং পরে কাগজি ভাউচার থাকে। আর সাম্যবাদে বেতন বা মজুরির অস্তিত্বই থাকে না।
  3. সমাজতন্ত্রে স্থায়ী সেনাবাহিনীর বদলে গণমিলিশিয়া থাকে আর সাম্যবাদে কোন বাহিনীরই অস্তিত্ব থাকবে না।
  4. সমাজতন্ত্রে কায়িক ও মানসিক, শিল্প ও কৃষি, দক্ষ ও অদক্ষ শ্রমের ভাগ থাকে আর সাম্যবাদে ভাগ থাকে না।
  5. সমাজতন্ত্রে মালিকানার দুই রূপঃ সর্বজনীন ও সমবায় মূলক আর সাম্যবাদে একরূপঃ সমাজের।
  6. সমাজতন্ত্রে শ্রম জীবনধারণের উপায় আর সাম্যবাদে জীবনেরই প্রাথমিক প্রয়োজন শ্রম।

তথ্যসূত্র

  1. "Communism"Britannica Encyclopedia
  2. World Book 2008, p. 890.
  3. EB
  4. http://www.allaboutphilosophy.org/what-is-communism-faq.htm
  5. অনুপ সাদি; মার্কসবাদ; ভাষাপ্রকাশ ঢাকা; পৃষ্ঠা-১৪২।
  6. সেতুং, মাও (১৯৬৮)। সভাপতি মাও সে-তুঙের উদ্ধৃতি (1 সংস্করণ)। বেইজিং: বিদেশী ভাষা প্রকাশালয়। পৃষ্ঠা ২৫।

আরও দেখুন

  • Reason in Revolt: Marxism and Modern Science By Alan Woods and Ted Grant
  • Forman, James D., "Communism from Marx's Manifesto to 20th Century Reality", New York, Watts. 1972. আইএসবিএন ৯৭৮-০-৫৩১-০২৫৭১-০
  • Books on Communism, Socialism and Trotskyism
  • Furet, Francois, Furet, Deborah Kan (Translator), "The Passing of an Illusion: The Idea of Communism in the Twentieth Century", University of Chicago Press, 2000, আইএসবিএন ৯৭৮-০-২২৬-২৭৩৪১-৯
  • Daniels, Robert Vincent, "A Documentary History of Communism and the World: From Revolution to Collapse", University Press of New England, 1994, আইএসবিএন ৯৭৮-০-৮৭৪৫১-৬৭৮-৪
  • Marx, Karl and Friedrich Engels, "Communist Manifesto", (Mass Market Paperback - REPRINT), Signet Classics, 1998, আইএসবিএন ৯৭৮-০-৪৫১-৫২৭১০-৩
  • Dirlik, Arif, "Origins of Chinese Communism", Oxford University Press, 1989, আইএসবিএন ৯৭৮-০-১৯-৫০৫৪৫৪-৫
  • Beer, Max, "The General History of Socialism and Social Struggles Volumes 1 & 2", New York, Russel and Russel, Inc. 1957
  • Adami, Stefano, 'Communism', in Encyclopedia of Italian Literary Studies, ed. Gaetana Marrone - P.Puppa, Routledge, New York- London, 2006

বহিঃসংযোগ

This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.